
স্নায়ুডাল হাওয়া বয় স্নায়ুডালে লকুচ ফলেরা সব স্তনের বোঁটার মতো দোলে শাঁসে-বীজে মধু, নেশা জিভে জিভে লবণ-শুশ্রূষা কোষে কোষে গাঢ় লীলা কোষে কোষে ঝরে পড়ছে সোনা… মায়াকোল, অখিল বিবর রক্তলাগা খড়্গহাতে কালী এসে বলবে, কী রে তুই এখনো আছিস ঠায় বসে? আয় তবে কোলে নিই ঠাঁই দিই এ-মায়াজঘনে আমাকে এখন আর ভয় পাস নে মূর্চ্ছা যাস নে ত্রাসে তার চে' বরং বল ‘এবমস্তু’ অজিন-আসন থেকে নেমে আয় ধীরে; মেরুন-ফিরোজা-লাল প্রহরে এবার এ-আমাকে শুধু একবার মাতৃজ্ঞানে জাপ্টে ধর, জাপ্টে ধর ঠোঁট লাগা উষ্ণ-গাঢ় রক্তপয়োধরে মুখ লাগা মুখ নামা শষ্পে-তৃণে ঘেরা এই অখিল বিবরে ২. আইসো এবে অন্দরে আইসো এবে প্রশমন! এবে অধিক অন্দরে আইসো এবে প্রশমন! শান্ত-নাভি তৃপ্ত শিশু জন্মদ্বারে স্বাগত, স্বাগত! এবে আইসো পুত্র হেন রজোপুষ্প হেন অশেষ জোনাকিলিপ্ত মায়া-মাতৃদ্বারে ভেকের শিশুর মতো লাফ দিয়া এবে আইসো জন্মজলায় এবে আইসো শূন্যগর্ভ জঠরের অযৌন, নির্ভ্রূণ কুঠুরিতে তুই-ই বল তা না হলে আমি কী করে পাব রে মাতৃরূপ! তোকেই না খাই যদি গিলে? হেমন্তে আমি যা চেয়েছিলাম অনেক ঋতু আর আগুনজল ডিঙিয়ে তোমার হেমন্ত-নিবিড় গ্রামে এসে দাঁড়ালাম; আসন্ন শীতকে জয় করবার জন্য তোমার কাছে চাইতে এলাম স্পর্শ ও স্ফুলিঙ্গ এসে দেখি, ভাঁড়ারে খিল আঁটা। আর ফটকের চারপাশে গনগনে কামারশালা; যা আমার ডানাগুলোকে পুড়িয়ে দিতে হাপরের মুখে আগুন নিয়ে অপেক্ষা করছে কিছু না বলে তোমার রম্যগৃহের সীমানা থেকে সরে এলাম ভেঙে-গিয়েও-লটকে-থাকা একটা ডালের মতো নিজেরই লম্বা ছায়ার ওপর ঝুঁকে রইলাম; এবার ছায়াকে গুটিয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি... শীতের কুন্ত-আগ্রাসন থেকে বাঁচবার জন্য হেমন্তে আমি পেতে চেয়েছিলাম তোমার স্ফুলিঙ্গ ও কার্পাস সে আর হল না... হল না... কানের ভেতর ঘেউ ঘেউ করছে তোমার কুকুর যার সারা গা-জুড়ে কেবল সুঁচালো দাঁত আর দাঁত আমার ভরা দুপুরের ভেতর বর্গীর মতন অতর্কিতে ঢুকে পড়ে বেজে চলেছে তোমার নৃশংস শীতের দামামা রতিসংকুল বর্ষাদিন এত জল বাইরে-ভেতরে আর এত-এত বজ্র-বিস্ফোরণ পুরোটা তল্লাটে যেন হামলে পড়েছে মাতাল নীলকরদের ট্রিগারহ্যাপি বরকন্দাজ আর পাইক-পেয়াদার দল; তারা ভীষণ কুপিত হয়ে গুলি ছুড়ছে গুড়ুম-গুড়ুম! অনেকটা সেরকমই এক হাতে বুলেট-কার্তুজ আর অন্য হাতে রতিপুস্তক নিয়ে আমাদের পিঠে অতর্কিতে সওয়ার হল বর্ষাকাল কড়-কড়াৎ বাজপড়া রাতে, এই খলবল নরক-আন্ধারে আমরা লক্ষ লক্ষ পাছাউদোম, উপদ্রুত লোক হাঁটুজল কোমরজল ডুবজল উজিয়ে চলেছি কোনও এক নিরাপদ, কল্পিত উচ্চভূমির দিকে আমাদের উদ্ধারলাভের আশা তবু দূরপরাহত ! এমন রতিসংকুল, এহেন পৈশাচিক বর্ষাকাল পেরিয়ে যতবার কোনও একটা নিরাপদ ঋতুতে, কোনও একটা শুকনো আর শক্ত-কঠিন ডাঙায় পা রাখতে যাই, ততবার দশমূর্তিরূপ ধরে ভগবতী পথ রোধ করে! ডুয়েল ও পূর্ণিমা ফকফকা এক চাঁদিম রাতে বাড়িতে বউ ছিল না কে যেন পাঁচিল ডিঙিয়ে এসে দরজার কড়া নাড়ল নাম ধরে ডাকতে থাকল বুকে থু-থু দিয়ে একটা মোটা লাঠি-হাতে দরজা খুললাম কিন্তু আগন্তুকের চেহারা দেখতে পেলাম না। তবে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম অবিকল আমারই মতো গলা সে জানাল, তারও নাম জুয়েল মাজহার আজ রাতে তারও নাকি ‘বউ বাপের বাড়ি গেছে’ নামের মিল দেখে আমরা খুশি হয়ে উঠি মেতে উঠি খোশগল্পে সাম্রাজ্য-গুটিয়ে-নেবার-আগে বৃটিশদের-টেনে-দেওয়া ষড়যন্ত্রময় সীমান্তরেখার মতো আচমকা একটা আয়না আমাদের মাঝখানে নিরালম্ব হয়ে ঝুলতে থাকে দেখতে পাই আমাদের দু-জনের একই রকম চেহারা একই রকম গায়ের রং, খোমা ও উচ্চতা দু-জনই ভড়কে গিয়ে বলে উঠি: এমনটা হতেই পারে না এসো তবে নগ্ন হই; দেখি, আমাদের আর কত মিল এরপর নগ্ন নাভির নিচে, কুঁচকিতে একই রকম জন্মদাগ অবিকল অণ্ড-শিশ্ন, অবিকল তিল ও জড়ুল দেখে আমাদের মনে হতে থাকে এসবই আসলে ষড়যন্ত্র আমরা পরস্পরকে সন্দেহ করতে শুরু করি মেজাজ হারিয়ে মেতে উঠি ঝগড়ায় আয়নার ভেতর থেকে আর আয়নার বাইরে থেকে সে আমাকে আর আমি তাকে শাসাতে থাকি পরস্পরকে চেহারা-চোর, খোমা-চোর বলে চিপা গল্লির ঘাউড়া কুত্তার মতন চিল্লাতে থাকি ঝাড়তে থাকি নানান রকম কাঁচা খিস্তি। তবু কোনও খিস্তিতেই আর আমাদের মন ভরে না পুরুষালি খিস্তিকে মনে হতে থাকে মুখ-বদল-করা, অতিব্যবহৃত আর পানসে আমরা তখন বাতাসে হাত বাড়িয়ে পেড়ে আনি তৃপ্তি সান্ত্রার লেখা ‘মেয়েদের চোরাগোপ্তা স্ল্যাং’ অতিহর্ষে, অতিশয় আশ্চর্য পুলকে আমাদের উভয়ের নগ্ন প্রত্যঙ্গ কেঁপে ওঠে আমাদের অজান্তে তৃপ্তিদি পেছনে এসে দাঁড়ান তাঁর গলা খাঁকারি শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই আর ভীষণ শরমিন্দা হয়ে পড়িমরি ছুটে পালাতে যাই; তখুনি ধাক্কা লেগে আয়নাটি ভেঙে চৌচির টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে নানা দিকে আমাদের আর দেখা হয়নি সেই থেকে পরস্পরের কাছে আমরা মৃত আয়নার ভাঙা টুকরোগুলোর ভেতরে নামহীন অসংখ্য অদৃশ্য কবরে আমরা দু-জন জুয়েল মাজহার চুপচাপ শুয়ে অছি আমরা আর কোনও দিন খোশগল্পে, খিস্তিতে-ঝগড়ায় মেতে উঠব না কিন ব্রিজ দেখবার স্মৃতি দুই কিংবা তিন সাল আগে আমি শ্রীহট্টতে গিয়া শ্রীহট্টরে ফিরা পাই নাই কিনব্রিজে গিয়া দেখি কিনব্রিজ নাই শুধু একটা জংধরা, জীর্ণ লাল লোহার ধনুক সুরমা নদীর উপ্রে উপ্তা হয়া আছে তাহার বুগলে একটা আলিশান ঘড়ি, যারে চাবি মাইরা রাইখা গেছে আলি আমজাদ তবে এর দীর্ঘ পেন্ডুলাম আজ আর লড়ে না, চড়ে না... যেন সে আসঙ্গবঞ্চিত কোনও অভিশপ্ত মৃত দানবের নতমুখ প্রকাণ্ড, নিঃসাড় লিঙ্গ আইজকা তাহারে ঘিরিয়া ঘিরিয়া শুধু বেশুমার চামচিকা ওড়ে বালিহাঁসের মৃ্ত্যু সামান্য পোকাটি মেরে নারী-পাখি কুয়াশায় ঠোঁট ধুয়ে নিল বসল দিগন্তে গাঢ় সঙ্গমলিপ্সায় অন্যদিকে... দূরে... আপন গুম্ফায় এক ‘লোন-লায়নেস’ মহাশয়া পশমদস্তানা খুলে, বৈদ্যুতিন স্তন খুলে ধীরে দিগন্তে তা বিছিয়ে রাখলেন তৎক্ষণাৎ তার আবছা পশমে ঢাকা হ্রদে ঝরে পড়ল গুলিবেঁধা সূর্য আর নোনা বালিহাঁস শাদা পৃষ্ঠা ঘুমন্ত শাদা পৃষ্ঠার উপর অক্ষরের অতর্কিত আক্রমণ হ’ল ধর্ষকামী পাঠকেরা দূরে বসে তালিয়া বাজাল গান্ধর্ব ‘‘খুব ভালো শাঁখার ব্যবসায়ী ছিলাম আমি, তোমার হাতও ননীর মতো নরম ছিলো, কিন্তু কোনো শাঁখাই পরাতে পারলাম না কেন?’’ ---মাল্যবান, জীবনানন্দ দাশ সিঁথিতে পরোনি আজও গান্ধর্বের অমল সিঁদুর কৌতুকপ্রবণ তুমি, ঠোঁটে বাঁকা হাসি; সেই কবে লবণহ্রদের পাড়ে আমাকে বসিয়ে রেখে বৈকুন্ঠের দিকে একা হেঁটে চলে গেলে! ফিরলে না কেন আর ফিরলে না আমাদের অবধস্ত পৃথিবীতে আর কোনও দিন? আমার গলায় আজ ঘুংড়ি কাশি রক্তে-কোষে মরণের ব্যাধি শোনো তবে মরণের কুঞ্জ থেকে গান্ধর্বের অনিবার্য কুহু ভেসে আসে রাইকে হাওয়ায় লেখা চিঠি তোমারে পাইমু, রাই, আর কুনুদিন না-পেয়েও পাইবার ইশারার মতো? না-বলা কথার তলে ফল্গু হেন বোঁচা নাকে তিলসহ, ভুরুতে জরুলসহ লীলালাস্যসহ আর অধরে মধুর হাসিসহ? তোমারে পাইমু, রাই, আর কুনুদিন লক্ষ্মীটেরা নয়ানে ঝিলিকসহ গ্রীবার মোচড়সহ হাওরের হাঁসিনীর মতো? তোমারে পাইমু, রাই, আর কুনুদিন কাউয়ালুলির ঝোঁপে, মিঞ্জিরিতলায় ----বিহানে বৈকালে আর কালাঞ্জিবেলায়? তোমারে পাইমু, রাই, শইট্টার বনে গুদারার ঘাট থিকা অল্প দূরে গোপাটে-জাঙ্গালে? ২. আমরা কমু না কথা থাকবে না আমাদের মুখে কুনু রাও বোবা হয়া থাকব আর বলব কথা না-বলা কথায় হাওয়ায় লিখিয়া চিঠি, ওগো রাই, তোমারে পাঠাই ৩. লতি দিয়া শুটকি আর হিদলের ঝালের সালুন উন্দালে রান্ধনকালে করো তুমি আমারে ইয়াদ? ইয়াদ করিয়া মোরে অহনো কি করো গুনগুন: ‘আমারে ফাউরিছো কেনে ওরে ও নিঠুর কালা চান!’ ৪. একচোখ-কানা এক জখমিডানা ফেসকুন্দা পাখি ঝিম মারা বৈকালেতে একা বইসা বাঁশের মাচায় নিজের মর্মের গান গায় আর নিজেরে শোনায়

জুয়েল মাজহার
জন্ম ২০ জানুয়ারি, ১৯৬২। বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার সাখড়া গ্রামে। বাবা মুকদম আলী, মা নূরজাহান সরু। দুজনেই প্রয়াত। বন্ধু শিরিন সুলতানা ও পুত্র অর্ক মাজহারের সঙ্গে থাকেন ঢাকায়। বর্তমান পেশা সাংবাদিকতা। এ-মুহূর্তে দেশের সর্ববৃহৎ দ্বিভাষিক অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম—এর সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।
কৈশোরে নিরুদ্দেশযাত্রা। এরপর দীর্ঘ ভবঘুরে জীবন। যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটের হাওরে-পাহাড়ে-অরণ্যে। অলৌকিকে বিশ্বাস নেই। ঘৃণা করেন বৈষম্য, জাতপাত, জাতিবৈর এবং সকল প্রকারের অন্ধতা। ঘৃণা করেন পৃথিবীকে খণ্ডক্ষুদ্র-করে-দেওয়া সীমান্ত নামের ‘খাটালের বেড়া’।
লেখেন মূলত কবিতা। কালেভদ্রে সাহিত্যশিল্প বিষয়ে গদ্যও লেখেন। প্রচুর অনুবাদও করেন। ইংরেজি থেকে বাংলায় আর বাংলা থেকে ইংরেজিতে। দুই বাংলার কবিতার ইংরেজি অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছেন সম্প্রতি। সে-কাজ চলমান।
প্রকাশিত কবিতাবই: দর্জিঘরে এক রাত, মেগাস্থিনিসের হাসি, দিওয়ানা জিকির, নির্বাচিত কবিতা, রাত্রি ও বাঘিনী, বসন্তরূপক হাসি, কবিতাসংগ্রহ
প্রকাশিতব্য কবিতাবই: রাইকে হাওয়ায় লেখা চিঠি
দুটি অনুবাদগ্রন্থ:
১. কবিতার ট্রান্সট্রোমার (নোবেলজয়ী সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমারের বাছাই করা কবিতার অনুবাদ-সংকলন)
২. দূরের হাওয়া (প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ২০০ কবিতার অনুবাদগ্রন্থ) ।
পুরস্কার ও সম্মাননা:
১. ‘জীবনানন্দ দাশ কবিতাপুরস্কার ২০১৯’
২. কলকাতার ঐহিক সাহিত্যগোষ্ঠির ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা ২০২০’
৩. ‘নির্বাচিত কবিতা’-র জন্য ‘বেহুলাবাংলা বেস্টসেলার বই সম্মাননা–২০১৯’
৪. রাত্রি ও বাঘিনী কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘শব্দঘর-নির্বাচিত সেরা বই-২০২১’ সম্মাননা পুরস্কার
৫. কবি হোসেন দেলওয়ার সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা ‘দূরের সাইকেল’ ২০২৩ সালের প্রথম সংখ্যাটি ‘কবি জুয়েল মাজহার সংখ্যা’ হিসেবে প্রকাশ করেছে