ফেসবুকের দেয়াল জুড়ে আসা ছবিগুলো নীলা খুব মন দিয়ে দেখে। ঝকঝকে নতুন একতলা দালানের সামনের বড়ো নীল রংয়ের সাইনবোর্ডের লেখায় চোখ আটকে যায় ওর- জোড়শিমুল গ্রন্থাগার, ধুনট, বগুড়া; প্রতিষ্ঠাকাল- ডিসেম্বর, ২০২২। নীলার একঘেয়ে ক্লান্তিকর দিনটা কেমন টুক করে উধাও হয়ে যায় এই ছবি দেখে, কিশোলীবেলার মতো আনন্দে ঝলমল করে ওঠে ওর চোখমুখ। একবার চিৎকার করে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়, এই অবেলায় এমন চিৎকার শুনে শিউলি হয়তো ছুটে আসবে ওর কী হয়েছে তাই দেখতে। বুকের ধুকপুকুনি সামাল দিতে দিতে নীলার কানে আসে ফিসফিসানো আনন্দিত কণ্ঠস্বর- দেখেছিস নী, লাইব্রেরিটা হলো।
সেই কথার স্রোতে নীলা ভাসিয়ে দেয় নিজের কণ্ঠস্বর- আমি জানতাম, তুই পারবি।
নীলা জানতো এই লাইব্রেরিটা হবেই একদিন। জোড়শিমুল গ্রামের এক শ্যামলবরণ ছেলের চোখে যে স্বপ্ন ছিলো একটা লাইব্রেরির জন্য তা সত্যি না হয়েই যায় না। তবু লাইব্রেরিটা হতে এতোগুলো বছর লেগে গেলো, এতোগুলো দিন মাসের চক্করে পড়ে সেই শ্যামলবরণ ছেলের মাথার ঝাকড়া চুলগুলো এতোদিনে নিশ্চয়ই ছোপ ছোপ সাদায় ভরে গেছে। নীলার নিজের চুলেই মেহেদির দারুণ খয়েরি রং আড়াল করে রাখে মাথাচাড়া দেয়া শুভ্রতাকে। সে যাক, এই মুহূর্তে ওর মনপ্রাণ ভরে থাকে ঝকঝকে দালান আর হাসিমুখের মানুষের ছবিগুলোতে। কোনোদিন নিজের চোখে দেখতে না পাওয়া গ্রামটাকে কী ভীষণ আপন মনে হয় ওর!
সেই কতো বছর আগে, এই জোড়শিমুল গ্রামে যাওয়ার কথা ছিলো ওর! আবছায়া সন্ধ্যার মায়াময় আবহ কাটিয়ে নীলা ফিরে যায় ষোলো বছর আগের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। সেবার অন্তু, বিকাশ, রূপক আর নয়নার সাথে ওরও যাবার কথা ছিলো জোড়শিমুল, রাহাতের বাড়ি। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে বিশাল বড়ো এক মেলা হয় রাহাতদের গ্রামে, সেই উপলক্ষেই সেবার ওরা যেতে চেয়েছিলো দিন দুয়েকের জন্য। নীলার সে কী আনন্দ! অবশ্য অনেকখানি লজ্জা আর অনিশ্চয়তাও জুড়ে ছিলো সেই আনন্দে-যদি রাহাতের পরিবারের মানুষেরা জেনে ফেলে ওদের সম্পর্কটা! রাহাত অবশ্য হা হা করে হেসে বলেছিলো-
আরে চিন্তা করিস না। আমার বাপ-মা মানুষ খারাপ না। বুঝে ফেললে আমি বলবো তোকে ছাড়া বাঁচবো না, তখন আর ঝামেলা করবে না। দ্যাখ, এই মেলার মাঝেই আমাদের বিয়েও দিয়ে দেয় নাকি!
বিয়ের কথায় আজও কি বুকের মধ্যে হাঁপ ধরে আসে নীলার? বুঝতে পারে না সে। সেবার ওর সারা গায়ে গুটিবসন্ত ছেয়ে গেলো বলে মেলায় রাহাতের বাড়ি যাওয়া বাতিল হয়ে গেলো ওদের। পরে অবশ্য বাতিল হয়ে গিয়েছিলো সেই শ্যামলবরণ ছেলেকে বিয়ের করার স্বপ্নও। বাংলা সিনেমার মতোই ক্যান্সারে আক্রান্ত মায়ের রোগশয্যায় দেয়া কথার দায় নিয়ে শিহাবকে বিয়ে করতে হয়েছিলো নীলার। ছেলে হিসেবে শিহাব কোনো দিক থেকেই খারাপ না তবু বিয়ের আট বছর পরও রাহাতের জন্য নীলার বুকে হাঁপ ধরা কমেনি এতোটুকু। শিহাব কি জানে সেকথা? তা জানে না নীলা, আসলে জানার সাহস বা ইচ্ছেও হয়ে ওঠেনি কখনো, শিহাব কী মনে করতে কী মনে করবে তাই ভেবে। তবে শিহাব জানে রাহাতের সব কথা, বিয়ের আগেই নিজের সব কথা তাকে খুলে বলেছিলো নীলা। শিহাব তাকে অকুণ্ঠ গ্রহণ করেছে সব সত্যি জেনেই।
হৃষিতার ছবিগুলো জুম করে দেখে নীলা। মেয়েটার যা অভ্যাস, একসাথে অনেকগুলো করে ছবি পোস্ট করে। তবে এই ছবিগুলোয় যারা আছে তাদের মধ্যে হৃষিতা ছাড়া আর কাউকেই চেনে না সে। হৃষিতাকে অনেক খুঁজে বের করেছিলো নীলা। ওদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হৃষিতা এইটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ে ছিলো। রাহাতের বোনের মেয়ে ও। এই ক’বছরে কতো বড়ো হয়ে গেছে! রীতিমতো বিবিএ-র ছাত্রী! ওকে খুঁজে পেয়ে নীলা খুশিতে আত্মহারা হেয়ে গিয়েছিলো। আর যাই হোক, রাহাতের কাছের কাউকে তো পাওয়া গেছে! হৃষিতা অবশ্য একদিন বেফাঁস প্রশ্নটা করেই বসেছিলো- মামা কি তোমার জন্যই বিয়ে করলো না, আন্টি?
ওর কথার কোনো উত্তর দেয়নি নীলা, ওই প্রশ্নের কোনো উত্তর ওর জানা নেই। রাহাত ওর বন্ধু তালিকায় নেই, রিকোয়েস্ট দেবার সাহস করেনি নীলা। সেই যে শিহাবকে বিয়ে করবে শুনেই কেমন পাগল হয়ে গিয়েছিলো ছেলেটা, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর কোনো যোগাযোগ হয়নি ওদের। নীলার প্রতি কোনো অনুযোগ অভিযোগ কিছুই ছিলো না ওর, কিন্তু কী অসহ্য শীতল চোখে তাকিয়ে থাকতো ঐ সময়টায়, নীলা সহ্য করতে পারতো না। তারপর বলতে গেলে এক রকম পালিয়েই বেঁচেছে ওর থেকে।
রাহাতের থেকে পালিয়েছে তো বটে কিন্তু বাঁচতে পারলো কই শেষপর্যন্ত? মনে মনে হাসে নীলা। আজও হৃষিতার সবগুলো ছবিতে ও কি রাহাতকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে না? জোড়শিমুল গ্রন্থাগার নামটার নিচে হরেক ভঙ্গিতে দাঁড়ানো মানুষগুলোর মধ্যে সে তো একটা মুখই খুঁজে বেড়াচ্ছে আর কী আশ্চর্য, শুধু সেই মানুষটাই ছবিতে নেই। নীলা আতিপাতি করে খোঁজে সাতসমুদ্র তেরো নদী, তন্নতন্ন করে বুক চিড়ে বেড়ায় পাহাড়-জঙ্গলের, কিন্তু রাহাত নেই কোথাও! কী এক জাদুমন্ত্রে কেবল রাহাত নামের এক শ্যামল ছেলে হারিয়ে গেছে এই আনন্দযজ্ঞের মাঝখান থেকে! নীলা কাঁদে, তার বুকের গহীনে আগলে রাখা সোনার কৌটো হারিয়ে ফেলেছে বলে সে বুক ভাসিয়ে কাঁদে যেন সহস্র জন্ম পর।
চা খাইবেন, আপা?- শিউলির প্রশ্নে সে কান্নায় বাঁধ পড়ে। নীলা জানায় সে চা খাবে। শিউলি চা আনতে চলে গেলে নীলার চোখের জল আবার সমুদ্র হয়ে যায়। সেই সমুদ্রের বালিতটে ভেঙ্গে পড়ে হাজার স্মৃতির ঢেউ। রাহাতের হাসি-কান্না-কণ্ঠস্বর এক হয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ায় আর তার সামনে ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে যায় নীলা।
কড়া লিকারের দুধ চা খেয়ে মাথাটা ছেড়ে দিয়েছে মনে হয়। তবু নীলার সেই ঘোর কাটে না। আচ্ছা, রাহাত একটা ছবিতেও নেই কেন? জোড়শিমুল গ্রামে এই যে লাইব্রেরি হলো, সেখানে রাহাত নেই? কিন্তু ও ছাড়া ঐ ঘোর গ্রামে এমন ঝকঝকে লাইব্রেরি বানানোর স্বপ্নই বা কার থাকবে? রাহাতের গভীর কালো চোখের তারায় ছড়িয়ে থাকতো এক স্বপ্নালু ঘোর- তার নিজের গ্রামে একটা সুন্দর লাইব্রেরি হবে যেখানে পাঁচ সাতটা বাংলা ইংরেজি খবরের কাগজ থাকবে, গোটাদশেক আলমারি ভরে থাকবে বিশ্বসাহিত্যের সব বিখ্যাত বই। সেই লাইব্রেরিতে ছেলেবুড়ো সব আসবে, পড়বে, আড্ডা দেবে; বিশেষ বিশেষ দিনে গান আর কবিতার আয়োজনও থাকবে সেখানে- এসব বলতে বলতে রাহাতের চোখ ঝলমল করে উঠতো! সেই রাহাত হৃষিতার দেয়া একটা ছবিতেও নেই!
আচ্ছা, ওর কি কোনো সমস্যা হয়েছে? কোনো অসুখ বিসুখ বা বাড়িতে কোনো জরুরি ব্যাপার? নীলার ভয় করতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোর মতো, রাহাতকে হারানোর ভয়। যে রাহাতের সাথে যোগাযোগ নেই আজ প্রায় পনের বছর, তাকে নতুন করে হারানোর কী আছে, ওর মাথায় ঢোকে না অথচ ভয়টা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে রাতের অন্ধকারে ছাতিম ফুলের গন্ধের মতো। এসিটা চালিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে নীলা, শিহাব এই অসময়ে ওকে শুয়ে থাকতে দেখলে হাজারটা প্রশ্ন করবে, শরীর খারাপ কি না জিজ্ঞেস করতে করতে অস্থির করে তুলবে সে জানে। অবশ্য শিহাব অফিস থেকে আজ ফেরেনি এখনো। নীলা মনে মনে চায় শিহাব এখন না ফিরুক। এখন ওর দরকার নিঃসীম নির্জনতা আর আকণ্ঠ অন্ধকার। দরজা জানালা বন্ধ ঘরে সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে নীলার মনে হয় ও আর ভাবতে পারছে না কিছুই।
মেসেঞ্জারে কল করেছে কেউ, তন্দ্রাচ্ছন্ন নীলার মনে হয় কে করেছে সেটা দেখবার মতো শক্তিও তার অবশিষ্ট নেই। কলটা কেটে যায়, তারপর আরেকবার বেজে ওঠে, তারপর আবার, আবার… নীলা জানে না কতো বার রিংটোন বাজার পরে সে মোবাইল হাতে নিতে পারে। হৃষিতা ভিডিও কল দিয়েছে! আজ এই সময়ে মেয়েটার ওর কথা মনে পড়েছে! বুক বেয়ে ওঠা একটা টলমলে ঢেউ পাশ কাটিয়ে কলটা রিসিভ করে বেডসাইড টেবিলটা জ্বালে ও। একটা রঙিন প্রজাপতির মতো ঝলমলে হৃষিতা বলে ওঠে- নীলা আন্টি, দ্যাখো কে আছে এখানে!
কে আছে তা খুঁজতে খুঁজতেই নীলার সামনে এসে দাঁড়ায় এক শ্যামলবরণ ছেলে। সেই কতো জন্ম পর! এতো জন্মেও শ্যামলবরণ ছেলের চুলে সাদার ছোপছাপ ছাড়া আর কিছু বদলায়নি, অবিকল সেই ভোরের আলো ঠিকরানো চোখ আর সব দুশ্চিন্তা এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দেয়া হাসি লেগে আছে ঠোঁটে। নীলা জিজ্ঞেস করতে ভুলে যায় সে কেমন আছে, হৃষিতার একটা ছবিতেও কেন নেই সে, লাইব্রেরিটা করতে কতো জায়গায় কতোবার দৌড়াতে হলো… এই মুহূর্তে ওর যেন কোনো প্রশ্ন নেই অথচ ওর হৃদয়জুড়ে হাজার প্রশ্নের ঘুর্ণিপাক। নিস্তব্ধ নীলাকে দেখে সেই শ্যামলবরণ ছেলে প্রাণভরে হাসে। কতো জন্ম পর নীলা এমন প্রাণখোলা হাসি দেখলো কারো? সেই হাসিতে নীলার জীবন-মরণ সব একাকার হয়ে যেতে আগের মতো, ও অপলক তাকিয়ে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে।
-দেখলি, লাইব্রেরিটা হলো এতোদিন পর। দেখলি নী, আমরা পারলাম?
সেই কণ্ঠস্বরের অপার্থিব আচ্ছন্নতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কড়া সহযোগী অধ্যাপক নীলা আহমেদ আবার একুশ বছরের ‘নী’ হয়ে যেতে থাকে, ছড়িয়ে পড়তে থাকে জোড়শিমুল নামের গ্রামের এক একহারা গড়নের ছেলের অস্থিতে, মজ্জায়, হৃদয়ে। সেই ক্ষীণাঙ্গী ছটফটে দূরন্ত মেয়েটা খুব অস্ফুটে বলে ওঠে- আমি জানতাম, তুই পারবি!