নাজকে দেখলেই চেনা যায়। শুধু ওর থুতনির জরুলটার জন্য নয়, এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সকালে এসেও কিশোরসুলভ সারল্যটা এখনো অবিকলভাবে ওর চোখেমুখে ছড়ানো আছে। আমার মনে হল ওর বয়সটা থেমে গেছে ষোলো সতেরোয়।
অসময়ে ঘর থেকে বেরিয়ে, ভিড় জ্যাম ঠেলে এতদূর এসে মনমেজাজ তেঁতে ছিল আমার। ছেলের স্কুল থেকে জরুরি ফোন পেয়ে আসতেই হলো। অথচ কিছু জমে থাকা কাজ সেরে নেব বলে ছুটি নিয়েছিলাম অফিস থেকে। সেই ঘরের বার হতেই হলো আমাকে।
চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে স্মিত হাসছে নাজ।
-কতদিন পর? মানে কত বছর বলতে পারিস?
আমাকে তুমি-তুইয়ের দ্বিধা থেকে কাটিয়ে দিল ওর এই প্রশ্ন।
-কুড়ি বছর তো হবেই।
-না, আরেকটু কম, পনেরো। বিয়েবাড়িতে একবার দেখা হয়েছিল, ভুলে গেছিস?
অস্বীকার করব না কিছু কিছু স্মৃতি আবছায়া হতে শুরু করেছে আমার। কিন্তু নাজের দেখছি সবই মনে আছে। এক বন্ধুর বিয়েতে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল।কথায় কথায় মনে পড়ছে আমার। মাস্টার্সের শেষ বছর। বন্ধুদের বিয়ের বহর নেমেছিল সেবার। নাজ অবশ্য ততদিনে দু’দুটো বাচ্চার মা। বহু আগেই, উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই ওকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল।
-এদিকটায় কী মনে করে? কেউ পড়ে এই স্কুলে? আমি কিছু জানতে চাইলাম বলে নাজ যেন খুশি হলো।
-আমার ছোটো ছেলে…ক্লাস এইটে এবার’
কথাটা বলতে বলতে নাজের গাল খানিকটা লালচে দেখায়।
নাজের প্রথম দুটি মেয়ে, আমার ভালো করে মনে আছে। মনে মনে প্রমাদ গুনি। কী করে তিন তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়ে তাদের দেখভাল করেও এমন ঝরঝরে শরীর ওর! হয়ত ঘরকন্নার সবকিছুই এক হাতে সারে যতদূর মনে পড়ে বড় ব্যবসায়ী পরিবারে বিয়ে হয়েছিল নাজের। বাড়িতে সাহায্যকারী নেই? দিনরাত নিজেই খেটে মরে গুচ্ছের কাজ করে করে? চাকরিবাকরি নিশ্চয়ই কখনো করেনি কোথাও। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কি আর পড়াশোনা হয়েছে ওর! চাকরি তো দূরের কথা।
সমস্ত বৃত্তান্ত জানতে ভেতরে ভেতরে খুব উৎসুক হয়ে উঠলেও মুখে কিছু বলতে পারলাম না। স্বভাবজাত গাম্ভীর্যটাই ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। নাজ অবশ্য বহুকাল পর খোঁজ পাওয়া পুরনো বন্ধুর মতোই আমার কাজ, সংসার সবকিছু সম্পর্কে হড়বড় করে জানতে চাইছে।
ওর গায়ে একটা ফুলেল নকশার কামিজ। গলায়, হাতে গুজরাটি ফোঁড়। এখনো নাজ ঐসব সূঁচ-সুতা দিয়ে ফোঁড় প্র্যাকটিস করে? এইম ইন লাইফ রচনা লেখার ইতিহাসও বলতো মেয়ে বড় হয়ে সূচীশিল্পী হবে। বোকার হদ্দ যাকে বলে তাই ছিল নাজ। রচনা লেখাটা যে গার্হস্থ্য অর্থনীতির ক্লাস নয় এধরণের স্বাভাবিক যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলত মাঝেমাঝে। নিজের বোকামির মাশুল ও কি জীবনে কম দিয়েছে! সত্যি বলতে ওকে নিয়ে আমার বহুদিনের একটা ইচ্ছে ছিল, যেটা এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। খুব ইচ্ছে করে নাজকে সজোরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলি – তুই কি সত্যিই বোকা না সমস্তটাই ভান? এতটা সরল হওয়াও তো কোনো কাজের কথা নয়!
নাজ হঠাৎ আমার দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে বলে- শিরিনের সঙ্গে কি তোর যোগাযোগ আছে?
আমি ভীষণ অবাক হলাম। আমার ভাবনাটুকু পড়ে নিয়েই কি মেয়েটা এই অমোঘ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল? আমার মাথার ভেতর তীব্র একটা ঝাঁকুনি লাগে। মনে হয় খুব পুরনো ক্ষততে কেউ খামচে ধরেছে। চায়ের কাপে অনেকটা সময় নিয়ে চুমুক দিতে দিতে নিজেকে ধাতস্থ হতে দিই। এখনো কেন যে উঠে পড়িনি তা ভেবে নিজেকেই মনে মনে শাপশাপান্ত করি। অফিসের কাজের ছুঁতো দিয়ে আরো আগেই উঠে পড়া যেত। দাঁতে দাঁত চেপে না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়াই আমি।
-না রে, শিরিন-বকুল-পারুল কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ নেই। ঘর আর অফিস সামলেই দিন চলে যায়। এত কাজ থাকে মাঝে মাঝে মনে হয় বোধ হয় মরবারও ফুরসত নেই আমার।
আমার কথা শুনে নাজের হাসি একান ওকান ছুঁয়ে যায়। গায়ে জ্বালা ধরে আমার। সবই ভান,সবই ভান। আসলে পেটে পেটে জিলাপির প্যাঁচ ওর। তাইতো এতদিন পর দেখা হলেও ঘাড়ত্যাড়ামোটা ওর করতেই হচ্ছে আমার সঙ্গে।
হ্যাঁ, শিরিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলাম আমি। তাই বলে যোগাযোগ বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকবে তা ধরে নেবার মানে আছে? হঠাৎ দেখা হতেই পুরনোদিনের ঝাঁপি খুলে বসতে হবে এমন মাথার দিব্যিও দেয়নি কেউ।
আমার ছটফটানি দেখেই হয়ত নাজ এবার উঠে পড়ল। যাবার আগে নিজের বাসার ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই দিয়ে দিল। মুখে হ্যাঁ বললেও আমার যে কখনো সময় হবে না একথা সে জানে। চোখের দৃষ্টি দিয়ে নাজ আমাকেই তাই বুঝিয়ে দিয়ে গেল।
নাকমুখ বুজে সারাদিন যত কাজই করিনা কেন সেদিনের পর থেকে কেবল পুরনো কথা, নাজের কথা, শিরিনের কথা, কলেজদিনের কথাগুলো আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘুমের মাঝেও স্বস্তি পাওয়া মুশকিল। নানারকম স্বপ্ন দেখি। আমরা দূরে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি। খুব আনন্দ হচ্ছে, হৈ-হট্টগোল আর গান হচ্ছে। শিরিন ওর প্রিয় কোনো একটা শাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। তাই দেখে নাজ কাঁদতে বসেছে। আমি ওদের অবিস্থা দেখে হেসে খুন হচ্ছি। নাজ হঠাৎ এসে চড় বসালো আমার গালে আর বলল – তোর লজ্জা নেই?
ঘুম ভাঙ্গলে দেখতে পাই চারপাশে সঁপসঁপে অন্ধকার। কুলকুল করে ঘামতে থাকি আমি। গলার ভেতর যেন কিছু একটা দলা পাকিয়ে থাকে সারাক্ষণ, না পারি গিলে ফেলতে, না পারি উগড়ে দিতে। দিনের আলোতেও আবোলতাবোল ভাবনা পিছু ছাড়ে না আমার।
শেষমেশ একদিন নাজকে ফোন করি আমি। এটা ওটা নিয়ে অনেক কথা হয়।শুধু শিরিনের প্রসঙ্গে যাওয়া হয় না। আমাকে স্বস্তি দিতেই হয়ত ফোন রাখার আগে নাজ আগলটা খুলে দেয়। জানায়-গত সপ্তায় শিরিনের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছে।
ফোনের এপাশে আমি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যাই। আরো শুনব বলে কান পেতে রাখি। নাজ খানিকটা সময় নিয়ে থেমে থেমে বলে- শিরিনের শরীরটা ভালো নেই। মাসখানেক হলো পেটে টিউমার ধরা পড়েছে। ডাক্তাররা বলেছে ক্যান্সারটা ছড়িয়ে পড়েছে শরীরে।
সেদিনের ছুটির দুপুরটা আমি কেঁদেই কাটালাম। নানারকম অসম্ভব সব প্রকারে, যেকোনো মূল্যে আমি যদি শিরিনের কষ্টটা কমাতে পারতাম! অন্তত কোনোভাবে কলেজদিনের ঐ একটা মুহূর্তে যদি ফিরে যাওয়া যেত!
নিজেকে ঘেন্না করার দুঃসহ অনুভূতিতে, গভীর অবসাদে চোখে বুজে আসতে চায় আমার। তবু ঘুমোতে পারিনা। মনে হয় ঘুমোলেই স্বপ্নটা আসবে। অস্থিরভঙ্গিতে শিরিন এদিক ওদিক ছুটবে আর নাজ আমাকে ‘তোর লজ্জা নেই?’ বলতে বলতে ক্রমাগত শাসিয়ে যাবে৷ না ঘুমিয়েও স্বপ্নটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে। সযত্নে ভুলে থাকা অধ্যায়টির কথা এবার আমি ডায়েরিতে লিখে রাখতে শুরু করি।
তখন প্রথমবর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে কেবল। কলেজ থেকে শিক্ষাসফরে সমুদ্রে গেলাম আমরা। কলকল ছলছল করে বাঁধনহারা দুটোদিন পার করেছি। ঘটনার দিন পুরো বিকেল সৈকতে ছোটাছুটির পর খুব ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম আমরা। পরদিন ভোরে বাড়ি ফেরার পালা বলে সবাই একটু তাড়াতাড়িই যার যার ঘরে চলে গেল। আমি আর শিরিন তখনো জেগে। হোটেলের সামনে সুন্দর মখমলী ঘাসে এলোমেলো হাঁটতে বেশ লাগছিল আমাদের। দূরের কটেজগুলোর বাইরে তখনো লালনীল বাতি জ্বলছিল।
বিকেলে লোকাল দোকান থেকে সবাই কিছু কেনাকাটা করেছিলাম। তার মধ্যে শিরিনের ব্যাগ ভুল করে স্যারের সঙ্গে চলে গিয়েছিল।
হাঁটতে হাঁটতে কটেজের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় শিরিনের মনে হল ব্যাগটা তখুনিই নিয়ে আসবে। ভোরবেলা ফেরার তাড়াহুড়োয় ফেলে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল বলে আমিও বাধা দিইনি ওকে।
ফুটফুটে জোছনা ছিল সেরাতে। হাওয়া কেটে কেটে গায়ে এসে পড়ছিল। বাগান থেকে দেখলাম কটেজের দরজাটা খুলে গেছে। স্যারের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি। ওরা কথা বলছে। একটু পর শিরিন ভেতরে গেল। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো না। আরো কিচ্ছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমি ইতস্তত করে ফিরে এলাম। ফিরতে ফিরতে আমার ভেতরের আমি আমাকে বলছিল বড় কোনো ভুল করে ফেলেছি।
শিরিন যখন ফিরল আমি তখন বিছানায় টানটান শুয়ে প্রানপণে গভীর ঘুমের প্রয়াসে ব্যস্ত। কিন্তু ওর কান্নার কাছে আমার হার মানতেই হলো। সবাইকে ডেকে তুলে ঘটনাটি তখুনিই জানাতে চেয়েছিল নাজ। কিন্তু বিধ্বস্ত শিরিনকে সামলাতে গিয়ে রাতটা ভোর হয়ে গেল আমাদের।
শুরুতে যেমনই মনে হোক ফিরে আসবার পর আমার যুক্তিবোধ একেবারে প্রখর হয়ে উঠল। শিরিন-নাজের বহুবার অনুরোধ স্বত্ত্বেও নিজের সিদ্ধান্তে আমি স্থির রইলাম। ওদের বিশ্বাস ছিল সত্যটা আমি সবার সামনে বলতে আপত্তি করব না। কিন্তু ক্লাসের সেরা ছাত্রী হিসেবে আমার তখন নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখার ভীষণ একটা দায় ছিল।
আমার আচরণ দেখেও নাজ পিছিয়ে যায়নি। একাই স্যারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিল বোকা মেয়েটা। কিছুদিন পর সব থিতিয়ে গেলে দুপক্ষের সমঝোতায় ঘটনার মীমাংসা হয়ে যায়। কিন্তু নাজকে ঠিক মাশুল দিতে হয়েছে। আমি এই এতদিন পরেও ভেবে অবাক হই যে মেয়েটি কখনো জানতেও পারেনি সবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রবেশপত্র কলেজে এসে পৌঁছালেও শুধুমাত্র ওরটা নিয়েই কেন অমন অদ্ভুত বিপত্তি হয়েছিল।
সব ভাবনাকে সরিয়ে রেখে আমার মাথায় আজকাল শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়। ওরা দুজন কি আমাকে ক্ষমা করবে? খুব অসম্ভব কিছু কি চাইছি আমি? আমার গ্লানিবোধের মধ্যে এতটুকু মিথ্যে নেই। গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পেরেছি শিরিনের কাছে ক্ষমা পাওয়া আমার জন্য কতোটা জরুরি হয়ে উঠেছে। এও বুঝেছি যে নাজকে ছাড়া কিছুতেই আমি শিরিনের নাগাল পাবো না।
জমানো কথাগুলো বলবো বলে গত দুদিনে কম করে হলেও দশবার ফোন করেছি নাজকে। ওরদিক থেকে কোনো রকম সাড়া না পাওয়ায় মনে মনে খুব অস্থির হয়ে আছি। ফলে ওর বাসায় যাব বলে প্রস্তুতি নিলাম। ঠিক ওরকম সময়ে ফোনটা এলো। শিরিনের শারীরিক অবস্থার খবরাখবর নিলাম আমি। নাজকে জানালাম অপারেশনের আগেই শিরিনের সঙ্গে একবার আমি দেখা করতে চাই।
আমার আবদার শুনে, আমাকে ভীষণ অপ্রস্তুত করে দিয়ে, কথার ছুরিতে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে নাজ সশব্দে হাসতে শুরু করল। আমি কখনো ওকে এভাবে হাসতে শুনিনি, দেখিনি। ওর হাসির তোড়ে, বিদ্রুপের ভঙ্গিতে আমার কান্নাগুলো তপ্ত হাওয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছিল।
হাসতে হাসতে নাজ আমায় বলল আমার সঙ্গে কথা বলার অবসর শিরিনের আর নেই। আমার মতো বন্ধুকে সে টিউমারের মতোই জীবন থেকে বহুকাল আগে কেটে ফেলে দিয়েছে। এখন আর এই দেখা অদেখায় কোনো কিছু যায় আসবে না।