এক
একটা প্রায়ান্ধকার ঘর। চারটে চেয়ার। তিনটি একপাশে। তিনটে চেয়ারের মুখোমুখি শেষ চেয়ারটা। মধ্যে একটা টেবিল। ছাদের দিকের কার্নিশে একটা টিমটিমে বাতি। যেন অন্ধকার দূর করা নয়, অন্ধকারকে সাহায্য করাই তার উদ্দেশ্য। চেয়ারে তিনজন লোক। পুরুষ । শক্তপোক্ত চেহারা। বয়স আন্দাজ করা যায় না। এখানে এদের একটা নাম দেওয়া প্রয়োজন। ধরা যাক, প্রথম পুরুষ , মধ্যম পুরুষ, আর উত্তম পুরুষ।
টেবিলের বিপরীতে মাঝবয়েসী একটা লোক। গালে আন্দাজ চারদিনের না কামানো কাঁচাপাকা দাড়ি। আলোর বিপ্রতীপে থাকায় লোকটার অবয়ব ঠিক স্পষ্ট নয়। ঘরের বাইরের কোনও শব্দ আপাতত এই ঘরে ঢুকছে না। না শহরের কোলাহল মুখর রাস্তায় লোকজনের ব্যস্ত যাতায়াত, না দৌড়ে যাওয়া গাড়ীর হর্ন, না পাখিদের কুচকাওয়াজ, কিচ্ছু না। সময় যদিও ঢুকছে। তা দিন ও হতে পারে, রাত ও। দুপুর কিংবা সন্ধেও অসম্ভব না।
এই ঘরটাকেই আমরা পৃথিবী ভেবে নিচ্ছি আপাতত। সেলুলয়েডে এই দৃশ্যটা এখন অনেকক্ষণ টেক রি-টেক হবে। আলোর বাড়া অথবা কমারও ফলে কোনও প্রশ্ন নেই।
দুই
দমবন্ধ অন্ধকার ও চাপা অস্বস্তির ভেতর কথোপকথন শুরু হয়। আলোর ফোকাস এসময় লোকটার মুখের একটা অংশ ধরার চেষ্টা করে। ঠিক পেরে ওঠে না।
উত্তম পুরুষঃ “ বাইরে আজ প্রবল বৃষ্টি। আপনি বৃষ্টি ভালবাসেন ?”
—-“ হ্যাঁ। আসলে আমাদের এই পোড়া দেশে বৃষ্টির দরকার খুব। দাগগুলো জলে ধুয়ে যায়। লুকোতে সাহায্য করে।“
“ আপনি তো দাবা খেলতে ভালোবাসেন।
—“হ্যাঁ”।(হাসি)
“ হাসলেন কেন ?”
—-“ না, মানে বার্গম্যানের “সেভেন্থ সীল” মনে পড়ে গেল তো ! প্রেক্ষিতটা একটু অন্যরকম যদিও। তাহলে, এবার কাজের কথা হোক নাহয় । গল্পগুজবের জন্য তো আমায় এখানে আনা হয়নি তাই না স্যার?”
মধ্যম পুরুষঃ “ আপনাকে এখানে কেন আনা হয়েছে, জানেন ?”
—-“ না স্যার”
“ আপনি তো সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও স্পষ্ট বললে ফেসবুকে বেশ অ্যাকটিভ ?”
—-“ হুম “
“ কবিতাও লিখেন শুনেছি ? “
—-“ হ্যাঁ , ওই একটা কাজই চেষ্টা করি স্যার। পারা না পারা তো অন্য বিষয়। এ দেশে কবিতা লেখা অপরাধ, জানতাম না স্যার। জানলাম।“
প্রথম পুরুষঃ “ আমরা কি সেকথা আপনাকে বলেছি ? প্রথমেই ভেবে নিচ্ছেন ? কতো লোকেই তো লিখছে। সমস্যা হচ্ছে না তো ? তা, আপনি কি গভীর জলের মাছ ? “
—-“ গভীর না অল্প জল তা আমার জানা নেই স্যার। ঐ রাত্তিরে একটু আধটু জল খাই থুড়ি পান করি তো! আপনাদের এ কথা মনে হওয়ার কারণ জানতে পারি ?”
“প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করার জন্য আপনাকে এখানে আনা হয়নি। বিষয়টা মাথায় রাখুন। প্রশ্ন আমরা করবো। আমরাই করে থাকি বরাবর। তাছাড়া প্রশ্ন আমাদের না পসন্দ। মালিকপক্ষও চায় না এটা “
তিন
উঃপুঃ “ আপনার টাইমলাইন ঘেঁটে দেখলাম, ২২/০২/২০২২ এ আপনি পোস্ট করেছেন
“ হম জানতে হ্যাঁয় দুশমন ভী কম নহী লেকিন
হমারী তরহা হাথেলী পে জান থোড়ি হ্যাঁয় ?”
এই পোস্টে আরও আছেঃ
“যো আজ সাহিব-এ-মসনদ মে হ্যাঁয় কল নহী হোঙে
কিরায়েদার হ্যাঁয় জাতি মকান থোড়ি হ্যাঁয় ?”
আর শেষেঃ
“ সভী কে খুন হ্যাঁয় শামিল ইঁহা কী মিট্টি মে
কিসি কি বাপ কা হিন্দুস্তান থোড়ি হ্যাঁয় ?”
জানতে চাই কেন ?”
—-“ ওটা আমার লেখা নয়, স্যার। মরহুম শায়ের রাহত ইন্দোরি সাহেবের লেখা। আপনারা জানেন না তা তো নয় “
“ আমরা জানি। প্রশ্ন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে লাভ নেই।লেখাটা শেয়ার করলেন কেন ?”
—-“ কবিতা শেয়ার করা কি দণ্ডনীয় অপরাধ, স্যার? আমার টাইমলাইনে তো আরও লেখা শেয়ার করেছি আমি।“
“ সে সবেও নজরদারি আছে আমাদের। আপনি বেছে বেছে এমন সব লেখা শেয়ার করেন……”
—-“ খুলে বলুন স্যার। কেমন লেখা? কেমন লেখা শেয়ার করলে ভালো হয়? মানে, যদি কিছু সাজেশন দেন? “
মঃপুঃ “ ন্যাকাচন্দর ! আপনি তাই না? কিছুই বোঝেন না ভাব দেখাচ্ছেন ?আমাদের মুখ থেকে শুনতে চান ?”
—-“ সত্যিই তাই স্যার। যদি কিছু জানাতেন খুশী হতাম।“
প্রঃপুঃ “ আপনি তো কৃষক আন্দোলনের সময় কৃষকদের সমর্থনে অনেক পোস্ট করেছেন। আপনার ডি পি তে এখনও “stand with farmer” লেখা। তারও আগে এন আর সি নিয়ে… আপনি তো এখনও এন আর সি বিরোধী একটা সংগঠনের সক্রিয় সদস্য।“
—-“ হ্যাঁ স্যার, সত্যি। দেশের নাগরিক হিসেবে দেশবাসীর পাশে দাঁড়ানো কি উচিৎ নয়, স্যার? সরকার, থুড়ি মালিকপক্ষের সমর্থন করলেই কি ভালো হতো স্যার? “
চার
উঃপুঃ( গলার স্বর নামিয়ে) “ আপনার ঠিকুজি কোষ্ঠী থেকে যা পেলাম তাতে দেখলাম , আপনি সরকারি চাকরিজীবী। বেতনও সে অর্থে খারাপ নয়। বাড়িতে বউ আছে,বাচ্চা আছে। এসব করে বেড়াচ্ছেন কেন?
দেখুন, আমরা আপনাকে একটা সুযোগ দিতে চাইছি।এসব ছাড়ুন এবার। যদি আপনার এগেনষ্টে সিডিশন চার্জ দেওয়া হয়, তবে চাকরি তো থাকবেই না, কি হতে পারে ভেবে দেখুন প্লীজ । বাকী জীবনটা …”
—-“ বিনা বিচারে জেলে থাকতে হবে, তাই না স্যার? কবিতা লিখে বা শেয়ার করলে জেল হাজত হয়, এটা হাস্যকর”
“ আপনার হাসি পেতেই পারে। আমাদের পাচ্ছে না।“
—-“ স্যার, একটা কথা। যদি কিছু মনে না করেন, আপনারা তো আবার প্রশ্ন ভালবাসেন না, তবু একটা প্রশ্ন করতেই হবে স্যার, আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। প্রশ্নটা হলো, আমার এগেন্সটে আর কি কি এভিডেন্স পাওয়া গেছে স্যার? যাতে আমাকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় ?”
মঃপুঃ “ সেরকম হলে আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এখানে আনা হতো না। অন্য ব্যবস্থা হতো। তা কি স্থির করলেন? “
—-এই জায়গাটা কেমন অস্বস্তিকর, দমবন্ধ তাই না স্যার?”
“ হ্যাঁ “
—-“ বাইরের দুনিয়াটাও তাই স্যার। ফলে আমার কিছু যায় আসে না স্যার।এই বয়সে এসে তো আর নিজেকে বদলানো যায় না।আপনারাও জানেন স্যার। আপনারাও তো বদলাননি।আপনারা ছিলেন, আছেন, থাকবেন। আমি বা আমরাও থাকব স্যার, এভাবেই, চিরদিন”

কবি, গদ্যকার
পেশায় ব্যাংক কর্মী