সকালবেলাটা ছিল মেঘলা । বেলা বাড়তেই ঝকঝকে অথচ কোমল এক রোদ্দুর এসে খেলা করছে ছোট্ট পাহাড়ি শহর জুড়ে। ভোরবেলা একটু শীত শীত করছিল। এখন আর করছে না। গায়ের চাদরটা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল সুদীপ্ত। মনটা ঠিক ওর আয়ত্তে নেই। এক অদ্ভুত চাপচাপ ভার যেন মনের ওপর চেপে বসে আছে। সেইসব অদৃশ্য ভারগুলোর ওপর ও কিছুতেই যেন নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছে না। বিগত কয়েকমাস ধরেই এটা ঘটে চলেছে। এমনিতে ও নিজেকে সবসময় কাজে ব্যস্ত রাখে। ওর যা কাজ, কাজের পাহাড়, ব্যস্ত রাখতে হয় না, সারাদিন ধরে ব্যস্ততাই থাকে। তবু ও যেটা করে সেই কাজগুলিকেই খুব সাজিয়ে গুছিয়ে, অত্যন্ত যত্ন আর ধৈর্য নিয়ে শেষ করে। আর শেষ করার পর এক ফুরফুরে আনন্দ খেলা করতে থাকে। ওটাই ওর ইমপেটাস। পরের কাজের প্রেরণা। এভাবেই নিজের সঙ্গে, নিজের জীবনের সঙ্গে একরকম সমঝোতা সূত্র আবিষ্কার করে নিয়েছে সুদীপ্ত। মধুমিতার সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে সাতবছর হল। কয়েকবছরের প্রেম পর্বের পর অনেক স্বপ্ন আর আনন্দ নিয়ে রেজিস্ট্রি করেছিল ও আর মধুমিতা। সুদীপ্ত ভেবেছিল এবার বোধহয় ভাঙা জীবনটাকে জোড়া দেওয়া গেল।খুব ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে মামা বাড়িতে মানুষ।চাকরি পেয়ে মামার অনুমতি নিয়েই লোন নিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনে সে উঠে আসে। সেই থেকে একার জীবন। তবে বন্ধুরা ওকে বলত বেশ সংসারী। সেই সংসারই টিকল না সুদীপ্তর জীবনে। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই…। খুব ঝটিকা সফরে হানিমুনে এসেছিল এই শিলং-এ। হাতে মাত্র দু-দিন। এরমধ্যে বেড়াবেই বা কী? নির্জনে নববধূর সাথে প্রেম করবেই বা কখন? আসলে পুরো ব্যাপারটাই হাতে ছিল না সুদীপ্তর। মধুমিতাকে জানিয়েছিল সে কথা। কোম্পানি নতুন দুটো প্রোডাক্ট লঞ্চ করেছে। ও সেইসময় জুনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ।কর্মক্ষেত্র ইস্টার্ন ও নর্থ ইস্টার্ন রিজিয়ন।প্রতি মাসে তিন-চারটি ট্যুর করতেই হত। তার মধ্যে সবে পদোন্নতি হয়েছে।ওর ইমিডিয়েট বস বাগচিদা-কে বলেছিল, কোম্পানি আমাকেই এত ট্যুরে পাঠায় কেন? মোক্ষম জবাবটি দিয়েছিলেন বাগচিদা, তোমার তো খুশি হওয়া উচিত। কোম্পানির গুডবুকে আছ হে ভায়া! যখন ধারাবাহিকভাবে দায়িত্ব কমাতে থাকবে, তখন জানবে খাঁড়া নেমে আসছে। মধুমিতাকে জানিয়েছিল সে কথা। তিনবছর যখন বিয়ে না করে থাকতে পেরেছে, আর তিনমাস বাদে রেজিস্ট্রি করলে কী ক্ষতি হবে। মধুমিতা জেদাজেদি করতে লাগল। তোমার একটা প্রজেক্টের পর আরেকটা প্রজেক্ট। এর কোনো শেষ নেই। আরে বাবা কর্পোরেট। এতগুলো মায়না কী এমনি এমনি দেয়। তিনজনের খাটুনি খাটিয়ে নেয়। ওর বাড়িতে খুব সমস্যা হচ্ছে। এভাবে আর নয়। রেজিস্ট্রি করলে করো। নাহলে বাই বাই। বাহ্, বললেই হয়ে গেল। কোনো ভাবেই মধুমিতাকে বোঝানো গেল না। অগত্যা। বিয়ে তো হল। হানিমুন হবে না? গুয়াহাটি অফিসের বড়ুয়াদা উপায় বাতলালেন। তুমি তো আসছই। তুমি একদিন আগে চলে এসে ইনিশিয়ালি সামলাও। বউ আসুক একদিন বাদে।দু-জনে চলে যাও শিলং।দু-দিন কাটাও। তারপর বউ ফিরে যাক। তুমি তিনদিন থেকে বাকি কাজ সামলাও। সেইমতো আগে চলে আসে সুদীপ্ত। সকালের সরাসরি ফ্লাইট না পাওয়ায় তাকে আগের দিন বিকেলেই চলে আসতে হয়।শিলচর হয়ে। সময়ও লাগল অনেকটা বেশি। ফ্লাইট চেঞ্জ করে আসায় ধকলও হল অনেকটা। কাজের চাপও ছিল। মধুমিতার জন্য ডাইরেক্ট টিকিট কেটেছে। দেড় ঘন্টায় পৌঁছে যাবে।ধকল হবে কম।ও আসবে পরের পরের দিন ভোরে। এয়ারপোর্টে ওকে রিসিভ করে সোজা শিলং। মধুমিতা সবটাই জানত। ওর অনুমতি নিয়েই গোটা পরিকল্পনা হয়। কিন্তু আশ্চর্য! এয়ারপোর্ট থেকেই ও বেসুরো বাজতে লাগল। এত হেকটিক ট্যুর নিয়ে মন কষাকষি ছিলই। হানিমুনে ওর এই একা যাওয়া একা আসাটা বোধহয় ও মেনে নিতে পারছিল না। সেই রাগ-ক্ষোভ-দুঃখই নানা ছোটোখাটো বাগবিতণ্ডাকে বিরাট বিরাট পারমানবিক চুল্লিতে পরিণত করছিল। আর তা মুহুর্মুহু চেরনোবিলের মতই তাদের মাঝে ফেটে পড়ছিল। সুদীপ্ত ভাবল, আজ সারাদিন তো বিশ্রাম। শিলং-এর হোটেলে গিয়ে হয়তো অবস্থা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। পরের দিন যাবে ডাওকি হয়ে মাওলিলং। সুন্দরের সান্নিধ্যে এসে আকাশ পুরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভুল, ভুল ছিল সেই ডিসিশন। হোটেলের ঘরে সারাদিন তাদের চলল কথা-কাটাকাটি। মধুমিতাকে আগে কখনো এত অ্যাগ্রেসিভ মনে হয়নি। আজ যেন ও এক নতুন মানুষ যাকে সুদীপ্ত চেনে না। সুদীপ্ত কি ভুল করল? মধুমিতা কি সাইকিক ? যতটা পারছিল মধুমিতার কাছে সারেন্ডার করার চেষ্টা করছিল। মধুমিতার মন যেন তাতেও শান্তি পাচ্ছিল না। ঝগড়া চালিয়েই যেন সে মনের সব রাগ বের করে দিতে চায়। একরকম পারগেশন হবে ভেবে সুদীপ্তও সঙ্গত দিতে লাগল।একসময় মধুমিতা বলেই ফেলল, বিয়ে করার আগে ওর আরও ভেবে দেখা উচিত ছিল।সেও মানুষ তারও সহ্যের সীমা আছে––এই কথা আজ মধুমিতাকে বোঝাতে যাওয়া বৃথা। সে শুধু আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকল পরের দিনের দিকে। পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে সকালেই ওরা বেরিয়ে পড়ল ডাওকির উদ্দেশ্যে। মধুমিতার চেহারাটা ভালো দেখাচ্ছে না। ভালো করে সাজেওনি। চোখ দুটো লাল। বোধহয় ঘুমও ভালো হয়নি। খুব ক্লান্ত থাকায় রাতে সুদীপ্তর ঘুম এসে গিয়েছিল তাড়াতাড়ি। পাশে শুয়ে মধুমিতা ঘুমিয়েছে কিনা বা কান্নাকাটি করলেও সে টের পাইনি। খাটুনি আর তার সঙ্গে মানসিক স্ট্রেস তাকে এক্সজস্টেড করে দিয়েছিল। ঘুমটুকুর তার খুব দরকার ছিল। গাড়িতে মধুমিতা চুপ। বাইরে সুন্দর প্রকৃতি। কিন্তু ওর মধ্যে কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। সেও দুয়েকটা খেজুরে কথা বলে চুপ করল। সুদীপ্তর হাতে একটাই তাস, ডাউকির উমগোট নদীর স্বচ্ছ জলের বুকে নৌকোবিহার। ওই সোন্দর্য আর স্বচ্ছতার কাছে দাঁড়ালে মন স্বচ্ছ ও নির্মল হবেই। আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস সে আঁচ করতে পারিনি। একটু বাদেই মধুমিতা আবার শুরু করল। ওর এখনকার কথাগুলো বেশ অসংলগ্ন এবং বিষাক্ত তীরের ফলার মতো। সম্বিত হারাল সুদীপ্তও। দুটি ষাড় এক ধূসর মরুভূমির বুকে আছড়ে পড়ল ভীষণ লড়াইয়ে পরস্পরকে ফালাফালা করে দেওয়ার জন্য। ওরা ভুলেই গেল ওদের গাড়িতে আরেকজনও আছে। একটা অল্পবয়সী হাসিখুশি ছেলে ছিল ড্রাইভার। যে শুরুতে ওদের সঙ্গে সহজ ভাবেই কথাবার্তা বলছিল। এখন সেও চুপ। এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়ে একমনে গাড়ি চালাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরেই সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটল। গাড়ি ততক্ষণে শিলং–চেরাপুঞ্জি রাস্তা ছেড়ে উমতিগর থেকে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে ডাওকির পথ ধরেছে। এইপথে প্রায় কিলোমিটার খানেক চলেও এসেছে। ঝগড়া তখন ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে। মধ্যে নীরবতা। মানে কি আরও বড় ঝড়ের পূর্বাভাস? হঠাৎই মধুমিতা ওর হাতের বালাটা খুলে সুদীপ্তকে দেয়। ওর দেহের ভাষা বোঝাচ্ছিল, ও এই সম্পর্কটির সমাপ্তি চাইছে। সুন্দর ডিজাইনের এই বালাটিই প্রায় লাখখানেক টাকা খরচ করে বিয়েতে সুদীপ্ত নিজে ওকে কিনে দিয়েছিল। মাথা এমনিতেই খারাপ হয়ে ছিল। বালাটা ফেরত দেওয়ায় যেন রক্ত চড়ে গেল। বালাটি জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল সুদীপ্ত। মধুমিতা দেখতে পেল না কারণ ও অন্যদিকে মুখ করে বাইরে তাকিয়ে ছিল। এরপর ঠিক কী কী ঘটেছিল সুদীপ্তর আজ যেন মনেও পড়ে না। শুধু একটা দৃশ্যই ঘুরে ঘুরে আসে বালাটি সে বাইরে ফেলে দিয়েছে একথা বিশ্বাস করতে পারছিল না মধুমিতা। সে বারেবারেই নিজের খালি হাতটার দিকে তাকাচ্ছিল আর ওর চোখের কোণ দিয়ে নেমে আসছিল জলের ধারা।
রিসেপশন থেকে ফোন এল। আপনার গাড়ি এসে গেছে। পনের মিনিট অপেক্ষা করার কথা বলে সুদীপ্ত খুব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিল। আজ ওর মনটা খুব উতলা। নিজের কাজের ফাঁকে সময় বের করে কেন যে ও শিলং এসেছে তা ওর নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়। শুধু একটা ছবি চোখে ভেসে আসছে কিছুদিন ধরে। পাহাড় ও ঝোপ জঙ্গলের মাঝে একটা বেশ পুরোনো শিকড় ছড়ানো রবার গাছ। গাছটাকে বেশ আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। ঝরঝরে বাংলায় ওর গাড়ির ড্রাইভার জানাল, তার নাম ব্যাবিট সিয়েমলি। ও একজন খাসি উপজাতীয় খ্রিস্টান। ওর গ্রাম মাওলিলং থেকে দু-কিলোমিটারের মধ্যে। আজ মাওলিলং এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে বিখ্যাত। সেখানে টুরিস্টদের ভিড়। কিন্তু ওদের গ্রামটাও কম পরিচ্ছন্ন নয়। ছোটো ছোটো পরিষ্কার রাস্তা আর প্রত্যেকের বাড়িতে রয়েছে অজস্র ফুলের গাছ। ব্যাবিট ওর গ্রামে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করল। আরও অনেক কথা বলে যাচ্ছিল ব্যাবিট। সবকথা কানে পৌঁছোচ্ছিল না সুদীপ্তর। গাড়ি ততক্ষণে উমতিগর থেকে বাঁদিকে ঘুরেছে। সতর্ক হয়ে বসল সুদীপ্ত। এই দাঁড়াও, দাঁড়াও। গাড়িটা ঝটকা দিয়ে থেমে গেল। তুমি দাঁড়াও। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। ঘোরগ্রস্তের মতো নেমে গেল সুদীপ্ত। ওই তো সেই ঝুড়ি বের করা রবার গাছ। হ্যা এখানেই তো…। গাছটার আশেপাশে ঝোপজঙ্গল অনেক বেশি বলে মনে হল। তন্নতন্ন করে খুঁজে যাচ্ছিল সুদীপ্ত। একটা গাছের ডাল ভেঙে নিল। ঘাস লতাপাতা সরিয়ে সরিয়ে দেখতে লাগল। দাঁড়িয়ে, বসে নানাভাবে। উন্মাদের মতো খুঁজছিল সুদীপ্ত। কতক্ষণ কেটে গেছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সম্ভবত চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট কেটে গিয়েছিল। হুঁশ ফিরল ব্যাবিটের ডাকে। আপনি কি কিছু খুঁজছেন? অপ্রকৃতস্থের মতো তার দিকে তাকাল সুদীপ্ত। তার হাতেপায়ে, প্যান্টে, জামায় ধুলোকাদা । না, কিছু না, কিছু না, চলো। হতাশের ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠে নিজের শরীরটাকে এলিয়ে দিল সুদীপ্ত। হোটেলে ফিরে চলো। আজ আর কোথাও যাব না। সারা দুপুর নিজের ঘরে শুয়েই কাটাল সে। দুপুরে লাঞ্চও করেনি। তীব্র এক বিষাদ তাকে ঘিরে ফেলছে। কালই ও ফিরে যাবে। সন্ধের দিকে কলিং বেল বাজল। দরজা খুলে ব্যাবিটকে দেখে অবাক হল সুদীপ্ত। কী ব্যাপার। স্যার, সকালে আপনার শরীর খুব খারাপ লাগল। তাই একবার খোঁজ নিতে এলাম। এখন কেমন আছেন ? ভালো আছি। কিন্তু আপনাকে খুব সুস্থ দেখাচ্ছে না। না না আমি ঠিক আছি। বেশ খানিকটা রাগ দেখিয়ে ফেলে অস্বস্তি হয় তার। স্যার আপনার সাথে কয়েকটা কথা ছিল। একটু ভেতরে আসতে পারি। হাত কচলাতে কচলাতে বলল ব্যাবিট। ইচ্ছে হচ্ছিল না। ব্যাবিট বলল, স্যার, অল্প সময় নেব। অগত্যা দরজা ছেড়ে দাঁড়ায় সুদীপ্ত। ব্যাবিট এসে সোফাটিতে বসে। মুখোমুখি সোফায় সুদীপ্ত। স্যার কীভাবে যে শুরু করি। আজ সকালে আপনাকে দেখে আমার কেন জানি না চেনামুখ মনে হচ্ছিল। ভাবলাম কত লোককেই তো গাড়িতে নিয়ে যাই, বোধহয় ভুল হচ্ছে। কিন্তু আপনাকে ওইভাবে খুঁজতে দেখে…। স্যার, আপনি কি আমায় চিনতে পারছেন? এবার মনোযোগী হয় সুদীপ্ত। ভালো করে ব্যাবিটের দিকে তাকায়। না, চিনতে পারে না। স্যার, সাত-আট বছর আগে আপনি ম্যাডামকে নিয়ে এসেছিলেন। চমকে ওঠে সুদীপ্ত। তুমি জানলে কী করে। স্যার, আপনি আমায় চিনতে পারেননি। সেদিন আমিই আপনাদের নিয়ে গিয়েছিলাম ডাওকি। স্যার, ম্যাডাম ? মাথা নাড়ল সুদীপ্ত, আমার সঙ্গে থাকে না, ডিভোর্স। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। স্যার, সেদিন আপনারা দুজনেই খুব ডিসটার্ব ছিলেন। মাথা নীচু করে বসে থাকে সুদীপ্ত। স্যার, আজ আপনি কি কোনো সোনার চুড়ি খুঁজছিলেন? চমকে উঠে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সুদীপ্ত। কী বলছ তুমি? কী করে জানলে ? বসুন, স্যার, বসুন। সব বলছি। বুকের ভিতরটায় কেউ যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে সুদীপ্তর। স্যার, সেদিন আপনার আর ম্যাডামের মধ্যে খুব টেনশন ছিল। আমি মিররে দেখলাম, ম্যাডাম আপনাকে চুড়িটা দিল। আর আপনি সেটা ছুড়ে ফেলে দিলেন গাড়ির জানলা দিয়ে। প্রতিদিন যাওয়া আসার কারণে জায়গাটা আমার চেনা। পরদিন টুরিস্ট নিয়ে ফিরছিলাম ডাউকি থেকে। ওখানে দাঁড়ালাম কী এক কৌতুহলে। বিশ্বাস করুন স্যার খুব বেশি খুঁজতেই হল না। একটা লতানো গাছের ডালে আটকে ছিল চুড়িটা। হা হা করে হেসে উঠল সুদীপ্ত। ও ব্যাবিট ব্যাবিট, ভাই আমার। তোমায় যে কী বলে ধন্যবাদ দেব। তুমি জানো না। আমার আর কিছু নেই। ওই একটাই স্মৃতিস্মারক। ব্যাবিট, ব্যাবিট তোমায় কী বলে যে ধন্যবাদ দেব। তুমি আমায় বাঁচালে। আমি নিজেও জানি না, কেন হঠাৎ শিলং এলাম। এখন বুঝতে পারছি আমি ওই চুড়িটা খুঁজতেই এসেছি। ব্যাবিট চুড়িটা তোমার বাড়িতে আছে তো ? তুমি কাল সকালেই ওটা নিয়ে এসো। আমি তোমায় খুশি করে দেব ব্যাবিট। তুমি আমার যে উপকার করলে! কথা দিচ্ছি তোমায় নিরাশ করব না। স্যার, স্যার। ব্যাবিটের ডাক শুনতে পায়নি সুদীপ্ত। আশা ও আনন্দের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে সে বহুদূর চলে গিয়েছিল। সম্বিত ফিরল ব্যবিটের তৃতীয় বারের ডাকে। স্যার, আরেকটু কথা ছিল। হ্যা, বলো বলো ব্যাবিট। চুড়িটা আমার কাছে নেই স্যার। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল সুদীপ্তর। মানে, কী বলছ তুমি!
স্যার চুড়িটা আমি বিক্রি করে দিয়েছি। মানে? সেটাই বলতে চাই একটু শুনুন স্যার। মাথা কাজ করছিল না সুদীপ্তর। মনে হচ্ছিল বহু দূর থেকে ভেসে আসছে কারও গলার স্বর। আস্তে আস্তে বলে যাচ্ছিল ব্যাবিট। স্যার আমার বউ ম্যাসোলিন। খুব ভালো খাসি লোকসংগীত গায়। পড়াশুনোও করেছে চার্চের স্কুলে। স্যার বিয়ের আগেই ওর সাথে আমার পরিচয়। ভালোলাগা, ভালোবাসা। এরপর বাড়ির লোকেরা দেখাশোনা করল। আমাদের বিয়ে হল। আমাদের সমাজে বিয়ের পর বর গিয়ে ওঠে বউয়ের বাড়ি। আমিও ম্যাসোলিনের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ম্যাসোলিনের মা আগেই মারা গিয়েছিল। বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে ওর বাবাও মারা গেল। আমাদের খাসিয়া সমাজের নিয়ম অনুসারে কনিষ্ঠ কন্যাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। ছোটো মেয়ে হওয়ায় ও-ই জমি,বাড়ির মালিক হল। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। ওর বাবার অসুখের চিকিৎসায় অনেকগুলো টাকা ধার নিতে হয়েছিল। ওর বাবার দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে যায়। বাবা মারা যাবার পর সেই ধারও এসে পড়ল ম্যাসোলিনের ওপর। অবস্থা এমন দাড়ালো ধার শুধতে গেলে ওই বাড়ি, জমিটুকুও বিক্রি করতে হয়। উত্তরাধিকারী মানে তো বাপ-ঠাকুর্দার এই সম্পত্তি বুক দিয়ে আগলানো। চিন্তায় চিন্তায় ম্যাসোলিন শুকিয়ে যেতে লাগল। সারাদিন মনমরা হয়ে থাকত। ঠিকমতো খেত না। ঘুমতো না। আর গাইত গান। হৃদয় নিঙড়ানো সেইসব খাসিয়া গান শুনলে বুকের ভিতরটা হু-হু করে উঠত। মনে হচ্ছিল এইভাবে চললে ম্যাসোলিনকে বেশিদিন বাঁচাতে পারব না। খুব নরম মনের ছিল ম্যাসোলিন। পানগাছের মত সুক্ষ্ম ও সংবেদনশীল। আমার অবস্থাটা ভাবুন স্যার। অনেক কিছু করতে চাইতাম। কিছুই করে উঠতে পারতাম না। সবে গাড়ি চালানো শুরু করেছি। তেমন কিছু জমাতেও পারিনি। সেই সময় ম্যাডামের ওই চুড়ি মা মেরির কৃপা নিয়ে হাজির হল। বিক্রি করে দিলাম চুড়িটা। কিছু টাকা ধার করলাম। বাড়িটা বাঁচালাম। বাঁচালাম ম্যাসোলিনকে। স্যার আমি পাপ করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন। স্যার, আমাকে আপনার ঠিকানা দিন। আমি প্রতি মাসে যতটা পারি মানিঅর্ডার করব। সব টাকা আমি শোধ করে দেব। কাঁদতে লাগল ব্যাবিট। সুদীপ্ত উঠে দাঁড়াল। ব্যাবিটের কাঁধে হাত রাখল। ব্যাবিট তোমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর, তাই না? হ্যা স্যার। ম্যাসোলিন এখন গান গায়? হ্যা স্যার, সারাদিনই গায়। তোমার বাড়িতে আমায় নিয়ে যাবে তো? হ্যা স্যার, অবশ্যই নিয়ে যাব। ব্যাবিটের চোখে মুখে খুশির ঝলক। কী আশ্চর্য! সুদীপ্তর মনটাও এখন ডাওকি নদীর জলের মত স্বচ্ছ আর টলটলে হয়ে গেছে। একেবারে নীচ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

কবি
জন্ম: ১৯৭৭
পেশা ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকতা