শরীফ ম্যানশনের বাতি গুলো নিভে গেছে।জানালা দিয়ে তখনো পপুলার ডায়াগনস্টিক হাসপাতালের আলো ভরিয়ে রেখেছে।দূর থেকে কেউ যেন ডাকছে,মণি রে এ এ…।
পথের কুকুরগুলো কেউ আর পথে নেই। বাতাসে উড়ছে কাগজের টুকরোগুলো, পলিথিনের অংশ। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এখন হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি আসে বাতাস আর ধুলো-ঝড় নিয়ে।মণি ব্যালকনিতে টুলের ওপর বসে আছে আলো নিভিয়ে।
আশরাফ এখন ঘুমিয়ে আছে।পাশ থেকে উঠে এলেও টের পায়নি। দেবরের ছেলে দুটো পড়ছে, ওদের ঘরে আলো জ্বলছে।
অনেক সময় মণি নিজেকে কিছু প্রশ্নের মুখে ছেড়ে দেয়। কেন সে এমন করলো? অল্প বয়স ছিলো বলে? ফুফু আম্মার উস্কে দেয়া কথায়? একটা আবছা চিৎকার সব নীরবতা কাচের মতো ভেঙে দেয়। একটু সময় নিয়ে ভাবা যেতো কিংবা ক্ষমা করা যেতো। ক্ষমা করার কথাই বা আসে কেন? একজন স্বাধীন মানুষ নিজের জীবনের একমাত্র অধিশ্বর, কেন ভাবা যায় না?
মণির শরীরে এখনো যেন একটা আদুরে স্পর্শ লেগে আছে। ছোট ছোট লোকমায় কাকের ডিম, বকের ডিম বলে ভাত খাইয়ে দিত মা। দুধভাত খুব প্রিয় ছিলো। আম দুধ,কলা দুধ,গুড় দুধ, এত চমৎকার মাখাতো মা। পাতলা চুলে সবসময় ঝুঁটি করে দিতো, চোখে যেন না লাগে।
স্কুলে মণির একটি পোশাকি নাম ছিলো, দিনাত হোসেন। মা তাকে ডাকতো মণি বলে, মায়ের আদর মাখা নাম। স্কুলে মণির কোন বন্ধু ছিলো না, সবসময় একটা অজানা ভয়ে চুপ করে থাকা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। স্কুলের অনুষ্ঠানে একদিন হেডস্যার ওকে গান গাইতে বললেন, মণি খুব অবাক হলো। কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে না বলে, কেন যেন গেয়ে ফেলে, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে…’
সেদিনও রাতে চুপিচুপি কেঁদে নিজেকে প্রশ্ন করেছে মণি, কাজটা কি ঠিক হলো?
পাড়ায় কারো বাড়িতে বাবার সাথে দাওয়াত খেতে গেলে খুব অস্বস্তি হতো। একথা সেকথার পর বাবাকে শুনিয়ে নরম গলায় আত্মীয়রা বলতেন, আহা! মিল্টনের মতো সোনার ছেলের সাথে এমনটা হয়! মণি তখন আড়াল করতো নিজেকে, তবু নিস্তার নেই, ওর মুখ থেকে একই কথা বারবার শুনতে চাইতো ওরা। মণি তাই কোথাও যেতে চাইতো না। বাবাও এতে রাগ করতো, বলতো, লোকে তো মিথ্যে কথা বলে না। আজ মনে হয় বাবাকে নিয়ে নরম নরম কথা বলা মানুষদের বাবাও পছন্দ করতেন। তাঁর ভালোলাগতো সেসব কথা, শুধু মণি হাসিমুখে সব শুনতে বাধ্য হলেও ভেঙে মিশে যেতো মাটিতে।
বাসার কাছেই ছিলো বান্টিদের দোকান। মণি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিবে। স্যারদের বাসায় যায় অংক, ইংরেজি পড়তে। বান্টি একদিন একা পেয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করে। মণি ভয়ে একরকম দৌড়ে আসে বাসায়, পেছন থেকে শুনতে পায়, কোথায় পালাবে? রক্তে আছে, ইত্যাদি,ইত্যাদি…।
মণি,ফুফুআম্মার বাসায় এসে সব কথা জানায়। বাবাকেও বলে। তাঁরা কেমন শীতল হয়ে থাকে।
কলেজে ভর্তি হতে এসে একটা অন্যরকম ভাবনার জন্ম হয়। অনেক পড়তে হবে তাকে। বাবা তখন পাত্র খুঁজছে, সবাইকে বলছে, একজন চাকরিজীবী ছেলে খুঁজে দিতে। মণি অসহায় হয়ে বাবাকে, বোঝায়। বাবার সাথে দূরত্ব তৈরি হয়। বাবা একএকদিন পাত্রের বায়োডাটা মেলে ধরে, নানা প্রয়োজন, অপ্রয়োজন বোঝায়। ঘেমে একাকার হয়ে মণি যখন পাত্রপক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তোতলায়, বিয়ে ভেঙে যাবার কারণে বাবা সেই পুরানো ইতিহাসে চলে যায়। আর ভেতর থেকে কান্নার সাথে একটি করুণ সুর দুলে ওঠে, মণিরে এ এ…।
২.
আশরাফের সাথে বিয়েটাও একটা এক্সিডেন্ট। মণি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মুখোমুখি। আশরাফের কোচিং সেন্টারে যায়। পরিচয় থেকে প্রেম, পালিয়ে বিয়ে করা। আসলে মণি তখন বাবার নতুন সংসার থেকে মুক্তি চায়। আজ নিজেকে প্রশ্ন করে,মণি কী আশফাককে ভালোবেসেছিল? নাকি একটা মাকড়শার জাল থেকে আর একটা জালে জড়িয়ে যায়। বাবা যখন ইটালি থেকে ফিরে আসে তখন মণি ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। যখন যা চেয়েছে পেয়েছে। মায়ের বিষয়ে ভেসে বেড়ানো কথাগুলো ফুফুর সাথে তাল মিলিয়ে বলে যায়। মা যখন মণিকে বুকে জড়িয়ে অজানা ভয়ে কাঁপে, মণি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। বলে, তুমি একটি অসভ্য মহিলা, খুব খারাপ, তুমি আমার কেউ না।
মা যেদিন সংসার ফেলে চলে যায়, কী যে হলো তাঁর সারাটা বাড়ি, তাঁর বিছানা, রান্নাঘর ছুটে ছুটে দেখছিলো। কেঁদে কেঁদে বলছিলো,’আমি কোন অন্যায় করিনি।বিশ্বাস করো অরবিন্দ আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমি ওকে মণির পড়াশোনার জন্য, গান শেখানোর জন্য বাসায় রেখেছিলাম। ‘
যখন বাবা, মণি, ফুফুআম্মা চিৎকার করে তাকে বের করে দিচ্ছিল, মায়ের করুণ কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলা,মণি রে এ এ…।
মাকে বের করে দেয়ার পর অরবিন্দ মামাকে আর দেখা যায়নি।বাবা যখন ইটালিতে ছিলো অরবিন্দ মামা সবসময় মায়ের সাথে ঠাট্টা,তামাশা করতো, মণির তা পছন্দ ছিলো না। ফুফুআম্মা বলতো, ‘মালাউনডারে ঘরের মধ্যে আনছে, পীরিতের বাহার। ভাইকে সব জানাবো। ‘মণিকে বলতো, তোর মা একটা নষ্টা মেয়েমানুষ, সবসময় খেয়াল রাখবি। ‘বাবা দীর্ঘদিন ইটালিতে চাকরি করছে। প্রতিবৎসরই শোনা যেতো এ বৎসরই মা আর মণি বাবার সাথে চলে যাবে ইটালি। কাগজপত্র ঠিকঠাক করা আর ওদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল না, কেবল বৎসর পার হছিল।
মণি একদিন দেখে মা আর অরবিন্দ মামা খুব গল্প করছে হেসে হেসে।আর একদিন মেঘাচ্ছন্ন বৃষ্টির দিনে স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল আগেই। কাছেই স্কুল, অসময়ে বাসায় এসে মণি দেখতে পায়, চওড়া সিঁড়িতে টিপটিপ বৃষ্টিতে জড়িয়ে ধরে আছে অরবিন্দ মামা মাকে। মণি চিৎকার করে মাকে শাসায়, ফুফূআম্মা আর বাবাকে ফোনে জানায়। বাবা ফিরে এসে শালিস বসায়। নানা বাড়ি, দাদা বাড়ির সকলের সামনে মণি সেদিন বলে,এই মাকে সে চায় না। মা শুধু বলে, আমি মণিকে চাই তোমরা আমার সব কিছু নিয়ে যাও, তাড়িয়ে দাও, শুধু মণিকে দিয়ে দাও।’
কেউ সে কথা শোনেনি। বাবা বিকৃত কণ্ঠে বলে, আমার মেয়ে তোমার ছায়াও মাড়াবে না। মাকে উদ্দেশ্য করে মণিও বলতে থাকে, আমি তোমাকে ঘৃণা করি। ফুফুআম্মা মণিকে বাহবা দেয়। নানার সাথে এক কাপড়ে মা যখন চলে যায় তখন নানাও অনেক বাজে কথা বলে মা কে। একটা ঘৃণার চাদর তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকে। মা কেমন ভিখারি হয়ে যায়।
অরবিন্দ মামা,মণিকে গান শেখাতো। মা সেখানে বসে থাকতো, মাঝে মাঝে একটি রবীন্দ্র সংগীত গাইতো, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি,কে আমারে।’ গানটি সাথে নিয়ে মা চলে গেলে, মণি দেখে তার অগোছালো বইয়ের টেবিল, প্রিয় খাবার নেই, পিরিয়ডের কঠিন সময়ে ব্যথায় কষ্ট পেলে পাশে মা নেই,বাবার কঠিন শাসন, কারণে অকারণে মায়ের কটু উদাহরণ। একদিন বন্ধ হয়ে গেলো গান, হারমোনিয়াম বিক্রি করে দেয়া হলো। মণি তখন হঠাৎ বড়ো হয়ে যায়। মায়ের জন্য কেমন হাহাকার করে বুক। নিজেকে ধিক্কার দেয়। মনে হয় সে ই তাড়িয়ে দিয়েছে মাকে। কেন সে এমন করলো! মা তো বৎসরের পর বৎসর একা একা বাবার অপেক্ষায় ছিলো।
অনেক ঘটা করে বাবার নতুন সংসার হলো ।বাবা এমন সোহাগে ব্যস্ত হয়ে উঠলো যে তাও বিরক্তির পর্যায়ে চলে আসে। অরবিন্দ মামা ভারতে চলে যায়। মা আত্মহত্যা করে। সেই থেকে মণি নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না।বাবা মণিকে বিয়ে দিয়ে নতুন মাকে নিয়ে আবার ইটালি চলে যেতে চায়। মণি বাবাকেও আর সহ্য করতে পারে না। আশরাফকে বিয়ে করে বাবাকে মুক্তি দেয়।
এখন আশরাফকেও অসহ্য লাগে মণির। তার পরিবারের সদস্যদের প্রশ্নের লেজ লম্বা হতে হতে মা পর্যন্ত গড়ায়। আশফাক অকারণে উপদেশ দেয়,বোরখা পরতে বলে। বিছানায় আশফাক যখন স্পর্শ করে ওর ভীষণ কান্না পায়। ইদানিং এসব নিয়ে ঝামেলা লেগেই আছে। ভালোবাসা ছাড়া শরীর দেয়া অনেক কষ্টের, সে কথা বলাও যায় না। মণি আশফাককে কিছুই দিতে পারেনি। না টাকা-পয়সা,না সন্তান। মণিও আজকাল সেই গান নিজেকে শোনায়, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি…’

পোশাকি নাম মাহাবুবা হুসাইন চৌধুরী
মূলত কবি
এছাড়া প্রবন্ধ, গল্প ও শিশুতোষ সাহিত্যেও তাঁর বিচরণ রয়েছে
জন্ম ৩০ নভেম্বর, ১৯৬৫
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাষক
1Comment
October 1, 2022 at 9:04 am
কবির হাতে গল্প একেবারে প্রকৃত গল্পই হয়ে উঠলো।