১. গর্ভেশ্বরী
এই চওড়া সবুজ ফিতেটাকে আমরা নদী বলে ডাকতাম। যদিও আঁতুড়ঘরে যাওয়ার আগেই গর্ভেশ্বরী নদীর মৃত্যু ঘটেছে। আর সুযোগ বুঝে মৃত নদীর কবরটাকে আমরা সবুজ দিয়ে বাঁধাই করে ফেলেছি।
দৃশ্যত সবুজ সুন্দর, কিন্তু গর্ভেশ্বরীর গর্ভজল গিলে ভরপুর বেড়ে ওঠা সবুজে সৌন্দর্যের বড় ঘাটতি।
নদীর গর্ভে জলই সুন্দর, জলই সত্য। এই সুন্দর সত্যকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেখেও আমরা দুঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া ওড়াই, গর্ভেশ্বরীকে ভরাট করে করে তাকে আরও পুরু করি। প্রবহমান নদীর জন্য হায় আফসোস করে প্লেকার্ড ফেস্টুন সাজাই, মিছিল গলে বেরিয়ে সোজা নদীর অপুষ্ট স্তন মাড়িয়ে হেঁটে যাই।
গর্ভেশ্বরীর আত্মাও হাঁটে, হেঁটে হেঁটে আমাদের ঘুমঘর পর্যন্ত চলে আসে। সবুজকে ফিরিয়ে না নিলে দুচোখের পাপড়ি এক করতে দেবে না বলে অভিশাপ দেয়। অভিশপ্ত হয়েও ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে শেষবারের মতো আমরা দেখে নিই, একটা সবুজ ফিতে থেকে এক ফোঁটা জল হতে হতে কী করে গর্ভেশ্বরী ক্রমশ ভূগর্ভে মিলিয়ে যায়।
২. মিলান্তি খেলা
নদীর কথা বললে পাখির কথা আসে।
রোজ সন্ধ্যায় নদীর ধারে নির্ঝরের যেই হুহুপাখি বসে থাকে তাকে দেখলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। মা যখন শাসন করত তখন মাকে দুচোখে দেখতে পারতাম না।
এখন আমার পানিপচা নখের কোনায় কোনায় মাকে দেখি, কপালের ভাঁজে নিয়তির দাগে মাকে দেখি। হাতের পাতার যেই রেখাগুলো হলুদ-মরিচের ছোপছাপে মুছে গেছে সেখানেও মাকে দেখি। মাকে দেখতে দেখতে দেখি আমার আর মায়ের চেহারায় খুব মিল।
মিলান্তি মিলান্তি খেলতে খেলতে আমার চুলে সাদা রঙ ধরে যায়। ভাবি সাদা হতে হতে একদিন আমি কাশবন হবো। আমি আর মা তখন নদীর সিঁথিতে পাশাপাশি শুয়ে থাকবো আর মেঘের কাছে গল্প করবো-এই জীবন আমাদের কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কী দেয়নি-সেইসব গল্প।
৩. প্রতিশ্রুতি
অদ্ভুত এক উড়ো উড়ো বিহ্বলতা নিয়ে মেঘের অপেক্ষা করি।
তবে কি আর তার সঙ্গে দেখা হবে না!
অপেক্ষারা উড়ে যায়, উড়ে যায়…সাত আসমানের সন্নিকটে, মেঘের দেখা মেলে না। আসমানের এক এক স্তরের খোলস চূর্ণ করে মেঘের বদলে বৃষ্টি আসে। মেঘহীন বৃষ্টি বড়ো নির্মম। এর তীরতীক্ষ্ম এক এক ফোঁটায় শরীরজুড়ে শত শত ক্ষত তৈরি হয়। ওসব ক্ষত নিঙড়ে নিলেই মেঘের সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও পাবো।
এই প্রতিশ্রুতি তোমারই দেওয়া। কে যেন বলেছিল, প্রতিশ্রুতি দিতে নেই, দিলে রাখতে নেই।
তোমার আস্তিনে ধুলোর বদলে রোজ অযুত-নিযুত প্রতিশ্রুতি জমে। ওদিকে প্রতিশ্রুতিহীন পথে হেঁটে যেতে যেতে টের পাই কারও অনুপস্থিতিই শূন্যতা হয়ে উঠছে না আর।