
ছোটবেলায় মায়ের কোলে শুয়ে বেপথু নক্ষত্রের উড়ে যাওয়া, উল্কাপতন দেখে, কৃত্তিম কোলাহল বর্জিত আমার গ্রামে মাথার উপর দিয়ে শব্দ করে প্লেন ছুটতে দেখলেই ভাবতাম, নক্ষত্র, উল্কার মত মানুষ যদি পড়ে যায়! কিংবা প্লেন যদি পড়ে যায়! প্লেন নিয়ে অনন্ত ভাবনা থেকে খুব আকাশ ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হতো! যেদিন আকাশ ছোঁয়ার তীব্র ইচ্ছে ছিল সেদিন ছুঁতে না পারলেও আজ আকাশ ছুঁয়ে দেয়ার অপেক্ষায় বসে আছি। সময়ের ব্যবধানে মনের ইচ্ছেও বদলে যায়। যে ইচ্ছেটা একদা আরাধ্য ছিল সে ইচ্ছের দ্বারপ্রান্তে বসে বুক এখন ধুকপুক করছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিমানের কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশপথে এটি আমার জীবনের প্রথম ভ্রমণ। যেদিকে তাকাই সবকিছুতেই আমার বিস্ময়। সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা দেশে পাড়ি জমানোর আগে খুব মনে পড়ছে, আমার গ্রাম, লেপা উঠোন, স্কুলের বাচ্চারা, মায়ের চুম্বন, ভোরের আলো, ধানক্ষেত, কাশবন, দেশের মাটির কথা।
বাঁ দিকে পাশের সিটে বসা স্বদেশী মানুষটা আমার ছেলের বয়সী। শুরু থেকেই ওর মার্জিত ব্যবহারে মুগ্ধ হলেও জড়তা কাটাতে পারছি না৷ আসলে চেনাজানা সীমানা, মানুষের বাইরে এর আগে কোথাও যাই নি, কিংবা যাওয়ার প্রয়োজনও পড়ে নি। আমার জড়সড় ভীতিবিহ্বল অবস্থা দেখে ও বারবার এটা ওটা জিজ্ঞেস করছিল। আমার উত্তরগুলো হ্যাঁ অথবা না এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় আলাপচারিতা তেমন গড়ায় নি। ছেলেটা পরে মাথায় হেডফোন গুঁজে সামনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিল। বুঝতে পারি, আলাপচারিতাও একটা আর্ট। এতে প্রাণ না থাকলে বেশিদূর এগোয় না। সব বুঝি, কিন্তু ভয় আমাকে এতটাই গ্রাস করেছে যে মুখে কথাই ফুটছে না। মনে পড়ে দীপক দা’র এপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের আগে ভয়ে যেভাবে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আমার অবস্থাও তেমন লাগছে আজ।
আলো আঁধারের সন্ধিক্ষণে সবসময় বুক ভারি লাগে, মন বেদনায় ভরে যায়। বৈকালিক বিষন্নতা ভালো লাগে না একদম। দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া আলো আর আসন্ন অন্ধকারে আবৃত এ এক অন্যরকম আলো-ছায়ার সন্ধ্যা। অন্য সকল সন্ধ্যা হতে আজকের সন্ধ্যা সম্পূর্ণ আলাদা। আমার গ্রামের বাড়ীর বারান্দার দুলুনি চেয়ারটার মত আমি যেন দুলছি হাওয়ায়। এ অস্থায়ী ঘরে তো দুলুনি চেয়ার নেই, তবে কেমন করে দুলছি! একটু পরেই বুঝলাম আমার অস্থায়ী ঘর, মানে প্লেনটি হাঁটতে শুরু করেছে রানওয়ে ধরে। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি সুদূরে। হাঁটার গতি ক্রমশ বাড়ছে, বাড়তে বাড়তে একসময় মনে হল চরাচর যেন লুপ্ত হয়ে গেলো। সাদা মেঘের শরীর কেটে কেটে প্লেন উপরে উঠছে, আর আমি যেন পরিষ্কার দেখতে পেলাম প্লেন নয় আসিফ সুপারি পাতার ডালে বসিয়ে আমাকে টানছে। আমি ওর মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি, ও আমার দিকে তাকিয়ে দশদিক আলো করে হাসছে। আমার হাতে ওর বানানো আম পাতার বাঁশি। আসিফ আমাকে পাতার বাঁশি বানানো এবং বাজানো শিখিয়েছে। ও যখন আমাকে সুপারির ডালে বসিয়ে টানতো তখন আমি পাতার বাঁশি বাজাতাম। আসিফদের বাড়ীর সামনেই ছিল শান বাঁধানো টলটলে জলের দীঘি। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় দীঘির জল ঝকঝক করে। অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য। ও বলেছিল বড় হয়ে আমাকে সূর্য রঙের জামদানি শাড়ি কিনে দিবে। আমি প্রায়শই ওই জলে উপুড় হয়ে নিজের মুখ দেখতাম। স্বচ্ছ জলে কখনো কখনো আমার সঙ্গে আসিফের মুখও দেখা যেত। কখন যে এসে ও আমার পেছনে দাঁড়াত, বুঝতেই পারতাম না। আসিফের হাতে রঙিন কাগজ থাকতো। আমরা একসঙ্গে কাগজ কেটে কাগজের নৌকা বানাতাম। অতঃপর, নৌকাগুলো দীঘির জলে ভাসিয়ে দিতাম। নৌকাগুলো ভাসানোর সময় আমরা দু’জন চোখ বন্ধ করে একটা ইচ্ছে পোষণ করতাম, আর বলতাম, নৌকা ফিরে এলে আমাদের ইচ্ছে পূর্ণ হবে। কেউ কাউকে গোপন ইচ্ছের কথা জানাতাম না। আসিফের ইচ্ছে জানা হয় নি কোনদিন, আমার ইচ্ছে ছিল ও যেন ছায়া হয়ে সবসময় আমার পাশে থাকে। সত্যি, আসিফের মত একজন সাথী এক জীবনে পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। আমি ভাগ্যবান!
ওদের বাড়ির চৌদিকজুড়ে নানান বৃক্ষের উদ্যান। বাগানবিলাসে ঢাকা সদর দরজাটি যে কারো নজর কাড়ে। হরেক রঙের ফুলে ঢাকা বাড়ীটিতে ঢুকতে মনে হতো যেন কুঞ্জগৃহে প্রবেশ করছি। কিন্তু আমার সে ঘোর বেশিক্ষণ স্থায়ী হতো না। কারণ, সদর দরজার ভেতরে যাওয়া আমার নিষেধ ছিল। আমার ধুলো মাখা ফ্রক, পায়ের কাদা, ওদের ঘরের চকচকে মসৃণ মেঝে অপরিষ্কার করে দিত। বাড়ীর সদা সতর্ক প্রহরী না করার পরও ভুল করে সদর দরজার ভেতরে কতবার যে ঢুকে পড়েছি আর ধমক খেয়ে বেরিয়ে এসেছি, হিসেব নেই। আসিফের বাবার শাঁসানি খেলে ভয়ানক মন খারাপ হতো। মন খারাপ হলে গাছের মগডালে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আসিফের মুখে আমার নাম শুনলেই সমস্ত মন খারাপ নিমিষেই উধাও হয়ে যেত। ও আমাকে শিপ্রা নয় শিপু বলে ডাকতো। ওর কন্ঠে অন্যরকম একটা মায়া ছিল, যে মায়ার কাছে আমার কোন বিষাদ টিকতেই পারতো না।
রাস্তার পশ্চিম পাশে ছিল আসিফদের বাড়ী, বরাবর ঠিক পূর্ব পাশে ছিল আমাদের ঘর। আমাদের ঘরটিকে ঠিক বাড়ি বলা চলে না। একটি আদর্শ বাড়ির কাঠামো যেমন হয়, আমাদের তেমন ছিল না। আসিফের বাবার দেয়া সামান্য জায়গায় খড়, প্লাস্টিকে মোড়ানো ছোট্ট একটি কুঁড়েঘর ছিল আমাদের। উঠোন, সবুজ উদ্যান, ফল-ফুলের বাগান কিংবা শান বাঁধানো দীঘি ছিল না। বৃষ্টিজল অনায়াসেই গড়িয়ে পড়তো আমাদের শিউরে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে কিংবা মিলেমিশে বাঁচতে হতো আমাদেরকে।
আমাদের বাড়ীর বাঁ দিকে, একটু দূরেই ছিল দিগন্ত ছোঁয়া কাশবন। প্রকৃতিতে ঋতুর রাণী শরত এলে পরিষ্কার নীলাকাশের নিচে সবুজ মাঠ, কাশফুল দেখলেই কুঁড়েঘরে থাকার কষ্ট ভুলে যেতাম। মনে হতো, এ দিগন্ত ছোঁয়া কাশবন, সবুজ মাঠ, ঝকঝকে নীলাকাশ, সব আমার! কেননা, আমার ধুলো মাখা ফ্রক, কাদায় জড়ানো পা দেখে ওরা কেউ দুরদুর করে তাড়িয়ে দিত না। মমতাময়ী মায়ের মত ওরা আমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিত। আমি যেন ওদের-ই অংশ! যতদূর চোখ যায় কোন মানুষ নেই, শুধু আমি আর প্রকৃতি। নিজেকে গোটা ভূখন্ডের মালিক ভেবে সুখ পেতাম মনে মনে!
কাশবনের পাশ ঘেঁষে আমি আর আসিফ রান্নাবাটি খেলতাম। ও বাজার করে আনতো, আমি রান্না করতাম। রান্না করার জায়গাটিকে মাটি দিয়ে লেপে রাখতাম। আমি ছিলাম আসিফের রান্নাবাটি খেলার বউ! কাশের ডগা দিয়ে রান্না হতো তরকারি, আর ফুল দিয়ে ভাত! রান্না শেষে দু’জনে হাপুসহুপুস করে কলাপাতায় খেতাম! খাওয়া শেষেই মেতে উঠতাম গোল্লাছুট খেলায়। আমাদের আনন্দে কাশবন, গোধুলি বেলা বিভোর হয়ে থাকতো। অন্ধকার গাঢ় হওয়ার আগেই আসিফ বাড়ি ফিরে যেত। বাড়ি যাওয়ার আগে আসিফ সবসময় বলত- আগামীকাল আবার দেখা হবে বউ। উত্তরে বলতাম- ঠিক আছে, আসিফ। ও চলে গেলে আমি একাকী অপেক্ষায় থাকতাম মা ফেরার জন্য। সেদিন ও বিদায় নেয়ার পর মা’র জন্য অপেক্ষা করার সময় মনে হলো একটু দূরে কী একটা নড়ে উঠলো! আধো আলো আধো অন্ধকারে কাছে গিয়ে দেখার সাহস হয় নি। ভয়ে কাশবন ফেলে আসিফদের বাড়ীর সামনে এসে মায়ের জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম।
ঘরে ফিরেই কুপির আলোয় মা জিজ্ঞেস করলো – আসিফ তোরে বউ বলে ডাকে ক্যান? বললাম – আমি ওর রান্নাবাটি খেলার বউ! মা শক্তভাবে আমার মুখ চেপে ধরে বলল- আর কোনদিন যেন ও তোরে এই নামে না ডাকে। সারাদিন গাব গাছের আঠার মত ওর সঙ্গে লেগে থাকবি না, মনে থাকে যেন। ক্যান মা, জানতে চাইতেই মা অগ্নিমূর্তির রুপ নেয়। ওই নামে তোরে ডাকলে মাথার উপরের এ আশ্রয় ফেলে আমাদেরকে খোলা আকাশের নিচে কাশবনে থাকতে হবে। জল আর তেল যেমন একসঙ্গে মিলে না, তেমনি ধনী -গরীবও মেলে না। মনে রাখবি, আমরা ওদের বাড়ীর কাজের লোক।
মায়ের কথাগুলো আমার মাথার উপর দিয়ে ফরফর করে উড়ে গেলো৷ কিছুই বুঝলাম না। এদিকে ঘুমে আমার চোখ যে বন্ধ হয়ে আসছে৷ মা বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই আমি রাজকন্যার মত ঘুমের দেশে হারিয়ে যাই।
আমাদের গ্রামে শেয়ালের ডাক, ঝিঁঝি পোকার গানে সন্ধ্যা নামতো। উঠোনে শীতল পাটি বিছিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে কীর্তন শুনতাম, আর আসিফদের বাড়ির দিকে চেয়ে থাকতাম। স্বর্গের বর্ণনা শুনেছি মায়ের মুখে কিন্তু কোনদিন তো ধারে পাশে যেতে পারি নি। ওদের আলোকজ্জ্বল বাড়ীটিকে আমার স্বর্গ মনে হতো! বাড়িটির ভেতরে যাওয়ার জন্য প্রাণ বড় আনচান করতো।
কোন কোন দিন ঘরে কেরোসিন থাকতো না বলে অন্ধকারে আমাদের রাত কাটতো। বাবা নেই, মায়ের একার উপার্জনে সংসার চলে। সেদিন রাতে উত্তেজনায় ঘুম হয় নি বললেই চলে। চোখ বুঁজলেই দেখতে পাই স্কুল ঘরে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি! কাক ডাকা ভোরে উঠেই স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। আজ বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল দিবে যে। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে উঠার পরীক্ষায় আমি প্রথম স্থান দখল করেছি শুনেই আসিফের বাবা চিৎকার করে বললেন- এই মালাউনের বাচ্চা ক্লাসে প্রথম হয় কী করে? তাঁর কথা শুনে আমি ভয়ে থরথর কাঁপতে থাকি। প্রথম হওয়ার আনন্দ উড়ে যায় নিঃসীম শূন্যে। তাঁর কথার কোন অর্থ খুঁজে পাই না। সেদিন জানলাম আসিফের বাবা এ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
বাড়ী এসে মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলাম। সব শুনে মা ও অঝোরে কাঁদলেন। চোখের পানি মুছে দিয়ে মা আমাকে সব ভুলে পুনরায় পড়াশোনায় মন দেয়ার জন্য উৎসাহ দিলেন। আমি স্কুলে যেতে থাকি। আমার মায়ের স্বপ্নকে সাথি করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকি। মায়ের অনুপ্রেরণামূলক কথাগুলো আমার চোখের মণিতে আলো হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। মায়ের দু-বাহু ধরে কান্না লুকিয়ে নিত্যকার কঠিন বাস্তবতা মাড়িয়ে যাই। চলার পথে আঘাত আসে, হোঁচট খেয়ে কত রক্ত ঝরে, তবুও নিজেকে বেঁধে রাখি গন্তব্যের পথে। বুঝতে পারি বয়সের ভারে ন্যুব্জ মায়ের শরীর কাজের চাপে ভেঙে পড়েছে। তাঁর জন্য বুকের ভেতরটা হু হু করে। জীবনের উপর অভিমান জন্মে। মানুষে মানুষে এত বৈষম্য কেন – রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ইশ্বরকে প্রশ্ন করি!
এস.এস.সির রেজাল্ট যেদিন প্রকাশ পেল সেদিন পুরো গ্রামে আমার নাম রটে গেলো। এ প্রথম এ স্কুল থেকে আমি বোর্ড স্টেন্ড করেছি। অনেকেই আমাকে আশীর্বাদ করলো, অভিনন্দন জানালো। কেরোসিন ছিল না বলে সেদিনও আমাদের ঘর অন্ধকার ছিল। আনন্দের গল্প রাতের অন্ধকারকে ম্লান করে দেয়! রাতের ঘন অন্ধকারে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলাম, আমার অসুস্থ শয্যাশায়ী মায়ের চোখে জলের আড়ালে চাঁদের হাসি!
আমরা এত গরীব হোলাম কেমন করে? মায়ের কোলে মাথা রেখে জানতে চাইলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে মা বলতে লাগলেন –
‘ সঠিক দিনক্ষণ মনে করতে পারছিনা। অনেক বছর আগের কথা। হিন্দু -মুসলমান দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল নোয়াখালীর প্রায় সবখানে। একদিন সূর্য উঠার আগেই জানতে পারি বাজারে তোর বাবার স্বর্ণের দোকান লুট করে পুড়িয়ে দেয়া হয়। সূর্য উঠার পর আমাদের বাড়িতে হামলা করা হয়। আমি আর তোর বাবা কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাই। ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষে তোর ঠাকুরদা সহ কাছের অনেককে হারাই। তোর বাবার জন্মস্থান নোয়াখালী জেলার রায়পুরের পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সেসময় অনেকেই বাপ-দাদার ভিটেমাটি ফেলে প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র বা দেশ ছেড়ে চলে যায়। আমি দেশ ছাড়ার কথা বললে তোর বাবা কোনক্রমেই বাপ-দাদার দেশ ছেড়ে যেতে রাজি হয় নি। তোর বাবার ইচ্ছের কাছে পরাজিত হয়ে আজ এখানে এ অবস্থায় অন্যের আশ্রয়ে বেঁচে আছি। দাঙ্গা শেষে রায়পুর ফিরে গিয়ে দেখি আমাদের ঘরবাড়ি, জায়গাজমি সব অন্যদের দখলে। অগত্যা বুকে পাথর বেঁধে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসি এখানে। ‘
দীর্ঘদিন আসিফের বাবার ভয়ে ওদের বাড়ির পথ না মাড়ালেও, আজ ভোরে ওদের বাড়ির দিকে পা বাড়াই। সদর দরজায় গিয়ে অবগত হই, আসিফ উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়েছে বেশ আগে। ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করে আশীর্বাদ নিতে চাইলে প্রহরী ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে বের করে দেয়।
‘চল্লিশ মিনিটের মধ্যে জন. এফ. কেনেডি এয়ারপোর্টে আমরা অবতরণ করবো’ – কিন্নরকন্ঠি বিমানবালার এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমার নিমগ্নতা ভেঙে যায়। চোখের সামনে ভেসে উঠে শুভ’র মুখ, কতদিন ছেলেটাকে দেখি না। টানা উনিশ ঘন্টা এক নাগাড়ে কবুতরের খোপের মত জায়গায় বসে থাকতে থাকতে হাতে পায়ে যেন খিল ধরে গেছে। ছেলেটাকে দেখব এ আনন্দে আকাশপথে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি কেটে যায় নিমিষেই!
ইমিগ্রেশনের প্রয়োজনীয় নিয়মাবলি সেরে লাউঞ্জের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকাতেই চেনা ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে! শুভ এসে মা মা বলে জড়িয়ে ধরেছে। দেশে থাকতেও ছেলেটা বিড়ালের মত সারাক্ষণ আমাকে ঘেঁষে থাকতো। ছেলেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরতেই আকাশপথে ভ্রমণের কাল্পনিক বিভ্রাটজনিত সব উৎকন্ঠা বিদায় নেয়। ওর পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে এতক্ষণে নজর পড়লো।
ওর নাম জারিন – শুভ পরিচয় করিয়ে দিল।
মা দূর্গার মত টানা টানা চোখের হাস্যজ্বল মেয়েটার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিতেই ও শুভর মত আমার বুকে আলুথালু হয়ে আছড়ে পড়ে। মেয়েটির মিষ্টি হাসি, মোহনীয় চাউনি আমার মন কেড়ে নেয়। আসিফ ফোনে ওর সম্পর্কে যেমনটি বলেছে, জারিন এরচেয়েও বেশি প্রাণবন্ত আর মায়াবী!
এ শহরের প্রকৃতিও দেখছি দেশের মতো সবুজ আচ্ছাদিত। শরতের নরম রোদ এসে পড়ে গায়ে। পরিষ্কার নীলাকাশ চুঁইয়ে জমিনে পড়া আলো মুক্তোর মত ঝলকাচ্ছে। আসলে প্রকৃতি একটি মায়া। পিচঢালা মসৃণ পথ ধরে শুভর গাড়ি দ্রুত বেগে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের দিকে। জারিন পরম আদরে আমার হাত ধরে বসে আছে। মনে হলো ছোটবেলার মত মা আমার হাত ধরে বসে আছে! ওর যত্ন আমাকে অবাক করলো।
বাসায় এসে কিছু সময় জারিন আমাদের সঙ্গে ছিল। যাওয়ার আগে বললো – আপনি বিশ্রাম নিন। কয়েকদিন পর এসে আপনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাব।
কয়েকদিন যেতেই এ যন্ত্র শহরে আমি হাঁপিয়ে উঠি। শুভ অফিস থেকে ফিরলে বলি – আমাকে দেশে পাঠিয়ে দে। এমন চৌখুপিতে দম বন্ধ হয়ে আসে। ও হেসে বলে – আগামীকাল আমরা জারিনদের বাসায় যাব। বাসার বাইরে যাব ভাবতে মন খুশি হয়ে উঠে।
ডোর বেল বাজতেই হাসিমুখে জারিন দরজা খুলে দেয়। মেয়েটা এত শুদ্ধভাবে বাংলা বলে আমার প্রাণটা শীতল হয়ে আসে। বসার ঘরে আমাদেরকে বসতে দিয়ে ও ভেতরে যায়। বসার ঘর তো নয় এ যেন রাজপ্রাসাদ! দেয়ালজুড়ে কত কত ছবি। ঘাসফড়িং, কাশবন, কদম গুচ্ছ, শাপলা ফুলের ছবি দেখে বিস্মিত হই। ভিনদেশের মাটিতে ঘরের দেয়ালজুড়ে যেন বাংলাদেশ ফুটে আছে! আমি আনমনে তাকিয়ে থাকি ছবিগুলোর দিকে। কোনটি ঝলমলে, কোনটা ধূসর! ছবি তো শুধু ছবি নয়, ছবি গল্প বলে! ছবির রহস্যাবৃত অর্থ আমি কখনো বুঝি না তেমনভাবে! আমার চোখ আটকে যায় চমৎকার বুক শেল্ফে! ভিনদেশে এত এত বাংলা বইএর সমাহার দেখে আবারও অবাক হই কিছুটা। কত যে বই সেখানে, বই এর গন্ধ এসে নাকে লাগছে। বইএর গভীর ঘোরে ডুবে থাকা অবস্থায় জারিন এসে বলল- আন্টি, আমার বাবা।
ভারি কাচের চশমা চোখে কালো হ্যাট পরিহিত আধা পাকা চুলের প্রৌঢ় মানুষটার দিকে তাকিয়ে আমার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম! তিনি দাঁড়িয়ে আমি বসে আছি, কারো মুখে কোন কথা নেই। আমি যেন কোন স্বপ্ন দেখছি, টাইম মেশিনে চড়ে পেছনে হাঁটতে শুরু করেছি। আমার আত্মা যেন খাঁচা ছেড়ে গেছে, আমি কোন ভিনগ্রহে এসে পৌঁছেছি।
শুভর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পাই। আমার মা – শুভ পরিচয় করিয়ে দিলে আমরা পরস্পর কুশলাদি বিনিময় করি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে আমি ঘামতে থাকি। বাইরে স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে! জীবনের কোলাহল শেষে গোধুলিতে উত্তাপের ঢেউ সদা অস্তমিত থাকে। এমন নরম আলোয় আমার চোখ পুড়ছে কেন! এমন ভর দুপুরের গনগনে রোদে আমার চোখে বৃষ্টি কেন! এত আলোর মাঝে আমার বুকের প্রাসাদে অন্ধকার কেন!
– তোমার বাবা আসেন নি?
– উনি আমার বাবা, উনি আমার মা। দিনভর স্কুল টিউশন শেষে বাসায় ফিরে রাত জেগে সেলাই করে মা যখন আমার হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ তুলে দিতেন, তখন তাঁকে বাবা মনে হতো! ক্লান্ত শরীরে যখন নিজ হাতে এই এতিম আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেন, কাপড় ধুয়ে দেন, তখন তিনিই আমার মমতাময়ী মা!
আসিফ – শুভর কথোপকথন আমাকে দূর অতীতে নিয়ে যায়! জীবনের প্রথম ও শেষ কথা জীবন নিজেই! জীবন কখন কাকে কোথায় এনে যে দাঁড় করিয়ে দেয়, সে শুধু জীবন জানে!
আসিফ কি আমাকে চিনতে পেরেছে? না চিনলে অমন পাথরের মত চেয়ে ছিল কেন? প্রশ্নবাণে জর্জরিত আমি উত্তর খোঁজা বাদ দিয়ে জারিনের উদ্দেশ্যে বললাম – তোমার মা কই?
– আমার বাবা-মা নেই। রোড এক্সিডেন্টে দু’জন ঘটনাস্থলে মারা যান। প্রস্টার হোম থেকে এ বাড়িতে এসে বাবা-মা’র আদরে বেড়ে উঠি। কোনদিন তাঁদের অভাব বোধ করি নি।
দুপুরের সূর্য ততক্ষণে দূর্বল হয়ে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। কফি হাতে আসিফ সামনে এসে বসে। জারিন, শুভ সহ ওদের অন্য বন্ধুরা মিলে কনে দেখা আলোয় ছবি তোলার জন্য বেরিয়ে পড়ে। শীতল বাতাস এসে খেলছে ঘরের আসবাবপত্রে, জানালার পর্দা দুলছে। শব্দহীন আমি অপলক তাকিয়ে আছি সামনে। কখনো কখনো কথারা শব্দহীন হয়ে পড়ে। ভাবছি, ওই বাতাসটুকু কী বয়ে এনেছে? ব্যথা নাকি স্মৃতি?
– কেমন আছো, বউ?
– সন্ধ্যাবেলায় মানুষ যেমন থাকে!
– ভাবলে অবাক লাগে নিজেরই, আমাদের এভাবে দেখা হলো!
– আমি কিন্তু অবাক হই নি। কাগজের নৌকা ভাসানোর সময় মনে মনে যা চাইতাম, তাই ঘটেছে।
– জীবনে জয়ী হতে না পারলেও অনুশোচনা নেই আর!
– জীবনের রোদ বেলায় তোমার স্মৃতি ছায়া দিয়েছে অহর্নিশি!
– সমস্ত ঠিক বেঠিকের সীমানা ছাড়িয়ে আনন্দ আলোয় এসো, সবুজ ঘাসের বিছানায় আমরা আবার বসি!
– এ যন্ত্র শহরে বড় বেশি ভীড় আর শব্দ দূষণ। এ শহর আমাদের জন্য নয়। হয়ত আমাদের আবার দেখা হবে, সেইখানে, ঝলমলে কাশবনে!
এইতো জীবন! আমি এবং আসিফ চোখ চাইলাম এর ওর। বুকের ভেতর পাথর সময়। বেলা গড়িয়েছে বহুদূর। একে অপরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে বুঝতে পারছি, রোদ্দুরে দিন পেরিয়ে আমরা এখন বেলাশেষে সবুজ পাতা খসে যাওয়া শীর্ণ গাছ! সময়ের কাটাকুটি খেলায় কখন যে খসে পড়েছে সবুজ পাতারা, বুঝতেই পারিনি! চশমার কাচ মুছে বেলা শেষের জীবনটাকে আরেকবার প্রান ভরে দেখলাম!
অন্ধকার ততক্ষণে আরো গাঢ় হয়েছে। আমাদের ঘরে ফেরার পালা। ঘড়ির কাটার মত গাড়ির চাকা সামনে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে কথা বলি নিজের সঙ্গে, কেউ শোনে না। ঈশ্বর শুনছেন কি-না, কি জানি! রাস্তার দু দ্বারে সোডিয়ামের নরম আলোয় আকাশ উড়ছে, ঘুরে যাচ্ছে পথের বাঁক। শুভর পাশের সিটে ভারি বুকে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। দিগন্তের সব রঙ মুছে গেছে। গহীন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে ফেলে আসা সময়। শূন্যতার তরঙ্গ সাঁতরে কানে এসে বাজছে,
‘ তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড়, নিভৃত, পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে
হৃদয়ে মম ‘