
আমার সে বন্ধুটি ধর্মসূত্রে কী সেটা বলার খুব বেশি প্রয়োজনীয়তা নেই এখানে, কারণ সে ‘যাই’ হোক তার ক্ষেত্রে অন্ধকার ও দুঃস্বপ্নের বিষয়টি একই থেকে গিয়েছিল। প্রতি রাতে তার কাছে অন্ধকারের একটা দরজা খুলে যেত, একই দরজা একই অন্ধকার।
এমনটা যে হতে পারে প্রথম প্রথম আমরা কেউ বিশ্বাস করতাম না, ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। ভোররাতে তার ঘুম ভেঙে যেত, দুঃস্বপ্নে ছারখার হয়ে যেত ঘুম। বাকি সময়টুকু সে আর ঘুমাতে পারত না; দ্বগ্ধে দ্বগ্ধে পায়চারি করত। আমাদের আশ্চর্য করেছিল তার স্বপ্নের বিষয়টি – সে প্রতিবার একই স্বপ্ন দেখত।
দেখত একটি ট্রেন ছুটে চলেছে, জ্বলন্ত ট্রেন। জানালা দিয়ে লকলক করে ছিটকে বেরিয়ে আসছে আগুনের হলকা। তারপর আরেকটি ফ্রেম – কাটা মুণ্ডের কাছে পড়ে আছে বালি-ভর্তি একটি বালতি। কেন বালি-ভর্তি বালতি, কেন জ্বলন্ত ট্রেন তার কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পেতাম না। দিনের পর দিন কেটে গেছে, এক সময়ে সে স্বপ্নটিকে ক্ষতের দাগের মতো স্বাভাবিক একটি বিষয় হিসাবে মেনেও নিয়েছিল।
অনেকটা সময় কেটে যাবার পর হাতে এসেছিল দুঃসময়ের স্বপ্ন নিয়ে আশ্চর্য একটি বই, শার্লট বেরার্ড-এর লেখা ‘দ্য থার্ড রেই(খ)শ অফ ড্রিমস’। বইটিতে এক বিশেষ সময়ের বেশ কিছু মানুষের ‘দেখা’ স্বপ্নের উল্লেখ আছে। এ এক আশ্চর্য গ্রন্থ যেখানে লেখক ক্রমশ দেখাতে দেখাতে চলেছেন কীভাবে আধিপত্যবাদ একনায়কতন্ত্র ফ্যাসিজম মানুষের স্নায়ু ও স্বপ্নের ভেতর প্রবেশ করে, দখল করে নেয় ব্যক্তি-মানুষের সব থেকে সংবেদনশীল ও দুর্বল জায়গাগুলি।
স্বপ্ন-বিশ্লেষণ ও তার মধ্যে দিয়ে যারা মানুষের মনস্তত্ত্ব-কে বিচার করেন তাদের কাছে এ বইটি অমূল্য উপাদান। কারণ বইটি আমাদের সামনে বহুবিধ প্রশ্ন তুলে ধরে। আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় অসহায়তার সামনে, মাঝে মাঝে কয়েকটি হিমশৈলের চূড়া উঁকি মারে। চূড়ান্ত অস্বস্তিকর নানা প্রশ্ন স্তম্ভিত করে দেয়। অনন্ত বিতর্ক শুরু হতে পারে তার যে কোনও একটি থেকে।
মানুষ কি তার স্বপ্নে স্বাধীন? নাকি দখলদারি সম্পূর্ণ সমাপন হয় মানুষের স্বপ্নের উপর দখলদারির মধ্যে দিয়ে?
এখানে ‘স্বপ্ন’ শব্দটির ব্যবহার ‘কোনও অবস্থাকে পরিবর্তন করার সচেতন প্রচেষ্টার মানসিক প্রক্রিয়া’ বোঝাতে করা হচ্ছে না; এখানে ‘স্বপ্ন’ ঘুমের ভেতর ঘটে যাওয়া প্রক্রিয়াটিকে নির্দেশ করছে।
মানুষ জেগে যে স্বপ্ন দেখে তার উপর নেমে আসে দখলদারের হাত, কিন্তু সেখানে প্রতিরোধের অঞ্চলটি মুক্ত থাকে। প্রতিরোধ অথবা সমর্পণ – যে কোনও একটির দিকে ঝুঁকে পড়ার বাস্তবতা থাকে। কিন্তু যে স্বপ্ন মানুষ ঘুমের ভেতর দেখে এবং যে স্বপ্নের প্রতিটি মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রণ করে দখলদারের হাত, ফ্যাসিস্টের রোমশ-থাবা সে স্বপ্ন আরও ভয়ংকর ও অসহায়।
এখান পর্যন্ত এসে সমস্যার শেষ বলে যদি কেউ ভাবেন তো ভুল ভাববেন, আসলে এখান থেকে সমস্যার শুরু। স্তম্ভিত হওয়া শুরু।
যে ফ্যাসিস্ট তাকেই ধ্বংস করে দিতে চায়, যে দখলদার তাকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় তারই সমর্থক হয়ে ওঠে ‘কিছু’ মানুষ তাদের স্বপ্নে। রীতিমতো মানসিক নৈকট্য অনুভব করে, এমনকি সে শক্তি ‘কনফেডারেট’ হয়ে ওঠবার সমস্ত উপাদান নিয়ে ঘোরাফেরা করে ক্ষমতারই কাছে।
যদিও এই হয়ে ওঠাটা ‘কিছু’ মানুষের, তবুও একে ব্যতিক্রম বলে গণ্য করা যাবে না শার্লট-এর বইটি পড়ার পর। কারণ তাদের সংখ্যা খুব কমও নয়।
ভয় কি মানুষকে ক্রমশ অসহায় করে তোলে? শার্লট উল্লেখ করছেন বেশ কিছু মানুষের স্বপ্নের কথা, যারা তাদের ঘুমের ভেতর হয়ে উঠতেন হিটলার, গেরিং, গোয়েবলস-দের ডানহাত, পরামর্শদাতা। এখন পরপর বেশ কয়েকটি ‘স্বপ্ন’ দেখে নেওয়া যাক।
এ স্বপ্নটি ছাব্বিশ বছরের এক পরিবহন-কর্মীর, সে বলছে, ‘আমি একদিন স্বপ্নে দেখেছিলাম স্টর্ম-ট্রুপার্স বাহিনীর একজন সৈনিক হিসাবে আমি মার্চ করছি, কিন্তু আমার গায়ে সেনাবাহিনীর পোশাক নেই। ওরা আমাকে মারতে এসেছিল, ঠিক সে সময়ে হিটলার স্বয়ং সামনে এলেন, বললেন, ‘ওকে ওর মতো থাকতে দাও… এটাই আমরা চাই।’
এবার এক গৃহবধূর স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে নেওয়া যাক, গৃহবধূর নিজের বয়ানে সেটি এ রকম,
‘আমি একটি থিয়েটার হলে গেছিলাম, বিরাট অন্ধকার এক থিয়েটার হল। বেশ ভয় লাগছিল, কারণ আমার সেখানে যাবার কথা নয়। শুধুমাত্র ‘পার্টি মেম্বার’রা সেখানে ঢুকতে পারে। হঠাৎ দেখলাম হিটলার এসেছেন, আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল; হিটলার শুধু যে আমাকে সেখানে রয়ে যেতে দিলেন তাই নয়, তিনি আমার পাশে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরলেন।’
এই ‘অদ্ভুত’ স্বপ্নটির সঙ্গে হাত ধরাধরি করে যেতে পারে এমন আর একজন গৃহবধূর স্বপ্নের কাছে যাওয়া যাক,
‘আমি বাড়ির কিছু কেনাকাটা করে ফিরছি, চারদিকে উৎসবের আমেজ। রাস্তায় মানুষজন নাচছে, গাইছে। কারণ আজ রাইখস্ট্যাগ-দিবস; ফ্রান্সের বাস্তিল-দিবসের ঢঙে পালন হচ্ছে এই দিনটি। চারদিকে বনফায়ার… শহরের স্কোয়ারগুলি দড়ি দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। তার ভেতর চলছে উদ্দাম নাচাগানা, আমার বেশ বিরক্তই লাগছিল। এসব আমার তেমন পছন্দের নয়। হঠাৎ কে যেন আমায় পিছন থেকে সজোরে টেনে ধরল; আমায় টেনে নিয়ে গেল দড়ি দিয়ে ঘেরা জায়গাটাতে। নাচতে শুরু করার পর আবিষ্কার করলাম, যে টেনে ধরেছিল সে আর কেউ নয়, সে হিটলার। আমার কিন্তু তখন তেমন খারাপ লাগছিল না আর।’
এই বইটিতে স্বপ্নের পর স্বপ্ন এসেছে, ভয়ংকর সব স্বপ্ন। তবে স্তম্ভিত করে দেয় একের পর এক মহিলার স্বপ্ন।
যে কোনও ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছে, যে কোনও দখলদারের কাছে মহিলা ও শিশুরা সফট-টার্গেট। নারী কি তার ‘ইন্সটিংক্ট’ দিয়ে অনেক আগে ও নির্ভুলভাবে সনাক্ত করতে পারে ফ্যাসিস্ট’কে? ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধারণ করবার জন্য তার লগ্নিকৃত সময় ও শ্রম অনেক বেশি থাকার কারণেই কি এই সূক্ষতা, দখলদার’কে চিনে নেবার ক্ষমতা তাকে প্রদান করেছে প্রকৃতি? না হলে কেন বারবার নারীর স্বপ্ন এমন বিচিত্র হয়ে উঠবে হিটলারের সময়ে? যদিও বহু পুরুষের স্বপ্ন’ও রয়েছে বইটিতে তবু পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয় – নারীর স্বপ্নগুলি অনেক বেশি বহুমাত্রিক, দখলদারের হাতে যে বিচিত্র সব অস্ত্র সেগুলিকে উন্মোচন করার ক্ষেত্রে এসব স্বপ্নের গুরুত্ব অপরিসীম। আরেকটি স্বপ্নের দিকে তাকানো যাক, এটিও এক নারীর স্বপ্ন
‘নাৎসি-পোশাক পরে একদল মানুষ বসে আছে, আমিও বুলেভার্ডের ধারে একটি টেবিলে বসে। আমার টেবিলটি নিঃসঙ্গ, কেউ নেই, আমি একা। এমন সময় হিটলার এল, ইভনিং-গাউন পরা হিটলার। হাতে তার লিফলেটের বান্ডিল, হিটলার প্রতিটি টেবিলের কোণে এক একটি করে বান্ডিল রাখছিল; টেবিলে বসা লোকজন পাশের লোক’কে লিফলেট ধরিয়ে দিচ্ছিল। আমি এমনভাবে তাকিয়ে ছিলাম যেন আমি কোনও লিফলেট পাইনি। হঠাৎ হিটলার তার পদ্ধতি পালটে ফেলল, সে সন্তর্পণে আমার ঠিক সামনে একটি বান্ডিল রাখল। তারপর এক হাতে আমাকে লিফলেট দিতে দিতে অন্য হাত দিয়ে আমাকে আদর করতে শুরু করল…।’
লেখক নিজে এ স্বপ্নটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন; তাঁর মতে হিটলার’রা আসলে এমনই। তারা এক হাতে প্রোপাগান্ডার লিফলেট বিলি করতে করতে অন্য হাতে নারীদের আদর করে চলে। এ এক যুগপৎ প্রক্রিয়া, কিন্তু এ স্বপ্নটির কথা পড়তে পড়তে আরেকটি অস্বস্তির সামনে এসে দিশাহারা লেগেছিল। যে নারী এ স্বপ্নটিকে চিহ্নিত করতে পারে, যে নারী নাৎসি সৈন্যদের থেকে কিছুটা দূরে বুলেভার্ডের পাশে নিঃসঙ্গ টেবিলে বসে থেকে হিটলারের লিফলেট, প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সে কি চিহ্নিত করতে পারেনি হিটলারের পদ্ধতিটিকে? হিটলারের এ পদ্ধতি কি লেখকের ব্যাখ্যা দাবি করার জন্য অপেক্ষা করেছিল, না কি নারীটি বহু আগেই সে ব্যাখ্যায় উপনীত হতে পেরেছিল?
মানুষের স্বপ্নের উপর এ দখলদারি এক আশ্চর্য প্রক্রিয়া। কিন্তু এ দখলদারির পিছনে কি কাজ করে মানুষের অপূর্ণ ইচ্ছা’ও? মানুষ তার জাগরণে সে বাস্তবতার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না স্বপ্ন কি তাকে তার কাছাকাছি পৌঁছানোর স্বাধীনতা দেয়?
গুরুতর এ প্রশ্নটি তুলে দিয়েছেন লেখক’ও। কারণ তিনি পঁয়তাল্লিশ বছরের এক ‘হাফ-ইহুদি’ মহিলার স্বপ্নের হদিশ পেয়েছিলেন, যে স্বপ্নের কথা মহিলাটির নিজের মুখে শুনে নেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ,
‘একদিন আমি হিটলারের সঙ্গে একটি বোটে ভেসে বেড়াচ্ছি, হিটলার’কে বললাম – আমার এখানে থাকার কথা নয়, কারণ আমার শরীরে ইহুদি রক্ত বইছে।
কথাটি শুনে হিটলারের ভাবান্তর হল না, বরং বেশ প্রসন্ন লাগল তাকে। নির্বিকার, শান্ত মুখ।
এবার আমি তার কানে কানে বললাম – আপনি ইহুদি’দের সঙ্গে এসব না-করে মুসোলিনির কায়দায় কাজ করলে এতদিনে মহান হয়ে যেতেন। এটা সত্যি যে ইহুদি’দের কেউ কেউ বেশ বদমাশ; কিন্তু তাদের সবাই অপরাধী নয়।
হিটলার এ কথাটিও নির্বিকার মুখে শান্তভাবে শুনলেন।
এরপর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম ওই বোটের’ই আরেকটি কেবিনে, ঘরের মধ্যে কালো উর্দি পরা এস.এস সৈন্য সব। তারা একে অন্যকে ঠেলছে, আমার দিকে তাকিয়ে বলছে – দেখো দেখো, এই সেই মহিলা, যে আমাদের নেতাকে মুখের ওপর সত্যিটা বলে দিয়েছে।’
এবার এ মহিলার স্বপ্নের ব্যাখ্যার দিকে তাকানো যাক, ইনি ‘নাজিফিকেশন’-এর শিকার হননি পুরোপুরি। তার কাছে নিজেকে পুরো সমর্পণ’ও করেননি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এ মহিলা, নিজের শরীরে ইহুদি রক্ত প্রবাহিত হলেও ইহুদি-বিরোধী। তা হলে কি এই মহিলা (যিনি আসলে লক্ষ লক্ষ ইহুদি’র প্রতিনিধিত্ব করছেন) মেইনস্ট্রিম জার্মানিদের মতো হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন? এ কি দখলদারের চূড়ান্ত বিজয় যেখানে সে আরেকজন মানুষকে সমস্ত বিরুদ্ধতা ‘ভুলিয়ে’ দিয়ে ক্রমাগত নিজের মতো হয়ে উঠতে বাধ্য করাতে পারে? এমনকি সে মানুষ স্বপ্নের ভেতর ক্রমাগত ‘মেইনস্ট্রিম’এর একজন হয়ে উঠতে চায়, কারণ সে জানে এটি হয়ে ওঠা ছাড়া তার কোনও পরিত্রাণ নেই আর।
কী অসহায় সে ডাক্তারের স্বপ্ন যেখানে তিনি হিটলার’কে রোগ থেকে সারিয়ে তুলেছেন, হিটলার তাঁকে জিজ্ঞেস করছে এই সারিয়ে তোলার জন্য তিনি কত টাকা পারিশ্রমিক নেবেন। ডাক্তার হিটলার’কে বলছেন, কোনও টাকা লাগবে না।
এ কথা শুনে হিটলারের বাহিনীর একজন তেড়ে আসছে আর শাসিয়ে বলছে, কী বলছিস রক্তচোষা ইহুদি! কোনও টাকা লাগবে না? ইহুদি বলছে কোনও টাকা লাগবে না!
তার অনুগত সৈন্যের দিকে শান্ত চোখে একবার তাকাল, হিটলার, বলল, ‘হ্যাঁ, উনি বলেছেন কোনও টাকা লাগবে না… উনি কোনও টাকা নেবেন না। আমাদের ইহুদি্রা তেমন ইহুদি নয়…।’
ডাক্তারের এ স্বপ্নের ভেতর কি আসলে কেঁপে ওঠে আউশৎভিচের লক্ষ লক্ষ ইহুদির খুলি?
ডাক্তারের এ স্বপ্নের ভেতর আসলে খেলা করে দখলদারের আশ্চর্য হানাদারি, যেখানে সে স্বপ্নের ভেতর ঢুকে মানুষকে তার নিজের স্বপ্নের থেকেও ছিনিয়ে নেয় আসলে।
3Comments
June 9, 2022 at 7:38 am
The human race is unimportant. It is the self that must not be betrayed."
I suppose one could say that Hitler didn't betray his self.
You are right. He did not. But millions of Germans did betray their selves. That was the tragedy. Not that one man had the courage to be evil. But that millions had not the courage to be good.
June 9, 2022 at 7:39 am
The human race is unimportant. It is the self that must not be betrayed."
"I suppose one could say that Hitler didn't betray his self."
"You are right. He did not. But millions of Germans did betray their selves. That was the tragedy. Not that one man had the courage to be evil. But that millions had not the courage to be good.
June 9, 2022 at 7:48 am
And I can fight only for something that I love, love only what I respect, and respect only what I at least know
— Adolf Hitlar