পুকুরের একদিকের পাড়ে পা ও গা ডুবিয়ে সাবধানে স্নান সারে সুবীরদের পরিবার। ওরা নতুন এসেছে এ অঞ্চলে। পুকুরের ধারেই তাদের ঘর ভাড়া নেওয়া। সুবীর পেশায় রাজমিস্ত্রি। ঘরে বৌ ও মেয়ে। যুবতী বৌ ও শিশু কন্যা নিয়ে সুবীরের পরিবারের এঅঞ্চলে থাকা ও তাদের চলাফেরায় অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের নানা কৌতুহল। সুবীর সকালে কাজে বেরোয়। সন্ধ্যায় ফেরে। ওর বৌ ও কন্যা সারাদিন বাড়ির বাইরে খুব কম বেরোয়। তার মধ্যে একবার পুকুরে নেমে স্নান সেরে নেয়। এলাকাটা তাদের কাছে নতুন। অচেনা এলাকায় প্রতিবেশী বা তাদের মনও তাদের অজানা। পুকুরের পাড়ে বাঁধানো ধাপ যেখানে জলে মিশেছে সেই জায়গাটা অবধি নেমে ওরা জলে ভিজিয়ে নেয় নিজেদের। ফেরার পথে চারপাশ দেখতে দেখতে ঘরে ফেরে। কে কিভাবে তাদের ওপর নজর রাখছে, প্রকাশ্যে বা আড়ালে তা দেখাই উদ্দেশ্য।
একদিন,দুদিন,একমাস,দু মাস পেরিয়ে ওদের বন্ধু হল কয়েকজন। সুবীরও পরিচিত হল এলাকায়। ভালো রাজমিস্ত্রি বলে লোকে জানল।
জল সকলের। জলের অধিকার সকলের। স্বচ্ছ জল বিতর্কহীন। জলের নীচে নুড়ি পাথরের ছোটখাটো সংঘর্ষ থাকতে পারে। কিন্তু এটাই তো সব নয়। ক’মাস পর সুবীরদের কানে এল পুকুরের মধ্যে বিপদ তৈরি হয়েছে। কোন্ সেই বিপদ জানতে সকলের মতো সুবীরের পরিবারও উদগ্রীব হল। মানুষের জীবন এত রকমের টানাপোড়েনে চলে যে একখণ্ড শান্তির মধ্যে কখনো অশান্তি, নির্ঝঞ্ঝাট যাপনে কখনো বিপদ আচমকা দখল করে বসে।
এই পুকুর ঘেরা ছোট পাড়ায় হঠাৎ বিপদের গন্ধ কিভাবে টের পাওয়া গেল ? কেউ কি পেয়েছিল সে গন্ধ ? দিনের শুরুতে মানুষের চোখে দ্বিতীয় শালিখটি না দেখা, অথবা রাস্তা কেটে বিড়ালের পথ করে নেওয়া, দাঁড়কাকের ডাক বা রাতে কুকুরের কান্না- এর কোনো এক বা একাধিককে মানুষ বিপদসংকেত হিসেবে দেখে। সন্দেহ করে তার আগমনের। সতর্ক হয় চলাফেরা। সেরকম কিছু ঘটেছে কিনা, একা বা অনেকের সে ধরনের কোনো পর্যবেক্ষণ ছিল কিনা তা বোঝার এবং ভাবনার বিষয়।
জলের কোনো শ্রেণী নেই। ধর্মও নেই। জল পবিত্র বলে পরিচিত। কিন্তু কি এক অজ্ঞাত কারণে সেই পবিত্রতায় ইদানীং কিছুটা পাপ দখল নিয়েছে বলে অনুমান অধিকাংশের। অর্থাৎ,অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে এই পুকুরের জল হঠাৎই অশুদ্ধ।
অশুদ্ধ বলেই কি জলে ভেসে উঠছে মরা মাছ ? প্রশ্নটা অনেকের মনে হয়েছে। জলের রং কালো হয়ে উঠেছে বলে মাছের মড়ক- এ অভিমত এদেরই। হয়তো সত্যি। কিন্তু জলের রং কেন কালো হয়ে উঠেছে এ নিয়েও রীতিমতো সোরগোল পড়েছে।
রাতে বাড়ি ফিরে সুবীর ও তার পরিবার এই আলোচনায় তটস্থ হয়ে পড়ে। তারা এ পাড়ায় নতুন। একখানা ঘর ভাড়া পেতে তাকে কি করতে হয়েছে তা শুধু তারাই জানে। তাদের কানে গেছে বিধর্মীদের ছোঁয়ায় নাকি জল এভাবে কলুষিত হয়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে বলে গোপনে এই মত মানুষের চিন্তায় দখল নিচ্ছে ক্রমশ।
কে বিধর্মী ? কজন বিধর্মী ? এই জলে কাপড় কাচা, বাসন মাজা, হাত পা ধোওয়া এবং সর্বোপরি সম্পূর্ণ অবগাহন করে শুধুমাত্র এক ধর্মের মানুষেরাই ?
মানুষের মস্তিষ্ক বড়ো সাংঘাতিক। সেখানে কখন অমানুষ দখলদার হয়ে যায় তা বোঝা বেশ শক্ত। এভাবে বিধর্মী চিহ্নিতকরণ হতে শুরু করলে কার বা কাদের দিকে আঙুল উঠবে সেই জবাব এখনও গভীর আঁধারে লুকিয়ে থাকা সাপের ফণার মতো।
সুবীর খুব সকালে তার কাজের জায়গায় পৌঁছে যায় রোজ। খুব কাছেই এক কারখানায় সে সিভিল লেবার। নির্মানের মিস্ত্রি। একদিন কাজের ফাঁকে তার নজরে আসে কারখানার বর্জ্য নালা দিয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। যে মাটি কারখানা ছাড়িয়ে ক্রমশ ঢাল হয়ে চলে গেছে পুকুরের দিকে !
সুবীর চমকে ওঠে এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে যায়। তাহলে কি এটাই কারণ ? তাকে বলতে হবে একথা। এলাকার সবাইকে জানাতে হবে। যে আতঙ্ক গ্রাস করেছে সকলের মনে তা থেকে উদ্ধার পেতে এই সত্যিকে সকলের সামনে আনতে হবে। কেন মাছের মৃত্যু, কেন জলের রং আকস্মিক ভাবে কিছুটা কালো, কোন্ বিধর্মী দখল নিয়েছে এই পুকুরের পবিত্র জলের-সব জানাতে হবে।
সন্ধ্যায় কাজ থেকে ছাড়া পেয়ে সে বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে পাড়ার দিকে। মাথার ওপর প্রাক পূর্ণিমার চাঁদ তার সঙ্গে এগোতে থাকে। যত এগোয় ততই সে অবাক হয়। গোটা রাস্তায় যে কজনের সঙ্গে তার দেখা হয় প্রত্যেকের স্থির বিশ্বাস বিধর্মীদের জলস্পর্শেই জলের বিপদ ঘনিয়েছে। এ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নিষেধাজ্ঞা। অন্য ধর্মের কাউকে এই জল ছুঁতে দেওয়া হবে না- এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিতে স্থানীয়দের খাপ পঞ্চায়েত বসছে কাল সকালে। এখানে বসবাসকারী প্রত্যেকের নাম, ঠিকানা, ধর্ম ইত্যাদি আধার কার্ড মোতাবেক রেকর্ড হবে। এতে সহজ হবে কাঙ্ক্ষিত চিহ্নিতকরণ।
শুধু বিস্ময় নয়, একটা ভয় তাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে। খাপ পঞ্চায়েতে গিয়ে সে তো সত্যটা জানা স্বত্বেও বাধ্যত নীরব থাকবে। কারণ,কেউ তার মতকে সমর্থন করবে না। ভয়ঙ্কর সংখ্যাগুরুর মতের বিরোধিতা সে করতে পারবে না। তাতে তার গোটা পরিবারের বিপদ বাড়বে। সংখ্যাগুরু মানুষের অন্ধ বিশ্বাস যখন যুক্তির ওপর অন্যায় দখল নেয়, বুদ্ধিমানের ওপর মুর্খদের দখল কায়েম হয়, সত্যের ওপর মিথ্যা একনাগাড়ে দখল নেয় তখন নীরব হয়ে যায় সংখ্যালঘুরা।
এই দমবন্ধ করা অবস্থায় সে চুপচাপ বাড়ি ফেরে। সন্ধে পেরিয়ে রাত হতেই সে পরিবারের মুখোমুখি হয়। তারা স্বামী স্ত্রী ঘটনাচক্রে প্রবল আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। শিশু কন্যারটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারা যেদিন এই ঘরে ঢুকেছিল সেদিনই একটা মিথ্যা তাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল। বাধ্য হয়েই সুবীর ও তার পরিবার সেই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল। সেই মিথ্যার ঘেরাটোপ আর রাখবে কিনা তারা এই নিয়ে অনেক রাত অবধি তাদের ফিসফাস চলে। ঘুমন্ত শিশুটি কাল সকালে আবার জলে নামবে কিনা তার বাপ মায়ের সঙ্গে তা ঠিক করতেই রাতের কথাবার্তা আরো গভীর হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় কাল সকালে খাপ পঞ্চায়েত বসার আগেই তারা এই ঘর ত্যাগ করবে। সুবীর ও তার পরিবার ঐ সভায় হাজির হবে না।
খুব ভোরে তারা উঠে পড়ে। সুবীর ওরফে সাবির, তার স্ত্রী সনকা ওরফে সাকিলা এবং তাদের শিশুকন্যা পাখি তাদের গা থেকে মিথ্যার বর্ম টা খুলে ফেলে। ধর্মপরিচয় গোপন রাখা ছাড়া উপায় ছিলনা তখন। এ পাড়ায় তাদের ঘর ভাড়া পাওয়া অসম্ভব ছিল।
একটা ছোট্ট কাজ। এরপরই এই ঘর ও পাড়া তারা ছেড়ে চলে যাবে। অযু করে শুরু হয় ফজরের নামাজ।
এভাবেই স্রোতের বিপরীতে, সকলের অগোচরে এক মিথ্যার ওপর সত্যের একান্ত দখলদারি শুরু হয়। আকাশের সদ্য ফিকে নীল যার একমাত্র সাক্ষী।