
দ্রাবিড় আত্মাভিমান আন্দোলনের পুরোধা পেরিয়ার একদা বলেছিলেন, ‘যদি বৃহত্তর দেশ ক্ষুদ্রতর দেশকে নিপীড়ন করে, তবে আমি ক্ষুদ্রতর দেশটির পাশে দাঁড়াব। যদি ক্ষুদ্রতর দেশটির সংখ্যাগুরু ধর্ম সংখ্যালঘু ধর্মকে নিপীড়ন করে, আমি সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়াব। যদি সংখ্যালঘু ধর্মে নানা বর্ণ থাকে এবং নিম্নবর্ণ উচ্চবর্ণের দ্বারা নিপীড়িত হয়, তবে আমি নিপীড়িত বর্ণের পাশে দাঁড়াব। নিপীড়িত বর্ণের মালিক যদি নিপীড়িত বর্ণের কর্মীকে অত্যাচার করে, তবে আমি নিপীড়িত বর্ণের নিপীড়িত কর্মীর পাশে দাঁড়াব। আবার সেই কর্মী যদি বাড়ি ফিরে নিজের বউকে নিপীড়ন করে, তবে আমি সেই নারীর পাশে দাঁড়াব। কারণ সামগ্রিক ভাবে আমি নিপীড়নের বিরুদ্ধে।’
দখলদারি এভাবে ধাপে ধাপে নেমে আসে, তা কোনো একমাত্রিক ধারণা নয়। আজকের নিপীড়িত কালই অন্যতর পরিস্থিতিতে হয়ে উঠতে পারে দখলদার। লৈঙ্গিক দখলদারি তাই পরিপার্শ্ব-বিযুক্ত কোনো অভিজ্ঞতা-অঞ্চল নয়। তা সম্পৃক্ত নানা বর্ণগত, শ্রেণিগত, জাতিগত দখলি অভিজ্ঞতার সঙ্গে।
সত্যি বলতে, এক দখল আরেক দখলের সঙ্গে এতই অঙ্গাঙ্গী জুড়ে থাকে যে তাদের আলাদা করা মুশকিল হয়।
লক্ষ্য করে দেখলুম, আজকাল যা লিখি, তা-ই আসলে দখলের গল্প। বস্তুত আমি যদি না-ও লিখি, তবুও কাগজের ভাঁজ খুলে সকালে যা যা পাবেন, তারা সবই দখলের গল্প। দেশ, জমি, সংস্কৃতি…ব্যাংক, সড়ক, রেলপথ…মায় শরীর, মন। অথচ আরবি ‘দখল’ কথাটির প্রাথমিক অর্থ নাকি ‘প্রবেশ’। জোর করে প্রবেশ নয়, অনুপ্রবেশও নয়। স্রেফ প্রবেশ। জোর করে নয়, স্বাভাবিক ভাবেই, অপাপবিদ্ধ চেহারাটি নিয়ে এমন অনেক কিছুই তো ঘাপটি মেরে থাকে, যা আসলে দখলদার৷ সেভাবে দেখতে গেলে, যে তালেবানদের আফগানিস্তান দখল নিয়ে আজ বাজার সরগরম, তারা ঘাপটি মেরে ছিলই প্রত্যন্ত প্রদেশে। সুযোগ বুঝে ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেছে। তার চেয়েও ভয়ংকর মনে হয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে আসীন সরকারের দখলদারি। এ লেখা যখন লিখছি, তখন হোয়াটস্যাপে ঢুকল এক ভিডিও। কিছু রুগ্ন, চিন্তাক্লিষ্ট মুখ। ‘অযোদিয়া বুরু বাঁচাও আন্দোলন’-এর কর্মীরা জানাচ্ছে, সরকার জবরদখল করছে তাদের জল, জমি, জঙ্গল। ঠুড়গা, বাঁদু, কাঠলাজোল- তিন নদীর সঙ্গে ষাটের অধিক গ্রামের জীবন, জীবিকা, সংস্কৃতি ওতোপ্রোতো জড়িয়ে। ধাত্রীনদীদের শ্বাস রূদ্ধ হবে। বনভূমি ধ্বংস হবে। জাপানি কোম্পানি ও রাজ্য সরকার জলাধার বানাবে সভ্যতার বিকাশার্থে। তৈরি হবে বিদ্যুৎ।
প্রশ্ন হল, সাংবিধানিক অধিকার-বিধির তবে কী হবে? কী হবে রাষ্ট্রসংঘ থেকে আসা আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির? সেই সব আশ্বাস বলেছিল, আদিবাসী মানুষের সম্মতি ব্যতিরেকে প্রকৃতি-নিবিড় যাপনে রাষ্ট্র বাধ সাধবে না। সে’সব অগ্রাহ্য করে দখলদারির বোঝাপড়া ওরফে ‘মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ স্বাক্ষরিত হয় বছর বছর। অভ্যস্ত হয়ে যায় দ্রুত স্ক্রোল করা আঙুল। কেউ কেউ বেয়াড়া প্রশ্ন তোলে ও বেমক্কা মরে যায়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে প্রশ্ন তুলেছিলেন স্ট্যান স্বামী, পাত্থলগড়ির প্রেক্ষিতে: ‘সহমানুষের স্বার্থে রাষ্ট্রের দখলদারির প্রতিবাদ করা কি দেশদ্রোহিতা?’
আবার আদিবাসীদের মধ্যেও দেখা যায়, নারীর ঋতুস্রাবকালে তাকে একঘরে করার রীতি। সেখানেও গৃহহিংসা। গ্রামীণ সালিশিতে যৌন নির্যাতনে নির্যাতিতা নারীরই অযৌক্তিক শাস্তি। অতএব সেই পেরিয়ারের উপলব্ধিতে ফিরে যেতে হয়। দখলদার ও দখলিকৃত, নির্যাতক ও নির্যাতিত — কোনো ধ্রুব একমাত্রিক ধারণা নয়। তা স্থান ও কাল ভেদে পরিবর্তনশীল।
‘সভ্যতার উন্মেষ’ আসলে দখলদারিরই গল্প এক। এ গল্পের সূচনা তবে থেকে, যবে থেকে প্রকৃতির দখল নিয়েছে প্রযুক্তি। দেশ-দখল তার উত্তরসূরী, অতঃপর দোঁহে পথ চলেছে একসাথে। আদতে এ সভ্যতা ক্ষমতাবানের, উন্মেষও তার-ই। বিত্তগত, জাতিগত, বর্ণগত, লিঙ্গগত, এমনকি বুদ্ধিগত নিরিখে ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীনের বিভেদ হতে পারে। তাই দখলও নানা কিসিমের।
ক্ষমতাবান ক্ষমতাহীনের ভূমি দখল করে থেমে থাকেনি। দখল করেছে সংস্কৃতি, ভাষা, যাপন, মনন। যুদ্ধাস্ত্র তথা বাহুবলের সাহায্যে দখল ঈষৎ স্থূল ও প্রাচীন, পদ্ধতিগত ভাবে। গুলির আওয়াজ সহজে কর্ণগোচর হয়, উড়োজাহাজ থেকে ঝুলন্ত মানুষের পতনের অসহায়তা চোখ টানে। কিন্তু তালেবানি মতাদর্শের কথাই যদি ধরা হয়, তবে আফগানিস্তানের ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে তার বিস্তার। জোরাজুরি না করে, এমনকি হয়ত পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ আমন্ত্রণেই, কোন্ তালেবান যে কার চিত্তে ও পরিপার্শ্বে প্রবিষ্ট হয়েছে কবে, তার হিসাব কে রাখে?
নানা ক্ষমতাতন্ত্র এবং নানা প্রান্তিকতা যেখানে কাটাকুটি খেলে, সেখানে দখলদারি আরও প্রবল হয়ে ওঠে। মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে দোপদি মেঝেনের শরীরের দখল নেয় সেনাবাহিনী। সে কাহিনীকে তাই ছাত্রছাত্রীদের পাঠবস্তুর পরিধি থেকে বেদখল করে দেয় রাষ্ট্র। বাস্তবের সোনি সোরির যোনির দখল নিয়েছিল রাষ্ট্রেরই ভরে দেওয়া নুড়ি-পাথর। কী আশ্চর্যভাবে, লিঙ্গগত, বর্ণগত, শ্রেণীগত দখল হাত মেলায়! যখন মুসলিম নাবালিকা আসিফার শরীরের দখল নেয় সংখ্যাগুরু পুরুষ, তখন তা হয়ে ওঠে উপত্যকা দখলের নিনাদ, যাযাবর উপজাতিকে বেদখল করার হুঁশিয়ারি। দখল শেষে হাথরসে রাষ্ট্র পুড়িয়ে দেয় দখলিকৃত দেহ। শরীর নশ্বর, আস্ফালন শ্বাশ্বত। আস্ফালন জাগ্রত থাকে আরও বহু দলিত মেয়ের দুঃস্বপ্নে। প্রিয়াঙ্কা ভোটমাঙ্গে নামের দলিত মেয়েকে, তার মা সহ, নিসুতো ঘোরানো হয়েছিল গ্রামে, ধর্ষণের কিয়ৎক্ষণ আগে। আর ধর্ষণের পর? পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদেরও। অন্ত্যজের অস্তিত্বের উপরে থাকবে উচ্চবর্ণের কর্তৃত্ব; আর অন্ত্যজ নারী হলে তার মন, শরীর, যৌনতা — সবেতেই থাকবে উচ্চবর্ণের পুরুষের দখলদারি। এসব স্বতঃসিদ্ধ প্রায়।
আর নারীগর্ভ? তা তো চিরকালই সমাজ বা ধর্মের বা পরিবারের দখলে। বহু দেশে গর্ভপাত ঘটানোর অধিকার পেতে লড়াই চলছে, এখনও, এই একবিংশ শতকেও।
দখল তো শুধু শরীরেরই নয়, দখল হয় মেধা ও মননও। আন্তোনিও গ্রামশি বলেছিলেন দুরকম দখলদারির কথা — রুল আর হেজিমনির মাধ্যমে। নিয়মের শাসন জারি করে, পুলিশ ও সৈন্য নামিয়ে যেমনতরো দখলদারি হয়, তার বাইরেও হয় আরেক রখম বৌদ্ধিক দখলদারি, যাতে মদত দেয় সমাজ ও সংস্কৃতি। যেমন, আশৈশব ‘রাজা একটি বালিকা লইল’ বুলি আউড়ে শিশু-ভোলানো খেলা খেলতে খেলতে আমরা ভুলে যাই তাতে নিহিত ‘ভায়োলেন্স’। রেবেকা সোলনিট পরম শ্লেষে লিখেছিলেন এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ, ‘পুরুষ আমায় ব্যাখ্যা করে বোঝায়’ (‘মেন এক্সপ্লেইন থিংস টু মি’)। পুরুষ যেমন করে হীনবুদ্ধি নারীকে ‘বোঝানো’-কে তার পবিত্র কর্তব্য জেনেছে, পরিচালনা করতে চেয়েছে তার দৃষ্টিপথ ও দৃষ্টিভঙ্গি, তেমনই ধলো বুঝিয়েছে কালোকে, বামুন বুঝিয়েছে শূদ্রকে। এক দল অবিরাম বলেছে। আর একদল শুনেছে, বুঝেছে — সে বোঝাবুঝি যতই তার স্বার্থবিরোধী হোক। শুনতে শুনতে সে হয়ত বলতে ভুলে গেছে। আর বললেই বা শুনছে কে? ‘প্রান্তিক কি কথা কইতে পারে?’ তাই উত্তর-ঔপনিবেশিক, উত্তর-আধুনিক জগতে এক অবিসংবাদিত রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে ওঠে। বিজ্ঞান বলে, নেহাত চন্দ্র-পরিবেশ তুল্য বায়ুহীনতা না থাকলে, নৈঃশব্দ্য বলে কিছু হয় না আসলে। যারা কথা বলছে না, অথবা বলবে ভাবছে কিন্তু থেমে যাচ্ছে, অথবা বলছে কুণ্ঠাভরে — তারা নীরবে বা সরবে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘বলতে পারি, তুমি কি শ্রবণে আগ্রহী?’
শব্দ নাকি অসীম ক্ষমতাশালী। শব্দের, ভাষার দখল কার হাতে?
*******
দখলের পথ যদি যন্ত্রণার হয়, পুনর্দখলের পথও বন্ধুর, দ্বন্দ্বকীর্ণ। নারী, দলিত, আদিবাসী, উপজাতি, প্রান্তিক — মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাবে তাঁরা সচল হয়েছেন, স্বপ্ন দেখেছেন, হয়ত কথাও বলেছেন কম বেশি। কিন্তু সে কথা লিপিবদ্ধ হয়নি, তার তত্ত্বায়ন হতে আরও দেরি ছিল। কারণ একই। শ্রোতা ও বক্তার ভূমিকাটি পাচ্ছে যথাক্রমে কে কে, তা সূক্ষ্মভাবে নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই ঐতিহ্য মেনেই একদল হয়েছেন বিপ্লবী, আর একদল সহায়ক।
অধিকার ফিরে পাওয়ার রাজনীতিতে মেয়েদের অবস্থানের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে দেখতে পাই, যখনই তথাকথিত মূলধারার রাজনৈতিক আন্দোলনের ডাক এসেছে, তখন তা মেয়েদেরও ঘর থেকে বাইরে টেনে এনেছে। যেমন অকালে বিধবা হওয়া বিমলা মাজী তেভাগা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে রীতি-নীতি চুলোয় যাওয়ার কথা বলেন: ‘১৯৪১। বিধবা আমি। রঙিন পাড় কেটে নেওয়া সাদা শাড়ি পরি৷ দাদারা আমাকে কড়া পাহারার মধ্যে রাখে…মণিদির (মণিকুন্তলা সেন) সোনার কাঠির স্পর্শে আমার দ্বিতীয় জন্ম ঘটল…মণিদির সঙ্গে দুধকেন্দ্র, রিলিফ সেন্টারে ঘুরে বেড়াতে শুরু করলাম। আমি রঙিন শাড়ি পরেই ঘুরি, কাজ করি।’ (তেভাগা, মেদিনীপুরের আন্দোলন, ২০০৬)। এভাবে বিপ্লবের ডাক এলোমেলো করে দেয় পিতৃতন্ত্রের নিদানকেও। দলিত, আদিবাসী মেয়েদেরও টেনে আনে সেই ডাক। স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন জুড়ে তার নজির। কিন্তু তারপর? সেই মেয়েদের ইতিহাস খুঁড়ে বের করতে হয়। সে মেয়ে অন্ত্যজ হলে তাকে খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন হয়।
কমরেড বেলা দত্ত, কমরেড সরোজ দত্তের স্ত্রী হিসেবেই যিনি অধিকতর পরিচিত, অথচ যিনি পার্টি মেম্বারশিপ নিয়েছিলেন সরোজ দত্তের আগেই, তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, তেভাগা আন্দোলন, তারপর খাদ্য-আন্দোলন যখন লাগামছাড়া হল, তখন নেতারা পুরুষ কর্মীদের বললেন শহরে ফিরতে। আর নারীকর্মীদের কী বললেন? বললেন, রান্নাঘরে ফিরে যেতে। যার শিকল একবার ভেঙেছে, তার পক্ষে ঘরের চারদেওয়ালে ফেরা কি এতই সহজ? ‘রান্নাঘরেই’ বা কেন ফিরতে হবে? মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে কেন ফের দখলিকৃত জমিতে ফেরত পাঠানো?
একই অভিজ্ঞতা তেলেঙ্গানা আন্দোলনের মেয়েদের। স্ত্রী শক্তি সংগঠন দ্বারা প্রকাশিত ‘উই ওয়্যার মেকিং হিস্ট্রি’ বইটিতে তেলেঙ্গানার গণসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নারীদের বয়ানে দুটি আপাতভাবে পরস্পরবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়। পার্টি নারীকে স্বাধীনতা দিয়েছিল, আবার পার্টিই স্বাধীনতা খর্ব করে তাকে ব্যবহার করেছিল। কোন্ডাপল্লী কোটেশ্বরাম্মা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন: ‘আমাদের পার্টি সমতার ধারণার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তারা আমাদের বলেছিল, একজন পুরুষ, একজন নারী বা একজন দলিত, সকলেই সমান। তারা আমাদের বাড়ি থেকে বার করে প্রকাশ্য ক্ষেত্রে নিয়ে এসেছিল। পার্টি নারীদের যে স্বাধীনতা দিয়েছিল, তার জন্যই আমরা যা করেছিলাম তা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু যখনই মেয়েরা ছেলেদের কোনও কিছুতে ছাপিয়ে যেত তখনই মেইল শভিনিজম দেখা দিত। নির্দিষ্টভাবে কোনও বৈরিভাব বা দমন যে ছিল তা না, কিন্তু একটা অটোম্যাটিক প্রতিক্রিয়া।’ এস সুগুণাম্মা বা মাল্লু স্বরাজ্যমেরও অভিজ্ঞতা একই। পার্টি যে নারীদের অংশগ্রহণকে টোকেনিস্ট হিসেবেই দেখতে চায়, নারী-প্রশ্নের গভীরতর সমাধানে তাদের যে অনীহা — তা তাঁদের লেখায় বারবার উল্লিখিত হয়।
নকশাল আন্দোলন বলতেও শহুরে মানুষের অবধারিত ভাবে কেরিয়ার বিসর্জন দেওয়া ‘প্রেসিডেন্সির ছেলেদের’ মনে পড়ে। অথচ ইন্সপেকটর সোনম ওয়াংড়িকে হত্যা করে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তো নকশালবাড়ি গ্রামের আদিবাসী নারীরাই। প্রথম এগারোজন শহিদের আটজনই নারী, বাকিরা শিশু-কিশোর। আদিবাসী নারীদের তো বটেই, উচ্চবর্ণের নারীদেরই বা কী চোখে দেখত আন্দোলন? ‘আমরা তো এসেছিলাম নারী-পুরুষে, ধর্মে ধর্মে জাতিতে জাতিতে কোনও বিভেদ থাকবে না এটা জেনেই। যা কিছু সামন্ততান্ত্রিক, তাকে দূর করবে আমাদের এই রাজনীতি। কিন্তু যখন বুঝিয়ে দেওয়া হল, আমরা নারী, এখানে একটা লক্ষণরেখা টানা আছে আমাদের জন্য, তখন মনে হল তাহলে কি বাড়ি-ঘর ছেড়ে ভুল করলাম?’, বলেছেন নকশাল কর্মী কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘নক্সাল আন্দোলনে মেয়েরা’ বইতে। লীলা মজুমদার, যিনি (আবারও) ‘চারু মজুমদারের স্ত্রী’ হিসাবে অধিক পরিচিত, তিনি যেমন বিমা কোম্পানির কাজ করতেন সংসার ভরণপোষণের জন্য, ঠিক সেভাবেই সেলাইকল চালাতেন, নার্সিং করতেন নকশাল বাড়ির বহু মেয়ে-বউরা। তা বহিরঙ্গে হয়ত নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দ্যোতক। এমনকি উপার্জমক্ষম নারী ও অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল রাজনৈতিক কর্মী পুরুষের সমীকরণটি দেখলে তাকে জেন্ডার বেন্ডারের উলটপুরাণও মনে হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি আরেকটু জটিল। উপার্জন তাঁরা করতেন বটে, কিন্তু সেটা গার্হস্থ্য-প্রতিপালনেরই প্রবর্ধিত রূপ। সংসার, শিশু, বৃদ্ধদের দেখাশোনা ও সেই সঙ্গে সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় উপার্জনটুকু করা- এই পুরো দায়িত্বটিকেই ‘মেয়েলি’ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এভাবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকেই আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়েছেন। অর্থাৎ যে রাজনৈতিক মতাদর্শ তাত্ত্বিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে শ্রমের মূল্যের ওপর, সেইখানেও গার্হস্থ্য শ্রমকে ‘শ্রম’ না বলে কখনও বলা হল ‘আত্মত্যাগ’, কখনও ‘সহিষ্ণুতা’। অর্থাৎ মগজের পিতৃতান্ত্রিক দখলদারি থেকে বিপ্লবীদেরও মুক্তি ঘটেনি সহজে। কোটেশ্বরাম্মা তাই আত্মজীবনীতে বলেন: ‘আমাদের পুরুষরাও তো এই সমাজ থেকেই এসেছিলেন, নাকি?’
তদুপরি, পার্টিতে মেয়েদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটা কায়িক শ্রম-বৌদ্ধিক শ্রম বিভাজন ছিল বলে তাঁদের অভিযোগ। যখনই এসেছে চিন্তাভাবনার স্তরে লড়াই-এর পৃষ্ঠভূমি গঠনের প্রশ্ন, তখন সেই অধিকার থেকেছে পুরুষের দখলে। এই প্রসঙ্গে সদ্যপ্রয়াত কমরেড শর্মিষ্ঠা চৌধুরী বলেন: ‘লড়াই-আন্দোলন, মিছিল-মিটিংয়ে মেয়েদের আনা হয়েছে, রাখা হয়েছে। বহু সামাজিক বাধা, কুসংস্কার চূর্ণ করে, মুক্তির আস্বাদ দিয়ে, এই কাজটা করা হয়েছে। কিন্তু তারপর?… কাজটা যখন অনেকাংশে বৌদ্ধিক? সেই অবস্থায় মেয়েদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে কী ভাবনা ছিল কমিউনিস্ট পার্টির?’ এ প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন পার্টির পলিটবুরোগুলিতে নারী প্রতিনিধিত্বের স্বরূপ দেখলেই বোঝা যায়। নারীর জমি পুনর্দখলের লড়াই তাই ঘরে ও বাইরে, সর্বত্র। শব্দের ও ভাষার দখলের কথা বলছিলাম। এই কারণেই কমিউনিস্ট মেয়েদের ভাষ্য আজ নতুন করে পাঠ করা প্রয়োজন। মণিকুন্তলা সেন, বিমলা মাজি, লীলা মজুমদার, বেলা দত্ত, মাল্লু স্বরাজ্যম, এস সুগুণাম্মা, কোটেশ্বরাম্মা, অনুরাধা গান্ধী, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী — এদের পাঠ করা প্রয়োজন, রাজনীতিতে লৈঙ্গিক দখল সম্পর্কে এদের বয়ান ও উত্তরণের দিশা হয়ত ডিসকোর্সের বাইরে থাকা সেই সব লেখাতে পাওয়া সম্ভব।
*****
প্রিয়াঙ্কা ভোটমাঙ্গের গল্প বলেছিলাম দলিত নারীশরীরের উপর উচ্চবর্ণ পুরুষের একচ্ছত্র দখলের উদাহরণ হিসাবে। প্রিয়াঙ্কার শরীর পুড়ে গেলেও, সে ঘটনার পর এক দলিত কবি ঘুমোতে পারেন না রাতে। গা গুলোয় তাঁর, বমি পায়। নিজেকে পুড়ে যাওয়া মেয়েটির জায়গায় কল্পনা করে তিনি শিউরে ওঠেন। কবি কীভাবে মুক্তি পাবেন আর, কবিতা লেখা ছাড়া? সে কবিতায় নিজের শরীরকেই অস্ত্র হিসেবে উঁচিয়ে ধরেন তিনি। লাঞ্ছিত শরীর কি দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নিশান হতে পারে? দোপদী মেঝেনের শরীর তা হতে পেরেছিল বটে। আর এই কবি লিখলেন —
‘আমার যোনিতে প্রোথিত
দণ্ডের আগায়
উড়বে আমাদের স্বাধীনতার পতাকা
রক্তরঙে রাঙা’
দখলকামীর গর্বোদ্ধত মাথাতেই তিনি স্বাধীনতার পতাকা ওড়ালেন। তাঁর কবিতায় কবিতায়, ঋতুরক্ত হয়ে উঠল নিষেধ ভাঙার ফতোয়া, লজ্জা হল গৌরব। ‘তোমার কবিতায় এত শরীর কেন?’, জিজ্ঞাসা করল উঁচু জাত, পিতৃতন্ত্র, রাষ্ট্র। কিন্তু দখলোপযোগী শরীর ভিন্ন কিছু মাত্র যদি না হই আমি, শরীরকেই তবে শাণ দেব না কেন তরবারি রূপে? তাই তিনি আরও লিখলেন-
‘আমাকে ফ্রেমে বাঁধবে, ছবির মতো
টাঙিয়ে রাখবে দেওয়ালে,
আমি ঝরে পড়ব
তোমাকে অতিক্রম করে
হঠাৎ বন্যায় নদীর মতো
আমি হয়ে উঠব
ধরা
আগুন
আকাশ
বায়ু
জল
যত বাঁধবে, তত ছাপিয়ে যাব,
প্রাকৃতিক জলপ্রপাত সম।’
তিনি তামিল দলিত কবি সুকীর্থারানি, যাঁর কবিতাও সম্প্রতি বাদ গেছে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম থেকে। কারণ পাঠ্যক্রমেও আছে কখনও সূক্ষ্ম, কখনও স্থূল দখলদারি। পাঠ্যক্রমও এক বৌদ্ধিক ভূমি, যার দখল কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া যায় বা দলিত, আদিবাসী, নারীর হাতে। আর যে কবিতা দখলের প্রতিবাদে পুনর্দখলের কথা বলে, তা দখলদারের দখলপ্রচেষ্টায় জল ঢেলে দেয়। দখলদার ভয় পায়।
সুকীর্থারানি শরীরের দখলদারি নিয়ে যে কাব্য লেখেন, সে অভিজ্ঞতা বিশেষত দলিত নারীর, আবার প্রতি-নারীরই কম বেশি। তাদের কৈশোরের দখল নেয় মায়ের সতর্কদৃষ্টিতে তৈরি জামার ঝুল, বেড়। মনের দখল নেয় শরীর ঘিরে অপরাধবোধ, কুণ্ঠা। এ লজ্জাকে ‘ভূষণ’ বলেন পুরুষ কবি। অথচ যখন কুণ্ঠা মিশকালো বোরখার রূপ পায়, বিমূর্ত যখন মূর্ত হয়, কেবলমাত্র তখনই ওঠে গোঁড়ামি, মানবাধিকার, নারী-অধিকারের প্রশ্ন। নিজের বেড়ে ওঠা নিয়ে কুঁকড়ে যাওয়া না থাকলে মেয়েবেলা আরও সুন্দর হত অনেক নারীরই। কবে তবে কোন তালেবান ঢুকেছিল মগজে? কবে নারী বুঝতে পেরেছিল, তার জল, জঙ্গল, জমিন সীমিত? লোকাকীর্ণ মেলা, ভিড় যানবাহন তার জমি নয়। আবার একলা তট আর সমুদ্রজলের নীলও তার জন্য নয়। ঘরে বা বাহিরে, সব জঙ্গলেই সে শিকার্য মাত্র।
সে বুঝেছিল। কিন্তু পুরোপুরি মেনে নেয়নি। বিদ্রোহ করেছিল। পুনর্দখল চেয়েছিল। সুকীর্থারানির এক পূর্বজা কবি, কবিতা সিংহ লিখেছেন, বাংলাতেই-
‘হইনি তোমার
হাতের সুতোয়
নাচের পুতুল
যেমন ছিল
অধম আদম
আমিই প্রথম বিদ্রোহিণী
তোমার ধরায়
আমিই প্রথম।…
আমিই প্রথম
ব্রাত্যনারী
স্বর্গচ্যুত
নির্বাসিত
জেনেছিলাম
স্বর্গেতর
মানব জীবন
জেনেছিলাম
আমিই প্রথম।’
ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, একটি নিজস্ব ঘর বড় দরকার সৃষ্টিশীলতার জন্য, যার বড় অভাব নারীর ক্ষেত্রে। এ’ এক সৃষ্টিশীল মানুষের উপলব্ধি। আত্মদীপ জ্বালাতে গেলেও যে নিজস্ব সময় ও আপন কোণ প্রয়োজন, তা অন্য কারও দখলে। নারী তাই মনে মনেই আপন কোণ গড়ে নিয়েছে কখনও। কবিতা সিংহেরও পূর্বজা রাজলক্ষ্মী দেবী বলেছিলেন-
‘মনের পেছন দিকে ঘোরানো সিঁড়ির খোঁজ কাউকে দেবো না।
সেই সিঁড়ি বেয়ে শুধু রাতের কুটুম্বগুলি করে আনাগোনা।
মনের পশ্চিম কোণে চোর কুঠুরির খোঁজ পেয়ে গেছে তারা,
আর কেউ জানবে না, আর কেউ দেখবে না । সদরে পাহারা। …’
কবিতা ও রাজনীতি যে এই লেখার শেষে এসে মিলেমিশে গেল, তা আমার দোষ নয়। তার কারণ, এই সব কবিতা একক মানুষের অনুভবের বহিঃপ্রকাশ হলেও, তাদের আছে নিজস্ব রাজনীতি। আজ অবশ্য নারী শুধু মনের নিভৃত কোণটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। সে চায় বাস্তবেও তার প্রতিফলন। রাজনীতির ভাষায় মার্ক্সীয় নারীবাদীরা বলেন, ‘আটঘণ্টা শ্রম, আটঘণ্টা ঘুম, বাকি আটঘণ্টা যা খুশি করি তাই’-এই যে মূলমন্ত্র দুইশত বছর ধরে প্রচলিত, তা কি আদতেই কার্যকরী হয়েছে কোনোদিন নারীর ক্ষেত্রে? নারীর ‘যা খুশি করি তাই’-এর অবসর কি গিলে নেয় না অবৈতনিক গৃহশ্রম? তবে শ্রমিকের মুক্তি সাধিত হল কীভাবে?
দখল হয়ে যাওয়া নিজের ঘরটুকু ফিরে পাওয়ার জন্য ‘আমাদের লড়া’। ‘যে যেখানে লড়ে যায়’ সে লড়াই, সে আসলে একটি রাজনৈতিক লড়াইয়েই অংশ নেয়। রাজনীতি বহুর কথা বলে। অথচ বহু তো অনেক ‘এক’-এর সমষ্টি। বহু-র কথা বলে যে বাম রাজনীতি, আর আত্মপরিচয়ের কথা বলে যে পরিচিতির রাজনীতি (আইডেন্টিটি পলিটিক্স), তাদের কোথাও গিয়ে মেশার সময় হয়েছে আজ।
2Comments
June 10, 2022 at 12:44 pm
দখলদারি প্রসঙ্গে এসেছে নারী জীবন। সমসাময়িক ও ঐতিহাসিক নানা উদাহরণ সহ সুলিখিত লেখাটি। বেশ ভালো লাগলো।
June 10, 2022 at 12:47 pm
দখলদারি প্রসঙ্গে এসেছে নারী জীবন। সমসাময়িক ও ঐতিহাসিক নানা উদাহরণ সহ সুলিখিত লেখাটি। বেশ ভালো লাগলো।