
তমাল যেদিন ঐহিকের ‘দখল’ সংখ্যায় কিছু লিখবার জন্য বলল,সত্যি বলতে একটা বড় লেখা লিখবার প্রস্তুতি চলছে দীর্ঘদিন ধরেই,কিন্তু লেখাটা এগোচ্ছে না,বারবার নানান পত্রিকার দাবি পূরণ করতে
গিয়ে,পত্রিকাগুলোও তো নিজেদের সাজিয়ে তুলতে চায়,আমি তাতে কতটা যোগ করতে পারি সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র,আমি এড়িয়ে যেতেই চেয়েছিলাম,কিন্তু ঘটনা যেটা ঘটল শুতে-বসতে তমালের প্রস্তাবটা আমার মনের ওপর তার নিজের দখল কায়েম করে বসল,যদিও এধরনের দখল,মনকে,নিজের ভাবনাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করবার একটা সুযোগ এনে দেয়,এতে মনেরও বয়স বাড়ে,ভাবনার বিস্তার বাড়ে,তাই শেষমেশ… পৃথিবীতে ‘দখল’ বিষয়টা ব্যবহারিক দিক থেকে ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন এই মানুষ্যসমাজ।
পৃথিবীতে পা রাখবার দিন থেকে,যখন একেকটি গোষ্ঠী গড়ে উঠছে,অনেক পরে দেশের ভাবনা এল,রাষ্ট্র,কিছু-না-কিছু দখল ব্যতিরেকে সে এক পা-ও চলেনি,তার এই দখল কার্যে যেমন অন্য গোষ্ঠী,দেশ বা রাষ্ট্রের সম্পদ রয়েছে,প্রথম থেকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী,নারীর শরীরের ওপর নিজের বা নিজেদের দখল সত্ত্ব কায়েম করা প্রত্যেক পুরুষ শাসিত গোষ্ঠী,সমাজ,দেশ বা রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবেই গণ্য হয়ে এসেছে,বর্তমান যুগে তার রূপ পাল্টালেও বিষয়টা একই থেকে গেছে,কী ব্যক্তিগত স্তরে কী পারিবারিক,সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় স্তরে,নারীকে অর্ধেক আকাশ বললেও পৃথিবীর বহুলাংশে এই প্রথা আজও বলবৎ,যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন মেয়েরা,আর যুদ্ধটা আজও চলছে পৃথিবীর নানান প্রান্তে,মানবসমাজ এ থেকে নিজেকে আজও বহুলাংশে মুক্ত করতে পারেনি।
প্রকৃতির মধ্যে থেকে উঠে এলেও গোটা পৃথিবী জুড়েই মানুষের আরও একটা যুদ্ধ প্রকৃতির বিরুদ্ধে এবং বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্রগুলিও এ থেকে মুক্ত তো নয়ই,বরং অগ্রণী ভূমিকা তাদেরই। প্রকৃতিকে নিজেদের দখলে রাখতে ও নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে যতরকমভাবে সম্ভব,সে কাজ তারা করে চলেছে,পাশাপাশি এর বিষময় ফল আমরা আজকের বিশ্বে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলেও এবং ভুক্তভোগী হলেও কোথাও-ই থামানো যাচ্ছেনা এদেরকে। প্রাণময় এই বিশ্বে মানুষ নিজেকে তার অধীশ্বর ভাবছে যদিও সে বুঝতেই পারছে না সে আসলে এই পৃথিবীতে যত প্রাণ আছে তার একটি ক্ষুদ্রতম অংশ মাত্র। অন্য প্রাণের বিনিময়ে সে নিজেও নিজেকে আসলে ধ্বংসের দিকেই নিয়ে চলেছে। এইনিয়ে বিস্তার বলা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি বরং অন্য যে দিকটিতে আলোকপাত করতে চাই সেটা হলো আধুনিক বিশ্বে দখলকার্যটির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রটি হলো মানুষের মন,মানুষের ভাবনার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা।
ক্ষমতার নানাস্তরীয় কাঠামোর মধ্যদিয়ে মানুষের মনের ওপর দখলকে কায়েম করাই ক্ষমতার একমাত্র উদ্দেশ্য। ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব স্পেসগুলোকে এজন্য সে ধ্বংস করে ফেলতে চাইছে যাতে প্রত্যেক ব্যক্তি তাই ভাবে যা ক্ষমতা তাকে ভাবাতে চায়,এবং এ কাজে সে বহুলাংশে সফল,বেশির ভাগ মানুষের নিজস্ব ভাবনাই নেই,তারা তাই ভাবে যা তাদের ভাবতে শেখানো হয়েছে,অথবা ভাবেনা কিছুই,একটা কবন্ধ সমাজ গড়ে উঠেছে যেখানে মানুষের দেহটা আছে,যা নেই তাহলো মগজ,যে মগজ নিজের মত করে ভাবতে সক্ষম। এবং এই কাজটা ক্ষমতা শুরু করে একটি শিশুর জন্মের পর থেকেই। পরিবার থেকে প্রতিবেশী,সমাজ,স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়,নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত,ক্ষমতার বহুস্তরীয় কাঠামোর মধ্যে,ছোট থেকে বড়,ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ,এসবকিছুকে ঢুকিয়ে এই কাজটাই অনায়াস করে ক্ষমতা,মানুষ বুঝতেই পারেনা যেসব ভাবনায় তাদের মগজ ভর্তি হয়ে আছে সেসব কতটা অসার,তার মনের বিকাশের পক্ষে অনুপযোগী,নিজের অজান্তে সে আমৃত্যু আসলে ক্ষমতার ভাবনাগুলোকেই বহন করে নিয়ে চলেছে। একটা বহুল প্রচলিত ‘জেন’ গল্পের কথা মনে পড়ে গেল।
অধ্যাপক এসেছেন জেন গুরুর কাছে জেন কী জানতে। জেন গুরু তাঁকে আপ্যায়ন করে তাঁর সামনে রাখা পেয়ালায় চায়ের পাত্র থেকে চা ঢালতে শুরু করলেন। চা তিনি ঢেলেই চলেছেন,পেয়ালা উপচে চা প্রথমে টেবিল,পরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লেও তাঁর থামার কোনো লক্ষণই নেই,যেন চা পাত্রে যতটা চা ধরে সবটাই তিনি ওই ছোট পেয়ালায় ঢালবেন। অধ্যাপক ততক্ষণে নিজেকে অপমানিত বোধ করতে শুরু করেছেন আতিথ্যের নমুনা দেখে। তাঁকে ক্রুদ্ধ হয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে জেন গুরু ফের ডেকে বসিয়ে যা বললেন অধ্যাপক ওরকম কথা কস্মিনকালেও শোনেননি। “আপনি জেন কী জানতে এসেছেন। কিন্তু আপনার মগজে তো পুরনো জ্ঞান গিজগিজ করছে। একটুও জায়গা ফাঁকা নেই সেখানে। আমি আপনাকে জেন কী জানাতে চাইলে সেটা আপনার মগজের কোথায় জায়গা নেবে ? এই পেয়ালার চায়ের মত সেটাও কি উপচে পড়বে না ? আগে নিজের মগজে পুরনো যা কিছু আছে সেগুলো ফেলে আসুন। তারপরে আমি আপনাকে বলব,জেন কী।” জেনগুরু বললেন অধ্যাপককে। জ্ঞানের দিকে যাওয়াটাই যে জ্ঞান,এছাড়া জ্ঞানের অন্য কোনো অর্থ নেই,সত্যের দিকে যাওয়াটাই একমাত্র সত্য,এটা বহু শিক্ষিত মানুষও আজও বোঝেননা।
আমাদের অধিকাংশ মানুষের মন তথা মগজ ভরে থাকে পুরনো সব চিন্তায় যেগুলো জন্মের পর থেকে ক্ষমতা তার আগে উল্লেখিত নানা স্তরের মধ্যেদিয়ে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমরা সেগুলো নিজের চিন্তা ভেবে হেগেমুতে দিব্যি থাকি। আমাদের শরীরের বয়স তার নিজের নিয়মেই বাড়ে। যেটা বাড়েনা সেটা মনের বয়স। এক জায়গাতেই সেটা চুপচাপ থেমে থাকে। আমরা ওই পুরনো চিন্তা নিয়েই চিতায় উঠি অথবা কবরে যাই। এর চেয়ে ভয়ংকর দখল,যা ওই মনকে,আর কী হতে পারে ? দখলিকৃত সম্পদ একসময় হয়তো নিজের দখলে ফের,আনা যায়। এমনকী শরীরও ফের নিজের হতে পারে। কিন্তু মন বা মগজ ? সেটা নিজের হবে কবে ? আসুন,এই প্রশ্নটা দিয়েই এই সামান্য আলোচনাটা শেষ করা যাক।