গত শতাব্দির নব্বই দশক। দুই দশক সময়ের পরেও উক্ত দশকের কবিতার প্রবণতা নিয়ে কিছু বলার আগে বলতেই হয়—দশকওয়ারী কবিতা বিচারের কোনো মানদণ্ড হতে পারে না। কবিতার আলোচনায় দশক বিবেচনা অনেকের কাছে অবান্তর প্রসঙ্গও। বাংলা কবিতায় দশকের চর্চা শুরু হয়েছে মূলত রবীন্দ্রবলয় পরবর্তী তিরিশের দশকের পর থেকে। তাই পূর্ববর্তী দশকের উল্লেখ কোথাও না পেলেও তিরিশ পরবর্তী সময় থেকে দশকওয়ারী বিভাজনের সূত্রানুযায়ী সংকলন করা হয়েছে। ঋত্বিক ঘটক মনে করেন, “এত বেশি কবিতা লেখা হচ্ছে যে, কবিরা নিজেরাই দশকভাগে পরমায়ু নির্ধারণ করেন।” সেই পরমায়ু নির্ধারণ আজও অব্যাহত আছে।
তবে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসের বিবেচনায় এর একটা কালানুক্রমিক গণনার গ্রহণযোগ্যতা হয়তো আছে। এর ধারাবাহিকতার একটা রূপ আমরা লক্ষ্য করি— প্রাচীন যুগ ১০০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ, মধ্যযুগ ১২০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ, প্রাক-আধুনিক যুগ ১৮০০-১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ, মধুসূদন যুগ ১৮৪০-১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ, প্রাক-রবীন্দ্র যুগ, ১৮৬০-১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ, রবীন্দ্র যুগ ১৮৭৫-১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (ত্রিশ) ১৯৩০-১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (চল্লিশ) ১৯৪০-১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (পঞ্চাশ) ১৯৫০-১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (ষাট) ১৯৬০-১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (সত্তর) ১৯৭০-১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (আশি) ১৯৮০-১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (নব্বই) ১৯৯০-২০০০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (শূন্য) ২০০০-২০১০ খ্রিস্টাব্দ, আধুনিক যুগ (শূন্যের দ্বিতীয়) ২০১০-২০ খ্রিস্টাব্দ। এই কালানুক্রমিক গণনা এক পর্যায়ে দশক পরিচয়ে সাহিত্যের রাজনীতির উৎপত্তি ঘটার সম্ভবনাই বেশি। দশকওয়ারী কবিতার বিশ্লেষণ, আলোচনা-সমালোচনার ব্যপক প্রচার বেশ লক্ষনীয়। যদিও কবি মহলে মত বিরোধ থাকলেও দশকভিত্তিক কবিতা ভাবনাকে (কবিতার শ্রেণীকরণ, বিষয়বস্তু ও চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য) সবাই মেনেও নিয়েছেন।
গাজী রফিক তার— ‘রুপান্তর আশির দশকের কবিতা’ গ্রন্থে বলেন—
“কবিতা দশকে দশকে বদল হয় না। কবিতার বহিরঙ্গ অন্তরঙ্গে নুতন হাওয়া, নতুন শিহরণ অনুভব করার ক্ষেত্রে প্রজন্ম প্রেক্ষিতটি অধিকতর যৌক্তিক। এক দশকে একটি নতুন প্রজন্মেও আবির্ভাব ঘটে না। একটি দেশে, সমাজে, তার ভাষায়, সংস্কৃতিতে এমনকি বিশ্বাসে ও মননে ব্যাপকতর কোনো বিপ্লব, কোনো পরিবর্তন প্রজন্মেও শক্তিতেই সংঘটিত হয়।”
সেই হিসাবে একজন কবির সূচনাকাল চিহ্নিত করা যায় মাত্র। হয়ত কবির উন্মেষকালের অবস্থান, সময় ও আবহ নির্ণীত হয়। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়— অনেক কবি ৪০/৫০ বয়সোর্ধ্ব সময়ের পরে কবিতা লিখতে এসেছেন, তাদেরকে কোনো দশকের সংকলনে চোখেই পড়েনি। তাহলে এই কবিরা কোন দশকের কবি বলে বিবেচিত হবেন? শিমুল মাহমুদকৃত ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারার কবিতা প্রকরণ ও প্রবণতা পর্যবেক্ষণ’ গ্রন্থে নিচের প্যারাটি প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি—
“কবির জীবৎকাল বা জন্ম-মৃত্যু, প্রথম কবিতা প্রকাশ বা পত্র পত্রিকায় মুদ্রিত সময় অথবা লিখিত হয়েছে আগে অথচ মৃদ্রিত হয়েছে ২/৩ বছর বা ১০ বছর পর; প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল; এগুলোর কোনটিই দশক নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। বিবেচ্য বিষয় হওয়া সম্ভব কবিতার যুগবৈশিষ্ট্য তথা আঙ্গিকগত প্রেক্ষাপট। আর এই প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করতে হলে কবির কবি হয়ে ওঠার শুরুকালটাই গুরুত্বপূর্ণ।”
যাক, তিরিশের কবিদের পথ পরিক্রমায় বাংলা কবিতা পঞ্চাশ দশক পর্যন্ত যে দিশা পায়, তা ষাট, সত্তর ও আশির দশকের কবিতায় অনেকটাই ছিল ঐতিহাসিকভাবেই ধারাবাহিক ও গতানুগতিক। নব্বই দশকের কবিতা বাংলা কবিতার কালানুক্রমিক ধারায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও নব্বই দশকের কবিতাও পূর্ববর্তী দশকের কবিতারই কিছুটা ধারাবাহিক আয়োজন বা দূরবর্তী কোনো সময়ের কাব্যবীজের বিলম্বিত উদ্ভিদ, যা নব্বই দশকে পাতা মেলেছে তার নিজস্বতা ও নবনির্মিতির পূর্ণতর উত্থানে। নব্বইয়ের কবিরা (শৈশব ও কৈশোর) বেড়ে উঠেছেন সত্তর ও আশির দশকের নানারকম ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আনন্দদায়ক ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। সেই যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর নানা নৈরাজ্য, ভায়োলেন্স, মৃত্যু এবং অলৌকিক আশাবাদের সাথে গণহত্যা, ধর্ষণ-লুণ্ঠন পরবর্তী ৭৫ এর পটপরিবর্তনের সাথে স্বৈরতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতায় বাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সন্ত্রাস, দূর্ণীতি, শিক্ষাঙ্গনে অস্ত্রের দাপট, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক কেনাবেচার সাথে সাথে সর্বত্র দলীয়করণের কালচার তৈরী হয়।
মোটাদাগে যদি বলি—স্বাধীনতা পরবর্তী বাকশাল গঠন, বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারে হত্যাকাণ্ড, অভুত্থান ও পাল্টা অভুত্থান ও জেল হত্যা, সামরিক শাসন, জিয়ার ক্ষমতা গ্রহন ও হত্যাকাণ্ড, এরশাদের ক্ষমতা গ্রহন ও পতন এবং ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতাও নারী, সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া, ১৫ ফেব্রুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচন ও সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং একুশ বছর পর আওয়ামী লীগের সরকার গঠন। এছাড়া নব্বই দশকে বৈশ্বিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার মাধ্যমে বিশ্ব ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়া। অন্যদিকে সোভিয়েত বলয়ের প্রায় সকল কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলিও ভেঙে পড়ে। দুই জার্মানীর একত্রিকরণের সাথে সাথে যুগোস্লাভিয়ায় গৃহযুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং ইউরোপের মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, নতুন চ্যানেল, ডিস-এন্টেনা ইত্যাদি।
অন্যদিকে বাবরি মসজিদ ভাঙা, তার জেরে বাংলাদেশেও ভাঙাভাঙির খেলা। সম্প্রদায় চিহ্নিতকরণ। পাকিস্তানে ঘটেছে সাম্প্রদায়িক উত্থান। আফগানিস্তানে ভেঙেছে বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি। তার পরেই গুজরাটে সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলেছে। ঋণ প্রকল্পে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গজিয়ে উঠেছে। বেড়েছে গ্রামের মানুষের শহরমুখী অভিযান। এরকম এক মনস্তাত্বিক প্রতিকুল পরিবেশে নব্বইয়ের কবিদের চিন্তায় নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন নব্বইয়ের কবিতাকে প্রভাবিত করলেও ইঙ্গিতময় ও সংবেদনশীল নব্বই দশকের কবিতা বিষয়বৈচিত্রের কারণে আত্মউপলব্ধির একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
কালিক সীমারেখায় প্রাক্কলিত সংকলন সমূহে কবিতার শ্রেণীকরণ, বিষয়বস্তু ও চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য কী তা সুমন সরদার সম্পাদিত ‘নির্বাচিত বাংলা কবিতা : নব্বই দশক’ এর সম্পাদকের কথা থেকে বোঝার চেষ্টা করি—
“পূর্ব দশকের কাব্য ঋণের পাশাপাশি ঐতিহাসিক চেতনা, পূর্ববর্তী ও চলমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কাব্য চেতনার শক্তি যোগান দেয়। সুতারাং দশকের একটি প্রভাব নব্বই দশকের কবিদের উপর পড়েছে এবং তা অন্য দশকের চেয়ে আলাদা। …………ব্যর্থতার গ্লানি অকপটে প্রকাশ, রাজনৈতিক চেতনার প্রতি অমনোযোগ, সহজাত ভোগবিলাসিতা নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ, বহুধাবিভক্ত ও বিচিত্র ধারায় কাব্যচর্চা, পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য উপস্থাপন না করে পাঠকের চিন্তাশক্তিকে আরও উস্কে দেয়া প্রভৃতি।”
এবার জেনে নিতে চাই, রবিউল মানিক সম্পাদিত ‘নব্বই দশকের নির্বাচিত কবিতা’র ভূমিকায় কী লিখেছেন—
“গত শতাব্দীর প্রারম্ভে রোমান্টিকতার ধারা থেকে রেরিয়ে এসে আধুনিক কবিতার গোড়াপত্তন এবং এক পর্যায়ে তা সার্বজনীন কাঙ্খিত চূড়ায় পা রেখেছে। উপরন্ত, বিশ্ব কবিতার চলমান স্রোতে মিশে এক অভিনব ও নতুন বাঁক নিয়ে উত্তরাধুনিক ধারায় প্রবল জোয়ার তুলে ভাষার উৎকর্ষতা, ছন্দের ব্যবহার এবং চিত্র নির্মাণের আয়োজনে নিরন্তর ভেঙে ভেঙে কাব্যাভিস্পাকে নবায়নযোগ্য করে তুলেছেন ………..এই সময়ে আদর্শবোধের উদ্দেশ্যহীনতা, কবিকৃতির উগ্রতা, অভিজ্ঞানলব্ধ অনুভূতি, নৈঃসঙ্গবোধ ও উপলব্ধিজাত সংবেদ, নিমগ্নতা, প্রাণ প্রাচুর্য্যে উচ্ছ্বলতা, ভাষার উদ্দামতা, মিথ, পুরাণ, ইতিহাসের সার্থক প্রয়োগ, মানুষ ও মহাকাশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক সন্ধানে মহাকাব্যিক ক্যানভাস নির্মাণ এবং নতুন আঙ্গিকের উদ্ভাবন ও তার সুসম্পন্ন ব্যবহার নব্বই দশককে আলাদা, মহিমান্বিত করেছে।”
আরও একটি সংকলন- মাহমুদ কামাল ও মোহাম্মদ আবদুল মাননান সম্পাদিত ‘নব্বই দশকের কবিতা’ পাঠ ও মূল্যায়নে মাসুদুল হক বলেন—
“নব্বই দশকের কবিতায় জটিল দায়বদ্ধ ও গদ্যকবিতার সঙ্গে শিল্পগুণ সমৃদ্ধ, পারিপার্শ্ববর্জিত সমাজ নিরপেক্ষ ঐতিহ্যে অন্তর্মুখীন কবিতার দ্বারা প্রবাহিত। এদের কবিতায় প্রচল ছন্দের বাইরে বেরিয়ে নতুন সমীক্ষাধর্মী গদ্য ভাষ্য-ধারার কাব্যশৈলী নির্মার্ণেও প্রবণতা দেখা দেয়; যেখানে ধ্বনিময়তার প্রাবল্য স্পষ্ট।”
বিষয় বৈচিত্রে নব্বইয়ের কবিদের লেখায় সত্তরের মতো যৌথ শব্দস্রোতে সম্মিলিত চরণসজ্জায় কিংবা আশির দশকের মতো মিথের ব্যবহারে কেবল কালের কথা উঠে আসেনি। কবিতা হয়ে ওঠে আত্ম-অনুভূতি ও সত্তা-উপলব্ধির স্বরগ্রাম। বিগত চার দশকের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত নব্বই দশকের কবিদের মনন, মেধা ও চিন্তায় বহু স্বরের সম্মিলন ঘটেছে। কবির মনের অন্তর্গত ভাব, ইঙ্গিতময়তা ও প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশের প্রবণতা দেখা যায় এ সময়ের কবিতায়। বিষয়বস্তুর গভীরতর স্তরে পৌঁছানোর জন্য অনেক কবিই বাস্তবজগৎ থেকে সরে গিয়ে পরাবাস্তব জগতে প্রবেশ করেছেন এবং কবিতাকে অবচেতনলোকের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু তিরিশ দশকের রবীন্দ্রীক প্রভাবমুক্ত কবিদের মতো ভিন্ন ভাবনা ও চিন্তাযুক্ত বৈশিষ্ট্যের কবিতা নব্বই দশকে পাচ্ছি কি? এ প্রসঙ্গেও বিতর্ক আসতে পারে। দেখে নিতে পারি, মাহবুব রশিদ কী মনে করেন—
“নব্বই দশকের কবিতার প্রবণতা গুলো কয়েকটি চাবি শব্দে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়— প্রথমতঃ পশ্চিমা প্রভাবের ফলে উত্তরআধুনিকতার সংক্রমণ, দ্বিতীয়তঃ আহমদ ছফার প্রভাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ও তৃতীয়তঃ নানা পীর মুর্শিদের পেছনে ঘুরে অনেক প্রতিভার নষ্ট হয়ে যাওয়া। এছাড়া— নাম কামাবার জন্য নব্য ঢাকা আসা মফস্বলবাসীসুলভ শিশুতোষ মোহ, এসব প্রবনতাকে সিদ্ধ করার লক্ষ্যে নানা উদ্ভটত্বের আবির্ভাব ঘটায়, শব্দে-বাক্যে-বিন্যাসে-গঠনে-পরিকল্পনায়-পরিকল্পনাহীনতায়। শিল্প কখনো উদ্ভট হতে পারে কিন্তু উদ্ভট হলেই তা শিল্প নয় এ সহজ সত্যটা তারা জানে এবং ভুলে যায়। উত্তর আধুনিক হারমনি বুঝতে না পেরে কেবল অসংলগ্নতা {শব্দ চয়নে, বাক্য গঠনে, বাকের পরমপার্য্য বিন্যাসে} চর্চা করা তাকেই আর্ট সমঝে নেয়া। বিচ্ছিন্ন হবার-নতুন হবার-ব্যাতিক্রম হবার-উত্তরাধুনিক হবার চেষ্টা পরিণত বাতিকে। ফরম আর কন্টেন্ট মাঝারি-নিম্ন মাঝারি। প্রতীক-চাবি শব্দ-থিম ও সূচন-সংহারে অন্বয়হীনতা।”
রবিউল মানিক সম্পাদিত ‘নব্বই দশকের নির্বাচিত কবিতা’ গ্রন্থের ১৭ জন প্রধান কবির কবিতা গ্রন্থিত, সেই গ্রন্থের ১০ জন এবং কবি পাবলো শাহি, কবি পরিতোষ হালদার, কবি মুজিব মেহেদী, কবি শামীম রেজা, কবি জফির সেতু, কবি শাহনাজ মুন্নী সহ ১৭ জন কবির কবিতা এ আলোচনায় সীমাবদ্ধ বিধায় তার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকটাই এভাবে শ্রেণীকরণ বা বিভাজন করা যেতে পারে। যেমন—
(১) এই সময়ের কবিদের শৈশব ও নষ্টালজিয়ার অনুসঙ্গ বেশ প্রকট না হলেও উচ্চকিত ছিল। অনেকে আবেগাশ্রিত ও সমাজ নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ সাহিত্য রচনায় ব্রতী হলেন।
(২) সংস্কারবাদী মন আর মননের উপমামিশ্রিত কারুকার্য এ সময়ের কবিতায় প্রকট হলেও আদিরসাত্মক কবিতাও লক্ষনীয়।
(৩) সাধনা বা অভিজ্ঞানের ধারাক্রমে দেখা না গেলেও মরমিবাদ, বাউলতত্ত্ব ও লোকজধারা কারও কারও কবিতায় চর্চার পর্যায়ে দৃশ্যমান ছিল।
(৪) নাগরিক চেতনা এবং নানাবিধ সংকট ও স্খলন এর ভেতর দিয়ে জীবনের রহস্যময়তা এবং বিমূর্ততার ভাবকল্পনার আবর্তন লক্ষনীয় ছিল।
(৫) অনেকে মার্ক্সীয়তত্ত্বকেই সাহিত্য সৃষ্টির ভিত্তি করলেন। কেউ কেউ বিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাসের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। অধিবৈদিক কবিতা লেখার পাশাপাশি ইসলামি রেনেসাঁকে অবলম্বন করলেন।
(৬) কারও কারও কবিতায় উত্তরাধুনিকতা, পরাবাস্তববাদ/অধিবাস্তববাদ, পোস্টস্ট্রাকচারালিজম বা বিনির্মাণবাদ, জাদুবাস্তবতা, ও ডিসকোর্সের প্রকরণ ব্যাপকভাবে দেখা না গেলেও এ সময়ের কবিদের লেখায় দৃশ্যমান হয় ঈর্ষনীয়ভাবে।
(৭) ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী চেতনা ও স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি নব্বই দশকের কবিতায় খুবই সীমিত আকারে এসেছে।
(৮) মিশ্রবৃত্ত ও মুক্তক ছন্দকেই ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া, যদিও এসময় গদ্যের চর্চাও লক্ষনীয়।
এই সকল বৈশিষ্ট্যগুলিই সবকালের কবিতাতেই থাকতে পারে, প্রেম-অপ্রেমের খেলা, বিশ্বাসহীনতাও। একটা সভ্যতাকে কোনও দিনই স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসাবে পেতে পারি না; থাকবে ভাঙন-নির্মাণ, পলায়ন-উত্থান, জীবন-মরণ পাশাপাশি। সেসব নিয়েই লেখা হবে কবিতা—
কবি সরকার আমিন শূন্যতার আঁধারে আঁকেন চিত্রময় কবিতার জগত। যেখানে আবেগ ও যুক্তির সমন্বয় সাধনে নিপুন ধর্মতত্ত্বের প্রয়োগ করেন। সেই সাথে মিথ ও লৌকিক জনশ্রুতিতে উপস্থাপন করেন। তার কবিতায় ব্যক্তিগত বোধের বৈশ্বিক চেতনা এবং বোধের বিকাশ ও বিবেকী আধুনিকায়নে বিচিত্র প্রবাহ স্রোত লক্ষনীয়।
চোখ বলে তাকাও বুকের দিকে তাকাই। পাই; পেয়েও যাই বুকপকেট জামা ও শরীর ভেদ ও অভেদ যেখানে জমা রাজ্যের ক্লেদ! সেখানে শত শত অন্ধকার রাত ঘুমিয়ে আছে সমুদ্র খুঁছছে মাছ, আকাশ ঠিকানা চায় আকাশের কাছে হেঁটে যাই আমি। সামনে কালভার্ট! বৃষ্টির জল ধেয়ে যাচ্ছে সলজ্জ চিল উড়ছে মাথা বরাবর স্মৃতির কই-মাছগুলো ডাঙায় ওঠে গেছে বুকের তলদেশে ড্রিমলাইট বেশ কালো এমন সময় চুপ করে থাকা-ই কি ভালো? জানি চোখের জলে কখনো শ্যাওলা থাকে না চোখ জানিয়ে দেয় নিরাপদ অবতরণের সংকেত! [কবিতা : চোখের জলে শ্যাওলা থাকে না]
কবি পাবলো শাহি-র কবিতায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, বিজ্ঞান এবং বুদ্ধিবাদি চেতনাকে নিসর্গের আত্মায় কাব্যিক রমনীয়তাকে নান্দনিকভাবে আত্ম উপলব্ধির জগতে যে সৌন্দর্য গাণিতিক যুক্তিকে ভেঙে মানবিক যুক্তি ও সৌন্দের্যের এক প্যারাডাইম তৈরী করে এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নির্মাণে দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় তার কবিতার অন্তরমহলে।
কোন রাত্রিবন্ধনে, সমাপ্তি রেখাকে সম্পাদন করি। মনোগোচর করি, প্রিয়তমা; তোমার উদ্ভিদজ্ঞানে। প্রতিবার প্রযুক্তিবিদ্যা নিদ্রাকুলে নিরাপদ রাখি, সেই টগর গাছ হয়ে কাঠবিড়ালির ঠাঁই খুঁজি, আর দুই বছরে পেয়ে যাই দুটি জামগাছের বাদামী সংকেত। এই লিঙ্গ বিনিময়, আমাদের নৌকাভর্তি বিষাদসিন্ধু, শরীরের কটি বাঁশপাতা ফিরিয়ে আনে। যেখানে ফুটেছে দেয়াল ঘড়ির বৃদ্ধাঙ্গুল। একদা, এতদিন পরে মীনকন্যাদের প্রদগ্ধ দ্যোতনা ব্যাখ্যা করে; জ্বেলে দেয় বিসর্গবর্ণগুলি। তারপর দেখো, কেমন সন্ধেবেলা, অর্ধদগ্ধ ইতিহাসের বই খুলে রাখে মহাকাল। [কবিতা : বিসর্গবর্ণগুলি]
কবি পরিতোষ হালদার এর কবিতায় সমকালীন সভ্যতার বাস্তবতার জীবনকে নদীর জলের লীলায়িত তরঙ্গে ন্যায় আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য শিকড় সন্ধান। জীবনের দেখা না দেখা এবং শ্লীলতা-অশ্লীলতাসহ জীবনের মরমী ভাবনার গভীরতা তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য।
ঘরোয়া গন্ধের রাত পেছনে মোমের সন্ধ্যা গলে পড়ে। ছেলেটি ঘুমাতে চায়, মায়ের বুকের আরব্যরজনী। ফড়িঙের ঘাস-উৎসব। মা তুমি লম্বা সরলরেখা... তবু যায়, সংসার তাকে নিয়ে যায়। ছেলে রোজ আরশির সামনে আসে, দেখে কতটা মা লুকিয়ে আছে নিজের শরীরে। চোখে-মুখে-চিবুকে তারই আদল। দূরে তারাখসা আকাশের শব্দ আর দীর্ঘশ্বাস। সে রাত জাগে, বুক পকেটের অন্ধকার নিয়ে আজও প্রশ্ন করে— মা ফড়িংগুলো কোথায় ঘুমায়। [কবিতা : ফড়িংবেলা]
কবি মুজিব মেহেদী’র কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মগ্ন একজন কবি। প্রচলিত কবিতার রীতি-নীতি উপেক্ষা করে মানুষের শালীনতা ও সৌজন্যবোধ এবং সম্ভ্রমকে উত্তীর্ণ সুন্দরতায় উপনীত করেন শব্দের রঙে আঁকা দৃশ্যমায়ায়। তাঁর প্রতীকী কবিতায় কাহিনীর সংস্থাপনে আবেগ, অনুভূতি ও মনস্তাত্ত্বিক চেতনায় তাঁর অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যকে বিশেষ মর্যদা দিয়েছে।
সাঁতার শেখোনি বলে ভর্ৎসনা কখনো করিনি জানি নদীই দেখেনি এক জীবনে—এমন ভূরিভূরি লোক আছে এই নদীমাতৃক দেশেও স্বপ্নে তোমাকে যেদিন সাঁতার শেখাচ্ছিলাম বিছানায় বসে গেছে জলের প্রবাহ—নদী ধরে ধরে ব্রেস্ট স্ট্রোক ব্যাক স্ট্রোক সযতনে দিয়েছি শিখিয়ে তোমার হাত পা নাড়ানো চাড়ানো দেখে ঘনঘন শ্বাসাঘাত শুনে মনে হয়েছিল তুমি এ যাত্রা সাঁতার শিখে গেছে দিব্যি [ কবিতা : সাঁতার]
কবি ওবায়েদ আকাশ কবিতার ভাষ্যে একজন রোমান্টিক কবি, তবে বাস্তবতা বিবর্জিত নয়। আধুনিক মনন ও লোক সংস্কৃতির নান্দনিকতার অপূর্ব দৃশ্যপটে সৌন্দর্য ধরা দেয় তার কবিতায়। টানাগদ্যে কবিতা নির্মাণে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ লক্ষ্য করা যায়, তবে তার পদ্যের বিনুনীও অবাক আকাশ। তার কবিতায় প্রধানত লোকজ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। আবার কখনও কখনও নগর সংকট ও মরমীতত্ত্ব এবং অধিবিদ্য ও নাগরিক ঈর্ষাবোধের চেতনা প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে আমাদেরকে ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়।
প্রতীক বিশ্বের দিকে আমার অন্ধত্বকে খুঁজে দেবো ভাষা আর যাদুবাস্তবতা, তুমি দেখো এই মায়াবিশ্বের ব্যাপারগুলো পরস্পর সম্বন্ধতাড়িত হয়ে আমার যে পরস্ত্রীকাতরতা ভর করেছিলো আর আমার মহাত্মা ধানজমিগুলো এক এক করে জলের দামে বিকিয়ে দিয়েছিলাম... ঐ ধানের জন্য মায়া, আর ঋণের জন্য খুলে দিয়েছিলাম অন্দরের সিঁড়ি... [কবিতা : সাম্প্রতিকগুলো]
কবি চঞ্চল আশরাফ আধুনিক-মনস্ক পরিবর্তনশীল জগতের অস্তিত্বেও অর্থ ও নিরর্থকতার দ্বান্দ্বিক চেতনার কবিতায় প্রকৃতি, লোকায়িত জীবন ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে নাগরিক জীবনবোধের গভীর সিসিফাস। তার কবিতা ক্ষয়িষ্ণু ও অবক্ষয়িত সময় ও সভ্যতার ম্রিয়মানতাকে কবিতার সুন্দরিত শরীরে উপস্থাপন করেন।
ঘাস থেকে পতঙ্গের নিঃশ্বাস চুরি করেছিলে তুমি, প্রজাপতির পাখা থেকে রোদ, কোকিলের কণ্ঠ থেকে কাকের ঈর্ষা দাঁড়িয়ে এসেছো সারা পথ : আহা কান্তি, আর এই রাত? তুলোর ভেতর ডুবে যেতে চায়। হুকের বন্ধনে আঙুলৃ যে যুবক এসেছিলো, সে তোমার অনিচ্ছুক বুক দুরন্ত শিশুর মতো চুষে পালিয়েছে সেই কবেৃ এখন সেখানে আয়না মস্ত এক, সেও চুরি করে তোমার শরীর, প্রতিরাতে; তবুও নিজের কাছে যাও, স্তনবৃন্তে ঝুলে আছে সেই ঠোঁট, আর, সেই কল্লোলিত করতল... রাত্রি পুড়ে যায়, প্রতিবিম্বের দুঃখিত আগুনে। [কবিতা : দাহ]
কবি টোকন ঠাকুর এর চোখে প্রকৃতি ও মানুষ অভেদ সিদ্ধ। তাইতো নাগরিক বিচ্ছিন্নতা ও অতিনিঃসঙ্গ জীবনের দ্বন্দ্বেও প্রকৃতির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছেন রোমান্টিক মুগ্ধতায়। তাঁর প্রকাশভঙ্গি আলাদা ও অভিনবও বটে। প্রপঞ্চ জীবনের বহুমাত্রিকতার সৃজনকে অনুধাবন করেন আঙ্গিকগত পরীক্ষার ক্রমাগত যাত্রায়।
বিষন্নপ্রধান ওই চরিত্র, ওই আমাদের মিডলক্লাস অভিনেত্রী, নায়িকা নায়িকা। ওকে অপলক দেখে নেওয়া যায় যেমন এই মুহূর্তে, অভিনেত্রীটা এক সদ্যমৃত বুলবুলির ঠোঁটে নেইলপালিশ করা আঙ্গুল বুলিয়ে দিচ্ছে... আর তুমি নির্দেশক, তোমার নির্দেশ পেয়েই ভোরবেলা নির্দোষ পাখি কিনে হত্যা করা হলো? চিত্রনাট্যে? আমি এমন কি লিখেছিলাম? [কবিতা : আউটডোর থেকে]
কবি মুজিব ইরম কবিতায় প্রকাশ ও উপস্থাপন টেকনিকে পরীক্ষা-নীরিক্ষায় বিশ্বাসী। লোক ঐতিহ্যতাড়িত সরল পদ্যের কথক। তার কবিতার বয়ান রীতি মধ্যযুগীয় হলেও লোকজ উপাদান উঠে এসেছে গ্রামীণ সোঁদা গন্ধে। তার কবিতার প্রাকিৃতিক পরিবেশটি গ্রামীন হলেও মানুষগুলোর মানসিকতা আধুনিক ও নগরকেন্দ্রিক। কবিতার ভাষায় আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগের ফর্মটিকে বেছে নিয়েছে স্বেচ্ছায়। প্রকৃতিবোধ ও সরলতা এবং জন্মসূত্রে পুঁথিতত্ত্বে অধিবিদ্যার সারল্য তার কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য।
মা যেমন নকশি কাঁথা শীতল পাটি বোনে, হাতের পাখায় ফুলপাখিগাছ তোলে, নক্সা করা শীতের পিঠা বানায়, জরি পুতি রেশমি সুতায় রঙ্গিন ময়ূর আঁকে, মনের কথা লিখে, তেমনি করে বইয়ের পাতায় লেখার খাতায় তোমার জন্য রঙ্গিন কিছু ফুলপাখি আর প্রজাপতি আঁকতে চেয়েছি। আর কিছু নয়, এই তো খায়েস মনে, যেমন করে মায়ের হাতের কাজগুলো বসার ঘরে শোভা হয়ে থাকে, যেমন করে দেয়াল জুড়ে মায়ের কথা বলে, তেমন করে তুমি তাকে টাঙ্গিয়ে রেখো মনে, গহিন সঙ্গোপনে। এই ভাবেই সুঁইসুতা-কাজ জপে জপে হয় যেন গো ইতি: ফুল ফুটে ঝরে যায় এই তার রীতি, মানুষ মরিয়া যায় রেখে যায় স্মৃতি। [কবিতা : রেশমি সুতার কাজ]
কবি মজনু শাহ-র কবিতায় স্বীয় ঐতিহ্যের শিকড় খুঁড়ে জাতির প্রকৃত বিকাশের গৌরবগাঁথা বিকশিত হয়েছে। তার কবিতায় বিমূর্ততা ও অদ্ভূতরূপ ও অস্পষ্টতা ইত্যাদি ঘোরের সুষ্টি কওে কবিতার বহিরঙে নতুন শব্দবন্ধ তৈরী করে। এই শব্দবন্ধ-ই কবিতার ধ্বনিগত কাঠামোর প্রধান উপাদান। তার কবিতায় জীবনের সম্ভ্রম-সম্ভবনারর রহস্য রক্তিমতায় ভাষায়িত হয়েছে।
অনন্ত সময়ের মধ্যে একটি ঘড়ির ভূমিকা কী- এটা ভাবলে আমার কিঞ্চিৎ মাথা ব্যথা হয় বিকেলের দিকে। উপশমের জন্য, তখন আমি গাঁদাফুলের সাজানো নৌকোয় গিয়ে বসি। এর মাঝি, প্রায়ই সহাস্যে আমায় পাতাল প্রবেশের প্রস্তাব দেয়। কিছুতেই আমি রাজি হই না, কেননা পাতালে গিয়ে যদি দেখা যায়, সংখ্যায় পাতালও অনন্ত, তখন? এর চেয়ে সদা ভাসমান ঐ সমুদ্রগণিকার বাড়ি থেকে ঘুরে আসা যাক। সময়, পাতাল ও দেহের তিনিই তো পরম শিক্ষক। [কবিতা : আমার স্কুল]
কবি আলফ্রেড খোকন তাঁর কবিতায় অতিকথন, অতিবর্ণনা, অতিরঞ্জনকে প্রশ্রয় না দিয়ে লিখেছেন। তাঁর কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার। ইমেজ প্রয়োগের স্বতন্ত্র ধারা নিয়ে ঐতিহ্য চেতনাপ্রবাহি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার পূর্ণ ন্যারেশন তারঁ কবিতার আর একটি বৈশিষ্ট্য। তিনি ঐশ্বর্যের ভেতরে কল্পনার প্রাচুর্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলেন চিন্তা ও প্রতিচিন্তার উপাদান। তাইতো তাঁর কবিতার দৃশ্যের সম্মোহনে ল্যারিক্যাল মূর্ছনা তৈরী করে জীবন চলার বহুরৈখিক অর্জন, সাফল্য ও যন্ত্রণার কথা ফুটিয়ে তোলেন।
দিনের ভিতর দাঁড়িয়ে আছি প্রথমে অনুপ্রবেশের তাড়া তারপর দূরের বাতাসে ক্রম-ইশারা এক একটা দিন ডেকে বলে— ’আমাকে নিন’ ক্রমশ ভিতরে যেতে থাকি ক্রমশ ছোট হয়ে আসে বিরাট রাত্রির ফণা; ক্রমশ ভিতরে ঢুকতে থাকি প্রথমে ঠিকানা থাকে না; ছোট হয়ে আসে রাতের চিবুক পরিচিত হতে থাকে মনোলীনা মুখ আবার ছোট হয়ে আসে দিন আবার ছোট ছোট রাত্রি; নতুন জন্মের দিকে ব্যথা পেয়ে তারা যেন ক্রমশ উন্মুখ। [কবিতা : দূরের বাতাসে ক্রম-ইশারা]
কবি শামীম রেজা বিজ্ঞানমনস্ক ও শিকড় ঐতিহ্যের উদার, ক্ষমাশীল, প্রেমিক মনের এক সংবেদনশীল কবি। তাঁর কবিতায় নস্টালজিয়ার শক্তি আমাদের অন্তর্গত স্মৃতিচেতনায় লুকিয়ে থাকা ঐতিহ্য ও জীবনচরিত স্পষ্ট করে তুলতে প্রকৃতি, ইতিহাস, পুরাণ ও মিথে জগতজীবনকে নিপুনভাবে তুলে আনেন। এছাড়া পূর্বাপর কবিতার ঐতিহ্য যেমন তাঁর কবিতায় আছে তেমনি সময়ের কবিতাও তাঁকে পিছু পাড়েনি। সৃজনশীল মানুষদের অন্তরাত্মার সৌরভকে দেশমাতৃকার চেতনার আবহ লক্ষনীয়।
এমন পাগলা বয়স, ঘুমরাত্তিরে মাটির বাঁশিবুকে ঘুমাইতে পারি না, পাপ স্পর্শ কওে না চোখের পাতায়— পানশালায় সাতাইশ বছর পইড়া আছি, বেহায়া বাতাস পিছন ছাড়ে না—অনুভূতির রহস্য আছড়ে পড়ে বুকে দুঃখের দেয়ালে ধাক্কা মারে—; পৃথিবীর বুকে ঘুটঘুটে আন্ধার নিয়া অনিচ্ছায় শুইয়া থাকি কত কত বছর; চোখের লাই ভাঙে না—পুঁথির গয়না পরি সাঁঝবেলায় শামুকের ভিতর দিঘির ঢেউ গুনি—; ইন্দ্রপাশা গ্রামের মেলায় পাশা শিকারিদেও সঙ্গে পাশা-পাশা খেলি, ঘুম আসে না; ধুলামাখা চাকতির মতো শবরীর স্তন, সবই কলকব্জা মনে হয়, ছেউরিয়ার ঘাটে সিকিচাঁদ পইড়া থাকে দিঘল দৃষ্টির আড়ালে—এসব আমার চোক্ষে ধরে না। ময়নামতির বৃক্ষ-ডালে মধুরাত্তিরে, জলপ্রণয়ী পাখিসাঁতারও ভালো লাগে না, লাঙলের ঘষা খাওয়া রেখাহীন হাত দেইখা-দেইখা মানুষ-জন্ম ভুইলা যাই আদি-আদিম—একই ঘৃণা কামশ্বাস—কোত্থাও ভালোবাসা নাই। পদ্মা-সুরমা-কুশিয়ারা-আগুনমুহা কত কত নদী নাম বুকে বাজে না, ঘুম আসে না, একবার কমলদহে প্রিয়তমার শরীর দাহ হলে কমলারঙের আগুন ছড়ায়েছিল পূর্নতোয়ার জলে; আর আমি সেই দিন থেইকা সাঁতার কাটছি আগুন-জলের ভিতর, তাতেও মৃত্যু আসে না। এমন পৃথিবীতে ঘুম আসে না-মৃত্যু আসে না। [কবিতা : যখন রাত্তির নাইমা আসে সুবর্ণনগরে : ১]
কবি কবির হুমায়ূন কবিতায় ব্যক্তিগত অনুভবে কবিতাকে শিল্পপ্রসাদে শুদ্ধ হয়ে সমকালীন চেতনা নিয়ে উপস্থিত হন। তাঁর কবিতায় নিঃসঙ্গতাবোধ ও বস্তুবাদী ছায়ার মাঝেও সুস্থ চিন্তাার সুর অনুরণিত হয় এবং জীবনের কান্না, বিকৃতিবোধ, বিষমিষা নিয়ে জীবনকে যাপন করে সুখজ স্বপ্নীল প্রতাশার চিত্র দেখতে পাই।
সিঁড়ি ভাঙি, সিঁড়ি রাখি, আকালে পড়িয়া আমি বাসা বান্দি পথে হিমালয়ে কথা বলে, নাচে আর রাম খায় চড়িয়া সোনার রথে। ও-দেহ কোথায় এলি! চারদিকে প্রপাগ্যান্ডা আলোতে বাজায় বাহু নিশি যায়— নিশি আসে, ভিভা শুধু দোল খায় মগজে গাঁথিয়া রাহু। কেগো কন্যা হলুদ বরণ মুখ, শিথাং-এ যাও রাখিয়া দীর্ঘ পা হাসিতে আসর জমে, হাসিতে মাতাল চোখ বলো, যাবে কি বানানা? যাবে মানে যেতে হয়, দেহেতে আগুন জ¦লে পরবাসী স্রোতে এ কন্যা সে কন্যা নয়, পেখমে ফণার বিষ বুঝা গেল নিশুতি-রাতে। [কবিতা : প্রপাগান্ডা]
কবি জফির সেতু শৈশবে বেড়ে ওঠা হাওরের অবধারিত প্রকৃতি ও নিঃসর্গের সিয়রে এবং পারিবারিক অনুসঙে প্রেম ও ঋতুবোধ সারল্যের সংবেদনশীল কবি। তাঁর কবিতার ভাষা ৫০ থেকে ৭৯ দশকের কবিদের মতো সাবলীল হলে ছান্দসিক ও নান্দিকতার সৌকর্যই তাঁর কবিতার ভুবন। তাঁর কবিতায় পুরুষপ্রকৃতি শিশ্নপরায়ণ হলেও কামুক নয়, কবি ও রমণী উভয়ে সেখানে আদিপ্রাকৃত ইতিহাসের অংশ। তাঁর কাব্যে মিথ-পুরাণ-সভ্যতার এক ধরণের সম্মিলনে আলো ও আশাজাগানিয়া পৃষ্ঠায় একটি নিজস্ব বয়ান নির্মিত হয় এবং বিনির্মাণ চলে কবিতার প্রান্তরে।
উঠোনে কবুতরের রক্ত সারা বুবুর হাতে কাঁপছে নীল পাখি এ-বছর তার বিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে কবুতরের চামড়া তুলে ফেলা হবে সারা বুবু জানে লাল ঠুকরো-মাংস রান্না হবে, বুবু জানে উচ্ছল হাতে বুবু তা পরিবেশন করবে সারা দুপুর আর একবাটি মাংস সে তুলে রাখবে অন্য কারো জন্য অন্য অনেকের জন্য উঠোনে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত বুবুর শাড়িতেও গরম লাল রক্ত, আঙুলের ফাঁকে তাকে কেমন ভয়ার্ত ও নির্বিকার দেখায় চৈত্রের দুপুরে সারা বুবু একটি নীলপাখি হয়ে কাঁপছে [কবিতা : দৃশ্য]
মোস্তাক আহমাদ দীন এর কবিতায় আত্মকেন্দ্রিক জীবন যাপনের আধুনিক ভাবনার বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে আসাার আকুতি ফুটে আসে। আধুনিক মায়াময় জাগতিক কবিচেতনায় সীমার মধ্যে অসীমানুভবের বেদনা এবং কথার অন্তরালে এক ধরণের মরমী চতনা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর কবিতায় জীবনের রহস্য সম্ভবনা থেকে জীবনের ইতিবাচকতার মর্মার্থ অধিগ্রহন করে।
স্থির করে আনো সেই দূরলক্ষ্য গৌরপ্রতিমাটি; আমার সকল বুঝি আজ ভেসে যায়— কৃষ্ণসূর্যের পথে কিছু অশনাক্ত লুণ্ঠনের বিন্দু বিন্দু কান্নার স্মৃতি মঙ্গোচিৎ বৃষ্টিতে ভেজে আমার এমন লব্ধি আজি কোন অর্থে যে ব্যথিত— ষড় গোস্বামীরা সেসব জানে না (কিছু জানে জয়দেব রাজ) তালিতাপ্পিতে ন্যস্ত করুন, আঙ্গুলগুলি দেখি আর ভাবি আমার স্ত্রী-আঙ্গুলটি যেন স্পর্শ করেছে রাজ কাঁকড়ার দেহ। [কবিতা : গৌর]
কবি শাহনাজ মুন্নী-র কবিতায় সৃষ্টিসত্তার অস্তিত্বকোরকে বেদনার ধারাজল প্রবাহিত হয় গতি ও প্রগতির সম্মিলনে। তাঁর কবিতা মরমী চেতনার রহস্য কুয়াশা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিনির্মাণ করে প্রতি পঙতি। কবি অন্তর্মুখীন ও অনুভূতিপ্রধান হওয়ার কারণে তাঁর দেখার বোধ ও বিশ্বাস সংসার ধর্মবোধ ও মানবের প্রেম আকাঙ্খার চিত্র কবিতায় ওঠে আসে বেদনা, ক্ষোভ ও সংক্ষুব্ধ চেতনা নিয়ে।
মাঝি, ভোর বিহান হইতে ঘাটে বইসা... পা আমার জলে ভাসে, আলতার রঙে ধরছে ঘুণ, জলের ঘুণ পোকা, কুটকুটায়া রঙ খায়... আলতার রঙ, মনের রঙ, বইসা আমি জল গুনি... ঢেউ গুনি, গো মাঝি... জীবনের ঢেউ... কানামাছি খেলে রইদ, ঘোমটা দেওয়া আঁচলের ফাঁকে আমি তো খুঁজি তোমার হাসি, ঐ ঢেউয়ে... গেল রাইতে স্বপনে দেহি, নাও তোমার, ঘাটে বান্ধা.. ঘরে আমার জোছনার আলো... দহনে পুড়ি আমি... পেঁচা ডাকে ভাঙে ঘুম! কই জোছনা! কই তোমার নাও, গো মাঝি! সূর্য ডুবে আমার চোক্ষের কোনায়, গড়ায় গড়ায় পড়ে তার আলো... মিলে গিয়া ঐ গাঙের জলে... আমি জল হইতে চাই মাঝি, সেই জলেই না হয় ভাসাইও তোমার নাও... [কবিতা : গাঙের টান]
কবি বায়তুল্লাহ কাদেরী-র কবিতায় লোকরীতির অনুসঙ্গে গভীর মর্মমূলে লুকিয়ে আছে মানবিক অবদমনের সরল জীবন। লোক আধুনিকতা এবং মাজার ও মরমী আধুনিকতা বোধের বাস্তবতায় মুক্তি হয়ত আছে। নগরের চোখে গ্রামীনতার উত্তরণে সেই অবদমনকে শিল্পরূপে জীবনের স্বরূপ ও সম্ভবনার ইতিবাচকতাকে চিত্রকাল্পিক গভীরতায় তুলে আনেন।
হোসেনের লহু-রঙ বর্ষা যদি কোনদিন নামে এই পানির শহওে, তেড়ে আসে হানিফা সুহৃদ তার অন্তরের বশে, জানি এক তরল এজিদ খুঁড়বে বৃষ্টির গর্ত, আমাদের রক্ত-বীর্য-ঘামে যে সোনার রঙ লিখেছিনু মুছবে সে বেয়াদব কুয়াশার যত্নে। আমি এই প্রিয় বর্ষাকে কেবল আত্মায় জমিয়ে রাখি, পিঞ্জরের সুবর্ণ শেকল ভেঙে জল ওঠে, চতৃর্দিকে দুষ্ট পানির আহব। এমনই বর্ষার তীর বিদ্ধ কওে রাধিকা রঙের আমার এ প্রিয় দুলদুল, কষ্টার্জিত নদী ঝরে বিবশ আঙুলে, কোথা গো রঙিন কৃষ্ণ, চরাচরে বুঝি তুমি ইস্রাফিল, আমার বুকের কিয়ামত ওঠোও বাঁশিতে? যেদিন বাতাসে শুধু মো’রমের ঘ্রাণ, জানবে আমার বাড়িতে সেদিন জিয়াফত। [কবিতা : বর্ষা ৭]
নব্বই দশক জুড়ে এক ঝাঁক তরুন প্রতিভাময় উজ্জ্বল কবি। এই দশকে কবির আগমণ যথেষ্টই, এদের মধ্যে আরও কবি হচ্ছেন : অদিতি ফাগ্লনী, অলকা নন্দিতা, আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ, আমিনুল ইসলাম, আমিনুল রানা, আমীর খসরু স্বপন, আয়শা ঝর্ণা, আশরাফ রোকন, আশিক আকবর, আশিক সালাম, আহমেদ নকিব, আহমেদ মুজিব, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, ঈশান জয়দ্রথ, কাজী জহিরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, কামরুজ্জামান কামু, কামরুল বাহার আরিফ, কুমার চক্রবর্তী, খলিল মজিদ, খোকন মাহমুদ, গাজী আলমগীর, জলিল আহমেদ, জহির হাসান, জাকির আবু জাফর, জাফর আহমেদ রাশেদ, জামসেদ ওয়াজেদ, জুনান নাশিত, জেনিস মাহমুন, জ্যাকি ইসলাম, তপন বাগচী, তাপস গায়েন, তুষার গায়েন, তৌফিক জহুর, নান্নু মাহবুব, প্রাঁশু প্রাপন, প্রত্যয় জসীম, ফাতিমা তামান্না, ফাহিম ফিরোজ, বদরে মুনীর, বায়েজীদ মাহমুব, বিপ্লব ফারুক, বীরেন মুখার্জী, ব্রাত্য রাইসু, মতিন রায়হান, মনসুর আজিজ, মশিউর রহমান খান, মহিবুর রহিম, মাতিয়ার রাফায়েল, মামুন মিজান, মামুন মোস্তফা, মারজুক রাসেল, মারুফুল আলম, মাসুদ মুস্তাফিজ, মাসুদার রহমান, মাসুদুল হক, মাহবুব আজীজ, মাহবুব কবির, মাহবুব মোর্শেদ, মিজান খন্দকার, মিলু শামস, মিহির মুসাকী, মোহাম্মদ আবদুল বাতেন, রওশন ঝুনু, রণক মুহাম্মদ রফিক, রনজু রাইম, রহমান হেনরী, রাজা সহিদুল আসলাম, রাজু আলীম, রাশেদ রহমান, রাসেল আশেকী, রায়হান রাইন, রিষিণ পরিমল, রোকসানা আফরিন, লীসা অতন্দ্রিলা, শওকত হোসেন, শাকিল রিয়াজ, শান্তা মারিয়া, শামীম সিদ্দিকী, শামীমুল হক শামীম, শাহীন মোমতাজ, শাহেদ শাফায়েত, শিবলি সাদিক, শিবলী মোকতাদির, শেলী নাজ, শোয়াইব জিবরান, সন্তোষ ঢালী, সমর চক্রবর্তী, সরিফা সালোয়া ডিনা, সাইমন জাকারিয়া, সাখাওয়াত টিপু, শাহেদ কায়েস, সায়ীদ আবু বকর, সিদ্ধার্থ হক, সুমন সরদার, সৈকত হাবিব, সৈয়দ শাহীন রিজভী, সৌমিত্র দেব, হাদিউল ইসলাম, হাবিব সিদ্দিকী, হামিদ রায়হান, হাসান আল আব্দুল্লাহ, হাসান মাহমুদ, হেনরী স্বপন প্রমুখ।
নব্বইয়ের দশকের পর আরও দুই দশকের অধিক সময় অতিক্রান্ত, দশকের অনেক কবি এখনও সক্রিয়, শুরুর দিকে বিচ্ছিন্নতা ও অস্থিরতা কাটিয়ে তারা এখন স্থিতধী ও পরিণত, তাই তাঁদের নতুন কবিতা এখন আরও বেশি পাঠকদের আকৃষ্ট করে চলছে, যেমন করে— বাউলরা একতারা বাজাচ্ছে; শিল্পীরা ছবি আঁকছে…
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা :
১। রুপান্তর আশির দশকের কবিতা— গাজী রফিক
২। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারার কবিতা প্রকরণ ও প্রবণতা পর্যবেক্ষণ— শিমুল মাহমুদ
৩। নির্বাচিত বাংলা কবিতা : নব্বই দশক— সম্পাদনায়, সুমন সরদার
৪। নব্বই দশকের নির্বাচিত কবিতা— সম্পাদনায়, রবিউল মানিক
৫। নব্বই দশকের কবিতা— সম্পাদনায়, মাহমুদ কামাল ও মোহাম্মদ আবদুল মাননান
৬। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠকবিতা— সম্পাদনায়, অরবিন্দ চক্রবর্তী
৭। বাংলাদেশের কবিতা, নন্দনতত্ত্ব ও জীবনার্থ সন্ধান— ড. রহমান হাবিব
৮। ইন্টানেটের বিভিন্ন ব্লগ ও ওয়েবজিন।
ঋজু রেজওয়ান কবি ও প্রাবন্ধিক জন্মস্থান : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। নিজ ঠিকানা : প্রিয়কাটি, ডামুড্যা, শরীয়তপুর। পেশা : সরকারি চাকুরী।