খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান শেষবার আমি সত্য উচ্চারণ করেছি খনার কর্তিত জিহবায় তোমরা কী আমাকে এখন চেনো আর, অনেক আগেই আমি ছেড়ে গেছি তোমাদের বিস্ময়-ভার.... বলা ভালো ছাড়িয়ে গেছি আমি পরস্পরের দ্রোহের সংসার, কে পায় আমাকে আজ?? যখন আপনা মাংসে হরিণা বৈরী তখনো চর্যাপদের সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ-জুড়ে আমারই কায়া-তরু-বর-পাঞ্চ-বি -ডাল মেলে দিয়েছে চৌষট্টি পাখুড়ি..... মধ্যযুগে দেড়শত বছরের অন্ধকার বুকে নিয়ে অন্য কেউ নয়, একা আমি মর্মতলে ধরে আছি শূনযপুরাণ আর মহুয়া মদিনার আত্মপীড়নের স্মৃতিগাথা। ভারতচন্দ্রের আদি রসের অর্গল ভেঙে রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য একা নয় শুধু অরণ্যবন্দী বাতাসের চাপা দীর্ঘশ্বাসের মতো আমরা অনেকে যুথবদ্ধ বেরিয়ে পড়েছি শেষের কবিতার জ্যোৎস্নালোকে.... নিজের নির্জনে পলায়নপর অমিত রায় আত্মপ্রেমে ভাসিয়ে দু’কূল তেইশ বসন্তে জেনে যায় শরীর সর্বস্ব নয় পবিত্র এক ধর্মগ্রন্থের ন্যায় হৃদয়ই পাঠ্য প্রথম—— গ্রহণের চাঁদের মতো শরীরের আড়াল থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছে যখন হৃদয় শাপগ্রস্ত ঋষি রাজন্যের পাপে তখন নগরী কাঁদে প্রচণ্ড খরায়—- তখনো তপস্বী ও তরঙ্গিনীর খর ভূমিতে দাঁড়িয়ে আমার মতো কেউ একজন ঋষ্যমুক পর্বত থেকে ডেকে আনে বৃষ্টির দেবতা আর্দ্র করে মহাপৃথিবীর করতল..... যুদ্ধ আর মহামারীর মতো উত্তর তিরিশের দ্বিধা ও সন্দেহের চাকতি নিক্ষেপ শেষ হলে মধ্য সমুদ্রের দিশেহীন হালভাঙা নাবিকের মনে দারুচিনি দ্বীপের মতন জেগে ওঠে নাটোরের বনলতা সেন...... দু’চোখে তার সবুজ ঘাসের দেশ, শান্তির নীড়; আমি না ছাড়ি বিশ্বাস আমাকে না ছাড়ে অবিশ্বাস এ রকম মেঘকৃষ্ণ দ্বিধার কাল যখন তখনও পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক চিলপুরুষের ইচ্ছের বলয়ে কাঁদে নামগন্ধহীন এই তুচ্ছ জীবন না বিংশ শতাব্দী, না একুশ শতক উত্তর-আধুনিক সময়ের সাম্পান যখন কবিতার ঐতিহ্যেই—- ভাসমান; তখনো আত্মপীড়নের ক্রান্তিকুলায় ভিক্ষাপাত্র হাতে কেবলি আমি খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান; ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান, ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান......॥ রিডো রিভার ও বিপন্ন এক রাধে জল ছুঁতেই আজ রিডো রিভার চমকে ওঠে বেশ দেউড়ি থেকে দৌঁড়ে এলো কালিগঙ্গার শিস, জলের ভেতর পায়ের নাচন চলে অবিরত দেহে আমার লীলাবতী, লজ্জাবতী শত। কে দ্যাখে—-কার,ঠমকখানি পায়ে-মোড়া জল পায়ে পায়ে বাজে এবার শ্যাওলা-সবুজ মল, স্পর্শ পেয়ে ভাঙ্গে পাথর,পরম্পরা একা স্রোতের মুখে আবদ্ধ জল ছুটছে আঁকা-বাঁকা। টপ্পা কিংবা দাদরা মিলে লাগে জলে-কাঁপন, প্রাণে আমার শার্লি-শুশু,আরো প্রিয় রিটন। বাণীর মোহে গাইছে সে গান—পিপাসা-প্রণয়ে রাগ-রাগিনী বসত করে উদাসী হৃদয়ে তৃষ্ণাজলে ঢেউগুলো আজ ভাঙে দুধারে শব্দে-ছন্দে জাগে ছড়া অন্ত্যমিলের জ্বরে… চিত্রশিল্পী ম্যারী সেদিন কাঁপছিলো খুব ভয়ে, জুলিয়া তার সঙ্গী ছিলো পতনবিহীন জয়ে পথের বন্ধু,নয় শুধু নয়,রয়েই যাবে পথে মনেও তারা বাঁধে বাসা সবার অলক্ষ্যতে হৃদয় যখন উদাসী এক শূন্য-প্রেমের মোহ, করুণ রসের কবিতা যে খুব টানে অহরহ…॥ বিদায় বেলায় নদীও বুঝি একাকিনী কাঁদে অশ্রুজলে, শ্বাসাঘাতে মৃত্যুর আগে প্রেম এলো (কবি জালাল উদ্দিন রুমী স্মরণে) মৃত্যুর আগে ঐ প্রেম এসে বললো: আমাকে রাখো: আমি হেসে বললাম, ছিঃ—কী—-বলছো এসব তুমি? সে বললো: জানোই তো তুমি,আমি খুব ইনোসেন্ট! হও ইনোসেন্ট,ইতিউতি কিছুতে যে, নেই আমি—- এখন আমি দয়াল-সাধিকা,ভক্তি রসে অধরা তার কাছে যেতেই পুলসিরাতের পথ খুঁজছি… সে বললো : আমি হলাম বিরহিনীর মায়া-সাঁকো, আমাতেই ভর করে,যেতে হবে ঐ দূরের পথ—- দেখো না, শত সহস্র পথচারীর এ-পদচ্ছাপ আমার হৃদয় তরঙ্গে বয়ে যাচ্ছে যে— ঢেউ তুলে। আমি বললাম—এখন আমার অনেক বয়স, তোমাকে আমার জানি নেই আর কোনো প্রয়োজন? দৃঢ়কণ্ঠে এবার বললো: তুমি অনিত্য,অনিতা নশ্বর ও নাশশীল—সহজে ভঙ্গুর দেহলতা… আমি না থাকলে,পৃথিবী উন্মাদ —কেউ নও তুমি। আমি আছি বলে,সর্বভূতে উত্তাল—তুমিই হও ঈশ্বর প্রণয়ে ছোঁয়া চিরন্তন ভাটিয়ালি গান॥ সবুজ গলিয়ে সবুজ গলিয়ে চোখের গোলক দুটো ঢুকে গেলো বনের গভীরে..... পড়ন্ত সূর্যের গোধূলি আলো পিছু নিলো তার, খোল-করতালসহ বেজে ওঠে মাটির খন্জনা, নবীন পাতাদের কোলাহলে বাজে আনন্দ-করতালি। শেকড়ের সঙ্গে দৌঁড়-ঝাঁপ, লম্ফ-ঝম্প শেষে মেপল বীথির ঝরাপাতা মাড়িয়ে দিব্যি তারা ঘুরে এলো পাইন বনের এ মাথা ও মাথা, কিছু কিছু শস্যের সীমানা প্রাচীর নেই জেনে আদিগন্ত সবুজেরা হেসে কুটিপাটি; ধাবমান মায়াবী হরিণ দেখে অবাক চোখে চেয়ে থাকে বুনো আপেলের দল। সেদিনের সেসব শ্রুতি যেন লম্বা এক বনস্পতি ভোঁ দৌঁড়ে মিলিয়ে গেলো সেণ্ট লরার আদুরে জলের সরোবরে..... একটুখানি গন্ধ একটু খানি গন্ধ দাও না, স্মৃতি বাজি রাখি জীবন পোড়া গন্ধ পেলে জীবনে ফের একলা জেগে উঠি। রাতগুলো হায় থোকা থোকা আধাঁর-ছোঁয়া কালো গোলাপ ফুল মরণ-ছোঁয়া পাপড়ি গুলো তাৎক্ষণিকে ঝরছে যে ব্যাকুল স্বপ্ন আমার ধীবর জালে আটকে আছে আগামীর এক হাটে সাত সমুদ্দর পারি দিয়ে যাবো আমি ব্রহ্মপুত্রের কূলহারা সে ঘাটে, মাল্লাবিহীন নৌকা আমার চলবে বাতাস কেটে অন্ধজনে ফিরে যেমন বাটে, নীলের পরে নির্ভরতা আকাশ যেমন জানে শ্রাবণ এলে কেউ বুঝি তা মানে হারানো সে হাসির ঝরণা হেসে উঠুক মনে হঠাৎ আসা নতুন জলের বানে... ছুঁয়ে দেখো ছুঁয়ে দেখো,কত স্পর্শ পড়ে আছে ত্বকে,আত্মায় বাঁধেনি ঘর মৃত মাছিদের আদর শেষে, নারীর শরীর ছুঁয়ে-ছেনে যেটুকু থাকে প্রাচীন… তার গায়ে শ্যাওলা-জমা মানবত্মার শোষিত-কোরাস আজো শুনতে পাই আমি রাতের গভীরে… স্বপ্নে কিংবা স্বপ্নের বাইরে দাড়িয়ে—- শোন তবে, প্রত্নতত্ত্বের নিধুবনে অবিশ্রান্ত সময়ের গান। শরীরে কতটা মাটি শরীরে কতটা মাটি মেখে নিলে আমি জমি হবো? চাষের ক্ষেতের ঘাস অথবা শস্যের মাঠ! নয়তো আইলে পড়ে থাকা তুচ্ছ অচেনা সবুজ আমি সেরকম শব্দবীজের অপেক্ষা করি আজো… আমি তো মোটেও হতে চাই না মাটির খানা-দানা কেঁচোমাটি নয়—- ধুলোমাটি নয় পৃথিবীর অসামান্য আয়ু বয়ে নিয়ে শব্দশস্যে,নিত্যানন্দে স্বপ্নময় ভোর হতে চাই… যদিও আমার শরীরিক মাটি কর্ষণ করেই দুই মিলিয়ন শস্য একদা বাজারজাত করেছিলো এক মস্তকবি অতপর, দেবোলোকে উর্বশীর—নয়তো রম্ভার ধ্যানস্থ সে—- অথবা হতেই পারে— আমার জন্যে তার প্রতীক্ষা সেখানেও অবিশ্রান্ত… ভোরগুলো দেখি না এখন দেশভাগে যেমন দৃষ্টির বাইরে চলে যায় জন্মের পুরোনো ভিটেমাটি, সেরকম আকুল-করা অপরাহ্নে আমারও ভাগ হয়ে গেছে সব—- অনুরাগের বাকীটুকু ঝুলে আছে দিগন্তের কাঁটাতারে—— মলিন দুপুরগুলো আমার ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে—- শৈশবের ছায়ারঙে আঁকা জয়নুলের ছবির মতো চেয়ে চেয়ে দেখি, আর ভাবি—এতো নয় আমার সময়! অন্য কারু! অন্য কারুর সময়। নদীগুলো আমার নয়, না ব্রহ্মপুত্র, না কালিগঙ্গা। এখানে আমি জলে ডাঙ্গায় অবিমিশ্র এক অতিথি নেই কোনো সমকালিন সুধা কিংবা ভবিষ্যতের নেশা প্রাণহীন অতীতের হাজারো রঙিন প্রজাপতির মধ্যে— আমিও বুঝি এক মমি… জানি, খুঁজেও পাবো না সেই দখিনের মলয় বাতাস, শরীর-উদোম-করা শিশুর উন্মত্ত হাসির জোয়ার রাতগুলো কালো ক্যানভাসে যেন শাদা শাড়ির উড়াল অনন্তের তর্ক-বিলাসে স্মৃতিরা বেষ্টিত বুঝি মন্থরতায়। প্রণয়ের বিভূতিটুকু গোধূলি আলোর মতো গলে গলে সমুদ্রকুল ডুবে যায়—— নিত্য ভোরের নতুন আভায়। সকালের স্বরবৃত্ত তোমার সঙ্গে বিরোধ আমার লেগেই আছে—শুরু থেকে মনের মধ্যে খিটিমিটি, জল তরঙ্গে কৃপা দৃষ্টি চিত্রকল্পে কথার খড়গ শ্বাসাঘাতে প্রণয়-যোগ তবুয়ো তুমি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখো সবার শেষে। যখন তখন বাগড়া বাঁধাও সকাল-সাঁজে যাচ্ছেতাই-ব্যবহারে তুমিও যে কী বাজে! তোমার পায়ে সমর্পনে যখনই আমি ইচ্ছে রাখি দূর আকাশে উড়িয়ে দাও অজুহাতের অযুত পাখি। নিবেদনের আর্তি আমার যায় ভেসে যায় নিরবধি তুমি ছাড়া শব্দদ্বীপে নেই যে আমার অন্য গতি। নিদয়াল তুমি দয়াল,চোখে জল আসে তোমার নামে, যে দিকে ফেরাই চোখ তোমাকেই দেখি নয়নে নয়ন, সব পথ শেষ হয় তবু তোমারই বুকের গানে। স্মৃতির ঝর্ণাতলায় আজো তো বিরহে অচঞ্চল,ভিজে যাচ্ছি পুড়ে যাচ্ছি, নিভে ভিজে যাচ্ছি রোজ দহনেও একি অপরূপ তুমি প্রেমে ও পূজোয়।
দিলারা হাফিজ
১৯৫৫ সালের ২০ নভেম্বর মানিকগন্জের গড়পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা বখশী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, মা রহিমাহাফিজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি. এ অনার্স ও এম এ করেছেন।১৯৮০ সালে ডিপ-ইন-এড এ তিনি প্রথমশ্রেণী পান।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বইউজিসির স্কলারশিপে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৯৮ সালে। ৩৭ বছর শিক্ষকতা জীবনে সরকারি কুমুদিনী কলেজ, ইডেন কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যায় ছাড়াও মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন।সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যানহিসেবে চাকুরি থেকে অবসরে যান।অধ্যাপনার পাশাপাশি দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণে বিটিভির বহুল প্রচারিত ও জননন্দিত গণশিক্ষামূলক অনুষ্ঠান “সবারজন্যে শিক্ষা” গবেষণা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছেন ২২ বছর।দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুনিজ অঞ্চলের পশ্চাৎপদ শিশুদের প্রতিভা বিকাশ ওসার্বিক উন্নয়নে গড়ে তুলেছেন ‘মানিকগঞ্জ শিশুফোরাম’।১৯৯৫ সাল থেকে তিনি এই ফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
ভালোবাসার কবিতা(১৯৮২), পিতা কিংবা পুত্র অথবা প্রেমিক(১৯৮৩), প্রেমের কবিতা(১৯৯৮), কে নেবে দায়(২০০১), খুঁজে ফিরি ভিক্ষালব্ধ জ্ঞান(২০১২), নির্বাচিত কবিতা( প্রথম প্রকাশ: ২০০৬) ৫ম সংস্করণ:(২০১১), অবিনশ্বর আয়না(২০১৮), নারী সংহিতা(২০১৯) , কবিতা সমগ্র(২০২১), স্তনের অহংকার-(২০২২), মনোকষ্ট হচ্ছে, স্নান করো (প্রকাশিতব্য)
প্রকাশিত গদ্য: সুষমার গল্প( শিশুতোষ—২০১৯),গবেষণা গ্রন্থ: বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ(১৯৪৭–৭১), আনন্দ বেদনা যজ্ঞে রফিক আজাদ( ২০১৮) চিত্রা প্রকাশনী।(স্মৃতি গদ্য), কে প্রথম কাছে এসেছি ( ২০২০) (স্মৃতি উপন্যাস),
সম্পাদনা:
মুখোমুখি রফিক আজাদ( ২০১৮), গদ্যের গহন অরণ্যে(২০১৯)
অনুবাদ:
মার্কিন কবি ক্যারোলাইন রাইট ও ভারতীয় বহুভাষাবিদ পণ্ডিত শ্যাম সিং শশী নারী অধিকার সম্পর্কিত তাঁর অনেক কবিতার অনুবাদ করেছেন।
সম্মাননা:
১৯৮৩ সালে কবিতার জন্যে লা ফর্তিনা সম্মাননা, ২০১১ সালে মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সংস্কৃতিক পরিষদ সম্মাননা, (প্রদান করেন নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেন) ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও নেপাল ফ্রেণ্ডশীপ সম্মাননা, প্রথম আলো( কলকাতা)কবিতা-সম্মাননা (২০১৯)
ব্যক্তিগত জীবনে দুই পুত্র সন্তান অভিন্ন ও অব্যয় এর জননী কবি দিলারা হাফিজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ( প্রয়াত) মর্ম ও কর্মসহচরী ছিলেন।