
অধিকার সমগ্র পৃথিবী নয়, একটি তৃণের অধিকারই যথেষ্ট আমার। যেন একটি রোমের ছোট্ট কূপে মধুপের আলতো ফুঁয়ে নিমেষেই ঢুকে যেতে পারি। যেন বেজে উঠি ওই হাড়ের বাঁশিতে একা, চুপে; ভেসে যাই সুর হয়ে—ঝরে-পড়া পাতার সওয়ারি... ঢেউ আমি যার ভাবনাতেও নাই, কেন তাকে নিয়ে ভেবে হয়েছি অস্থির? আজ বলে যাও তুমি ঢেউ, আরও একটু কাছে এসে। জানি, এখনই বাতাস মুছে নেবে ফেনিল হাসিটি মুখ থেকে। এই পৃথিবী তোমারও কথা যে না শুনে ফেরে, ব্যথা পাও মানুষ হিশেবে? টলমল গাছগুলি প্রশ্নব্যাংক। প্রশ্নের মতন পাতা ঝরে। সব পাতা ভিজে যায়—ভেসে যায় নদীর ওপরে। নদী কি উত্তর দেয়? চিঠি লেখে মেঘের সমীপে? কত যে নরম মেঘ—বুঝতে চেয়ো না শরীর টিপে। শরীরে শিশির-মন—সারাক্ষণ শুধু টলমল— এই বুঝি খসে যাবে, তাই কাঁপে ঘাসের অঞ্চল। হসন্ত খসখসে ঠোঁট, পাতা-মরমর গাছে— তবু কেন আসে চির-গরবর বসন্ত? কথা কিছু নাই আজ, ব্যথা যেন আছে— শব্দের পায় থমকে দাঁড়ায় হসন্ত। কোনো বই আর পড়বার তাড়া নাই, তবুও পড়তে চায় বুঝি প্রেমে কান্তারা! ফুসলানো হাওয়া দেয় উসকানি তাই— লেখো চিঠি তুমি বুড়োদের অভিধান ছাড়া। অনঙ্গ রূপের দেশে সুচ এক, সুতো ছাড়া, যুবতীর আঙুলে সে নাচে; খেলে যায় ডুব-সাঁতারের খেলা—কাঁথার সমুদ্রে—সারাদিন। পৃথিবীতে কিছু ফুটল না ফুল, যত্নে শুধু আঁকা হলো; অরোরা-রাতের স্বপ্ন বুঝল না কেউ। আমি সুতো, গুটলি পাকানো, কেবলই গড়িয়ে যাই— যদিও জড়াতে চাই, পড়ি গিয়ে জলে। দেখি ঢেউ, অর্থহীন আদিম উল্লাস। সে উল্লাসে নারীরা প্রহার ভোলে, পুরুষও ছলনা। শিখার কবলে পড়ে তাই পুড়ে গেল বায়ু, আগুনেরও আয়ু ফুরালো কি হাওয়ার ছোবলে? শেষ হলো দাবানল... কখন ডানার ভস্ম ছেয়ে যায় আকাশদুপুর বিষণ্ন ব্যাধের বুকে, চেয়ে দ্যাখো পাখি, বিঁধেছে এ কোন ব্যাসকূট? মর্ম-পরিযায়ী তুমি, ধুপছায়াময়— ফেলে গেছ এইখানে খড়ের নূপুর। পাঠ যে ভাষা মরে মুছে গেল তিন হাজার বছর আগে যে ভাষায় গাইলে তুমি একা বসে গান বোবা পাহাড়ের বিষণ্ন চূড়ায় উঠে তার কোনো লিপি, রেখাচিত্র পাথরের গায়ে যদি লেখা নাও থাকে, কোনো বাজপাখি উড়ে এসে তার সাক্ষ্য যদি নাও দেয় শান্ত দুপুরের রৌদ্র-বিলাবলে সহসা মেঘের ধূসর ইঙ্গিতে এইখানে ভেসে এলে তুমি বৃষ্টির ফোঁটার মতো। আজকে এই ডুমুরগাছের পাতায় এত যে আলেখ্য, এত যে আখ্যান, জেগে উঠছে কীটের অক্ষরে, ফুটে উঠছে বনের চিন্তার বাইরে বিচিত্র ফুল ও ফুলের বিভ্রম আর উড়ে যাচ্ছে যেসব গান, কিচিরমিচিরে মুচড়ে যাওয়া ব্যথিত হাওয়ার নির্জন পৃষ্ঠায় স্নিগ্ধ কোনো জলাবনের ধারে তুমি তা পড়তে গিয়ে আমাকে পাঠ করতে পারছ কি? বৈকালিকী গজারি বনের ভেতর ৩৬ গজ হেঁটে পার হলেও যে শব্দ পাতার মর্মরে বেজে ওঠে না কারো অসতর্ক পায়ে, ঘুমন্ত বিকেলের আয়না এড়িয়ে যাবার সময় বিশেষত একটি জানালার পাশ দিয়ে, চমকে উঠেছি আমি—থমকে গিয়েছি একেবারে— . এত যে অনৃত চিন্তা, এত যে দুরন্ত স্বপ্ন জংধরা পাল্লার কব্জা নাড়িয়ে জেগে উঠছে— যদি তুমি শুনতে, যদি দেখতে পেতে গজারি বনের ভেতর ধরাশায়ী কোনো গজের পিঠ থেকে তোমার গড়িয়ে পড়া—গড়িয়ে গড়িয়ে পড়া . আর আমার জড়িয়ে ধরা—পাতার মর্মরগুলো গা থেকে ধুলোর মতন সরিয়ে সরিয়ে... আবার ঘুমিয়ে পড়তে কি তুমি শিয়রে পলাশ কিংবা পারুল গাছটিকে রেখে? শিকার হরিণ-মুদ্রিত বন থেকে মুছে ফেল শিকারিকে। গাছের গুঁড়ির আড়ালেও যেন আর দেখা না যায় তাকে। বরং এসে দাঁড়ায় তোমার বাড়ির পেছনে। আর অবিরাম তির ছোড়ে—অসতর্ক, বুকের কপাট-খোলা ওই জানালায়। পথ ভুলে যাওয়া হরিণটিকে তখন করব আদর। এতটাই যে, নিশ্চিন্তে সে ঘুমিয়ে পড়বে নখর থাবার নিচে। সে ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখবে তুমি। শিখণ্ডিত অন্ধকারের রঙে ও রেখায় জেগে উঠল যে ছবি, সে আমার তুলিতে আঁকা নয়। রাত্রি, তোমার ভেতর তাপমান-যন্ত্রের মতো নিজেকে ডুবিয়ে এই সত্য লাভ হলো। দীর্ঘ ধূসর দেয়ালে বেগুনিবর্ণ একটা লম্বা দাগ কেটে চলে গেছে কেউ, সেমিট্রির পাশ দিয়ে, বিষণ্নতা-নাম্নী কোনো একগুঁয়ে বালিকার পিছনে পিছনে। সেই মেয়েটি এ দেশের নয়, তুমিই বলেছিলে। যে দেশে তার বাস, সেখানে শরতে শিশির তুহিন হয়ে ঝরে। ‘ওইসব আঙুলে ছুঁলেই—একবার—কোনোমতে আঙুলে ছুঁলেই—হয়ে যাবে ফ্রিজ—যাকে বলে ররফমুরতি, তুষারতনু। তারপর অণুতে অণুতে প্রিজমের প্রাণ—ছড়াবে অপার শূন্যে শিখীবাঁকা রঙধনু।’ আমি কি শুনতে পাব সেই ধনুকের টঙ্কার, প্রবাসের প্রদোষচূড়ায় উঠে কোনো একদিন? আমার স্খলিত বাক্য যার ভগ্নতির হয়ে ছুটে এসে, হে তমস্বিনী, পড়েছে পায়ের উপর লুটিয়ে তোমার। অভিশাপ আমাকে আঁচড় কেটে নির্মম দন্তস্ফুটের পর হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দত্রাসে যে বাঘিনী ছুটে পালিয়েছে ক্ষীয়মাণ অরণ্যের দিকে সে অরণ্য আমি আর দেখি না যে। তবু সেইখানে ধাবমান সব ছায়ার পিছনে এখনও হয়তো শোনা যায় সমুদ্রের আর্তস্বর। এরও বহুদিন পর অনেক কুহক ও কুয়াশা-ভোর পার ক’রে কুমারের হাঁড়িভাঙা কালো-ঘুম রাত্রিশেষে আঙিনায় দেখি কার ব্যগ্র পদচ্ছাপ? এই ফিরে আসা, ফের চলে যাওয়া—সে কি নয় একটি তৃণের তনুদগ্ধ অভিশাপ?

সোহেল হাসান গালিব
জন্ম: ১৫ নভেম্বর ১৯৭৮, টাঙ্গাইল।
সহযোগী অধ্যাপক ও প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ, নায়েম, ঢাকা।
সম্পাদক: ‘পরস্পর’ (সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক অনলাইন পোর্টাল)
প্রকাশিত বই :
কবিতা—
চৌষট্টি ডানার উড্ডয়ন [সমুত্থান, ২০০৭]
দ্বৈপায়ন বেদনার থেকে [শুদ্ধস্বর, ২০০৯]
রক্তমেমোরেন্ডাম [ভাষাচিত্র, ২০১১]
অনঙ্গ রূপের দেশে [আড়িয়াল, ২০১৪]
তিমিরে তারানা [অগ্রদূত, ২০১৭]
ফুঁ [বাতিঘর, ২০২০]
চৌষট্টি পাখুড়ি (আদর্শ, ২০২২)
দরজায় আইভিলতা [ঐতিহ্য, ২০২৩]
প্রেমের কবিতা [ক্রিয়েটিভ ঢাকা, ২০২৩]
প্রবন্ধ—
বাদ-মাগরিব (ভাষা-রাজনীতির গোপন পাঠ) [অগ্রদূত, ২০১৮]
সম্পাদিত গ্রন্থ—
শূন্যের কবিতা (প্রথম দশকের নির্বাচিত কবিতা) [বাঙলায়ন, ২০০৮]
কহনকথা (সেলিম আল দীনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার) [শুদ্ধস্বর, ২০০৮]
সম্পাদনা [সাহিত্যপত্রিকা] : ক্রান্তিক, বনপাংশুল।
Facebook Comments Box