রাত তখন সাড়ে তিনটা। এ নিয়ে এক রাতে ঘুম ভাঙছে নীলার তৃতীয়বারের মতো। বাইরে শুক্লপক্ষের অন্ধকারে ভেসে আসছে গলির পোস্টের লাইটের অস্পষ্ট আলো। নাইটির গাওনটা টেনে নিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে নীলা। সম্ভবত মাসের শেষের দিক। এ তল্লাটে সবাই চাকরিজীবী। মাস শেষের এই সময়টায় প্রায়ই গভীর রাতে ভেসে আসে দাম্পত্য জীবনের বহুমাত্রিক স্বাদ। নীলার ভেজাল নেই এইসবের। কিছু না ভেবেই মগভর্তি জল নিয়ে বেরিয়ে আসে সে বারান্দায়; আশ্বিন আসার আগের একটা শীতশীত ভাব নিয়ে বাতাসের ঝাপটা লাগছে যখন তখনই আসে আবার তীব্র চিৎকারটা।
কিছু সময় মনে হয় ঘরেই কেউ তার ঘরেই যেন চিৎকার করছে,
-কেন গিয়েছো?
-আমারতো যাওয়ারই কথা।
-আমি তো মানা করেছিলাম।
-আমি তোমার কাছে অনুমতি চাই নাই, কেবল জানিয়েছিলাম।
-বেশ, তবে এখন একেবারে চলে যাও!
সেই রাত দুইটায় বের হয়ে এসে আর ফেরা হয়নি ঘরে। আশ্চর্য এক অবস্থান থাকে দাম্পত্যে মেয়েদের।সে না জানে নিজের ঘর না জানে অবস্থান! অবশ্য ওভেন সারাই করতে এসে ছেলেটা বলছিল, ম্যাডাম যাই বলেন বেশি শিক্ষিত মেয়ে ভালো না! তারা বেশী বুঝে! এই মিস্ত্রি ছেলেটার সাথে নীলা তার বিছানা সঙ্গীর মানসিকতার কোনো পার্থক্য সেদিন পায় নাই!
এইসব অপ্রয়োজনের ফেরার কোনো মানে হয় না। কালো টিনের ঘরটার যে শিকের জানালায় বসে শৈশবে লগারিদম বুঝতে বুঝতে নীলার ক্লান্ত লাগতো, পাশে কদমের তলায় মাটির কাছাকাছি চুলায় মায়ের লালচে মুখটাই তখন বলতো যেন অজানা ভাষার কবিতা। সেই থেকে কবিতা পছন্দ তার! কঠিন করে আবার তখন সে বুঝতে শুরু করে সূচক আর থিতা। সেই সময়টায় নীলা একষট্টি নম্বর নিয়ে পাশ করে জীবনের কঠিনতম গণিতপাঠ।
গণিতের চেয়েও ভয়ংকর লাগছিলো যখন নীলা বন্ড সই করে, সকাল নয়টা দশ মিনিট তখন। পেপারের কিছুই না পড়ে পৃথিবীর কঠিনতম স্বাক্ষর দিয়ে দেয় সে! বৃদ্ধাঙ্গুলি জুড়ে নীলচে রঙটা নিয়ে নীলা ছুটছে এখন প্রতিদিনের আরও গন্তব্যে। জীবন গণিতের চেয়েও কঠিন!
এ নিয়ে দু’বার একরাতে এমন শব্দ আসছে। প্রথম সম্ভবত খাবার টেবিলে সমস্ত ছুঁড়ে মারছিল নিচের দম্পতি একে অন্যকে। তারা এসেছে এই বাড়িটায় এক মাস হলো; নীলার শোবার ঘরটার ঠিক নিচের ঘরটাই তাদের শোবার ঘর। একদিন দেখেছে নীলা ভদ্রমহিলাকে; টানটান ফর্সা রঙের অহংকারী একটা চেহারা। জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করে নীলাকে দেখে। নীলার অবশ্য এসব অহেতুক অহংকার না-দেখা অভ্যাস হয়ে গেছে। আজও প্রথম দিনের মতো নারীটি চিৎকার করছে আর তা ছাপিয়ে কুৎসিত কিছু আওয়াজ রাতের স্তব্ধতা ভেঙে আশেপাশের ফ্ল্যাটে আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নীলা চুলটা টেনে নিয়ে পিছনে একটা খোঁপা করে বেসিনের আয়নায় গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজেরে তখন কিশোরী লাগছে দেখতে।
মামা বাড়ির তাঁতঘরগুলোর মতো একটানা বেজে চলেছে মাথার ভিটরে একটা নাম। গোলাপি ঝুড়িতে জামা গুছিয়ে মা যেন তাদের ছুটছে তখন মামাবাড়ি, কী অদ্ভুত সে পথের নদীটা! কেমন একটা রেলের ব্রিজ লাল ইটের সিমেট্রি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নদীর বুক টনটনে করে। নৌকা থেকে গলা উঁচিয়ে আঙুল দিয়ে মা দেখাচ্ছে ব্রিজ কাকে বলে। ঘাটের কাছে মামারা দাঁড়িয়ে আছে গ্লুকোজ বিস্কিটের প্যাকেট হাতে নিয়ে এবং মামার কাঁধে ব্যাগ; আর মাইল দেড়েক মা হেঁটে চলছে আশ্বিনী দূর্গার মতো। কয়েক মুহুর্তে নীলার ফ্ল্যাটে চলে আসে সেই তাঁতঘরের মাক্কু, দাদুর পায়ের মাপ, হানাবো, সুতার ববিন, চর্কায় ঘূর্ণি মামীদের জীবন। তাঁতীপাড়ার ব্যস্ততা এখন কমে গেছে অনেক। শিমুলগাছ পেরিয়ে ঢোকার পথটা এখন আর গমগম করে না একটানা মাক্কুর টানে । শীর্ণ দুপুরে সে পাড়ার একটানা শব্দ চলে এসেছে যেন নীলার সিলিং এ। একটানা ডেকে চলেছে তার নাম!
তিনতলায় তারা এখনও চিৎকার করছে। এইসব জীবনের কী মানে হয়! জোর করে যে জীবন আনন্দহীন বেঁচে থাকতে বাধ্য করছে তার সুর কেমন নীলা জানে না। দাম্পত্য কী তবে সীমাহীন নিজেকে প্রহার করা! দুইজন অসুখী মানুষ কেমন করে বেঁচে আছে জানছে না কেউ; অথবা জানবে যারা তারাও অসুখী। শৈশবের পাড়ার আবু আর ছায়া দুই বোনের কথা মনে পড়ে প্রায়ই। নীলাদের লাগোয়া ঘোষ বাড়িটা তাদের। দুই বোনের চ্যাপ্টা পানপাতার মতো মুখ সাথে তামাটে রঙ, মাথায় তেলছাড়া একগুচ্ছ লাল চুল। বেশিরভাগ সময়ও দুই বোন গরু আর গোবর নিয়ে মাঠের দিকে দৌড়াত। ভাইদের সংসারে মায়ের সঙ্গে তারা ছনের ঘরটায় থাকতো। ছোট বেলায় স্কুলে যাবার সময়টায় কখনো কখনো আবুর চিৎকার শুনতো নীলা। সে কান্নার কোনো অর্থ নীলারা জানেনি। বড়ো হয়ে জেনেছে একটা করে সংসার তাদের আবু আর ছায়ারও ছিল। ভেঙ্গে গেলে তারা পাগল হয়ে যায়। এমন দাসত্ব তবে শারীরিক না মানসিক? তাদের মাখন টানার খুঁটিতে আবুকে বেঁধে রাখা হতো, পরনে ছায়া আর ব্লাওজ। জীর্ণ শরীরটার ঘাড় বাকিয়ে সে ডাকতো সবাইকে, ঠোঁট নেড়ে চেটে চেটে রক্তও খেয়ে নিতো। ছায়া তখনো আছে, যেদিন ফুলতোলা জর্জেট শাড়ি পরে ও বেরিয়ে যেতো, সেদিন আবু বেশি পাগলামি করতো। বেশ কয়েক বছর পর নীলার মায়ের কাছে ছায়া আসতো। তাদের বাড়ির পেছনের বড় গেইট পার হয়ে সে একটা ঘোষের দোকানে তাকিয়েই থাকতো। লোকটা আসতো না। আবার বিয়ে করে নিয়েছে ততোদিনে। মার কাছে কিছু সময় থেকে ছায়া আবার চলে যেতো। আরও কয়েক বছর পর ছায়াকেও খুঁটিতে বাঁধা হয়! এমনতর জীবনের আকাঙ্ক্ষাও তবে মানুষের হয়? হয়তো এটাই স্বাভাবিক যে জীবনে নীলা অভ্যস্ত হতে পারেনি তার বাইরেও একটা জীবন আছে যার খোঁজ কেউ রাখে না।
পাগলের সবচেয়ে সুবিধা সে পাগল। জীবন আর পৃথিবী তারে নতুন পৃথিবী দেখায়। সেখানে ভালো থাকারা অবাস্তব নয় হয়তো কিংবা অবাস্তবও ভালো থাকার নাম। মহাভারত নীলা পড়েছিলো, পৃথিবীতে জীবনের রাজনীতির চাইতে বড়ো ধর্ম নেই। নীলা বারান্দা মাড়িয়ে ঘরে ফিরে; জলটা খেয়ে আবার বিছানায় ফিরে আসে। ঘরটায় তখন অন্ধকার জমিয়ে নেমে আসে চারবছর আগের নীলার দাম্পত্য ঘরের রাত আর নিচতলায় হয়তো মিটে গেছে কলহ।

কবি
জন্ম তারিখ- ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪,নরসিংদী
উপপরিচালক
বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল
প