================================================================

================================================================
কথাটা যিনি লিখেছিলেন সেই কবীর সুমনের কথা দিয়েই এই লেখাটা শুরু হতে চাইছে। সুমন যে আমাদের সময়ের বাংলা গানের জগতে শ্রেষ্ঠতম প্রতিভা এই বিষয়ে আমার মনে অন্তত কোনও সংশয় নেই। সঙ্গীত বলতে আমি অন্তত যেটুকু বুঝি তাতে মনে হয় যে শুধু সুরের সম্মোহন সঙ্গীত হতে পারে না। বাণী হল সঙ্গীতের প্রধানতম অবলম্বন দুটির একটি,সুতরাং সঙ্গীতশ্রবণের ক্ষেত্রে সুরের থেকে বাণীর গুরুত্ব কম,এমন উদ্ভট তত্ত্বে আমি বিশ্বাস করিনা ; সত্যিই যদি কম হতো তাহলে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়টি বহুকাল আগেই আমাদের সময় থেকে মুছে যেত ; কিন্তু সেটা তো হচ্ছেই না বরং রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বেড়ে চলেছে বলেই দেখা যায়। অত:পর আমার প্রিয়তর সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন সম্বন্ধে আমার আগ্রহ এবং প্রশংসা প্রচুর। সেই কারণেই সুমনের অধিকাংশ লাইভ অনুষ্ঠানে, মানে যাকে বলা হয় একক অনুষ্ঠান, সেইসব অনুষ্ঠানে শ্রোতার আসনে আমার নিয়মিত অবস্থান অনেকেই দেখে থাকবেন। তেমনই একটা অনুষ্ঠানে সুমন তাঁর গানের ফাঁকে একবার বললেন যে, রবীন্দ্রনাথ যখন যা অনুভব করেছেন, তা-ই নাকি শিল্পমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এই কথাটাই পরে শুনলাম অধুনা বহুল পরিচিত চন্দ্রিল নামের এক চটুল ‘বুদ্ধিজীবী’র বক্তব্যে। চন্দ্রিলাদি ফালতু আঁতেলদের চিন্তার অগভীরতা নিয়ে বলার কিছু থাকতে পারে না, তাই বলব না ; কিন্তু কবীর সুমনেরও যে একই মতামত! তাই ভাবনা – চিন্তা করতেই হল। চিন্তা-ভাবনা, লেখাপড়া করে মনে হল, এই কথাটা অসম্পূর্ণতা দোষে দুষ্ট। রবি ঠাকুর অন্তত এমন কোনও প্রোজেক্ট ( চন্দ্রিলের কথায়) নিয়ে লিখতে বসেননি যে যখন যা মনে আসবে তখন তাই লিখে বসে থাকবেন। ওটা আমাদের পাশের পাড়ার কবি পাঁগোরাস,ওরফে শ্রী পাঁচুগোপাল রায় সর্দারের স্কিম হতে পারে কিন্তু কোনওভাবেই বিশ্বকবির প্রোজেক্ট হতে পারে না। তবে এসব কথা আসলে কথার পিঠে উঠে এল। আসল কথা হল সুমনের একক অনুষ্ঠান এবং সেইসব অনুষ্ঠানে সুমনের গানের ফাঁকে ফাঁকে বলে যাওয়া কথা থেকে তাঁর প্রতিরোধ, প্রতিবাদ। তিনি যেসব কথাবার্তা তাঁর গানের ফাঁকে ফাঁকে বলে চলেন সেগুলো শুনতে খুব ভালো লাগে। শুনলে গা গরম হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে মনে হয় এক্ষুনি বন্দুক – পিস্তল হাতে বিপ্লব করতে নেমে পড়ি। মুশকিল হল,অনুষ্ঠানের হাইপ যখন মন থেকে মুছে যায়,যখন নাটকীয় অনুষ্ঠান শেষে ক্যাটাস্ট্রপি শুরু হয় তখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারি এসব ফাঁকা আওয়াজের অন্ত:সারশূন্যতা। যে শূন্যতা, যে হতাশা ইদানীং আমার মতো সুমনপ্রেমীকে আচ্ছন্ন করে তুলেছে সেই শূন্যতার ভিতরেই লুকিয়ে আছে বর্তমান বাংলার প্রতিরোধ আর রাষ্ট্রক্ষমতার দ্বান্দ্বিক অবস্থানের জোচ্চুরি। জ্ঞান, ক্ষমতা, যৌনতা এই ত্রিভুজের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় দমন এবং তার প্রতিরোধের বিন্দুগুলোকে খতিয়ে দেখে যিনি এই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর দর্শনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নি:সন্দেহে সেই দার্শনিকের নাম মিশেল ফুকো। এই ফরাসি দার্শনিক তাঁর সন্দর্ভে জ্ঞান, ক্ষমতা আর যৌনতার ত্রিকোণ সম্পর্ককে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ক্ষমতা যেখানেই কাজ করে সেখানে অবশ্যই কাজ করবে প্রতিরোধ। এ যেন সেই নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র, কিন্তু প্রশ্ন হল ক্ষমতা কাজ করে কেন? এই প্রশ্নে ফ্রয়েড এবং ফুকোর অবস্থান বিপরীতপন্থী নয় আবার সরলরৈখিকও নয় একেবারেই। ফুকো মনে করেন ক্ষমতাস্পৃহাই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলে, কারণ ক্ষমতা মানুষকে যৌনতায় নিয়ে যায় আর ফ্রয়েড মনে করেন যৌনতা হল মানুষের প্রাথমিক চাহিদা, তাই যৌনতার দ্বারা উদ্দীপিত হয়ে মানুষ ক্ষমতা পেতে চায়। আমরা এই দুটো ভাবনা থেকে যদি ক্ষমতা ব্যাপারটাকে আলাদা করে নিতে চাই তাহলে বুঝব যে, ক্ষমতা আসলে সমাজের প্রতিটি বিন্দুতেই কাজ করতে থাকে। এখন বুঝতে হবে কোন ক্ষমতাকে আমরা দমন বলব আর কাকেই বা বলব প্রতিরোধ। এই জায়গায় একটি শব্দবন্ধকে খুবই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, সেটা হল রাষ্ট্রীয় দমন। আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রীয় দমন বললে কিন্তু ব্যাপারটা প্রকৃত বাস্তবে দাঁড়ায় না। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণের দ্বারা পরিচালিত, তাই খাতায় কলমে সেখানে শাসকের যেমন ক্ষমতা, বিরোধীরও তেমনই। মুশকিল হল আমাদের দেশে গণতন্ত্র ব্যাপারটা কেবল নামেই আছে। তাই শাসক আর প্রশাসন এখানে মিলেমিশে এক হয়ে যায় : কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! তাহলে এমন হয় কেন? আসলে আমাদের গোটা দেশটাই দুর্নীতিতে ডুবে গেছে। নীতিভ্রষ্ট এই দেশে যার যা করণীয় সে তা করে না বা করতে পারে না। এইরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের যে অংশের উপর দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল, সে শাসকের অস্ত্রে পরিণত হতে থাকে। তাই দমন আসতে থাকে শাসকের দিক থেকে। শুধু তাই নয়, এই ধরনের দমনক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সর্বোৎকৃষ্ট বাহিনী শাসকের হয়ে কাজ করতে শুরু করে। এবার কথা হল, এই যে দমন তার প্রভাব জনগণের উপর কীভাবে পড়ে? এক্ষেত্রে আমরা ফ্রানজ ফ্যানোঁর লেখা ‘ black skin,white mask’ বইটার কথা ভেবে নিতে পারি। এই বইতে কালোদের উপর সাদাচামড়ার ইউরোপীয়দের যে দমন বহুবছর ধরে চলেছিল তার প্রভাব কীভাবে সমাজমনে পড়েছে, সেই কথা ব্যাখ্যা করেছেন ফ্যানোঁ। সেই তত্ত্ব থেকে এটা বোঝা যায় যে দমনের ফল সাধারণের উপর দুইরকমের যেকোনোরকমভাবে পড়তে পারে। প্রথম প্রভাবের ফলে যে দমনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে দমনকারীকে এতটাই মহান বলে মনে করতে থাকে যে, সে নিজেই শাসকের আসনে গিয়ে বসতে চায়। আমাদের রাজ্যের দিকে যদি নজর দিই তাহলে দেখব বেশ কিছু মানুষ এই কারণেই হয়ে উঠতে থাকে শাসকঘনিষ্ঠ। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে যে এরা রাষ্ট্রক্ষমতালিপ্সু, কিন্তু প্রথম কথা, ভালো করে বিচার – বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে,জগতে কে-ই বা ক্ষমতালিপ্সু নয়! তবে সকলেই যে ক্ষমতা দখল করতে চায় তার প্রকার বা উদ্দেশ্য কিন্তু সবার ক্ষেত্রে সমান নয়। এই যারা আজকের পশ্চিমবঙ্গে শাসকের উন্নয়নে শামিল হওয়ার ডাক দিয়ে জনমতকে পিষে দিচ্ছে কিংবা অনেকের কষ্টের কল্যাণে নির্বাচনে জিতে এসে কেবল একের সুবিধার কথা ভেবে ‘উন্নয়ন’ নামের একটা অশ্বডিম্ব খুঁজতে ডিগবাজি খাচ্ছে এবং শুধু এইটুকুতেই শান্ত থাকছে না — চুরি, জোচ্চুরি,রাহাজানি এসব নানাবিধ উপায়ে কাঙালের ধন চুরি করে চলেছে, তাদের উদ্দেশ্য অখণ্ড ক্ষমতাভোগের মধ্যে দিয়ে জীবদ্দশায় ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয়সুখ উদযাপন হতে পারে, কিন্তু এটা ভুললে চলবে না যে, তারা যা করে চলেছে তাকে বলে বোকার চালাকি অথবা চালাকের বোকামি। কারণ, ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে যেমন সমাজ হয় না তেমনই সমাজকে বাদ দিয়ে সামাজিক পরিসরে ব্যক্তি বেশি দূর এগোতে পারে না। তাই, এরা বুঝছে না যে, তাদের দুর্নীতির ফলে শুধু অন্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, তারা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আর সেইসঙ্গে নিজের পরবর্তী প্রজন্মকেও ফোঁপরা করে দিয়ে যাচ্ছে। যারা এসব বুঝবেই না তাদের বোঝাতে যাওয়া আর কুকুরের লেজ সোজা করা একই ব্যাপার, সুতরাং এইসব কথা থেকে সরে,আসুন দেখি যে,এখনও যে কতিপয় মানুষ এই কথা বুঝে শাসকের কোলে দোল খাওয়ার বদলে বিরোধিতার বিউগল বাজাচ্ছেন তাদের অবস্থা মানে যাকে বলে প্রতিরোধ সেটা অন্তত এই বঙ্গে এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে। ফ্রানজ ফ্যাঁনোর মতে এটাও শাসকের দমননীতির প্রতিফল। দমনের তীব্রতার ফলে যেমন একদল মানুষ শাসককেই মহান মেনে তাদের পদলেহন করতে চায়, তেমনই অন্যদল লোকে শাসকের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে তাকে সর্বাংশে বর্জন করতে চায়।এই বিরোধিতার ফল সমাজের অন্যন্য ক্ষেত্রে ততটা উপযোগী না হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উপযোগী হয়ে উঠতে পারত,কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কেন গোটা ভারতবর্ষেই এমন অবস্থানগত বিরোধিতা আর কোথায়! নির্বাচনী গণতন্ত্রের ঘেরাটোপে শাসক আর বিরোধী যেখানে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব নির্মাণ করতে থাকে সেখানে অন্নদামঙ্গলের সেই পঙক্তি, ‘কেবলই আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরন্তর ‘ মনে পড়ে। এই দ্বন্দ্বে বৈরিতা আর সখ্য এতো দ্রুত পাক খায় যে কোনটা বৈরিতা আর কোনটা সখ্য তা কিছু ঠাহর করা যায় না। অতএব এতাবৎ অঞ্চলে কবীর সুমন লেখেন, ‘ দারুণ অসম্ভবে তোমাকে চাই ‘ আর লিখেই একটি আদ্যোপান্ত দুর্নীতিতে ডুবে থাকা শাসকদলের নগ্নতা ঢাকতে প্রেস ক্লাবে দৌড়ন এবং লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বলে ওঠেন, ‘শাসককে ভোট করাতে হয়’, তাই একটা – দুটো খুন তো হতেই পারে। হা হতোস্মি! এই আমাদের অসম্ভব!আর এই আমাদের প্রতিরোধের গঙ্গাপ্রাপ্তি।