১৬.০৬.২০২২
আমি কল্পনা করি। আমি কল্পনা করতে শুরু করি। কল্পনা আমাকে শেখায় কীভাবে কল্পনা করা যায়। কীভাবে কাছাকাছি যাওয়া যায় কল্পনার। যেভাবে জীবন। যেভাবে সময়। সময়ই একমাত্র নিজেকে উজাড় করে। ঘাপটি দিয়ে থাকে। সময় এরকম নয়। সময়ের কোনো প্রকৃত সময় নেই। যেভাবে একজন মানুষ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকতে শেখে। বেঁচে থাকতে শুরু করে। বেঁচে থাকার ভেতরে বেঁচে থাকা মিশিয়ে দেখে। বেঁচে থাকার ভেতর রক্ত কল্পনা আলো কল্পনা শরীর বাঁচা জীবন কল্পনা শরীর জল তারপর শরীর তারপর কত কী। দীর্ঘ দীর্ঘ বাক্যের প্রতীক্ষা বাক্যকে আরও ক্লিষ্ট করে। খর্ব করে। খর্ব করতে শেখে। খর্ব করার মধ্যে খর্ব করা শুরু হয়। খর্ব ধারণ করে খর্বকে। আরও খর্ব হয়। তবুও আমি কল্পনা করি। এই জীবনের দীর্ঘতাকে কল্পনা করতে শিখি। ধীরে ধীরে আরও ধীরে। যেভাবে আমি আঁকি বা যেভাবে দেখি।।
২০.০৬.২০২২
আমার জীবনের গল্প আমি বলা শুরু করেছি। এভাবে বলতে বলতে অনেক বছর পার হয়ে যাবে। অনেক বছরের দীর্ঘ হবে জীবন। তারপর অন্য কেউ গল্প শুরু করবে আমি যেখানে শেষ করব। সেও বলে যাবে অনন্ত। তার জীবনের গল্পও অনেকটা আমার মতো হবে কিংবা আমার জীবনের সঙ্গে তার জীবনের হয়তো কোনো সাদৃশ্য থাকবে। তারপর আরও একজন এই গল্প এগিয়ে নিয়ে যাবে। এরকম ভাবতে গিয়ে নিজেকে প্রাচীন কচ্ছপ মনে হচ্ছে। নদীর অনেক গভীরে। সমুদ্রের গভীরে। আমি এখন শক্ত খোলে আবৃত। আমি শুধু অনুভূতি। ক্ষুধাও আমি। উপশম আমি। আমি কল্পনা করতে ভুলেছি। অথচ আমিই আমার কল্পনার অংশীভূত। আমিই জলের অনুভূতি। আমিই সময়। সময়ই আমি। আমি শান্তি। অফুরন্ত অন্ধকার আমি। আমিই বাহক। আমি সঞ্চরণশীল। আমি বোধ। আমি আলোর রেখা। আমিই আমার চোখ। আমিই আবার কচ্ছপের মধ্যে অবস্থিত আর-একজন কচ্ছপ। আমার গল্পই এখন অন্য কেউ লিখছে।
০১.০৭.২০২২
আমি আজকাল বসে থাকি। একটানা অনেকক্ষণ। কোনো কিছু ভাবি না। ভাবার দিকে এক শক্তিহীনতা কাজ করে। অর্থহীন থাকার চলার বলার একটা গল্প লিখেছিলাম একসময়। আর এই এখন আমার বসে থাকার ভেতর আমিই একটি মূর্তি। কীভাবে আছি-না-আছি তারই প্রতিফলন। হয়তো তা নয়। তবুও একজন মানুষ যেভাবে বেঁচে থাকে আর বসে থাকে। তার বসার মধ্যে বিরতিহীন ঘোষণা। আর আমিই কি সেই মানুষ যে অনেকটা সময় বসে ছিল। অর্থহীন কিছু থাকার কথাও বলেছিল। দেখা হয়েছিল কয়েকজনের সঙ্গে। তার খিদে পেয়েছিল। অন্তহীন রাস্তা দেখেতে দেখতে হেঁটেছিল। ফিরেছিল বাড়ি। এই বাড়ির ভেতর আবার সে এসে বসেছিল। কিছু কথা বলেছিল কারো সঙ্গে। আবার শুধু বসে ছিল। অনেকক্ষণ। এরই মাঝে অনেকটা সময়। অনেকটা বলেও কিছু নেই। সময় ছিল। তার অতিক্রম ছিল।— ধীরে ধীরে মানুষ এসে বসে, ধীরস্থির হয়। ভাবে, জেগে ওঠে ঘুম থেকে। শুরু কিংবা শেষ নেই কোনো। আমিই কি সেই মানুষ যে বসে থাকে। এভাবে ভাবতে গিয়ে মানুষটার অস্তিত্ব ক্ষীণ হয়, শুধুমাত্র তার বসার ভঙ্গি, তার বসার অবয়ব, তার বসাটুকু থাকে। হয়তো সেটাও ধূসর।
০৩.০৭.২০২২
একেক সময় কিছু বলা হয় না। কেউই তখন কথা বলে না। ছায়া সরে যায়। গাছ জেগে ওঠে। ছায়াও থাকে গাছের। এমন অনুভূতি আমাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়, মনে করায় এবার মরে যাওয়া ভালো। কিংবা কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে ভালো হয়। ধ্বংসের এ এক এমন রূপ যার ভিতরে আমি নিজেকে কীভাবে খুঁজে পাই। সংশয় দীর্ণ। শরীরী চেতনা লুপ্ত শরীর। একে কখনো তাই শরীর বলে মনে হয় না। প্লাটোর সেই নামের মীমাংসা নিয়ে বইটা ফিকে হয়। আকাশের রং লুপ্ত হয়। স্থির এই রসায়নকে আমি বোঝার চেষ্টা করি। আমি সরে যাই। ছায়ার দিকে। মানুষের ছায়া মানুষ হয় না কখনো।
০৭.০৭.২০২২
কাহিনিটি ঠিক কীরকম অন্য কেউ জানে না। একমাত্র যে শুনেছে আর যে বলে খালাস হয়েছে এই দু-জনের মধ্যে সীমিত। এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। ঠিক কবে থেকে তা কেউ জানে না। অকথিত না-বলা কাহিনিটি জগদ্দল পাথরের মতো। তার ক্ষমতা আছে সেই মানুষটাকে পাথরে পরিণত করবার। না বলা কাহিনিটি কিন্তু গল্প নয়। লুপ্ত অবস্থান থেকে তার এখন পর্যন্ত নড়চড় হয়নি। প্রতিটা বর্তমান সময়ে শুধুমাত্র দুইজন তা জানে। একজন ধারক যার ক্রমাগত পাথুরে হয়ে যাবার আশঙ্কা। আর যে বলে ফেলে মানুষ হয়ে থাকার আনন্দে অযথাই লুপ্ত। তার ভেতর অদ্ভুত লুপ্ততা সেখান থেকে তার নিজের পরিচয়টুকুও মানুষ হওয়া পর্যন্ত সীমিত পাথর না হওয়ার ফুড়ফুড়ে অবস্থা। আর যে ধারক, সে ভীষণ নিঃসঙ্গ তার ভারে। হয়তো কোনোদিন সে কাউকে শোনাতে পারবে সম্পূর্ণ কাহিনিটি। এতসব কথা পীযূষ ভট্টাচার্যের গল্প ‘লুপ্ত কাহিনি উদ্ধারের খোঁজে’ পাঠ করার প্রেক্ষিতে বললাম। তবু এই গল্প আমাদের অনেকের কথাই তুলে ধরে। এই অকথিত থেকে যাওয়া ‘আমি’র ক্রমশ পাথর হওয়ার দিকে যাত্রা।
০৮.০৮.২০২২
গতকাল সারাদিন ক্লান্ত ছিলাম। অনেক রাত পর্যন্ত শুধু মুহূর্ত গুনেছি। ওসিপ মান্দেলস্তামের ‘Stone’ কাব্যগ্রন্থের আঠারো নম্বর কবিতা মনে পড়তে থাকে। সেটা পড়ি। অনুবাদ করার চেষ্টা করি। যদি কবির সঙ্গে আমার বর্তমান অবস্থার যদি কিছু যোগাযোগ তৈরি হয়। একটা কালো বড়ো জলাশয়। একটা ফ্যাকাশে সাদা জানালা। তলিয়ে যাওয়া হৃদয়। আবার ভেসে ওঠা৷ নিজের বিষণ্ণতার পরিচর্যা করাই এই কবিতা। তার কবিতার পথ অদ্ভুত। সহজ। সাবলীল। অথচ এর ভেতর পৌঁছাতে আমার সারারাত লেগে গেল। অনুবাদ তো শুধু করতে চাইনি, চেয়েছি সেই বাক্যগুলোকে অনুভব করতে। অনুভূতির চেয়ে চূড়ান্ত দর্শন আর কিছু হয়! আর যে-অনুভূতি চিন্তার জন্ম দেয় কথাকে পঙ্গু করে দেয় তার স্থায়িত্ব স্মৃতিতে চিরন্তন। আর তারপর আমার যে কত ঘুম আর জাগরণের তোলপাড়। সামলে ওঠা। ভেসে ওঠা। এই পরিচর্যা যেন মৃত্যু পর্যন্ত। অনুভূতির স্থায়িত্ব পর্যন্ত…
০৯.০৮.২০২২
পৃথিবী ভীষণ অদ্ভুত। আজ রাতে একসঙ্গে বাবা মা মাসি আমরা খাচ্ছি। হঠাৎ কী মনে হল অনেক কথা অনর্গল বলতে থাকলাম। আমার অনর্গল বলবার মধ্যে রাগ ছিল না। ছিল না শূন্যতা। পৃথিবীর এই শূন্যতা অদ্ভুত। আমরা যেভাবে বেঁচে থাকি। জন্মাই, বয়স বাড়ে, মৃত্যু হয় অনেক বছর বেঁচে থাকার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। এখনও পুকুরের কালো জলে তাকিয়ে আমিও ওসিপ মান্দেলস্তামের মতো শূন্যময় কবিতা ভাবি। আমি অবশ্য কবিতা ভাবি না এভাবে ঠিক। আমার পথ চলার ইতিহাস আমাকে ভাবায়। আয়নায় দেখার মতো আমার অতীত। আমার নানা বয়সের স্মৃতি। নানা শরীর আমার! সে-সব জড়ো হয়ে আসে। ভেসে ওঠে খড়ের মতো। আমার দাদুরবাড়ি রায়গঞ্জে ছিল। একুশ বছর আগে বাড়ি বিক্রি করে আমার দাদু আর মাসি মালদায় ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে। আজ অনেক কথা খাবার টেবিলে বলছি, হঠাৎ মাসিকে বলে উঠলাম— “বাড়িরও শরীর হয় জানিস? সেই শরীর তোর শরীরের সঙ্গে বাড়ে। তারও একটা আলাদা অস্তিত্ব থাকে। তুই আর তোর বাড়ি একে-অপরের সঙ্গে যুক্ত। বাড়ি না থাকলে তুই এখন ছিন্নমূল। শেকড় আছে কিন্তু সেই শেকড় প্রোথিত হওয়ার জায়গা নেই। কী করুণ এই সত্য হয়তো পৃথিবীর সমস্ত উদ্বাস্তু মানুষেরা জানেন।…”
১০.০৮.২০২২
With no faith in the miracle of resurrection
we wandered through the cemetery.
— Osip Mandelstam
ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টার মধ্যে সবসময়ই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার তীব্র টান থাকে। এ চোরাটানও। শরীরকে সহ্য করে যেতে হয়। কখনো কখনো তাই গভীরে নেমে যাওয়ার রাস্তা দিয়ে শুধুই স্মৃতির কবর পড়ে থাকে। ইদানীং ভয় পেতে শুরু করেছি। স্মৃতি থেকে মুক্ত হতে পারি না। আমার কাছে সুখস্মৃতি বা দুখস্মৃতি এরকম কোনো বিভাজন নেই। সবসময়ই সেই শারীরিক টান বিদ্যমান থাকে যেন এখুনি পূর্ব সময়ের বিপুল টান আমাকে যে-কোনো সময় গ্রাস করে ফেলতে পারে। এসব টানাটানির মধ্যে স্বপ্নেও প্রবেশ করি। যে-সব মানুষে যে-সব মুহূর্তে একসময় অনায়াস ছিলাম। সেইসব খণ্ড খণ্ড মুহূর্ত নতুনভাবে সেই মানুষগুলোর সঙ্গে আমার স্বপ্নের ভেতর প্রবেশ করে। ঘুম ভাঙার পর আর বর্তমানে ফিরতে পারি না। বিশ্বাস রাখতে পারি না প্রকৃতির নিয়মের ওপর। প্রকৃতি থেকে আমি যেন আজ এই মুহূর্তে ঝরে গেছি। আমার শরীরে অসংখ্য দাগ এঁকে দেওয়া। আর আমি চলতে ফিরতে ভুলে গেছি। এ যাত্রা আমার শুধুই নিজের। সময়ের ধারণা পালটে পালটে যায়। আমি সাঁতার কাটি। ডুবে যাই।