================================================================

================================================================
ল্যাজ
পুরাকালে মানুষ ও দেবতারা একসাথে ডিনার করতেন। বিজ্ঞান নামক কুসংস্কারের জন্ম হয় নি তখনো, অবিশ্বাস্য কিছুই ছিল না সে যুগে। নেমন্তন্ন পেলে দেবতারা আসতেন, চর্বচোষ্য গিলতেন, টেবিলে হাত শুকিয়ে কিছুক্ষণ গ্যাঁজাতেন এবং তারপর যে যার মতো ঘুমোতে চলে যেতেন। দেবতাদের বেডরুম স্বর্গে, তাঁদের তো ডিভাইন ডিভান। পুং দেবতারা অবশ্য এক আধদিন গৃহস্থ বাড়িতে থেকেও যেতেন। হাফ-গেরস্ত বাড়িও বলা যেতে পারে, গৃহকর্তা ব’লে সেসব বাড়িতে কেউ থাকতেন না। অধিষ্ঠাত্রীকে বারাঙ্গনা, নগরনটী ইত্যাদি ভালো ভালো নামে পরিচয় দেবার রেওয়াজ ছিল। অশেষ গুণবতী ছিলেন তাঁরা, যাঁরা আসতেন তাঁদের তুলনায় তো বটেই। আর কী সুন্দর সে সব নগরের নাম! উজ্জয়িনী, শ্রাবস্তী…। আহা! ধ্রুপদী স্ক্যানডিনেভিয়া আমাদের! এ যুগে তো সেক্সটাকেই ট্যাবু বানিয়ে ছাড়লে।
সে যাক গে, এখন প্রশ্ন উঠতে পারে: দেবতায় মানুষে মিশ খেত কিনা। তা খেত বৈকি। না-হলে অতীত জুড়ে অত ক্ষেত্রজ সন্তানেরা এলেন কোথা থেকে? সবই লেখা আছে, পুরাণ ব’লে পুরানোকে হেলা করা ঠিক হবে না। মহাপুরুষদের নাম নিচ্ছি না আর, মুখ্যুগুলো জেলে পুরে দেবে। পড়াশুনো করে না তো। ল্যাজকাটা হনুমান সব।
তবে ল্যাজকাটা ব’লে গাল পাড়াটা ঠিক হলো না বোধহয়। সেই স্বর্ণযুগে মানুষের ল্যাজ ছিল। ল্যাজ ছিলো? আজ্ঞে হ্যাঁ, ল্যাজ ছিল। পুরুষ্টু লম্বা একটা ল্যাজ পাছা থেকে ঝুলতো। দুলতো। নাক সিঁটকোনোর কিছু নেই, ল্যাজের অনেক উপকারিতা। ভেঙ্গে পড়লে ল্যাজে ভর দিয়ে সহজেই উঠে দাঁড়াতেন পূর্বজেরা। দুহাতে বাজারের ব্যাগ, এদিকে বৃষ্টি নামলো প্রবল। তখন ল্যাজের মুঠোয় ছাতাটি ধ’রে মাথার উপর। মানুষের পৃথিবীটা একঘেয়ে হয়ে গেলে গাছের ডালে ল্যাজ পেঁচিয়ে বাদুর-ঝোলা। এরকম আরো কতো! তাছাড়া ভাষায় ও কর্মে ল্যাজের অন্যান্য ব্যবহারও ছিল। যেমন, পড়া না পারলে মাস্টারমশাই ছাত্রদের ল্যাজ মুলে দিতেন আচ্ছা ক’রে। তবে প্রেমিকার সম্মতি না-পেলে অবশ্য প্রেমিকের ল্যাজে ল্যাজ ধরার অনুমতি ছিল না। এই ভাবে ভেবে ভেবে ল্যাজের আরো অনেক রকমের ব্যবহারের কথা লিপিবদ্ধ করা যায়। আবার প্রশ্ন উঠতে পারে: ল্যাজের এত উপকার ও ব্যবহার সত্ত্বেও তা বিলুপ্ত হয়ে গেল কেন? অথচ অ্যাপেনডিক্সের মতো অকেজো একটা অঙ্গ দিব্যি জন্ম জন্মান্তরের সঙ্গী। সেই গল্পটাই বলি বরং।
সমুদ্রে ঘেরা এক বিপুল সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল, ধরা যাক তার নাম সমুদ্রগড়। রাজার আসল মুখটা কেউ দেখে নি, অনুষ্ঠানের মুড অনুসারে মেক-আপ নিয়ে বেরোতেন। এই কারণেই কিনা কে জানে, রাজা বহুরূপ নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। অন্য সব দেশের রাজার মতোই জিনিস পত্রের উপর জিএসটি বসিয়ে বহুরূপ চোখধাঁধানো বিশাল প্রাসাদ উদ্যান মূর্তি এইসব বানিয়েছিলেন। তাছাড়া ঘুষ দিয়ে দেবতাদের কাছ থেকে ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র সংগ্রহ ক’রে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এসব দেখে জম্বুদ্বীপের দেবপ্রিয় রাজাদের খুব হিংসে আর ভয় হলো। তারা সমুদ্রগড়ের রাজার নামে খারাপ খারাপ গল্প রটিয়ে দিল, সবাই বিশ্বাস করলো বহুরূপ একটা রাক্ষস। তারপর দেবতাদের পরামর্শে দ্বীপরাষ্ট্রে পাঠানো হলো একজন প্রশিক্ষিত চর। তার নাম চরণদাস। উদ্দেশ্য: বহুরূপের দুর্বলতাগুলো জেনে নিয়ে বিপাকে ফেলা। কিন্তু চরণদাস গুপ্তচরের ওভার অ্যাক্টিং করতে গিয়ে প্রথম দিনেই দক্ষ নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে গেল। ধরা পড়লে যা হয়, তাকে টানতে টানতে রাজসভায় নিয়ে গিয়ে ঠাট্টায় টিটকিরিতে খুব হেনস্থা করা হলো। কিন্তু কিছুতেই যথেষ্ট মজা হচ্ছে না দেখে এক চ্যাংড়া মন্ত্রী চরণদাস চরের ল্যাজে আগুন ধরিয়ে দিল। শাস্ত্রে আছে “সর্বম অত্যন্তম গর্হিতম”। প্রথমটায় চরণদাস “দমকল দমকল আমার ল্যাজে আগুন”, এই বলে চ্যাঁচামেচি লাফালাফি শুরু ক’রে দিয়েছিল। এ যত লাফায়, ওরা ততো মজা পায়। এদিকে কেউ খেয়াল করে নি, লম্ফঝম্ফতে রাজসভার জানলা দরজায় পর্দা কার্পেটে ল্যাজ ঠেকে গেছে। ঋষিবাক্য তো মিথ্যে হবার নয়, প্রথমে রাজসভা এবং তারপরে গোটা রাজভবনেই আগুন লেগে গেল। তখন উল্টে রাজা মন্ত্রী পাত্র মিত্র আতঙ্কে দিশেহারা। এই ফাঁকে চরণদাস রাস্তায় নেমে এসে এই দোকানে ওই বাড়িতে ল্যাজ ঠেকিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল। তার আনন্দ যেন ধরে না। অতঃপর সমুদ্রগড় ছারখার ক’রে পুচ্ছটি উচ্চে তুলে ধরে সে দেশে ফিরে এলো।
এদিকে সমস্যা হলো, চরণদাসের ল্যাজের আগুন নিভছে না। বস্তুত সে নিজেও ওটা নেভাতে চাইছিলো না। এক তো যখন তখন বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দেবার সুবিধে। তার উপর সবাই কেমন ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধার চোখে তাকে দেখছে, এটা সে ভারি উপভোগ করছিলো। পুচ্ছের আগুন নিভে গেলে কেউ কি আর পুছবে তাকে? কিন্তু দেশের রাজা পড়ে গেলেন মহা দুশ্চিন্তায়। রাজভবন তাঁরও একটা আছে এবং আগুন লাগানোর নেশা সর্বনাশা। ল্যাজ ততক্ষণই উপকারি যতক্ষণ না তা রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে। রাজামশাই হুকুম দিলেন: উহার ল্যাজ কাটিয়া দাও। জল্লাদ এসে কাজটি সুচারু রূপে সম্পন্ন করলেন। দুঃখে চরণদাসের তিন রাত্তির ঘুম হলো না। ঘা শুকিয়ে গেলে রাজার হাত থেকে দেশরত্ন পুরস্কার নিয়ে তার দুঃখের লাঘব হলো কিছুটা। আরো খুশি হলো জেনে যে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজা দেশের সব মানুষেরই ল্যাজ কেটে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে হলো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত দেশের প্রথম ল্যাজ-কাটা। ল্যাজের অপকারিতা বিষয়ে ইস্কুলের পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষামন্ত্রীর লেখা একটি প্রবন্ধ অবশ্যপাঠ্য করা হলো। মানুষের নির্ল্যাজ হবার এই হলো সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
[মানুষের অন্যতম দোষ হলো, কেউ না কেউ কোনো না কোনোদিন প্রশ্ন ক’রে উঠবে। এরকম একটা ফিসফিস ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে — ল্যাজকাটার বাচ্চা ল্যাজকাটা হয় না। তাহলে তো সুন্নত প্রথাই উঠে যেত এতদিনে। বাইশ প্রজন্ম ধ’রে ইঁদুরের ল্যাজ কেটে দেখা গেছে ল্যাজ অতি নাছোড় পদার্থ। প্রতি জন্মে ল্যাজ ঝেড়ে ফেলে বড়ো হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেও, ব্যাঙকে সেই সল্যাজ ব্যাঙাচি হয়েই জন্মাতে হয়। অর্জিত চরিত্রের তত্ত্বকে ঝেড়ে ফেলে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে শিরোধার্য করে এভাবেই তো মানুষ ল্যামার্ক থেকে ডারউইন হয়ে উঠলো। তাহলে ল্যাজ কোথায় গেল?আমার যেটা মনে হয়, মানুষ তার ল্যাজটিকে বিস্মৃত হয়েছে বলেই তা অদৃশ্য। ল্যাজ থাকাটা দেশদ্রোহিতার চিহ্ন হিসেবে ঘোষিত হবার ফলে এবং সোস্যাল মিডিয়ায় ট্রোল্ড হবার ভয়ে ল্যাজ নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। ল্যাজ-লজ্জা কাটিয়ে উঠে মানুষের ল্যাজ যদি প্রকাশ্যে এসে পড়ে, তাহলে তো লঙ্কাকাণ্ড!]
——————————————————————————————————————————————————————
কবির মেরুদণ্ড ও একটি কলমের গল্প
পোষ না-মানা বিরল প্রজাতির এক কবি অসুস্থ হয়ে অনেকদিন ধরেই হাসপাতালে ভর্তি। উদ্বিগ্ন সবাই। জনসভায় রাজনৈতিক নেতা কবির আরোগ্য কামনা করলেন, সামাজিক মাধ্যমে লিট্ল ম্যাগাজিন সম্পাদক লিখলেন, “সেরে উঠুন কবি, এটা সময়ের দাবি”। সংবাদপত্র কবির স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির ধারাবিবরণীর জন্য বেছে নিয়েছে সামনের পাতার পদতলে বাঁদিকের কলমের মহার্ঘ্য দু-ইঞ্চি। আড়ালে কিন্তু মৃত্যুর অপেক্ষা, শোকের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ। কবিকে গুলি করে মারতে পারে নি যে বন্দুক, মৃত্যুর পর অন্তত গান-স্যালুট দেবার জন্য বারুদ ভরে নিয়েছে পেটে। কবির সঙ্গে ছবির সঙ্গতে গভীর শোকবার্তা আস্তিনে লুকিয়ে রেখেছে ছোট শহরের অভিমানী কবি, বড়ো কাগজের অবিচুয়ারি এক-পা বাড়িয়ে আছে কাঙ্খিত সকালের দিকে। দেড়-মাস পর অবশেষে কবি মারা গেলেন। রানিং ট্র্যাকে ‘অন-ইওর-মার্ক’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শোকপ্রস্তাব অমনি ছুটতে শুরু করলো বাংলা-বাজারে। সমাজমাধ্যমের পাতায় ‘কে প্রথম আগে বলেছি’-র প্রতিযোগিতা, ফুলের বাজারে আগুন, তিড়িং-সাংবাদিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গাফিলতির খোঁজে বুম বাগিয়ে তাড়া করেছে একে তাকে। এত কোলাহলের মাঝে কবিপুত্র কোনোমতে জানাতে পারলেন: বাবার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী মরদেহ নিয়ে শোভাযাত্রা করা যাবে না, মরণোত্তর দেহটি তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে উৎসর্গ করে গেছেন, দেহের কোনো অংশই যেন অপ্রয়োজনীয় গণ্য না-করা হয়। রাষ্ট্রীয় শোকের অনেক প্রস্তুতিই ব্যর্থ ও হতাশ। নীরবে কবির মরদেহ শুয়ে পড়লো মেডিক্যাল কলেজের লাশকাটা ঘরে। শোকের উত্তাপ নেই, মৃত্যুর চেয়েও শীতল সেই ঘর।
হৃদপিণ্ড, পাকস্থলি, বৃক্ক ও যকৃৎ সহ পচনশীল সমস্তকিছুই বিজ্ঞানের সেবায় নিয়োজিত হলো। কবির কঙ্কাল আরো অনেকদিন ধরে অস্থিবিশারদগণের ল্যাবরেটারিতে আগ্রহের কেন্দ্রে। ওই অন্তর্কাঠামোতে ছাত্রেরা কিছু অসাধারণত্বের সন্ধান পেয়েছিল। তারপরেই ঠিক কার মস্তিষ্কপ্রসূত এই প্রস্তাব জানা নেই, জনগণের উদ্দেশে ঘোষণা করা হল: প্রয়াত কবির মেরুদণ্ডের হাড় দিয়ে একটি সুদৃশ্য কলম তৈরি করে নিলামে তোলা হবে। ঘোষণামাত্র কবি ও নাট্যকার, ধনী ও মধ্যবিত্ত, নেতা ও অনুগত প্রজা ইত্যাদি সমাজের বিভিন্ন স্তরের সম্ভাব্য ক্রেতাদের মধ্য একটি মেরুদণ্ডী কলমের প্রতি প্রবল আগ্রহের সঞ্চার হলো। দিন যায়। অবশেষে একদিন ইন্ডোর স্টেডিয়ামের ঠিক মাঝখানে ভেলভেটে মোড়া বেদির উপর রাখা হলো অস্থিশুভ্র কারুকার্যময় অপূর্ব একটি কলম। কবির মেরুদণ্ড দিয়ে কলমটি তৈরি করেছেন মুর্শিদাবা্দের এক প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র শিল্পী নিতাইচন্দ্র ভাস্কর। প্রয়াত কবির একান্ত ভক্ত ও তাঁর কবিতার অনুরাগী এই শিল্পী একেবারে বিনামূল্যে বিশুদ্ধ আনন্দের বিনিময়ে এই কাজটি করেছেন। স্টেডিয়ামের দর্শকাসন পূর্ণ। অধিকাংশই এসেছেন নিছকই বিনোদনের কারণে, সম্ভাব্য ক্রেতার দল বসেছেন সামনের সারিতে। নির্দিষ্ট সময়ে সঞ্চালক ঘোষণা করলেন, “কলমটি এবার ক্রেতাসাধারণের জন্য উন্মুক্ত”। ভালো ক’রে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সভাকবি দাম হাঁকলেন, “এক লক্ষ টাকা”! দর্শকাসনে মৃদু গুঞ্জন। কর্তৃপক্ষের সম্মতিসূচক মৃদুহাস্যের প্রেক্ষাপট পেছনে রেখে সভাকবি এগিয়ে গেলেন ভেলভেটের বেদির দিকে। সঞ্চালক দর্শকদের অনুরোধ করলেন করতালি দিয়ে সভাকবিকে অভিবাদন জানানোর। কিন্তু একী! অস্থিনির্মিত কলমটি তিনি তুলতেই পারছেন না! একবার চেষ্টা করলেন, দুইবার, তিনবার…দুহাত দিয়ে বেদি থেকে আলগা করার চেষ্টা করলেন কলমটিকে…কিন্তু কোনোভাবেই একচুলও নড়াতে পারলেন না বজ্রকঠিন সেই বস্তুটি। মাথা নিচু করে ফিরে এলেন সভাকবি নিজের আসনে। প্রাক্তন প্রতিবাদী নট ও নাট্যকার দু’লক্ষ টাকা দাম হেঁকে অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে সভাস্থলের মাঝখানে পৌঁছে গেলেন। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হলেন কলমটি পকেটস্থ করতে। মুখপাত্র ও মুখ্যসচিবেরও একই দশা। দু’কোটি টাকা দাম হেঁকে উদ্যোগপতিও যখন ব্যর্থ হলেন, উঠে দাঁড়ালেন “কিংবদন্তি” নামক লিট্ল ম্যাগাজিনের সম্পাদক, সদ্য পুরস্কারপ্রাপ্ত নাতিতরুণ কবি প্রসাদ গুপ্ত। মাত্র দুহাজার টাকা দাম দিতে পারবেন তিনি, কিন্তু মাত্র কয়েকজনই খেয়াল করলেন, সভাকবির নীরব ভর্ৎসনায় পুনরায় তিনি আসন গ্রহণ করলেন। অতঃপর আর কেউই যথেষ্ট অনুপ্রাণিত বোধ করলেন না। এক প্রবল অনিশ্চয়তা ছেয়ে গেল স্টেডিয়ামের প্রতিটি কোণে। তখন সভাকবি তাকালেন মহামন্ত্রীর দিকে, নাট্যকার তাকালেন মহামন্ত্রীর দিকে, গানমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, উপস্থিত সমস্ত দর্শকের দৃষ্টিই আসলে নিবদ্ধ তখন ওই একজনের দিকেই। তিনি শুধু মহামন্ত্রীই নন, তিনি একজন জাদুকর। বিচিত্রকর্মা ও বহুভাষাবিদ এই আশ্চর্য মানুষ সব কাজ শেষ হয়ে যাবার পরেও কাজ করে চলেছেন। বৈপরীত্যই তাঁর ভূষণ। সকলের প্রত্যাশা অনুমান করে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন: “দেখুন, এখনই আমার গ্রন্থের সংখ্যা প্রয়াত কবির চেয়েও বেশি। দু’হাতেই আমি লিখতে পারি বলে শীঘ্রই জাতীয় গ্রন্থাগারের সংগ্রহের চেয়েও অধিক গ্রন্থের লেখক হিসেবে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করতে চলেছি। ফলে আমার ওই কলমটির প্রয়োজন নেই। এখন জাতীয় সঙ্গীত হবে। এই গানমন্ত্রী, এদিকে এসো”। মুখ্যসচিব জিজ্ঞাসা করলেন, “কলমটির কী হবে, ওটা কি এখানেই পড়ে থাকবে?” মহামন্ত্রী নিতাইচন্দ্র ভাস্করের খোঁজ করলেন। নিতাইভাস্কর ভেতরেই ছিলেন, করজোড়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন। মহামন্ত্রী আদেশ দিলেন, “কলমটা তো বিক্রি হলো না। তুমিই তৈরি করেছো যখন, তুমিই নিয়ে যাও।” নিতাইচন্দ্র কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “জাহাপনা, দর্শনীয় এই বস্তু গরীবের ঘরে রেখে কী হবে আজ্ঞে। গাঁ গেরামে থাকি, লোকে তো দেখতে পাবে না। কবির মেরুদণ্ড না-হয় জাদুঘরেই থাক”। এই বলে অনায়াসেই তিনি কলমটি হাতে তুলে নিলেন। মহামন্ত্রী বললেন, এবার তাহলে গান হোক।