দুর্গতিনাশিনী দুর্গা আসছে। কাশবন পেরিয়ে ভোরের শিশির মাখা পায়ে মৌষল দুই বাংলায়। লক্ষ্মীর আসন ভাঙ্গা, বীণাপাণি ডুবে গেছে শ্যাওলায়, গণেশমার্কা সিন্দুকে কেবল টাকার টং টঙ্কার, রক্তমুখী ক্ষুধায় উদ্বাহু উচাটন বাংলার ঘর, দোর, মন ও মনন। পিওনি বাল্বের রঙ্গীন আলোয় পাড়ার বেষ্টবয়রাও চোলাই খায়। বুক দেখে মেয়েদের। সে ওরা দেখেই ! পূজা এবং ঈদে, সিনেমা হলের গেট, শপিং মার্কেট, মাছ মাংসের বাজার, নিরালা স্ট্রীটে ! ঢাকিদের রোগা ছেলেগুলো সম্বৎসরের ক্ষুধা পেটে কত যে খায় ! বিধবা মাসিমা উপুড় করে ভরে দেয় খইমুড়ি, নাড়ু, পাটালি গুড়ের টুকরো, নারকেলের চাকতি, খা বাছা এই ত কটা দিন, তারপরে তো অভাবে যাবি, সেই আগের মত নিরন্ন পেট, ঘর ভর্তি হাহাকার ! কুঞ্জলতা মাধবীমঞ্জুরীর সঙ্গে গেটে দোলে রাঙতার ঝালর। কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি গেছে বিকেলের কোচিঙে। ফিরতে সন্ধ্যা। আজকাল কতকিছুই তো ঘটছে। বোর্কা, হিজাবও দু পেয়ে জন্তুদের হামলা ঠেকাতে অপারগ। প্রতিবাদী মোমজ্বলে এপার ওপার। যার যায় সে বোঝে ! হে ঈশ্বর, আল্লাহ , ভগবান !! যেন অক্ষত ঘরে ফেরে মেয়ে ! আমাদের ত্রাতা নেই, দয়া মায়া পরম্পরাহীন আকাশ বাতাস। ময়ুর নৃত্যে পালক খসে গেলে আমরা অসুরে অসুর হয়ে খেলে যাই দিন ও রাত। লাল হলুদ কাগজে মোড়া রঙিন বাঁশে হেলান দিয়ে দুর্গার ছেলেটি শারদীয়া পুজার কবিতা হাতে আদম হাওয়ার মেয়েটিকে বলে, শোন্ লালপরি চ্যালেঞ্জ নিলাম আসছে বছর তোকে জয় করবই। লালপরি খুব রাজী ! মৌলবাদের ধোঁয়া তুলে দুই ধর্ম ক্ষেপে ষাঁড় হলেও, হোক ! ও দুর্গা, তুই কি বোধনের শক্তিতে শক্তিমতী মহামায়া নোস ? তুই হিন্দু, তুই মুসলিম, খ্রিস্টান, ইয়াজিদি স্তনবতী, যোনীরূপিনী, নারীগন্ধ ছড়িয়ে মানুষ বাজারে তোর দেদার বিক্রি ! কে তোকে বাঁচাবে বল ? অই ত্রিশূলখানা রেখে যাস তো মেয়ে, যদি সাহস আসে ফিরে, বাংলার আনাচ কানাচ গ্রাম নগর ঘুরে ! আবার আসিস মেয়ে- ১ বিচ্ছিন্নতার শক্তি কমে গেছে আজকাল। তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি, যতখানি বেদনা পাবো বলে ভেবেছিলাম, পারছে না দিতে ! বিচ্ছেদ আজকাল মুক্তির পরোয়ানা হয়ে গেছে, একলা চলোর অহংকারে লেখা এক ইশতেহার। তিনটে তিরিশের গাড়ী। ফিরে যাচ্ছি আমি— ইচ্ছে ছিল ফাটিয়ে দেব তোমার মুখোশ মুখ, হাঁটুভাঙা দ য়ের মত কোমর ভেঙ্গে ধ্বসিয়ে দেব তোমার ঋজুতা। তার বদলে রবি ঠাকুর এসে গেল, ধুত্তোর নিকুচি করি ‘তবু যেতে দিতে হয়’ এর আদিখ্যাতায়, ইলেক্ট্রিক বিল জমা দিয়ে দিও, গ্যাস বিল আর সার্ভিস চার্জ দিয়ে গেলাম, আমাদের সবকিছুই ত ফিফটি ফিফটি ছিল-- এত এত বিদ্রোহে যৌবন থেকে গেল অসফল, এখন সাদা পতাকায় ভগবান তথাগত ! তোমাকেই ডাকছি হে অকম্মা ঈশ্বর, থলি খুলে একবার দেখাও ত দেখি কি রেখেছ আমার ভাগ্যে ! কেন এত ডাঙ্গা ভাঙ্গা, কেবলই ভাসান আমার ! ডুবে যাচ্ছে প্রতিমা, রঙ ভাসছে জলে, রঙ ছড়াচ্ছে বিষণ্ণতার জলে। ঘাট পাড়, তল বিচ্ছেদে করুণ। তবু দশ হাতে বরাভয় রেখে যাচ্ছে পরমেশ্বরী, ভাল থাকিস মানুষ ভালো রাখিস যতখানি পারিস। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামায় জননী, আবার আসিস মা। মোটা চালের খিচুড়ীতে সামর্থ্যের বেশি তেলে বেগুন ভেজে তুলে দেবো তোর পাতে। এক চিমটি কালোজিরা, এক টুকরো লেবু--- কলিজার টুকরো নন্দিনী আমার ! যদি মন কাঁদে আসছে বছর আবার আসিস মা। আমার আর ফেরা হয় না---- হরিপ্রিয়া-২ একটি হারাণো দুপুরকে খুঁজে নিতে পরিত্যক্ত স্মৃতিঘরে হানা দিয়েছি। চেনা চেনা রাস্তা। কৃষ্ণ তুলসির ঝোঁপ ঝাড় হাস্নুহেনার সুগন্ধে সুরটা শুনতে পাচ্ছি। মাধবী জড়ানো গেটে জং ধরেছে লাল, ঘাসে ঘাসে ঝরা করবীর হলুদ আসন পেরিয়ে খোলা বারান্দায় সুরটা ঘুরে ঘুরে কেঁদে যাচ্ছে বাতাসে তোমার ত সব ছিল মাগো, প্রিয় পুরুষ, বাধ্য প্রেম, চাইলেই পুর্ণতার শ শ ব্যস্ততা, তবু কাঁদতে কেন নিদাঘ দুপুরে একলা বসে বারান্দায় ? এক জনমে আর কত পুজা বাকি ছিল সমর্পণের ? দুপুরটা দিয়ে গেলে আমাকে, সুরটিও -- কেবল লক্ষ্য পেলাম না আজও ! বেলা শেষের শুদ্ধঘাটে গেয়ে যাচ্ছে মায়ামন-- হরিপ্রিয়া সুজনেষু হয়নি- হয়নি- হয়নি কো সমাপন। আমার ঈশ্বর - ৩ মাঝে মাঝে ঈশ্বর আসেন আজকাল, মোড়া টেনে বসতে দিই তাকে, মাল্টা জুসের সোনালী চা দিয়ে নতুন কেনা বই পত্রপত্রিকাগুলো দেখাই, ঈশ্বর দেখে শুনে রেখে দেন অভিযোগে আঘাত করি, তিনি বাদামী নোখ খুঁটে খেয়ে যান সময়, কিছু কি বলবেন ? বিব্রতের সময় ভেঙ্গে আরও কুঁজো হয়ে কাছে বসেন, নতমুখ ঈশ্বরকে বলি, লজ্জা করে না কেড়ে কেড়ে মানূষের জীবন তুলে নিতে ? নীল হোন তিনি, টেবিলের কালো কাঁচে দুহাত বিছিয়ে গভীর বেদনায় আমার মুখ দেখেন— কি অসহায় ছেঁড়াফাটা ভিখেরী করপুট ! আমি দেখি আর মায়া ফেলে দুহাতে জড়িয়ে নিই, ভেবে যাই কি দিই ! কি দিলে ভরে যাবে ঈশ্বরের করুণতম শুন্য করতল ভালবাসা নাকি এই ফুল ফুটন্ত সুখী জীবন !

কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক
অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত, ঢাকা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তনী রুখসানা কাজলের বসবাস ঢাকায়।
Facebook Comments Box