সেদিন দৌড়াচ্ছিলাম অনেকটা কারিনা কাপুরের মতো। কারিনার কখনো ট্রেন চলে যেত না কিন্তু আমার সবসময়ই মনে হয় ট্রেন শুধু আমাকে রেখে আর সবাইকে নিয়ে চলে যাবে। ঠ্যালায় পড়ে সেবার গাড়ি ছেড়ে, পয়সা আর সময় দুই বাঁচাতে আমার প্রয়াস ট্রেন যাত্রা। গন্তব্য নরসিংদী থেকে ঢাকা।
একজন কলিগ আমাকে জানালেন দুপুর আড়াইটে বাজার মধ্যেই স্টেশন পৌঁছুলে চট্টলা ট্রেন ধরা যাবে। আমি দশ মিনিট সময় হাতে নিয়ে বের হলাম। ছোট্ট একটা ব্যাগ সাথে। এবার যাবার সময়ে মাকে বলছিলাম, আমি যদিও ট্রেনে উঠতে পারি তবুও ব্যাগ মনে হয় তোলা সম্ভব হবে না। তাই বাবা সাথে আসলেন স্টেশন অবধি।
কী কপাল আমার! স্টেশনে পৌছেই দেখলাম আমার সামনে ট্রেন দাঁড়িয়ে। আর লোকজন হুড়াহুড়ি করে উঠছে। আমি বুঝতে পারছি না সময়ের এত আগে চলে আসছে, এ কেমন ট্রেন! খেয়াল করলাম এক ভদ্রমহিলা উঠছেন লম্বা পা ঝুলিয়ে দিয়ে সাথে ঝুলছে কোমর অবধি একটা ঝোলা। আমি জানতে চাইলাম এটা কী মানে এই ট্রেন কি ঢাকা যাবে! উনি উদ্ভট দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন। আমার মনে হলো উনার ইচ্ছে করছে আমাকে এখনই একটা ধাক্কা মারবেন। আমি সপাৎ করে পড়ে গেলে তিনি খুব ভালো বোধ করবেন। তবুও তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হলেন। কিন্তু যখনই আমার সাথে কথা বলতে উনি তার একটা এক পা নামালেন এবং বললেন এটা তিতাস’ আর তিতাস ঢাকায় যায়! এই মুহূর্তে আমি উনাকে একটা ধাক্কা মেরে শো করে ট্রেনে উঠে গেলাম। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ হাসলেন।আমার তাতে কিছু যায়ব আসে না!
আমি তো টিকিট কাটার সময় পাইনি। কি হবে আমার! তাই উঠেই একটা সিটের পাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর সেই ভদ্রমহিলাকে অনুসরণ করতে থাকলাম। আমার মনে হলে এই যে তাকে ধাক্কা দিয়ে আমি উথে গেলাম এবং এতে তিনি হেসে আমাকে কিছু বললেন না সুতরাং তাকে বিপদে পরলে আরেকবার ধাক্কা দেয়া যাবে। সাদা পোশাকে টিটি সাহেব আসলে আমি আমার জন্যে একটি টিকিট কেটে নিলাম। আমার কাছে ত্রিশ টাকা আর উনার কাছে বিশ টাকা নিলো। আমি অধিকার সচেতন হয়ে বলেই ফেললাম- এই দশ টাকা বেশি নিলেন কেন!
ভদ্রমহিলা হাসলেন আবারো। বললেন আমি তো এয়ারপোর্টে নেমে যাবো। তাই কিছু কম নিলো। আবার আমার বিপ্লব-মুখ থুবড়ে গেলো। গবা না হয়ে এবার আমিও হাসলাম।এরপর তিনি বললেন-
-কোথায় যান
– ঢাকায়
– কেন
– চাকরি
– নতুন হলো?
-না,বাংলার সহকারী অধ্যাপক।
কথাবার্তা কিছুক্ষণ আমাদের বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেনের নিজস্ব গতিটা চমৎকার, অনেকটা কবিতার মতো। কোন একঘেয়েমি নাই। আড়িখোলা স্টেশনের লাল ইটের ঘর কিছুটা দেখা যাচ্ছে। আমি জানি এখানে কিছুদূর পরেই শীতলক্ষ্যা নদী। কালচে জলের ভিতরে বাহিরে ঢেউ। আমার এই সংগ্রামী জীবনে নতুন বদলীর পর ঢাকা যচ্ছি। ঢাকা কেউ নেই তবু যাই। জীবনে এমন যাত্রা করছি প্রায় টানা বারো বছর।
হঠাৎই চোখ পড়ল যে চারটি সিটের পাশে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই সামনে আমার মায়ের বয়সী একজন মা খালি চোখ মুছে যাচ্ছেন।আমি মাস্টার হয়ে গেলাম আবার। মায়ের পাশে বসা অল্প বয়সী মেয়েটিকে ধমক দিয়েই বললাম, উনার চোখে বাতাস গিয়ে পানি পড়ছে, দেখতে পাচ্ছো না! তুমি এদিকে সরে যাও। মেয়েটি হাসলো। বললো “উনি কান্দে, উনি আমার মা
-ওমা কান্দে কেন!
-ছেলে বিদেশ যাইবো গ্যা।”
আমি এমন সময়ে ছেলেটিকে প্রথম দেখলাম। আমার ছোট ভাই এর বয়সী হতে পারে। চোখ কান শক্ত করে বসে আছে। সে দুবাই যাবে। কালো ছেলেটি আরো কালো হয়ে যাবে, বিনিময়ে আমরা আর তার মা বোনটি ভালো থাকবে।
দেশের বাইরে থাকা অনেক বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেলো। সবাই কেমন আছে, অনেকদিন জানতে চাই না। ভাবছিলাম আর শীতলক্ষ্যা পার হয়ে যাচ্ছি। ট্রেনের চাকা আর রেলের লোহা এক অবিমিশ্র শব্দ গড়ে তুলছে একটানা।
ককককরেকক!
ওমা চলন্ত ট্রেনে মোরগা। সবাই একসাথে দৃষ্টি একদিকে ঘুরাই। কালো বড়ো একটা পলিথিনে বাধা একটা পোটলা আর কিচ্ছু অংশ ছিড়ে মুখ বের করে আছে এক মোরগা। সবাই তাকাতেই কালো বোরখা পরা আরেক মা বয়সী মা হেসে দিলেন। নিজেই বলতে শুরু করলেন “বড়ো পোলার লাইগা নেই। নাতিটা দুইদিন খেলবো তারপর জবাই হইব।”
সবাই আবারো হেসে উঠে। ততোক্ষণে যাকে ধাক্কা মেরে আমি ট্রেনে উঠলাম উনার সাথে আমার গল্প জমে গেছে। মেয়ের গল্প। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। মেয়ে সব পারে শুধু বাংলা পারে না। তালগাছ চিনে না মেয়ে। উঁইপোকা দেখেনি। বললাম প্রতিদিন ঢাকা আসেন? জানালেন, মেয়েকে নিয়ে একা সংসার। আসতেই হয় জীবিকার টানে। কথায় কথায় এয়ারপোর্ট চলে আসি। আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো উনি মেয়ের বাংলা পড়ার দায়িত্ব দিতেন।
নিজের দুঃখ আর কি! এবার বেশ শান্ত লাগছে যখন প্ল্যাটফর্মে গাড়ি ঢুকে গেলো আমার মতো আরও বেকুবদের নিয়ে ঠিক একটা পাইপের মতো যারা ঢুকে গেছি কিন্তু জানি না গন্তব্য!