কৌতুহলবশত পাঁচ বছর বয়সী ছেলেকে একটি কবিতা শোনাতে গিয়ে চমকে উঠলাম౼ সে স্পষ্ট জানিয়ে দিল ‘তোমার কবিতাটি ভালো হয়নি’; বললাম ‘কেন হয়নি?’ সাময়িকপত্রে প্রকাশিত কবিতাটির পাশে জুড়ে- দেওয়া পাখির শিকল-বাঁধা পা দেখিয়ে সে বলল, ‘তোমার কবিতার পা তো দড়ি দিয়ে বাধা’। সেই কবিতাটির বিষয় ছিল এমন একটি পাখি, যে কোথাও যেতে পারছে না, যেতে চাইলে খাঁচার পাঁজরে লেগে যাচ্ছে শরীর, যে-পায়ে ঘুঙুর থাকবার কথা, সে পায়ে বেজে উঠছে লোহার শিকল, আর তাই, বারবার কেঁদে উঠছে প্রাপ্তিটি। এ-বয়সের একটি ছেলে ওই কবিতার মর্মার্থ ও তার অধ্যাত্যভাব বুঝে ফেলবে সে-আশা করব এমন নির্বোধ আমি নই౼ তবু চেয়েছিলাম কবিতাটির মূল বাস্তব যাই থাক, এর ভাব তার মধ্যে কতটা সঞ্চারিত হয় তা দেখা আর অনুভবের জগতকে একটু-আধটু ছুঁয়ে যাওয়া। কিন্তু দেখি সে উল্টো আমাকে পৌঁছে দিল শিল্পের সেই অমীমাংসিত তর্কে। কথাটি সে যে-অর্থেই বলুক, অস্বীকার করবার উপায় নেই, আমরাই নানা ভাবে নানা রূপে কবিতার পায়ে শিকল পরাই আৰ নষ্ট করে দিই তার সকল সম্ভাবনা। একটি কবিতার কবিতা না হয়ে ওঠার পিছনে যে-যে কারণ থাকে, সচেতন হোন আর নাই হোন, তার দায় তো গ্রহণ করতে হয় সেই কবিতা লেখককেই। কত ভাবেই না, কত ভারেই না কবিতা বাধাগ্রস্ত হয়, জাড্যগ্রস্ত হয়, সম্ভাবনা নষ্ট হয়, মৃত্যু ঘটে কত-শত কবিতার ।
এরপরও কারও এমন ক্ষমতা নেই౼ থাকবার কথাও নয় যে౼ কেউ বলে দিতে পারবে, এ-ই হলে কবিতা হয়, এরকম হলেই বরং তাকে আমরা কবিতা বলতে পারব, অন্য কোনোভাবে নয়। একটি কবিতার ভালোত্ব বা কবিতাত্ব বলে যা আমরা ভাবি তা কোনোভাবেই কোনো পূর্বধারণার অভিব্যক্তি নয়౼ হতে পারে না౼ তা আসলে ওই কবিতাটিরই ধারণকৃত পরিবেশের অভিব্যক্ত পরিণতি। তাই কবিতার যদি কোনো সংজ্ঞা থেকে থাকে, তাহলে তা পুরোটাই কবিতা নির্ভর : মুক্ত পাখির / কবিতার উড্ডয়নপ্রয়াসের রূপ আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি শুধু, কিন্তু সেটি সবসময় প্রাথমিক চেষ্টার নামান্তর মাত্র, কারণ, কবিতা / পাখি যখন উড্ডীন, তখনই তা কবিতা, আর উড্ডয়নপ্রয়াস সবসময়ই পাখিভেদে/কবিতাভেদে আলাদা। ছড়িয়ে পড়া, বা, উড়তে পারার মধ্যেই মুক্তির আকাঙ্ক্ষা লুকোনো থাকে, কিন্তু ছড়িয়ে পড়াটাই মুক্তি নয়, মুক্তি যদি ছড়িয়ে যাওয়ারই অন্য নাম হতো শুধু, তাহলে ‘বনলতা সেন’ কবিতার পর্যটককে অন্ধকার ‘মুখোমুখি বসিবার’-তথ্যে যুক্ত হতে হত না, সে ছড়িয়ে পড়ত দেশে-বিদেশে౼ সর্বত্র। আসলে এই মুক্তি শব্দটি আবহ ও ব্যঞ্জনার বিচারে বিমূর্ত একটি শব্দ: দেশকালপাত্র-এর পার্থক্য তো আছেই, কখনো তা থেকেও মুক্ত। মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যেমন ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে, তেমনই হতে পারে গুটিয়ে থাকার মধ্যেও, এমনকি পলায়নেও অর্থাৎ মুক্তির পথও বিভিন্ন ও বিচিত্র। তারপরও অনুমান করি, মুক্তি শব্দটির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার সম্পর্ক সামান্য, তাতে দ্বন্দ্ব ও জট-এর সম্পৃক্ততা যতটুকু, বিচ্ছিন্নতার সম্পর্ক তার চেয়ে কম। এই সম্পৃক্ততা নানা রূপে ঘটে – বাহ্যব্যাপার সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে (অনেকটা সন্ন্যাসগ্রহণের মধ্য দিয়ে), না ভুলে মূলে ফিরে যাওয়ার আকৃতি থেকে এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার অনুভব থেকে౼ এই তিন প্রবণতার কবিতা বাংলা ভাষায় কমবেশি লিখিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিষয়গত কারণেই আজ বিশেষভাবে আলোচিত হবে দেবদাস আচার্যের তিলকমাটি কাব্যগ্রন্থ : বইয়ের কবিতাতে তো অবশ্যই, মাটির রঙে আঁকা (অনন্য) সাধারণ প্রচ্ছদচিত্রেও রয়েছে সেই মুক্তির পরিচয়। বইটির প্রচ্ছদ লেখকের নিজেরই করা, (হয়ত অখণ্ডকৃতির নজির হয়ে থাকবে বলেই এই স/অচেতন প্রয়াস), পুরো বইটির পরিবেশনায় রয়েছে সহজ মানুষের নিবেদন, এ-সকল বিচারে তিলকমাটি কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কবিতার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হয়ে থাকবে, সে- বিষয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেই এই আলোচনা।
২
বইয়ের প্রথম কবিতা থেকে শেষ কবিতা পর্যন্ত পড়ে দেখা যেতে পারে বইয়ের অখণ্ডতা কাকে বলে, আর কবিতাকে বাড়তে দিতে দিতে উড়তে দিতে দিতে কীভাবে কবিতার/পাখির পায়ের শিকল খুলে দিয়েছেন কবি। ‘বাড়তে দিই’ নামক প্রথম কবিতায় দেবদাস শুনিয়েছেন তার হাতের আঙুল বাড়তে দেওয়ার গল্প, আঙুলের মাথায় কীভাবে একটা জোনাক এসে বসল, পরে আঙুল বাড়িয়ে দিলে, তারার মতো আরও ঝাঁক ঝাঁক অসংখ্য জোনাকি, তারপর তারা আঙুল টেনে নিয়ে চলে গেল বহু দূরে, বহু বহু দূরে এবং তাঁর মনে হয় ‘সবচেয়ে কাছের একটা ছায়াপথ/আমার আঙুল’। দ্বিতীয় কবিতার নাম ‘কুপ্রস্তাব’, হ্যাঁ কুপ্রস্তাবই বটে, যখন রাতের মাঠে আঁচল-ছড়িয়ে শোয়া নির্জনতায় কুয়াশার মধ্যে দোল খায় চাঁদ, তখন চারদিকে কিছু একটা মন্ত্রণার মধ্যে মৃদুস্বরের গান-গান ভাব নিয়ে কেউ যদি হাত বাড়িয়ে বহু আগে যৌবন-পেরোনো কবিকে শুভেচ্ছা/আহ্বান জানায়, ইশারায় ডেকে যৌবন ফিরিয়ে দিতে বলে, তাহলে সেই প্রস্তাবকে ‘কুপ্রস্তাব’ না বলে কী বলবেন কবি? কবিতাটি পড়া শেষ করলে বোঝা যায় ‘কুপ্রস্তাব’ নামটা আসলে মজা করেই দেওয়া, ‘কু’ বিশেষণটিও ঠিক কদর্থে ব্যবহৃত নয়, এমনিতেও তাঁর বয়স বা জীবনকে যৌবনের বেড়ায় বাঁধবার আকাঙ্ক্ষা বইয়ের কবিতায় নেই। পাখি দেখে তাঁর ভালো লাগছে, আনন্দ পাচ্ছেন, প্রকৃতির রহস্যে পুলকিত হচ্ছেন এবং এই আনন্দেই তাঁর বসবাস; ফলে এরকম ডাক এলে সেই প্রস্তাবে তাঁকে ঠিকই সাড়া দিতে হয়, সেই ডাক/টান মুর্ত হোক বা বিমূর্ত, তা অস্বীকার করা কঠিন :
যখন জঙ্গল ডাকে, যাই লতা-গুল্ম ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিহরন হয় সর্বাঙ্গে গজায় লতা-পাতা বুনোগন্ধময় যখন ফসল-ক্ষেত ডাকে, আমি যাই যাই, তবে, কিছুক্ষণ পর দোল খাই শিসে বা ডগায় ফুল হয়ে দানা-শস্য হয়ে আকাশের নীচে ভাসি, মেঘ বাতাসের ছোট ছোট উড়ানে খড়-কুটো জলাঙ্গির জলে পা রাখলেই হয়ে যাই ঢেউ আর স্রোত বয়ে যাই, বয়ে বয়ে যাই, বয়ে যাই এভাবে নিজেকে আমি আবিষ্কার করি এ জগতে রূপে-রসে, মুগ্ধতায়
কবিতাটি মুক্ত কবিতার উদাহরণ কি না সে-আলোচনা বাদ দিয়েও লক্ষ করে দেখা যেতে পারে তার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে-থাকা মুক্তি ও আনন্দের বার্তা—এই অনুভব আদিম, আরণ্যক, প্রাকৃতিক ও চিরসাপেক্ষ । কবিতাটির শেষ দুটি পঙ্ক্তিতে নিজেকে আবিষ্কারের তথ্যে আমাদের মনে পড়ে যেতে পারে আবহমান প্রকৃতি-বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির কথা—প্রকৃতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এমন একদৈহিক অনুভব তাঁকে যেমন ছড়িয়ে দিয়েছিল দিক্-দিগন্তরে, আবার ফিরিয়ে এনেছিল মাটির সান্নিধ্যেও। রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন, আগে থেকেই তিনি মাটির সঙ্গে একাত্ম, বা বলা যায় তিনি খোদ মাটিই—লিখেছিলেন, একসময় তিনি যখন পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলেন, যখন তার ওপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যের আলোয় সুদূর-বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধ উত্তাপ উত্থিত হতো….তখন শরৎসূর্যালোকে তার বৃহৎ সর্বাঙ্গে একটি আনন্দ-রস জীবনীশক্তি যা ‘অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং প্রকাণ্ড বৃহৎ-ভাবে সঞ্চারিত’ হত। এই অনুভব ও সম্পৃক্ততার খেলা/আনন্দ ছড়িয়ে রয়েছে তিলকমাটির নানা কবিতায়।
‘ছায়ানট’ কবিতায় কবি যেন ছায়ার সঙ্গে—ঠিক ছায়া নয়, গাছের সঙ্গে—খেলায় শরিক হয়েছিলেন, ছোটোবেলায় সকাল-দুপুরের রোদে দাঁড়িয়ে আমরা যেমন ছায়ার সঙ্গে খেলতাম, অনেকটা সেরকম : কবি দেখেন ছায়া হয়ে শুয়ে আছে গাছ আর সেই ছায়াও ছায়ায় শুয়ে আছে, (আস্তে আস্তে) পাশে দাঁড়িয়ে নিজের ছায়াকে সেখানে দেখে উৎসাহ পান (এবং খেলায় মেতে ওঠেন) : ‘আমার ছায়াকে আমি শুইয়ে দিই ওই শায়িত ছায়ার ভিতর’ আর, পরে যা হয় :
ক্রমে আমি ছায়া-প্রিয় হয়ে উঠি, ভাবি, আমিও আমারই ছায়া, আমার ছায়াকে আমি ছায়া-সিদ্ধ করে ছায়ায় ছায়ায় লালন করি, আর তাকে আমারই মনোবাঞ্ছাময় এক ছায়ালোকে গান গাইতে থাকি ।
একে খেলা বলছি যদিও, তবু এ-অনুভব আসলে সত্যকারের অনুভব, ছায়াকে ছায়ার ভিতর যেমন কখনো শুইয়ে দেওয়া যায় না তা যেমন সত্য, তার চেয়েও বেশি সত্য হলো ছায়া-সম্পৃক্ততার এই অনুভব ও তার সত্যতা, এবং মৌলিকত্ব। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘যে গাছ দেখি না’ কবিতাটির কথা, যেখানে কবি যে-গাছ কখনো দেখেননি তার ছায়া খুঁজেছিলেন এবং শেষপর্যন্ত সেই গাছহীন ছায়া চোদ্দ নয় বরং বিশ পোয়া কষ্ট হয়ে তার বুকে চেপে বসেছিল—তিনি লক্ষ করেছিলেন, ‘…ভরাট জমির/মাটি ভাঙে বারবার কংক্রিটস্তূপের তলে তলে,/আলো খর্খর্ করছে দশতলা ভরানো নিশছায়ায়’। দেবীপ্রসাদের এ-কবিতাটিও চমৎকার, কিন্তু এমন জটিল-গভীর পথের পথিক নন দেবদাস। মাত্র সাড়ে চার লাইনের এক কবিতাভাবনা লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘খুব গভীর কিছু নয়। আমার সময়, আমার জীবন, আমার পরিপার্শ্ব থেকে উপাদান সংগ্রহ করি। সততাকে মান্য করি। যা ভাবি, যা বোধে আসে তা নির্ভার ভাবে প্রকাশের চেষ্টা করি’। দেবদাসের শেষপর্যায়ের কবিতা পড়ার জন্য আমার কাছে এই ‘নির্ভার’ বিশেষণটি তাৎপর্যপূর্ণ। অবশ্য একটি কবিতাকে নির্ভার করে, নানা বদ্ধতা থেকে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা তাঁকে পেয়েছিল অনেক আগে থেকেই এবং এ-বিষয়ে আভাসে-ইঙ্গিতে একটি কারণেরও উল্লেখ করেছিলেন অন্যত্র, ‘একটু বেশি আশা’ শিরোনামের কবিতায়। কবিতাটি পড়লে বোঝা যায় সত্তরের দশকের পর থেকে শুরু করে যখন সেই কবিতাটি লিখছেন, তার মধ্যবর্তী সময়ের কবিতাপ্রবাহ নিয়ে একধরনের অনীহা/বিবমিষা তৈরি হয়েছে তাঁর : তিনি লিখেছেন, পেছনে ফিরে তাকালে তাঁর ভয় হয়, মনে হচ্ছে হৃদয়ের ব্যবহার’ উষ্ণতা হারিয়েছে, ভাষা হারিয়ে ফেলেছে কাঙ্ক্ষিত তীব্রতা :
দুটো প্রচ্ছদ, একটা সত্তর দশকের আর একটা এখনকার মাঝখানে যে-বহমান ধ্বনিতরঙ্গ ছিল আমাদের এই দুই প্রচ্ছদের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে কে কোন ভাষায় কথা বলে ঠিক বুঝি না। কে কোনদিকে টলকে যায়, ধরতে পারি না তাই কিছুটা স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকি, আর ভাবি মনের কথা এখন মনেই থাক একদিন থিতিয়ে আসবে এই ঘোলা জল তখন সেই জলে মুখ দেখার চেষ্টা করব, এর বেশি আর কোনো প্রেরণা নেই আমার
ইঙ্গিতে বললেও বুঝতে বাকি থাকে না কবি কী বলতে চাইছেন, কিসের প্রতি তাঁর অনীহা আর কোথা থেকে আপাতপলায়ন/আপাতনিৰ্বাসন-এ যেতে হয়েছে তাঁকে। তার পর ঘোলা জল থিতিয়ে এলে সেই জলে মুখ- দেখার-পর্বও শুরুও হয়েছে একসময়।
দেবদাস আচার্যের কবিতার পর্বান্তরের কথা বলতে গিয়ে মধ্যবয়সে পৌঁছে তাঁর বাড়ি-বানানোর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন মণীন্দ্র গুপ্ত । এমন বাড়ি, যেখানে ঘরে চলে আসে বাইরের প্রকৃতি আর ঘরের মানুষের জীবনযাপন বাইরে খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে পড়ে আর চারদিকে থাকে গাছপালা, পাথরশিলা, নদী মাঠ প্রভৃতি। মণীন্দ্র জানিয়েছেন, এমন একটি বাড়ি পেয়ে দেবদাসের মন ও কবিতা উভয়ই পালটে যায়। আগে তাঁর কবিতায় থাকত বাইরের জীবন, পরে তিনি চলে এলেন ভিতরের জীবনে। মণীন্দ্র যাকে ‘বাইরের জীবন’ বলেছেন, তা শুরু থেকেই ছিল দেবদাসের কবিতায় : প্রথম কাব্যগ্রন্থ কালক্রম ও প্রতিধ্বনিতে ছিল ষাটের দশকের সমাজ-সময়ের আলোড়ন, মানুষের মূর্তিতে ‘শ্রমজীবী জীবনকে পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা’ দেওয়ার চেষ্টা, পরবর্তী কয়েকটি কাব্যগ্রন্থেও রয়েছে জনজীবন ও জনপদের নানা অনুষঙ্গ—এই সব বিষয় বিবেচনায় রেখেই হয়তো আচার্যর ভদ্রাসন বই-প্রসঙ্গে আলোচনা শেষে লেখেন : ‘আমার মনে হয়েছে, আপাতত এ বই ভূমিকা, হয়ত পরবর্তী বইটি হবে আসল বই। এর পরের বই যেটি প্রকাশিত হয়েছে সেটিকেও সেই ব্যঞ্জনায় মণীন্দ্র গুপ্ত ‘আসল বই’ বলবেন কি না জানি না, তবে তারপর থেকেই সেই পর্বের শুরু এবং যে আছো অন্তরে বইটির পর থেকে ধীরে-ধীরে এসে পৌঁছেছেন আসল বইয়ে, ভেতরের জীবনে এবং এখনকার তিলকমাটির পূর্ণতায়।
এখানে ‘পূর্ণতা’র কথা বলছি যদিও, তবু তার জন্য কবির বিশেষ কোনো উচ্চ আকাঙ্ক্ষা আছে বলে মনে হয় না, এমনিতে আকাঙ্ক্ষা যতটুকু আছে তাও অন্য কবিদের থেকে ব্যতিক্রম : তাঁর আকাঙ্ক্ষা সহজ স্বাভাবিক, জগতের প্রতি শিশু ও সন্ন্যাসীর তাকানোর মধ্যে যে-আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ লুকোনো থাকে তার সঙ্গে এ-আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দের মিল আছে। তাঁর ‘দৃষ্টিসুখ’ কবিতা পড়লে এর প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে :
আজ দুপুরে একটা টুনটুনিকে আমাদের জবা গাছের ডালে ডালে নেচে বেড়াতে দেখলাম সারাদিন আর কিছুই দেখিনি
কিন্তু আসলেই কি দেখেননি, নাকি দেখার মতো কিছুই ছিল না? এ-প্রশ্নের একটা ব্যাখ্যা রয়েছে পরের স্তবকেই—বলছেন, ‘কোনো কিছু দেখতে পাওয়া বেশ বিস্ময়কর’, তাই মাঝে মাঝে দেখেন এবং প্রতিদিন একটি একটি করে দৃশ্য দেখেন, এর বেশি দেখার-মতো-কিছু দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু কেন দেখতে পাওয়া যায় না এ-ভাবনা শুধু আমাদের নয়, তা নিয়ে কবি নিজেও ভাবিত :
কেন তা দেখা যায় না, ౼ভাবি আর ভাবি শেষ কবে কিছু একটা দেখেছিলাম একটা বাছুরের দৌড় দেখেছিলাম একটা বেদেনীর নাকে নোলক দেখেছিলাম...
এই যদি হয় দেখার-মতো দৃশ্য, তাহলে আন্দাজ করা যেতে পারে দৃশ্যটাও এখানে প্রধান কোনো ব্যাপার নয়, অন্তর্দৃষ্টিটাই আসল; কারণ এই দৃশ্য দুটি সবিশেষ ব্যঞ্জনার নিদর্শন নয়। এমনিতেও অভিজ্ঞাননির্ভর প্রতীক হিসেবে দুটি দৃশ্যই বিপরীতার্থক, শুধু অন্তর্দৃষ্টির তৎপরতা ও দেখার আনন্দে তা হতে পারে অর্থবান, আর তা হলে ‘দৃষ্টিসুখ’ নামের তাৎপর্যও এতে ধরা পড়ে। এ-কথার পক্ষে উল্লেখ করা যেতে পারে বইয়ের ‘মন নাচে রে’ কবিতার প্রসঙ্গ, যেখানে উঠোনের বাতাস ঘুরে ঘুরে নাচছে, পাখি নাচছে, দু-একটা খড়কুটোও সঙ্গত করছে—এ-সব দেখতে দেখতে উপভোগ যখন মাত্রাছাড়া হয়ে যায় তখন তাঁর/কবির ‘ভিতর থেকেও খড়- কুটো পাখ-পাখালি বেরিয়ে/নাচে যোগ দেয়’। তাঁর কবিতা নিয়ে এমনটি ভাববার পক্ষে নানা দৃশ্য-চিত্র-উপাদান ছড়ে-ছিতরে রয়েছে বইয়ের নানা কবিতায়। ‘মহাস্পর্শ নামের কবিতায় শুকনো কঞ্চির ডগায় একটি ফড়িঙ এসে বসার পর সেই কঞ্চি জীবন্ত-হয়ে-ওঠার বর্ণনা দিয়ে উল্লেখ করছেন, এভাবে আমাদের দৃষ্টির সামনে ও বাইরে ‘বহু নিষ্প্রাণ বহু পরিত্যক্ত মূল্যহীন বস্তু কোনো-না-কোনো অপ্রত্যাশিত ছোঁয়ায়’ নড়া-চড়া শুরু করে, কথা বলে এবং প্রাণ ফিরে পায়। এ-কবিতায় উল্লেখ করেছেন, কবি নিজেও দেখতে পান না অনেক কিছু, কিন্তু যখন দেখতে পান তখন সেই দৃষ্টিসুখে তাড়িত হন, আলোড়িত হন। এমন বিশেষ বিশেষ দৃশ্য নয় শুধু, লোকায়ত ও গার্হস্থ্য দৃশ্যেও যে কবি আনন্দ পাচ্ছেন এবং এই কারণে আরও কিছুদিন পৃথিবীতে থেকে যেতে চান তার পরিচয় আছে আয়ুরেখা’ কবিতায়। মাটির হাঁড়ি থেকে ফুটন্ত ভাতের বাষ্প, পুকুরের জলে দলে দলে কিশোরীদের স্নান, কুমুদিনীর দুগ্ধদোহন এবং ধান কাটা শেষ হলে ‘ওড়না খোলা মাঠে’ সোনালি মোথার ওপর দুপুর, ঝাঁ ঝাঁ রোদ এবং ওই রোদের ভিতর ঘূর্ণি হাওয়ার একতারা বাজানোর দৃশ্য সকলের চোখে পড়ে না—আসলে সকলেই তাকান কিন্তু দেখেন না, কেউ-কেউ দেখেন, আর যারা দেখেন তারা শুধু চোখের আলোয় দেখেন না, দেখতে দেখতে আন্তরিক আলোয় মুক্তির স্বাদ খুঁজে পান :
জলের ওপর নকশা হাওয়ায় হাওয়ায় এরকম হালকা ভাবে মুক্ত হওয়া মন্দ নয়—মন্দ নয় প্রাণ আজ ঝিরি-ঝিরি বাতাসে নেচেছে মন আজ স্থির জলে মুখ রেখে ধৌত হতে চায় পৌঁছে গেছি সর্বান্তকরণে এই বাঁকে, এই চূড়ান্ত বাঁকে যেখানে টুকরো মেঘ মেঘেরই ভিতরে ঝুঁকে আবছা হতে থাকে
লক্ষযোগ্য যে, প্রাণ হাওয়ায় হাওয়ায় মুক্ত হয়ে౼নেচে౼ধৌত হয়ে౼সর্বান্তকরণে চূড়ান্ত বাঁকে পৌঁছে যায়। এ কিসের ইঙ্গিত? টুকরো মেঘই-বা মেঘের ভিতরে ঝুঁকে লীন হয়ে যাচ্ছে কেন? তা কি মৃত্যুরই ইশারা? হতে পারে, তবে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বা যেকোনো মঞ্জিলে পৌঁছেই যে সবকিছুই শেষ হয়ে যাচ্ছে না, তা পোস্টমডার্ন তত্ত্বের আশ্রয় না নিয়েও, কবিতার পরিবেশেই বোঝা যায়—কোথাও রয়ে যায় কিছু, কবির ভাষায়, ‘ফুরায় না কিছুই’। ‘ফুরায় না কিছুই’ তিলকমাটি বইয়ের অন্য একটি কবিতারই শিরোনাম, যেখানে কবি বলছেন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হাড়-মজ্জা-রক্ত-মাংস তিনি ফেলে যান, নিজেও মিলিয়ে যান, তবু থেকে যান অবিস্মরণীয় রেখে-যাওয়া অনুভূতির কুচগুলির মধ্যে, আর বলেন, ‘নিঃশেষ হওয়ার অর্থ/আমি/এভাবে অর্থহীন করে ফেলি’। বইয়ের অন্যান্য কবিতার প্রবণতা বিচার করলে অবশ্য বোঝা যায় এই ‘থাকা’টাও নির্দ্বন্দ্ব নয় সবসময় — কৃষ্ণ গহ্বর’ কবিতায় আছে এই থাকাটাও এক নেই-এর আবরণে সুন্দরভাবে ঢাকা আর সেই আবরণ খোলা যায় না বলে বারবার একটি ‘নেই’-এর মধ্যে আরেকটি ‘নেই’-এর শূন্যতা ভরে সেই ‘নেই’কে যুক্তিপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা করেন। এ-প্রসঙ্গে অনেকের হয়ত নিৎশের কথা মনে পড়বে, তাঁর কোনো কোনো কবিতায় তার প্রভাবের কথা স্বীকারও করেছেন কবি, কিন্তু তা নির্দ্বন্দ্ব নয় বলে একে চিন্তার স্ফূর্তি ও একপ্রকার ইঙ্গিতময় খেলা হিসেবে ভাবাটাই সংগত। সঞ্জীব প্রামাণিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিল্পে বিষয় কীভাবে বিকৃত হয়ে আসে কবিতায়—এমন এক প্রশ্নের জবাবে দেবদাস আচার্য একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছিলেন : ‘ধরো ফুল-ঝাড়ু, মরগির পালকে তৈরি। নষ্ট হয়ে গেছে, কাজে লাগবে না, তুমি ছুঁড়ে দিলে। ছুঁড়ে দেওয়ার সময় তোমার ভেতর একটা ভ্রান্তি তৈরি হল। ঐ মুরগির পালকগুলো, যা ঝাড়ুর গায়ে লাগানো ছিল—মনে হল জীবন্ত হয়ে পাখা মেলে শূন্যে উড়ে যাচ্ছে—ঝাড়ুটা মুরগিতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এই ভ্রান্তিটুকু তুমি কবিতায় নিলে—লিখলে—ঝাড়ুটা মুরগির মতো উড়ে গেল’। এই উদাহরণের কথা মনে রাখলে বিষয়চেতন দেবদাস আচার্যের কবিতার বিষয় বিস্তারের ধরনটি বোঝা যেতে পারে, আর তা না বুঝলে তার বহু সহজ-স্বাভাবিক কবিতাই কারও-কারও কাছে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। তাঁর দশকের অনেক কবি যেখানে আঙ্গিকচেতন, দেবদাস সেখানে প্রকাশ্যেই বিষয়চেতন, আঙ্গিককে তিনি জল/তেল ও পাত্রের মধ্যকার সম্পর্কের মতো মনে করেন, জলের প্রয়োজনে যেমন পাত্র নির্বাচন, বিষয়ের প্রয়োজনে তেমনই আঙ্গিক, সেকারণেই তাঁর কবিতার অঙ্গ ও আকার, পঙ্ক্তির সংখ্যা ও বিন্যাস কোনোরকম অভ্যস্ত চোখের সীমা-পরিসীমা মানে না। এ সব কিছু ঘটেছে বিষয়ের কারণে চিন্তার স্ফূর্তিতে—মুক্তির প্রয়োজনে—পাখির ওড়ার আকাঙ্ক্ষায়; ছন্দ-বিষয়ে যেমনটি মনে করেন দেবদাস, অনেকটা সেরকমই : “যেমন পাখি উড়তে উড়তে একটা মোচড় দিয়ে জলে ঝাঁপ দেয়। এতে গতিশীল ছন্দ আছে। ফিঙে—টেলিফোন তারে বসে দোল খায়—এতেও একটা ধীর-লয় ছন্দ আছে। কোনো কোনো নারীর কথা বলার ধরনে যে-ছন্দ থাকে, তা শুনে আমরা মুগ্ধ হই। যা মুগ্ধ করে—তাতেই একটা ছন্দ থাকে। একে ‘স্বভাব-ছন্দ’ বলে। কবিতায় এই স্বভাব-ছন্দ আমার ভালো লাগে।” তিলকমাটির ভর থেকে মুক্ত ও উড্ডীন কবিতাগুলির আনন্দ আস্বাদনের জন্য এই স্ফূর্ত চিন্তাগুলো সহায় হতে পারে। যে-কবি নিজেকে ‘আজীবন একটা ফুঁ-এর নীচে আদি-অন্তহীন’রূপে আবিষ্কার করেন, যিনি তাঁর বইয়ের শেষ কবিতায় নিজেকে ‘সুখ-দুঃখের মধ্যে জড়িয়ে থাকব না’ বলে ঘোষণা দেন, তাঁর কবিতা পড়তে গেলে (পূর্ব-সংস্কার থেকে) মুক্ত হওয়া ছাড়া উপায় কী ।
মোস্তাক আহমাদ দীন
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন ২০০৯ সালে, ‘কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব’ শীর্ষক এই অভিসন্দর্ভ ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত। তিনি পেশাগত জীবনে লিডিং ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন।
কবিতার পাশাপাশি সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন মোস্তাক আহমাদ দীন। অনুবাদ করেছেন [প্রথমে ফারসি এবং পরে] উর্দু ভাষায় লিখিত সিলেট-ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থ ‘তারিখে জালালি’।
সম্পাদনা করেছেন ফকিরিতত্ত্বের প্রাচীন গ্রন্থ ‘ফকির বিলাশসহ সিলেট অঞ্চলের কয়েকজন লোককবির গান, জনজাতিবিষয়ক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ১৯১৬ সালে প্রকাশিত ‘বাঙ্গালা ও বাঙ্গালার বাহিরে যেসকল দুর্বৃত্ত জাতি চুরি ডাকাইতি করে তাহাদের সম্পর্কে পুস্তক’ এবং সমালোচনাকাগজ ‘মুনাজেরা।
চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘ভিখিরিও রাজস্থানে যায়’-এর জন্য এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কারসহ কবিতায় সামগ্রিক অবদানের জন্য পেয়েছেন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার।