মাসাধিক কাল আগে একদিন ভাতফোটার মতো সপ্রাণ কৌতূহল আর বুকে জড়ানোর এক অনির্বাণ ঢেউকে দমাতে না পেরে ইচ্ছেডানায় উড়াল দিলে জীবন পেয়েছিল এক অন্য মাত্রা। ঝরাপাতা নয়, যেন সবুজ কুশির উচ্ছ্বাস, যেন প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে পড়েছিল সৃষ্টির আদিমাতা হাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।
মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেনটা যখন নানা আকারের মেঘের ইমারত, নকশাদার মেঘের পাহাড়, পর্বত, পেরিয়ে ছুটছিল তখন সন্তানকে স্পর্শের তৃষ্ণায় কাতর মায়ের মনে হচ্ছিল প্লেনটা আরো দ্রুত গতিতে ছোটে না কেন?
অতপর, উড়ালডানা সিডনী সময় রাত সাড়ে নটায় মাকে পৌঁছে দেয় ‘কিংসফোর্ড স্মিথ’ এয়ারপোর্টে। হাজার হাজার মাইল দূরে নাড়ীপোতা মাটি রেখে পৌঁছে যাই নাড়ীছেঁড়া ধনের কাছে।
কাস্টমস-ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ বেল্ট থেকে নিজের মালামাল খুঁজে, সব বিধি বিধান শেষ করে হ্যান্ড লাগেজের ট্রলি নিয়ে চলে আসি বাইরে। সেখানে অপেক্ষমাণ অসংখ্য মানুষের ভিড়ে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে উৎসুক ব্যাকুল দু’চোখ খুঁজে ফিরছিল যা, পেয়ে যাই। একটি ঢাউস বেলুন যেখানে লেখা-‘ওয়েলকাম অস্ট্রেলিয়া’ আর টকটকে ‘লাল গোলাপ’। ভেজা চোখে, তৃষ্ণার্ত বুকে জড়াই বুকের ‘স্পন্দন’কে। হাতে নেই লালের চেয়ে বেশি লাল গোলাপ, যা আমার দেশের মতো সুগন্ধিযুক্ত না হলেও কাঁটাযুক্ত। কাঁটা যেন কানে কানে ফিসফিস করে লেবানিজ কবি কাহলিল জিবরানে’র ‘দ্য প্রফেট’ কবিতার লাইন মনে করিয়ে দেয়-
‘তোমার সন্তানেরা তোমার নয়।
তারা জীবনের জন্য জীবনের আকুল প্রত্যাশার পুত্রকন্যা
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, কিন্তু তোমাদের ভেতরে জন্ম নেয় না
এবং তারা যদিও তোমাদের সাথে থাকে, তোমাদের সম্পদ নয়’।
এই মহান সুবিখ্যাত কবিকে সামনাসামনি পেতে ইচ্ছে করে, বলতে ইচ্ছে করে,
‘হে মহামান্য কবি! আপনার কথা মানি কিন্তু তালগাছটি আমার। আমার সন্তান আমারই। থাকুক দূরে, যাক ছড়িয়ে পৃথিবীর বুকে, এগিয়ে নিক সৃষ্টিকে…কিন্তু তার স্থান আমার অতল গহীনে। এ দাবী চিরন্তন’।
ঘুরছি-বেড়াচ্ছি-খাচ্ছি। বেড়াচ্ছি উত্তর থেকে দক্ষিণে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। পাহাড়, সাগর, নদী, উদ্যান, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা থেকে শপিংমলে। জগতের আনন্দ যজ্ঞে সকলের নিমন্ত্রণ। এমনকি আমারো।
বেড়াতে বেড়াতে যা কিছু আমার দেশের মত যা কিছু আজন্ম পরিচিত তা দেখেও অবাক হই, মনভরে দেখি, চোখভরে দেখি, ক্যামেরার চোখে আরো আরো দেখি। সেই দেখতে গিয়ে দেখা পেলাম এক অসমাপ্ত গল্পের-
ওইদিন ফিরছিলাম উলংগং থেকে অসাধারণ এক টেম্পল ও ফলস দেখে। (Nan Tien Temple Wollongong) . সিডনি থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে এই উলংগং শহর। এখানে রয়েছে একটি বৌদ্ধমন্দির যেটি তৈরি হয় ১৯৯৫ সালে। এটি মহায়ানা বৌদ্ধদের। ভেতরে একটি টেম্পল ও একটি প্যাগোডা আছে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সবুজে ছাওয়া সেই প্রাঙ্গণের মনমাতানো সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো। আমরা টেম্পল এবং প্যাগোডা দুটোরই অভ্যন্তরে গিয়েছিলাম, অর্থাৎ তারা আমাদেরকে ঢুকতে দিয়েছিল। বুদ্ধের অসংখ্য ছবি সংবলিত, গাছপালা বেষ্টিত টেম্পল ও প্যাগোডা দেখা শেষে ফিরছিলাম…
শহরে ঢুকে পড়েছি, গাড়ি ব্যাংকস টাউন এলাকা পেরুচ্ছে। পুরো এলাকাজুড়ে প্রতিটি বাসার সামনে অন্যান্য গাছের সাথে ফুলে ফুলে উপচে পড়া চাঁপা গাছ আছে। কামিনীও আছে, আসার পর থেকেই মুগ্ধতা ও বিস্ময় নিয়ে দেখে যাচ্ছি। ভাবি এই চাঁপা বা কামিনী এখানে এলো কি করে! এগুলি তো আমাদের উপমহাদেশের নিজস্ব ফুলগাছ।
তুলব তুলব করেও এখানকার চাঁপা বা কাঠগোলাপের সাথে এখন পর্যন্ত ছবি তোলা হয়নি। গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার শখ পুরণে নেমে যাই। ছবির মতো দেখতে একটি বাড়ির সামনে চাঁপার সাথে ছবি তুলছি, তুলছি নানান ভঙ্গিমায়, বয়সী বটের মতোন ছায়াময় দুজন নারী এলেন–
‘এই ফুল যেমন সুন্দর তেমনি এর স্মেইল। খুব চমৎকার। ছবি তুলছ! তোলো তোলো… ছবি তোলার সময় বিপত্তি! তবুও একমত হয়ে ওদের ভাষায় হু হা করে দায়সারা উত্তর দিয়ে আবার মন দেই ফুল ও ক্যামেরার দিকে। তারা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ফের ফিরে এসে বলে-
‘শোনো মেয়ে, এ গাছটার চেয়ে দেখ ঐ গাছটায় বেশী ফুল আর বেশী সুন্দর। তাকিয়ে দেখি দুটো গেট পরেই গাছটি আসলেই পরিপুর্ন সৌন্দর্য মেলে দাঁড়িয়ে আছে। ধন্যবাদ দিয়ে পা বাড়াতে যাব তাদের সাবলীল কৌতূহল-
‘তুমি কি বেড়াতে এসেছ? Visitor’?
‘হ্যাঁ’
‘কোন দেশ থেকে? এদেশ তোমার কেমন লাগছে?
‘জানাই’
‘কবে এসেছ? উঠেছ কোথায়’
‘জানিয়ে দেই’
এবারে আরো কাছে এসে হাসিমুখে বলে,
‘আমাদের দেশটা কিন্তু খুব চমৎকার, তাই না? এবারে আমি তাদের দিকে মনোযোগ দেই। বলি,
‘অবশ্যই তোমাদের দেশ সুন্দর। আমার দেশও অনেক সুন্দর। জানো, আমার দেশে এই চাঁপা যে কতরকমের আছে!
‘তাই নাকি! কেমন বল শুনি’।
চাঁপা নিয়ে মোটামুটি অনেক কথা বলি। নাগচাঁপা, দোলনচাঁপা, কাঠালিচাঁপা, স্বর্ণচাঁপার কথা বলি। আরো বলি হিম চাঁপার কথা।
‘যা তোমাদের ম্যাগনোলিয়া তা আমাদের হিমচাঁপা। এই হিমচাঁপার নাম পাল্টে আমাদের একজন বিখ্যাত কবি নাম দিয়েছেন ‘উদয়পদ্ম’। তারা খুশি হয়ে ওঠে। আবার জিজ্ঞেস করে,
‘ও তোমার কি হয়’?
‘আমার সন্তান। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকিয়ে তারা হেসে ফেলে-
‘Are You joking! তুমি মজা করছ’?
‘না’। এবারে হাসি থামিয়ে সিরিয়াস মুখে বলি ও আমার সন্তান। সেও সমর্থন জানায় ‘হ্যাঁ, আমার মা’।
দুই নারী এবারে হাসির ঝংকার ছড়িয়ে এমন উচ্ছসিত আর আনন্দিত হয়ে ওঠে, বলার মত না। দু’জনেই এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে।
‘তুমি এতো ইয়াং, এতো সুন্দর…এত ফ্রেন্ডলি’… বলতে বলতে ঠোঁটের মাঝে একটু থুতু এনে, নিজ তর্জনীতে লাগিয়ে আমার কপালে, গালে, গলায় ছুঁয়ে দেয়। কি করছে বুঝতে একটু সময় লাগে। যখন বুঝতে পারি সময় যেন থমকে যায়। বিহ্বল একটা মুহুর্ত এসে দাঁড়ায়! আনমনা হয়ে ওঠি! হঠাত করেই আমি যেন স্মৃতিভ্রংশ হয়ে পড়ি, মনে হয় কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, সামনে কি আমার মা খালা নাকি অন্য কোনো আত্মার আত্মীয়!
মনে হয়, আমার দাদী, নানী, ঠাকুমা, পিসিমা তাদেরই কেউ একজন আমাকে সবরকম ‘বদ নজর’ থেকে আগলে রাখার জন্য এই ‘রক্ষাকবচ থুতুর’ স্পর্শ দিলেন। যেমন ছোটবেলায় দিতেন ‘নজরটিপ’। যুগ, সংস্কৃতি বদলালেও ভালোবাসার রূপ একই থাকে।
একজন জড়িয়ে ধরেই থাকে আর প্রজাপতির মতো ঘুরেঘুরে একই কথা বলে তুমি আমার মেয়ে, তুমি আমার মেয়ের মতো, আসলে তুমি আমার মেয়েই…
এরপর আরো খানিকটা গল্প হয়, ভাব বিনিময় হয়, চোখে চোখে অন্তরঙ্গ দৃষ্টি বিনিময় হয়।
তারা তাদের বাসায় যাবার জন্য আন্তরিক আহ্বান জানায়। বার বার দরোজার দিকে আঙ্গুল তুলে অনুরোধ করে-
‘এসো একটু বসে কফি খেয়ে যাও’। ইচ্ছে করল খুব তবুও গেলাম না। কেন যে গেলাম না! ঐযে কোথায় যেন এক পেন্ডুলাম তাড়া দিতে থাকে সময় নেই! সময় নেই! একজন জড়িয়ে ধরে বলে-
‘যে কোনোদিন, যেকোনো সময় তুমি আমার কাছে চলে আসবা। এইযে দরোজা মনে রাখবা’। মনে থাকবে তো…
শুরু থেকেই নিজ শার্টের খোলা বোতাম কাঁপা হাতে আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন- হাত বাড়িয়ে যত্নে তা লাগিয়ে দেই-যেন আমার মায়ের ম্যাক্সির জিপারের মতো। তিনি আরো ব্যাকুল হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে চুমুর পর চুমু খেতে থাকলেন সারা মুখে। নিয়ন্ত্রণ নামক শক্ত ফিতায় বেঁধে রাখা আমার ভেতরটায় চিড় ধরে, মনে মনে এই নানি, দাদীর নাম দেই ‘রোজ’ আর ‘মেরি’। ভেতরে টইটুম্বুর শান্ত জলের প্যারামাট্টা নদী যেন উতল হয়ে যায়!
ভাষা, গাত্রবর্ণ, বয়স, পোশাক, ভৌগলিক দূরত্ব সব ভেসে যাক প্যারামাট্টার জলে… ‘রোজ’ আর ‘মেরি’র কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এই অপাত্য ভালোবাসা পরমাবেশে তুলে রাখি পাঁচসিকে জীবনের সঞ্চয়ের ঝুলিতে…