‘ধর্ম -কর্ম-আধ্যাত্মিকতা’ এই শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট যে আলোচ্য্ প্রবন্ধে্ মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক তিনটি বিষয়ের প্রকৃত স্বরূপ ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরাই প্রবন্ধকারের মুখ্য উদ্দেশ্য।তার উপর ‘ধর্ম’ ও ‘আধ্যাত্মিকতা’ শব্দ দু’টি অনেকার্থবোধক এবং যথেষ্ট গোলমেলে, বিতর্কিত শব্দবন্ধ। তবে এই প্রবন্ধে শব্দ দু’টিকে এক বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এই শব্দযুগলের যথাযথ অর্থ পরিস্ফুট না হওয়া পর্যন্ত শব্দ দু’টির বাস্তব প্রয়োগকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভ্রান্তির প্রশমন সম্ভব নয়। আলোচ্য নিবন্ধের পরিসরে প্রথমেই শব্দ দু’টির যথাযথ অর্থ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘ধর্ম’ শব্দটি যে বহুরূপে ব্যবহৃত তা বোঝানোর জন্য সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর ‘মহাভারতের কথা’ গ্রন্থটির নিম্নোক্ত অংশটি বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য :“ধর্ম! ধর্ম! ধর্ম! কতবার আমাদের শুনতে হল ধর্ম – ভীষ্মের মুখে, বিদুরের মুখে, নারদের মুখে – সবচেয়ে বেশি যুধিষ্ঠির ও ধৃতরাষ্ট্রের মুখে – অবিরাম, অফুরন্তভাবে পুনরুক্ত। এবং শুধু তত্ত্বজ্ঞানীরাই নন – এই দ্বিমাত্রিক ভারবান্ শব্দটি মুখে না এনে ভীম, কর্ণ, কুন্তী, দ্রৌপদীও তাঁদের বক্তব্য উপস্থাপিত করতে পারেন না। কুরুপাণ্ডবের বিরোধের আরম্ভ থেকে উদ্যোগপর্বের শেষ পর্যন্ত সহস্রবার আবৃত্ত হলো কথাটা, নানা ব্যক্তির দ্বারা, নানা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত, ব্যাখ্যাত ও বিমর্দিত হলো। আর সেই বিতণ্ডা থেকেই আমরা স্পষ্টভাবে বুঝে নিতে পারলাম শুধু এই কথাটুকু যে, ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ণ – অনির্ণেয় – আমাদের পক্ষে প্রায়শই বিভ্রান্তিজনক।….ধর্ম এক বহুরূপী ধারণা”। এই কারণেই আমাদের শাস্ত্র বলে ধর্মের তত্ত্ব গুহায় নিহিত -“ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম”। ‘ধর্ম’ শব্দটি বহু জায়গায় বহুরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। ফলতঃ ‘ধর্ম’ শব্দের অর্থ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মের স্বরূপ নিয়ে এ হেন জটিলতা থাকাতেই সম্ভবত স্বয়ং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও ধর্মের তত্ত্বকে গুহায় নিহিত বলেই মেনেছেন।
বলাবাহুল্য বর্তমানে আমাদের চারপাশে ঘটে চলা ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় হানাহানি, হিংসা, অসহনশীল ঘটনার মূলে রয়েছে এই ‘ধর্ম’ সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব। এই প্রবন্ধে প্রবন্ধকারের মূল উদ্দেশ্য হলো ‘ধর্ম কী’ তা বোঝার চেষ্টা করা, ধর্মের সঙ্গে কর্মের সম্বন্ধ, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি পর্যালোচনা করা। এই প্রসঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্ম সমন্বয় আদৌ সম্ভব কিনা সে বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করাও নিবন্ধকারের অভিপ্রায়।
ধর্ম কী? ধর্ম কাকে বলে? উত্তরে বলা হয়, ‘ধৃ’ ধাতুর উত্তর ‘মন্’ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন এই ‘ধর্ম’ শব্দটি ‘যা ধারণ করে রাখে’ তাকেই বোঝায়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয়
২
‘property’ অর্থাৎ বস্তুর অন্তর্নিহিত আবশ্যিক প্রকৃতি। অর্থাৎ ধর্মকে বাদ দেওয়ার অর্থ বস্তুর অস্তিত্ত্বকে বিপন্ন করা। যেমন আগুনের ধর্ম দহন করা, আগুন থাকলে দহনক্রিয়া থাকে, আগুন না থাকলে দহনক্রিয়া থাকে না। তেমনি মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব, যা তাকে অ-মানুষ থেকে পৃথক করে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, বস্তুর আবশ্যিক ধর্মকে বস্তু থেকে পৃথক করা যায় না। যেমন আগুনের ধর্ম দাহিকা শক্তি সর্বদা আগুনের সঙ্গেই থাকে। তাহলে পৃথকভাবে মানুষের ধর্মের কথা বলবার সার্থকতা কোথায়? মানুষ তো মনুষ্যত্ব ধর্ম নিয়েই জন্মায়। এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় আহার, নিদ্রা, ভয় এবং মৈথুন – এই যে চারটি ধর্ম, তা মানুষ এবং পশুর মধ্যে সমানভাবেই থাকে। কিন্তু তার পরেও মানুষের মধ্যে যেটি বিশেষ এবং অধিক সেটি হল তার ধর্মবোধ এবং এই ধর্মবোধই মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে। মনুষ্যেতর প্রাণীর কাছে ধর্ম জন্মপ্রদত্ত অর্থাৎ তারা ধর্ম নিয়েই জন্মায়। কিন্তু একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই ধর্ম অর্জন করতে হয়। এটি জন্মগতভাবে প্রাপ্ত নয়। আপাতদৃষ্টিতে এই বক্তব্য স্ববিরোধী মনে হতে পারে, কেননা ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে মানুষ মনুষ্যত্ববিশিষ্ট। বলাবাহুল্য মানুষ হয়ে জন্মালেই মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠে না। এখানে ‘মনুষ্যত্ব’ শব্দটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। যে বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলী মানুষকে সত্যিকারের মানুষ করে তুলতে সক্ষম সেগুলি তাকে অর্জন করতে হবে এবং এই অর্জন করার ক্ষমতা মানুষের মধ্যে রয়েছে। সেই বিশেষ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর তার জন্য প্রয়োজন নিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলাবোধ।
ওপরের আলোচনা থেকে একথা তো স্পষ্ট যে, মনুষ্যত্ব হচ্ছে মানুষমাত্রেরই ধর্ম। এই ধর্ম অর্জন করতে হয়। জাতি-ধর্ম-সংস্কৃতি নির্বিশেষে এই মনুষ্যত্ব এক ও অভিন্ন। হিন্দুর জন্য একপ্রকার আর মুসলমান বা খ্রীষ্টানের জন্য অন্যপ্রকার মনুষ্যত্বের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। বস্তুতঃ হিন্দু, মুসলমান বা খ্রীষ্টান ও অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকৃত অর্থে কোন ভেদ থাকতে পারেনা। সকলেই মানুষ এবং সকলের ধর্মই এক – মনুষ্যত্ব অর্জন।
আলোচ্য প্রবন্ধে ‘ধর্ম’ শব্দটির দ্বারা কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে বোঝানো হয়নি। বরং ‘ধর্ম’ শব্দটি ‘নৈতিক কর্তব্যকর্ম’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সে কারণেই শব্দটির ব্যঞ্জনা সম্পুর্ণ স্বতন্ত্র। ধর্ম বলতে আমরা বুঝব বিশেষ নিয়মশৃঙ্খলা যেগুলি কিনা একজন মানুষের মধ্যে শুভপ্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলে। এই ধর্মকে যেমন ব্যক্তিগত আদর্শরূপে গ্রহণ করা যায়, তেমনি সামাজিক আদর্শ, বিশ্বজনীন আদর্শরূপেও গ্রহণ করা যায়। মনুষ্যসৃষ্ট যে সমস্ত নিয়মশৃঙ্খলা, সদাচার পালন করে মানুষ নিজেকে এবং তৎসহ সমাজস্থ অপরাপর ব্যক্তিদের ক্রমোন্নতির পথে টেনে নিয়ে যায় তাই ধর্ম তথা নৈতিক কর্তব্য। অতএব একটি বিষয় স্পষ্ট যে বর্তমান প্রবন্ধে ‘ধর্ম’ শব্দটি নৈতিকতা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। নৈতিক কর্তব্য সম্পাদন করা মানেই ধর্মাচরণ করা বা ধর্ম পালন করা। সমাজস্থ প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের নির্দিষ্ট কিছু কর্তব্যকর্ম থাকে। সমাজস্থ জীব হিসেবে আমাদের
৩
প্রত্যেকেরই নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, এমনকি সমাজস্থ অন্যান্য
প্রাণীকূলের প্রতি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে যেগুলি অবশ্যপালনীয়। প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ কর্তব্যকর্ম সুচারুরূপে সম্পাদন করার ওপরেই সামাজিক শৃঙ্খলা, সামাজিক সুস্থিরতা নির্ভর করে। এইসব কর্তব্যকর্মই ‘ধর্ম’ শব্দের দ্বারা বোঝানো হয়েছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে মানুষের জীবনের চারটি স্তরভেদ (four stages of life) স্বীকৃত হয়েছে। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস -জীবনের এই প্রতিটি পর্যায়ের জন্য নির্দিষ্ট কর্তব্যকর্মগুলোর সুষ্ঠু সম্পাদনের ওপর নির্ভর করে সামাজিক শৃঙ্খলা ও সংহতি।
ধর্ম মানুষের জন্য খুবই হিতকর। আমাদের শাস্ত্রে বলে সব মানুষকেই ধর্ম রক্ষা করে চলতে হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি সব মানুষ স্বভাবত ধর্মকে চায়না। তার কারণ কী? বলা বাহুল্য, সমাজস্থ অগণিত সাধারণ মানুষের পক্ষে ধর্ম রক্ষা করে জীবনযাপন করা সবসময় সম্ভব হয়না। আসলে ধর্মপথে চলতে গেলে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়, অনেকটা ক্লেশ, ত্যাগ এবং সংযম পালন করতে হয়, তাই সেই পথে প্রবৃত্তি না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ধর্মকে পরিত্যাগ করে মানুষের জীবন অর্থপূর্ণ হতে পারে না। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে রয়েছে উত্তরণের একটা প্রচেষ্টা। অর্থাৎ যে মানুষ যে অবস্থায় রয়েছে সেখান থেকে সে নিজেকে ক্রমান্বয়ে উন্নততর, উন্নততম অবস্থায় উন্নীত করতে চায়। একেই বলে অভ্যুদয়।এই অভ্যুদয়ের পথে ধর্মাচরণ অর্থাৎ নৈতিক কর্তব্যপালন অত্যন্ত জরুরী।
এই ধর্ম বা নৈতিকতার একটি আধ্যাত্মিক ভিত্তি রয়েছে। এতক্ষণ ‘ধর্ম’ শব্দটির অর্থ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং নির্যাস হিসেবে জেনেছি বর্তমান প্রসঙ্গে ‘ধর্ম’ শব্দটি নৈতিকতা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে ‘আধ্যাত্মিকতা’ কী? ধর্মের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কি কোনরূপ সম্পর্ক আছে? ‘ধর্ম’ বলতে যদি ‘Religion’ বোঝানো হয়, সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ক্ষেত্রে ‘Spirituality’ বা ‘আধ্যাত্মিকতা’ বলতে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়া বোঝাতে পারে। এখানেও মনে রাখতে হবে ‘Religion’ শব্দটি কিন্তু ধর্মের প্রতিশব্দ হতে পারেনা। বঙ্কিমচন্দ্র বিশেষ বিচারপূর্বক তাঁর ‘ধর্ম্মতত্ত্ব’ গ্রন্থটিতে এই বিষয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে Religion হল এক ধরণের মত – অবশ্যই কোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বা দ্রষ্টা মানুষের মত। কিন্ত ধর্মমত নয়। এমনকি কোন পূত পবিত্র সদগুণসম্পন্ন ব্যক্তির মতও নয়। ধর্ম হল তাই যা ধারণ করে রাখে। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা বলতে ভিন্ন কোন অতিজাগতিক সত্তায় বিশ্বাস বোঝাতে পারে। সাধারণভাবে অনেকেই ঈশ্বর বা ভগবানে বিশ্বাস করেন। সাধারণ মানুষের এই ঈশ্বরবিশ্বাস হল ‘conventional religion’ এবং এই বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক। ধর্ম বা নৈতিকতার ক্ষেত্রে যে আধ্যাত্মিকতার কথা বলা হয় সেটি বিশেষ ধর্মাবলম্বীর অতিজাগতিক অতীন্দ্রিয় সত্তায় বিশ্বাস নয়। ধার্মিক তথা নীতি-পরায়ণ ব্যক্তি কোনও ধর্ম বা ধর্মমতে বিশ্বাসী নাও হতে পারেন। ধর্ম তথা নৈতিকতার ক্ষেত্রে ‘আধ্যাত্মিকতা’ শব্দটি এক বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে ‘আধ্যাত্মিকতা’ শব্দটিতে
৪
‘আত্মঅন্বেষণ’ তথা ‘আত্মদর্শনই’ মুখ্য হয়ে ওঠে। নিজেকে আবিষ্কারের প্রচেষ্টা থেকেই এই অধ্যাত্মবাদের জন্ম। এটি এক ধরণের জীবনবোধ, এক ধরণের উত্তরণের প্রচেষ্টা। মনে রাখতে হবে, এই প্রচেষ্টা একমাত্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব। কোন মনুষ্যেতর প্রাণীর পক্ষেই প্রেয়কে পরিত্যাগ করে শ্রেয়র পথে যাত্রা সম্ভব নয়। কেননা ভাল মন্দের বোধ তাদের থাকে না।
এখানে প্রশ্ন হতে পারে, এরূপ আধ্যাত্মিকতার কী আদৌ কোনো দরকার আছে? আছে বৈকি। কারণ দুঃখনিবৃত্তি ও আনন্দপ্রাপ্তি – এ দুটি সবাই চায়। কিন্তু সবকিছু পাওয়ার পরেও দেখা যায় দুঃখকষ্টের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হচ্ছে না। প্রশ্ন জাগে, এমন কিছু কী আছে, যা পেলে দুঃখকষ্টের চরম নিবৃত্তি ঘটবে? চিরকালের জন্য দুঃখনিবৃত্তির কোনো উপায় আছে কী? দুঃখনিবৃত্তি আধ্যাত্মিকতা ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। এই হল সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা – নিবৃত্তিমার্গীর আধ্যাত্মিক ভাবনা। নিজেকে জানবে – আত্মাকে জানবে – আত্মাকে জানার এই প্রচেষ্টা – এখান থেকেই আধ্যাত্মিকতার জন্ম।
সাধারণ দৃষ্টিতে অধ্যাত্মবাদ এমন এক বাস্তবতাকে বোঝায়, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের স্থূলতা থেকে, প্রাত্যহিক হতাশা, অপ্রাপ্তি ইত্যাদি থেকে অনেক দূরে, অনেক গভীরে নিয়ে যায়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আধ্যাত্মিকতা মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন বিষয়। বরং আমাদের অভ্যন্তরস্থ, অন্তর্নিহিত সত্তাকে উপলব্ধির প্রচেষ্টা হল আধ্যাত্মিকতা লাভ। মানুষের মনের বিস্তার যত বেশি হয়, তার ভেতরকার আধ্যাত্মিক সোপানগুলিও ততটাই প্রসার লাভ করে।
এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় পাঠকের সামনে তুলে ধরা দরকার। ঈশ্বরে বিশ্বাসী হওয়া এবং আধ্যাত্মিক হওয়া – এই দুটি বিষয়কে কিন্তু এক করে ফেলা যুক্তিযুক্ত নয়। আধ্যাত্মিক হওয়া মানেই ঈশ্বরবিশ্বাসী হতেই হবে, এমনটি বলা যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসম্মত ঈশ্বর যাঁরা মানেন না, তাঁদের কাছে অতীন্দ্রিয় কোন শক্তিতে বিশ্বাসী না হয়েও কেউ আধ্যাত্মিক হতে পারেন। নিজেকে জানবার আগ্রহ যাঁর রয়েছে, তিনিই অধ্যাত্মবাদীরূপে বিবেচিত হবেন এবং এই অর্থেই ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা পরস্পরের পরিপূরক।
বর্তমানে চারপাশে ধর্মকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা মানুষের জীবনে চরম দুর্দশা বয়ে এনেছে,তা আমাদের অভিজ্ঞতাসিদ্ধ। কিন্তু এর দায় আমাদেরই নিতে হবে। ধর্মভাবগুলি যতক্ষণ পর্যন্ত সর্বজনীন না হচ্ছে, এই সংকট কাটবে না। এই বিষয়টিতে স্বামী বিবেকানন্দ চরম আশাবাদী মানুষ ছিলেন। ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবী তাঁর স্বপ্ন ছিল। তিনি বলেছেন, “কখন কখন এইরূপ বলিতে শোনা যায় যে, ধর্মভাব পৃথিবী হইতে তিরোহিত হইতেছে। আমার মনে হয় ধর্মভাবগুলি সবেমাত্র বিকশিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে। যতদিন ধর্ম মুষ্টিমেয় ‘ঈশ্বরনির্দিষ্ট’ ব্যক্তিদের বা পুরোহিতকুলের হাতে ছিল, ততদিন উহা মন্দিরে, গির্জায়, গ্রন্থে, মতবাদে, আচার-অনুষ্ঠানে নিবদ্ধ ছিল। কিন্তু যখনই আমরা ধর্মের যথার্থ আধ্যাত্মিক ও সর্বজনীন ধারণায়
৫
উপনীত হইব, তখন এবং কেবল তখনই উহা প্রকৃত ও জীবন্ত হইবে – ইহা আমাদের স্বভাবে পরিণত হইবে, আমাদের প্রতি গতিবিধিতে প্রাণবন্ত হইয়া থাকিবে, সমাজের শিরায় শিরায় প্রবেশ করিবে এবং পূর্বাপেক্ষা অনন্তগুণ কল্যাণকারিণী শক্তি হইবে”। কী অপূর্ব ব্যাখ্যা! শুনে ধর্ম নিয়ে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়।
স্বামীজীর চোখে ধর্ম মানবজীবনের এক মহার্ঘ সম্পদ। তিনি বলেছেন, “মানুষ যতপ্রকার প্রেমের আস্বাদ পাইয়াছে, তন্মধ্যে তীব্রতম প্রেমলাভ হইয়াছে ধর্ম হইতে এবং মানুষ যতপ্রকার পৈশাচিক ঘৃণার পরিচয় পাইয়াছে, তাহারও উদ্ভব হইয়াছে ধর্ম হইতে।…..ধর্মপ্রেরণায় মানুষ জগতে যে রক্তবন্যা প্রবাহিত করিয়াছে, মনুষ্যহৃদয়ের অপর কোন প্রেরণায় তাহা ঘটে নাই; আবার ধর্মপ্রেরণায় যত চিকিৎসালয় ও আতুরাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, অন্য কিছুতেই তত হয় নাই”। এর থেকে বোঝা যায় যে, ধর্মের শক্তি অমোঘ, কিন্তু সেই শক্তির প্রয়োগের ওপরই নির্ভর করে ধর্ম শান্তির, মিলনের দূত হবে; নাকি দ্বন্দ্ব-কোলাহল, হিংসাদ্বেষের স্রষ্টা হবে। ধর্মপ্রভাবে মানুষ ভয়াল, ভয়ঙ্কর যেমন হতে পারে; তেমনই ধর্মপ্রভাবেই মানুষ কোমল, দয়ালুও হতে পারে।
মনুষ্যত্ব অর্জিত হলে মানুষের মধ্যে কোন ভেদবুদ্ধি থাকে না। আমরা সবাই মানুষ, মানবিকতাই আমাদের ধর্ম – এই শুভবুদ্ধি এবং কল্যাণ প্রার্থনাই ধর্মের প্রাণ। এই ‘আত্মানুসন্ধান’ অর্থেই ‘আধ্যাত্মিকতা’ বা ‘অধ্যাত্মভাব’ শব্দটি এসেছে এই নিবন্ধে। একবার এই বোধে উত্তীর্ণ হতে পারলেই ‘ধর্ম‘, ‘আধ্যাত্মিকতা’ শব্দগুলিকে কেন্দ্র করে যেসব বিভ্রান্তি, অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়, তা থেকে আমরা কিছুটা হলেও মুক্ত হতে পারব।

কবি
লিটল ম্যাগাজিনের সাথে সংশ্লিষ্ট
পেশায় ব্যবসায়ী