দু’হাতে হেলেঞ্চা শাকের ডালাটা বাড়িয়ে ধরে কন্ঠ তোলে নয়নতারা,
-বুবু, অ বুবু! এ্যাই এগিলা হইবে? না আরো তুলি আনিম? সফুরা উনুনের পাশ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে শাকের ডালাটা দেখে, সবুজ শাকের কচি কচি ডগায় ডালা উপচে পড়ছে। বুবুর উত্তরের আগেই আবার ঝনঝনিয়ে ওঠে তারার কন্ঠ,
-জানিস বুবু, ম্যালাগুলা ডিমালি শাকও আছে, তুলি আনিম নাকি? শুকটা দিয়া আন্দিলে এলা খুব মজা হইবে, তোর হাতের আন্দনে যে মজা…
বুবু হাসিমুখে বলে আইচ্চা যা তুলি আন, আর এগিলা দিয়া যা মুই বাছি নেও। বুবুর কথা শুনে ডালার শাকগুলা তার সামনে ঢেলে দিয়ে সে জরি, পরি দুই ভাগ্নিকে নিয়ে আবার হাসতে হাসতে ছুটতে থাকে খালপাড়ের দিকে। যেখানে বৃষ্টির জল পেয়ে শাকেরা সব ডগমগিয়ে মাথা তুলে সবুজ হয়ে নাচছে হেলেদুলে। হেলেঞ্চা, ডিমালি, ঢেকি, কলমিলতা কি নাই সেখানে! প্রান্তিক মানুষদের নুনভাত খাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এতোটুকু কার্পণ্য না করে এরা দুরন্ত বেঁচে থাকে।
খাল উপচে জল পাড় পর্যন্ত উঠে এসেছে। ছপছপে কাঁদাজলে তুলকালাম রোদের মধ্যে তিনজন ধুন্ধুমার আনন্দে শাক তুলতে থাকে। ছোটটা মানে পরি ঘাসের ডগা ছিড়ে দেখায়,
-খালা, খালা এইযে শাক তুলচি…
-হ, এগিলা শাক না তোর বাপের কাল্লা। ছাওয়া তুই শাক চিনিস না? বলে পরিকে দুহাতে মাথার উপরে তুলে ঘুর্ণিপাক দেয়, পরি খিলখিল করে হাসতে থাকে। নিজেও হিহি হেসে ওকে নামিয়ে দিয়ে বলে,
-তোকে আর শাক তোলা না নাগবে। তুই বসি থাক। কিন্তু ও ছাড়বে কেন? আবার সে হাতের কাছে যা পায় তাই ছিঁড়তে থাকে মনের আনন্দে। কলমিলতার পাতার খাঁজে খাঁজে ফুটে আছে হালকা বেগুনি রঙয়ের ফুল যাকে নয়নতারারা মাইক ফুল বলে। সে পুট করে একটা ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় গুঁজে দেয়।
বছর খানেক থেকে নয়নতারা ওর বুবুর কাছে থাকে। মা মরে যাবার পর বুবু দুলাভাই ওকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছে। না এনে উপায় ছিল না। বাড়িতে আর কেউ নাই। এমনকি মা যে ঘরটাতে থাকত সেটার অবস্থাও একেবারে জীর্ণ। যে কোনোদিন ভেঙে, মাটিতে মিশে যাবে।
উঠতি বয়সের মেয়েটাকে না এনে কি করবে? তারার দুলাভাই মানুষটা সাদাসিধা দয়ালু ধরনের। বউকে বলেছিল,
-তা আসুক। হামরা চাইরটা খাবার পাইলে অয়ো খাইবে।
মায়ের সাথে থাকা কালীন নয়নতারা ওদের পাড়ার একটা স্কুলে পড়ত। গরীব ঘরের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় প্রধানত সরকারের উপবৃত্তির টাকার জন্য, বইও সরকার থেকেই পায়। কাজেই গ্রামে গঞ্জে অনেক দরিদ্র ছেলেমেয়েই স্কুলের গন্ডি পার করে ফেলে।
তারা সেখানে ক্লাস নাইনে পড়ত। ভজা স্যারের মেয়ে বকুল আর তারা ছিল হরিহর আত্মা। দু’জনে ছাত্রী ভালই ছিল। ওরা পাঠ্য বইয়ের কবিতাগুলো একসাথে মুখস্ত করত আর স্যারের কঠিন নির্দেশে শুদ্ধভাষায় কথা বলার চর্চা করত। সকল ছাত্র ছাত্রীর জন্যই স্যার এই কাজটা করত।
এখানে আসার পর ওর বুবু, দুলাভাই বলেছে স্কুলে ভর্তি করায় দেবে, কিন্তু হয়ে উঠছে না।
বুবুর সাথে সাথে সংসারের বহু কাজ কাম নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে হাসিখুশি সুঠাম স্বাস্থ্যের মেয়েটা। বাচ্চা দুইটা তো খালাকে পেয়ে মহাখুশি।
তারার দুলাভাই হাটবাজারে একে তাকে একজন পাত্রের কথা বলে- এতিম মাইয়াটার বিয়াশাদী দেওয়া দরকার। কিন্তু ওর বুবু ভাবে কতই বা বয়স! থাকুক আর কয়টা বচ্চর বইনের গোরত থাকুক। এলাও সে খুব বেশি অবুজ, চঞ্চল! এত লাফফাঝাপ্পা করে! স্বামীর বাড়ি যায়া খালি ডাং মাইর খাবার নাগবে। আরেকনা জ্ঞান-বুজ হউক।
শাক তুলতে তুলতে ওরা বেশ কিছুটা খালের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে পায়ের পাতা ডোবানো কাঁদাজল। হঠাত, পায়ের কাছে কিযেন নড়ে ওঠে। তারা চমকে ওঠে! ভয় পেয়ে যায়। একঝটকায় সে পরিকে কোলে তুলে নিয়ে জরির হাত ধরে ছুটতে যাবে, তখুনি দেখে ওটা একটা বড় শোল মাছ। সে পরিকে কোল থেকে নামিয়ে দক্ষ শিকারীর মতো দুই হাতে শক্ত করে মাছের ঘাড়ের কাছটা ধরে ফেলে। কিন্তু মাছটা বেশ শক্তিশালী। কাঁদার মধ্যে খুব মোচড়াতে থাকে, তারা সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে, পিচ্ছিল মাছ এই বুঝি ছুটে যায়! শাকের ডালাটা ছোটবোন পরির হাতে ধরিয়ে দিয়ে জরি একটা আধলা ইট দিয়ে মাছটার মাথায় বাড়ি দেওয়ার সাথে সাথে একগাদা জলকাঁদা ছিটকে ওদের গা মুখ ভরে যায়। তবে মাছটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এবার তারা মাছটাকে দুহাতে উপরে তুলে ধরে, জরি শাকের ডালাটা নেয়, তিনজনে হৈহৈ করতে করতে, ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসে। ওর বুবু ভীষণ খুশি হয়। সে মহা উদ্যমে রান্না শুরু করে আর ওরা তিনজন কলপাড়ে যায় গোসল করতে। সেখানেও তিনজনে কলের মুখ চেপে ধরে ফোয়ারা বানিয়ে, জল ছিটাতে ছিটাতে হিহি করতে থাকে।
দুপুরে জরি পরির বাবা ভ্যান নিয়ে ফিরলে সবাই একসাথে খেতে বসে। শোলমাছের জন্য আজকের খাওয়া হয় ঈদের দিনের মতো আনন্দ উত্তেজনায় ভরা। খেতে খেতে শতমুখে মাছধরার গল্প চলতে থাকে।
-তা একনা মাছের তরকাই মেম্বার চাজীর বাদে পটে দিলে হইত, বলে ওঠে জরির বাবা। হঠাত মনে পড়ায় সফুরাও বলে ওঠে,
-ওরে আল্লাহ, একনাও ফম হয় নাই। চাচীও বাড়িত নাই, ঢাকা গেইচে, দেলে খুশি হইত। এদের হায় আফসোসের মাঝে তারা বলে ওঠে,
-আরে! অত বাউরা হইনেন ক্যানে! এলা খাও, সাঞ্জেরবেলা মুই এলা দিয়া আসিম। ওর বুবু দুলাভাই দুজনেই খুশি হয়ে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়।
এলাকার ধনী মানুষ ধলু মেম্বার। কবে কোনদিন মেম্বার ছিল কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু ওটাই তার নাম হয়ে গেছে। যতদূর দুচোখ যায় জমি জিরেত আগান বাগান সবই তার। আসলে এসবই তার স্ত্রীর পৈতৃকসূত্রে পাওয়া। নিঃসন্তান এই মেম্বারের স্ত্রী এলাকার মানুষের কাছে একজন দেবী। মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকেন। এই গ্রামে স্কুল কলেজ থাকায়, অন্য গ্রামের বিভিন্ন ছেলেমেয়েদেরকে নিজ বাড়িতে লজিং রেখে লেখাপড়ায় সাহায্য সহযোগিতা করেন। এখনও তার বাড়িতে মমিন নামে একজন থাকে। সে এখানকার কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। এখন বিএ পড়ছে আর কিছুদিন হয় একটা এনজিওতে কাজ পেয়েছে।
জরি পরির বাবা এই ধলু মেম্বারের বাগান বাড়িতে পাহারাদারের কাজ করে। ওই বাগানের এক কোনে বাড়ি তুলে ওরা থাকে। দিনের বেলা ভ্যান চালায়।
সন্ধ্যে নেমে আসছে। বুবুর হাঁস, মুরগির দরজায় ঝাঁপ বন্ধ করে মাছের বাটি নিয়ে মেম্বারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা। ফটকের কাছেই মমিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। দুজনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে একটু কথা বলে নেয়। তারা বলে,
-আমি গেলাম। তুমি আইসো… মমিন একটু ভয় পেলেও চোখে চোখে সম্মতি জানায় আর তারা’র চোখে মুখে বুদ্ধির ঝলকানী যেন ঠিকরে পড়ছে।
ধলু মেম্বার দোতলায় নিজের ঘরের বারান্দায় ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। তারা এসে সামনে দাঁড়ায়। আজকের এই দিনটির জন্য মেম্বার এবং তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে অপেক্ষায় ছিল।
মেম্বার সোজা হয়ে বসে। চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলে ওঠে,
-আরে! আরে! নয়নতারা, আইছিস! আমার চক্ষের তারা তুই আইছিস! আয়, আয় এই কাছে আসি বস। তরকারির বাটি টেবিলের উপর রেখে সে বলে,
-উঁহু, চলেন ঘরোত যাই। কাম আছে। সাথে সাথে মেম্বারের চোখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দ্রুত উঠে হাঁটতে শুরু করে,
-আয়, আয়, বুলবুল পাখি, আমার কইতর, আয়। ঘরে ঢুকে তারা স্পষ্টকরে বলে, -দাদা, আপনে এদ্দিন ধরি যে কতা কইছিলেন তাতে আমি রাজি। খালি ঐ যেটা দিবার চাইছিলেন, সেটা দেন।
-তা আগোত যা দিবার চাইছি তা দেবো তো। এলা আয়…
-উঁহু আগোত দাদীর হাতের বালাজোড়া দ্যান…
বাধ্য মেম্বার তড়বড় করে উঠে আলমারি খুলতে খুলতে মৃদু গজগজ করে, কী মাইয়ারে বাবা! এতো ত্যাজ! এতো জিদ! কিন্তু এতো ডগমগা! স্ত্রীর হাতের বালা বের করে ঘুরে এসে তারার হাত ধরে ওর হাতে সযত্নে পরিয়ে দেয়।
-নে, এবার হইছে তো। আয় এখন…
তারা হাতের বালা দুটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। একবার মেম্বারের দিকে তাকায় আবার বালা দেখে। মেম্বার অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। এরপর খুব শান্ত ধীরস্থির হয়ে, শক্ত হাতে যেভাবে পিচ্ছিল দাপুটে শোলমাছের ঘাড় ধরেছিল, সেভাবে দুপাশ থেকে মেম্বারকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। হাতের বালা খুলে আবার মেম্বারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে,
গলা চেপে হিসহিসিয়ে বলে,
-শোনেন বুড়াভাম, আপনের বয়স কত হইছে কন তো! চার কুড়ি? মানে আশি বচ্ছর? নাকি তারো উপরে? আর আমার বয়স কত? আপনের সন্তান থাকলে তাদের সন্তান বয়সে আমার চাইতেও বড় হইত। আমি আপনের নাতনির মতোন না? দাদী আমাকে কতো আদর করে, মায়া করে। আর আপনে! এক ঠ্যাং কব্বরে গেইচে, নামাজ পড়তে পড়তে তো কপালে ইয়াবড় এক কালা দাগ ফেলাইচেন, হজ্বও বোলে করি আসচেন, তারপরও এই লুচ্চামি যায় না? বইনের বাড়ি আসচি থাকি আপনে আমার পিছে লাগচেন। ক্যানে? আমি এতিম, আমি গরীব সেইজন্যে! এতো খায়েশ! এ্যা! উত্তর দ্যান না ক্যান!
এবার সে একটু দম নেয়, আবার বলে,
দাদী ফিরলে এই জিনিস তাকে দেখাব। বলে সে পেছন ফিরে মমিনকে টেনে এনে তার হাত থেকে ফোন নিয়ে এতক্ষণের পুরো ভিডিওটা দেখায়।
নির্বাক মেম্বারের চোয়াল ঝুলে যায়, এইভাবে তাকে বোকা বানালো! মনে মনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু ক্রুদ্ধ হয়ে করবে কি! মান সম্মানের ভয়, বউয়ের ভয়। কী সাংঘাতিক মাইয়ারে বাবা! আর হারামজাদা মমিনও যোগ দিছে এই ষড়যন্ত্রে…
-দাদা, ভালো হয়া যান। আর আমাকে ত্যক্ত না করলে, মমিন ভাইকে বা আর কাউকে কিচ্ছু না কইলে আমরাও দাদীক কিচ্ছু দেখাব না। ঠিক আছে?
নিরুপায় মেম্বার ঢক করে ঘাড় হেলিয়ে অসহায় সম্মতি জানায়। তার চোখের সামনে দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটি হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে, নিচে নামতে থাকে।
মমিন নয়নতারাকে নিয়ে ওর জন্য বরাদ্দ ঘরটার পেছনে যায়। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দুধ ধোয়া জ্যোৎস্নায় চারপাশের সব ভেসে যাচ্ছে। তবুও ঝোপঝাড়ের থোকা থোকা অন্ধকারের মাঝে জোনাকিরা প্রদীপ জ্বালিয়েছে।
মমিন আঙুল তুলে দেখায়, অনেকখানি জায়গাজুড়ে সে ফুটিয়েছে রাশি রাশি নয়নতারা ফুল। চাঁদের আলোয় ফুলের হাসি। নয়নতারা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে…
ফুলের মাঝে দাঁড়িয়ে দুজনে একটা কবিতা বিড়বিড় করে। এই একটা কবিতাই দুজনের মুখস্ত, এটি ওদের পাঠ্য বইয়ে ছিল…
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক…