================================================================
================================================================
আজ সেই নিধিরামের গল্পটাই বলব। আমি জানি তুমি এক্ষুনি বলবে, ওই শুরু হল। জানি আমার এই দশা দেখে তোমার বিলক্ষণ হাসি পাবে। কিন্তু এই গল্পটা ছাড়া আর কিছু বলারও তো নেই আমার। ওই গল্পটা আমার নিজেরই গল্প। শুরু থেকে শেষ অবধি এই গল্পের মধ্যে, এই হাসিতামাশার মধ্যে, ভেব না কিন্তু আমি একা। ভেব না এ নিছক গল্প। – এর মধ্যে তুমিও আছ! যে-তুমি আমাকে দেখে হাসছ, আসলে তো তোমাকে দেখেও হাসছ! আমি তো তোমারই ছায়া। দু’জনেই, সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দুজনেরই ছাপ পড়েছে তাই – তোমার, আমার, আমাদের সকলের ছায়া পড়েছে আয়নায় – কেঁপে কেঁপে উঠছে একের অন্যের প্রতি অট্টহাসিতে । কারণ তোমার, আমার, আমাদের সবারই হাত-পাগুলো সময়ের শক্ত বাঁধনে বন্দি – যেন সুতোয় ঝোলা পুতুল আমরা সবাই। ঢাল নেই তরোয়াল নেই, যেন আমরা এক-একজন নিধিরাম সর্দার। সরকার নেই, প্রশাসন নেই… সরকার আছে তবু নেই, প্রশাসন আছে তবু নেই, আর সেই নিধিরাম গো, গল্পের সেই নিধিরাম, জীবনের সেই নিধিরাম – সেই কেবল আছে, গলা অবধি জলে সেই কেবল হাবুডুবু খাচ্ছে, আগুন জ্বালাতে চেয়ে সেই বেশি পুড়ে যাচ্ছে – সেই আমি, আর সেই তুমিও। একুশে আইনের দেশে, দেশে আর রাজ্যে, রাজ্যে আর পাড়ায় পাড়ায় – সে তবু চলেছে নিভন্ত চুল্লিতে জ্বালানি ঢেলে দিতে। তবু তার হাহাকার, একটু আগুন দে! সে তবু প্রতিবাদ করছে হাওয়ায় খড়কুটোর মতো উড়ে যাবার আগে। সে চলেছে খোদ ঈশ্বরের দরবারে, কিংবা, ধরো মেট্রো চ্যানেলেই। সে চলেছে বাহুবলীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। তার এই যাওয়ার, এই হাসিতামাশার পাত্র হয়ে ওঠার, তার প্রতি এই উপেক্ষার আর বঞ্চনার যেন কোনো শেষ নেই। সরকার তো ঈশ্বরই, ধরাছোঁয়ার বাইরে, শোনাশুনির ঊর্ধ্বে – তা ছাড়া আবার কী! তাহলে এই যে বোকা হদ্দ নিধিরাম – কাকে বলবে সে নিজের দুঃখের কথা ? কার দিকে মুখ রেখে সে প্রতিবাদ করবে? অন্ধ-বধির-খঞ্জ ঈশ্বর যে শুনতে পান না, তাঁর চোখে তো ঠুলি – তিনি যে তাঁর সিংহাসনে অনড়।
আর ঈশ্বর যেখানে বধির, বধির আর খঞ্জ – অধিকন্তু অন্ধও – সেখানে তো আমি, তুমি, সব নিধিরামই অসহায়! আমি, তুমি, সৎভাবে বাঁচতে চাওয়া নিধিরামরা প্রত্যেকেই অসহায়। জানে না সে , কেন তার জন্য কোথাও কোনো দয়া নেই! জানে না উলটোদিকে কেন অসৎ মানুষের জন্য হাজার কিসিমের ব্যবস্থা – উকিল-মোক্তার বলো, ডাক্তার বদ্যি নামি হাসপাতাল বলো, মাথার ওপর পাকা ছাতের আয়োজন বলো, মরাইয়ে সোনার ধান বলো, জগাই-মাধাই দাপুটে বন্ধুরা বলো, পুলিশের জামাই আদর বলো, নেতাদের বাহাদুরি বলো, স ব আছে! সমস্ত তাদের জন্য। তার জন্য কি কিছুই নেই! তাদের জন্য?
তুমি যদি বোঝো, তুমিও তাই, আমি যা – যদি বোঝো দুজনেই আমরা বেবাক হাসির পাত্র – যদি বোঝো সময়ের আয়নায় আমাদের সবারই ছায়া কেঁপে উঠতে চায় – তবে পায়ে পা মেলাও। তাহলে তো আর আগুনে কম পড়ে না, তাই না? আর, তা না হলে? – আগুন জ্বালাবার এই স্বপ্ন, স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে, স্বপ্ন হয়েই পাশ ফিরে শোবে আবার, তুমি যদি একা পথ হাঁট। যদি তুমি একা গান গাও, একা পতাকার নীচে ফ্যালফ্যাল করে দাঁড়িয়ে থাক – তোমার যে দোসর দরকার :
এদিকে শুঁড়িখানার ঝুলন্ত আলোগুলো অস্থিরভাবে কাঁপছে আর বাচ্চাটার ঝুমঝুমির আওয়াজ বেড়েই চলেছে চারদিকে … যা হোক, গল্প হতে পারে ভেবে আমি তার দিকে দু’লহমা তাকিয়ে থাকব সে উপায় নেই। মেয়েটা নখগুলো খুঁটেই চলেছে, উপচে পড়ে কাঁদছে কখনো – দেবদূতেরা তাঁদের অন্ধকার সরিয়ে বেরিয়ে এসেছেন তারই ভিতর থেকে, হাত ধরতে চাইছেন কখনো, রঙিন কত পতাকা নাড়িয়ে আগামী জন্মের জন্য মহতী শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। কিছুতেই শুনবে না সেও, ভাইয়ের নিথর শরীরের শুকনো রক্তের দিকে তার ক্লান্ত স্থির চোখদুটো কখনো বুলেটের মতো তীক্ষ্ণ, কখনো পায়রার মতো ভীত। গল্প হতে না হতেই ড্যামেজ কন্ট্রোলে পুলিশ চৌকির বৃদ্ধ ভ্যানগুলো শান্তিপল্লীর দৃষ্টি আড়াল করে দেয়… হ্যালো… হ্যালো…
২
এই অসহায়তার বিপরীতে আমরা নিজেদের আড়াল করব, এ তো স্বাভাবিক, কলকে না পাওয়া মানুষের প্রতি সমাজ কেমন মজার দৃষ্টি মেলে দেখে, তা তো আমাদের জানাই আছে – কে আর বোঝে একে অন্যের ছায়া আমরা! একটি নাটকের কথা মনে এল এই সূত্রে – মজার একটি নাটক। মূল জার্মান ভাষায় তার নাম ছিল, ‘কী করে শ্রীমান মকিংপটের দুর্দশা ঘুচল’। সেখানে এক কাব্যিক কথা-বলার চাল – যেন সমস্ত দেশ খুশিতে ডগমগ। যেন রাজা-উজির-সেনাসামন্ত-ছাত্র-মাস্টার, সবাই এক ছন্দের জগতের মানুষ! তাহলে সেই জগৎ? সেও কি বেবাক ছন্দের! আসলে তো জীবন তার নিজের ঢালেই গড়ায় – রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সমস্তই ক্যারামের ঘুটির মতো এ-ওরা গায়ে ধাক্কা খেয়ে, এ ওকে সরিয়ে, গড়িয়ে, কোনোমতে জালে জড়াতে চায়, দল ভারী করে, কৃপাদৃষ্টি পেতে চায় – জেতার যে একটাই নিয়ম, যত পার দল ভারী করো, যত পার আনুকূল্য পাও। তাই ছন্দে-ছন্দে কথা, অছন্দের এই জগতে যেন চাবুকের এক একটা ঝাপটা – যার একদিকে আমরা , নিধিরামেরা – অন্যদিকে সেই বধির, খঞ্জ, নয়নাভিরাম উচ্চাসন !
বহুরূপী পত্রিকায় ১৯৮৭ সালে নাটকটি প্রকাশিত হয়। এর একদিকে এক সর্বহারা শ্রমিক শ্রীমান মকিংপট, অন্যদিকে তার চারপাশের জগৎ। কী জানো, ‘মকিংপট’ নামটা কিন্তু জার্মান ভাষাতেও খুব একটা পরিচিত নাম নয় – সে যে সকলের হাসিঠাট্টার পাত্র, এইটাই নাটককার সামনে রেখেছেন। বেচারা মকিংপট এক সামান্য শ্রমিক। একদিন বাজারে বেরিয়ে এক গণ্ডগোলের মধ্যে সে ফেঁসে যায়, আর পুলিশ ধরবি তো ধর তাকেই অপরাধী ভেবে পাকড়াও করে আনে। মকিংপটের তো কোনো মুরুব্বির জোর নেই , টাকাপয়সার ঢিবি নেই – লড়বে কী করে সে একটা গোটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে ? সে যেন আমাদেরই মতো সাক্ষাৎ নিধিরাম সর্দার, যার না আছে ঢাল , না তরোয়াল – অথচ যাকে একটা যুদ্ধ তার অনিচ্ছায় হলেও লড়তে হচ্ছে। পত্রিকায় ছাপা হল, ‘নিধিরামের মুশকিল আসান’ নাম দিয়ে। এর ভাষান্তর করেছিলেন, শ্রী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। মূল নাটকটির লেখক, পেটার হ্বাইস। তাঁর লেখাপত্রে মার্ক্সীয় তত্ত্বের ছাপ ছিল স্পষ্ট।
ছোটোবেলায় আমরা পড়েছি না – সেই যে এক দুষ্টু রাজা , যার মাথা কামিয়ে গোবর জল ঢেলে ,গাধার পিঠে উলটো করে বসিয়ে দেশ ছাড়া করা হয়েছিল ! এখন ভাবো, একজন দুষ্টু রাজার বদলে যদি কোনো অরাজক দেশের সরকার-বাহাদুর নিজেই হয় দুষ্টু – তখন? তখন তো আর তাকে দেশ ছাড়া করলেই সমস্যা মেটে না! সরকার তো এক যন্ত্র – তাকে তুমি দেশ ছাড়া করতে পারবে? আর যদি কোনো সরকার তুমি বদলে দাও-ও, তাহলেই কি ভাবছ তোমার সমস্যা কেটে গেল ? – নতুন সরকারে আগের শাসনযন্ত্রের কোনো নাট-বল্টুকে তুমি কাজে না লাগিয়ে পারবে ? তারা তো সেই দুষ্টু যন্ত্রেরই অংশ ! রাজা বদলায়, সিস্টেম বদলায় না। যাই হোক, এই কথাগুলো বলা নিধিরামের সঙ্গে একটা চলনসই পরিচয় করাবার গরজেই। চলো , এবার সেই নাটকেই উঁকি মারি। আমাদেরই আত্মলাঞ্চনার দৃশ্যগুলো দেখি আর হাসিতে ফেটে পড়ি – অসহায় নাচনকোঁদনের সেই রঞ্জক দৃশ্যগুলো ! – প্রথম দৃশ্যে যখন প্রহরী নিধিরামকে খাবার দিয়ে চলে যাচ্ছে, সেইখানে যাই, চলো :
প্রহরী :
ওঠ ব্যাটা ওঠ, তোকে খেতে দিতে ওরে
ডালনা এনেছি টিনের এ-পাত্তরে
অভ্যেসমতো উগরে দিয়েছি থুতু
মেজাজটা কেন দেখিনে মনঃপুত?
(বিরক্ত) কম্বল ছেড়ে উঠে পড়ো এইবার
জাগো জাদুমণি নিধিরাম সর্দার…
নিধিরাম :
দুনিয়ার কোনো ন্যায়নীতি নেই ভাই
কোনোদিন বাপু করিনি তো অন্যায়ই
সুখের চেয়েও সোয়াস্তি জেনে ভাই
কারো পাকাধানে কখনো দিইনি মই
থাকি বড়ো বেশি বিনীত সর্বদাই
ভুল বোঝাবুঝি এড়িয়েই যেতে চাই
জীবন থেকেই বরবাদ তার ফলে?
কয়েদ করল আমাকে তোর বদলে।
প্রহরী :
ব্যাটা জোচ্চর! কুলুপ মেরে দে মুখে
এখেনে আছিস – সেটা কি বিনা হুজুগে?
এইখেনে বাপু বসেছে যে জন তার
হিসেবের খাতা নয় রে পরিষ্কার…
কার কাছে বাপ ধাপ্পা-টাপ্পা বলা?
জানি বাপু তুমি ক্ষুণ্ণ করহ রাজ্যের শৃঙ্খলা
কুপথে বিপথে দৌড়োদৌড়ি তোর
ধরা পড়ে গিয়ে সেজেছ বোকা বাঁদর।
তার পক্ষে শুধুমাত্র একটা উকিল পাবার জন্য নিধিরামকে অনেক কষ্টে তার জমানো টাকা থেকে ৫ টা মোহর প্রহরীকে ঘুষ দিতে হয়। উকিল যথারীতি জামিন করে দেবার জন্য কড়া দর হাঁকেন। উকিলমশাই বলেন,
ধানাই পানাই ছেড়ে বলে দিন রাজি নাকি গররাজি
হিসেব মতন পয়সা ঢালতে – আমার কি বাপু অঢেল সময় আছে?
উকিল মশাই আরও বলেন :
দাঁড়িপাল্লায় ঝটপট করে কথা দিয়ে দিন তেরে কেটে ধেই
আপনার দশা শোচনীয় তাতে দর কষাকষি করে কোনো লাভ নেই
মুক্ত পুরুষ মশায় আপনি কড়ি ফেললেই
কড়ি না ফেললে শ্রীঘরে পচুন আমার তাতে কী? তেরে কেটে ধেই।
দুই দেবদূত আড়াল থেকে সমস্ত দেখছিল। তারা এবার প্রার্থনা করে ওঠে :
দয়া করো প্রভু দয়া করো এর পরে
দুর্বিপাকের সমস্ত বোঝা চাপাও এটার ঘাড়ে।
এই নাটকের পরতে পরতে স্যাটায়ার, শ্লেষ – হাসির ছলে সমাজের আর শাসন-ব্যবস্থার ফোঁপরা চেহারাটা দর্শকের সামনে তুলে ধরাই এর মূল ইচ্ছা। এখানে বিচারসভাও তেমনই মজার। প্রহরী ক্ষিপ্রগতিতে একটা বেগুনি রিবন নিধিরামের কলারে বেঁধে মস্ত বড়ো একটা ঢোলা কোর্তা তাকে পরিয়ে দেয়। দুটো পেল্লাই বুট জুতো তার পায়ের কাছে রেখে তার শেকল খুলে দেয়। একটা মস্ত পকেট ঘড়ি বের করে তাতে দম দেয় প্রহরী। ঘড়িটা ঠকঠকিয়ে কাঁপে, স্প্রিংটা শব্দ করে ফেটে ছিটকে বেরিয়ে আসে। কানের কাছে ধরে সেটা যাচাই করে নেয় প্রহরী, তারপর নিধিরামের পকেটে ঢুকিয়ে দেয়। এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট মশাই ম্যাজিশিয়ানের ভঙ্গিতে একটা মানিব্যাগ দর্শকের সামনে উঁচিয়ে ধরেন। তারপর সেটা হালকা আঙুলে চট করে খুলে ফেলে চারটে সোনার টাকা তার থেকে বের করে আনেন। এবার নাচের ভঙ্গিতে প্রহরীর দিকে একটি টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বাকি তিন টাকা নিজের পকেটে অতি দ্রুত চালান করে দেন। খালি বটুয়াটা নিধিরামকে ফেরত দেওয়া হয়। নিধিরাম চটকা ভেঙে দাঁড়িয়ে পড়ে, হেঁটে যায় এমনভাবে যেন এক পায়ে এখনো তার ভারী শেকল। প্রহরী নিধিরামের পা-জোড়ার মাঝে হঠাৎ নিজের ঠ্যাং গুঁজে দেয়, হোঁচট খেয়ে মঞ্চের বাইরে যেন উড়ে যায় নিধিরাম।
ছাড়া পেয়ে তার বাড়িতে ফিরে আসে নিধিরাম। তার স্ত্রীয়ের সঙ্গে আগের মতোই ভাব জমাতে যায় সে। কিন্তু এতদিনে স্ত্রী-ও তার হাতছাড়া হয়ে গেছে – কম্বলের ভেতর থেকে অন্য এক পুরুষের বদখত এক জোড়া পা নিধিরাম খেয়াল না করলেও দর্শকদের চোখ এড়ায় না। স্ত্রী বলে :
বুঝেছি তোমার মনের ফন্দিখানা
কাছে ঘেঁষাঘেঁষি সহ্যই করব না
ওই ভাব ভাব কদম ফুলের সাধ
আমার সঙ্গে চলবে না আর চাঁদ।
এরপর তার মনিবের কাছে গিয়ে দেখে সেখানেও তার চাকরি নেই আর – সে যে ছিল একদিন, সেই স্মৃতিটাই নেই মনিবের ! উলটে মনিব বলে ওঠেন :
ভেগে যাও, আমি ভালো ‘ফিল’ করছি না।
তারপর একজন কর্মচারীকে ডেকে বলেন :
লোকটাকে তুমি একেবারে টুঁটি ধরে
আমার হুকুম দাও তো ‘গেট- আউট’ করে।
বিচার চাইতে চাইতে, ক্লান্ত হতে হতে, সাত ঘাটের জল খেয়ে শেষে একদিন নিধিরাম হাজির হয় খোদ সরকার বাহাদুরের কাছে। সরকার কারা ? উঁচু টেবিলের পিছনে মস্ত মাথাওলা তিনটি চরিত্র। প্রথম জন মাথা চুলকোয়, তো দ্বিতীয়জন নাক খোঁটে, আর তৃতীয়জন টেবিলের ওপর পা তুলে দেয়। নিধিরাম যখন তার দুঃখের কথা বলছে, তখন একজন তার গিন্নির জন্য ভালো কোনো দর্জির খোঁজ লাগায়, অন্যজন আগের দিনের ভূরিভোজনে হাঁসের মাংসে চর্বি বেশি ছিল, কি ছিল না – তাই নিয়ে আলাপ শুরু করে, আর তৃতীয়জন চর্চা করে তার বাড়িতে মাছির উৎপাত নিয়ে। এইসব করতে করতেই শুনানী শেষ হয়ে যায়। তিন সরকারি প্রতিনিধি এবার তাদের রায় ঘোষণা করেন পালা করে :
১ম : সমাপ্ত নির্ধারিত সমবেত মীমাংসিত
২য় : নির্ধারিত সমবেত মীমাংসিত অপ্রতিহত
৩য় : অপ্রতিহত-সমাপ্ত সমস্ত কিছুর জন্য প্রস্তুত
১ম : সমাপ্ত গোলাগুলি আহত মদোন্মত্ত আশাপ্লুত
২য় : সংযত আশাপ্লুত মদোন্মত্ত সমবেত পানোন্মত্ত মদোন্মত্ত…
১ম : শীর্ষাসন সমর্পণ শালীনতা দায়িত্বহীন চুক্তি প্রণয়ন
২য় : (কাশতে কাশতে) চুক্তিদক্ষ সমাবেশ নিপুণ দায়িত্ব…
হতবাক নিধিরাম এই আজব সরকারি সমাধানসভার রায়ের বিন্দু-বিসর্গও বুঝতে পারে না। সেখান থেকে সে একরকম পালিয়ে এসে বাঁচে। নিধিরামের বন্ধু মাটন-রোল তাকে বেজায় ভর্ৎসনা করে :
বক্তৃতাখানা আহা শুনবার মতো
রয়ে গেল বটে কিছু কিছু তার কুজ্ঝটিমণ্ডিত
কথাগুলো তবু বড়োই চমৎকার
যে শোনে পুণ্য তার …
তত্ত্ব কতই বলা হল তবু কিনা
তুই তার এক বর্ণও বুঝলি না।
কোনো উপায় না দেখে শেষে নিধিরাম হাজির হয় শ্রী ভগবানের কাছে। করুণাময় ঈশ্বর তখন একটা ঢোলা ফারের কোট পরে বসে ছিলেন, মাথায় একটা সিলিন্ডারের মতো টুপি পরা – পুরু চুরুটে টান দিচ্ছেন তিনি বেশ কেতা করে। নিধিরাম তার প্রার্থনা পেশ করে :
হে করুণাময় ঈশ্বর প্রভু পরম কর্ণধার
অধিনের নাম ( আজানু কুর্নিশ করে) নিধিরাম সর্দার
অধীন জানতে চায় অতি সুবিনীত
তাকে নিয়ে কেন এক্সপেরিমেন্ট এত…
মাটন রোল এর মধ্যে ফস করে বলে বসে :
দেবদূতদের কোরাসে ক’জন রয়েছে সব মিলিয়ে
গান ছাড়াও কি গেঁজানো এবং নাচ টাচ তারা ইয়ে
জানে টানে? আছে এরকম ভালো চুরুট আর কতটা?
হিংসার তরে ছানাবড়া চোখে দেখতে হত না নিছক ধোঁয়ার ঘটা।
ঈশ্বরমশাই চুরুটে এক মস্ত টান দিয়েই ভুল ঢোঁক গিলে কাশতে শুরু করেন। মাটন রোল কাশির দমক কমাতে তাঁর ঘাড় চাপড়ে দেয়। সামলে নিয়ে চোখ পাকিয়ে ঈশ্বর বলেন :
ভেবেছেনটা কী মশায়-রা আমারও কি
ইচ্ছে জাগে না তোমাদেরই মতো যথা-তথা ঘুরে দেখি
ইচ্ছে মতন প্রশ্ন শুধু শুধাই
সব প্রশ্নেরই উত্তর পেয়ে যাই
আসলে ডিয়ার জেন্টেলম্যান, ওসব ইয়ার্কিতে
মন দেব তার সময় কোথায় আমাকে নজর দিতে
হয় কিনা ওই আমার কারখানার
মূলধন ঠিক? বিভাগগুলোও চলছে তো ঠিক? আর
ম্যানেজারি করা কত ঘুষ দেওয়া তারো আছে শৃঙ্খলা
একটার পর একটা কতই আছে কৌশলকলা
ঘোরাঘুরি আর সঞ্চয় হাতে থাকা
অন্তত এই কোম্পানিটার সুনাম বজায় রাখা
(মাটন রোলের দিকে) মশাই আমার চাই যথেষ্ট সম্ভ্রম সান্ত্বনা
আপনি আমার চিত্তে জাগান অসোয়াস্তি – না – না
আপনার নয় শুনব আমি অন্যজনের কথা
এই লোকটা সত্যি ভালো, রয়েছে ভদ্রতা
নাম কী যেন – ধেনোরাম, হ্যাঁ বলুন ব্যাপারখানা
দেখব আমার অভিনিবেশ টানতে পারেন কি না।
এইবার নিধিরাম বুঝতে পারে ভগবানে আর তার মালিকে বিশেষ তফাৎ নেই – দু’জনেই দুই কারখানার মালিক। দু’জনেই নিজের গদি সামলাতে ব্যস্ত, দু’জনেই বিপদের আশঙ্কায় থরহরিকম্প – অন্যের উপকারে কাজে লাগবার এক ফোঁটা সময় বা আগ্রহ তাঁদের নেই। ধীরে ধীরে নিধিরামের বোধবুদ্ধি ফিরে আসে – সে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। বিচার চাইবার জন্য আর কারো কাছে দরবার করবে না সে। একজন ওস্তাদ নাচিয়ের মতোই এবার মঞ্চের ওপর দিয়ে হেঁটে যায় নিধিরাম। হাঁটতে হাঁটতে মঞ্চের এক কোণে চলে যায়। এদিকে হাত দুটো মাথার নীচে দু-ভাঁজ করে রেখে চিৎ হয়ে তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে মটনরোল। সে সদানিশ্চিত – দুনিয়াদারির হাল হকিকত সে তো কবেই জেনে গেছে !
(নিধিরামের মুশকিল আসান, মূল নাটককার : পেটার হ্বাইস, মূল নাটক : Wie Dem Herrn Mockingpott Das Leiden Ausgetrieben Wird, অনুবাদ : শ্রী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কুবোপাখি প্রকাশন, বিনীময় মূল্য : ১০০/- )