জলপাই সুখ গাঢ় লিপিস্টিকের ছায়ায় অবনত মায়া ঝুলে আছে। সন্ধ্যা ছাড়িয়ে যায় গভীর আঁধার। তখনও হাতের মাঝে বৃত্তআদর, আদরের ভাঁজে ভাঁজে নীরব নিথর থাকে জলপাই সুখ। চোখের পাতায় আঁকা আগামীর এক্সরে— মাঝে মাঝে বিনয়ী হয় ক্ষণকাল। তারপরও আমাদের রাজপথ রাত নিয়েই ছুটে চলে। রাজপথ হাত খোলে। স্লোগানে স্লোগানে আসে নতুন দুপুর। মুড়িভাজা ভোর থেকে খইভাজা গোধূলি প্রতিটি পর্ব থাকে চঞ্চল মায়ায়। তখনো শিশির থাকে তখনো শিশির আঁকে নিমগ্ন আনাড়ি আনকোরা ছায়ায়। দূর ও অভিজ্ঞান যাচ্ছি বলেই হয়ত যাওয়া হলো না। গুটি থেকে বের হয়ে প্রথম অরণ্যের দিকে খোলস ছেড়ে মাতৃভূমিতে পরিভ্রমণ হলো মায়ার চোখে। সাঁওতাল সবুজাভ আধামাঠ এমনকি মৃত সাদা কবরগুলিও আমাকে শেখালো দূরের অভিজ্ঞান প্রাক-পরবর্তী পৃথিবীর অমিলিত ইতিহাস। নিমঘটু একটি সন্ধ্যা কেবলই অলীক হয়ে উঠছে। যেন বা মহাধ্বনি, কল্লোলিত হচ্ছে শুধু। যেনবা তন্দ্রা, কাটছেই না অগণন বিভোর। বাবলার মদিরা আমাদের নিয়ে গিয়েছিল নিমঘটু। তারপর অজস্র শব্দসিম্ফনিসমেত বেজে উঠলাম, একসাথে, না ফোটা ঘাসফুলদের সাহচর্যে। মদ ও হাড়িয়ার দেশে চলুক তবে এ আকণ্ঠ পান। আরো কিছুক্ষণ—আরো কিছু হয়ত সুদূর। পৌঁছে যাব ক্রমে নিমঘটু। মর্মরতা এখনো যা কিছু মুখাপেক্ষী লুপ্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। সমস্ত শহর খরস্রোতার দিকে ধূলিঝড় নামিয়েছে। বর্ষণ ঘন না হতেই চোরাস্রোতে ভেসে যাচ্ছে সম্পূর্ণ অধর ও আধুলি কলা ও কাকলি। আমি তাকে বলেছি, ধ্যানবিন্দু কিসের যেন নাম? ফুটে থাকা কি কারাগার? ধুতুরার মতো তুমি চেয়ে থাকো ধুতুরার মতো আমি চেয়ে থাকি এ কেবল মন্দ বিকশিত। অপবোধ মায়াবাগানে চন্দ্রপ্রভা ফুল ফোটে না। সমাধিতে পড়ে আছে কিছু নির্জন পাতা। তামাকপাতার মতো মোহনীয় ছিল যা, তার সবই আজ ভূলুণ্ঠিত, তছনছ। মিথ্যে দিয়ে ঢেকে গেছে সমস্ত কুসুম, গুপ্ত কথামালা, হৃৎ শুশ্রুশা। দ্যাখো, তবু কি সহজ তর্কে মিথ্যেকে সত্য করে জিতিয়ে দিচ্ছি। যেন আমরা পরস্পর দুইজনে একটি বিন্দু। আর কি কঠিন অপবোধে একই বৃক্ষে জোড়া অপরাজিতার মত ক্রমশ নীল রঙ ধারণ করছি সযতনে। সমর্পণ একটি গোলাপসুন্দর রাতে কিভাবে খুন হয়ে গেলাম! গোপন তন্ময় ছুরি রক্তধারার দিকে ছুটলো— ক্রমে নিঃশেষিত হলো অহমের ধারণা, একশত সুরের কম্পন, সমর্পণ। অতিবেগুনি রোদের সমুদ্রে যাবার আগেই হঠাৎ মুহুর্ত কেটে ফালি ফালি, অনেক রক্তবেদনা ও লীলাভঙ্গ হলো। খুন হতে হতে জেনে যাই, আমার হাতে আর চোখে কোনো রূপালি ধার নাই। চরখিদিরপুর এবারও যাওয়া হলো না চরখিদিরপুর। হেমন্তের রোমান্সজালে আটকে গেছি। আমারও আছে একা নদী, যুগল চাঁদ, একা চষ্ণুআরতি। এবার তবে নিয়ে চলো অঘ্রাণের রোদ ও সুখের সমান মহৎ চরাচরে— যেখানে সুখাসন। যেভাবে লোকে যায় বসন্তপুর। যাবো খিদিরপুর। বোঁটার পরান আমি সাজলাম রক্তমদির রঙে ছন্দে। একটি শিমুল ফুটে আছে কাছে লাল হয়ে। দেহেÑশ্বাসের উপরিতলে। বুকের বোঁটার কুসুম মেখে। তার কাছে যাই, যেতে চাই যদি পালাবে সে পতনস্বভাবে। কুহক ও নিজস্ব পথে। আমার সাজের দানিতে কোনো ভণিতা নেই। আমি একাগ্র। তবু আমিই হলাম নত। কুহকের ভারে মুহূর্তরা ভাঙে। ভাঙে বৃহৎ কোলাজ। তবু আমিই রয়েছি জেগে। একটি ক্ষুধার দিকে তাকিয়ে অনেক ক্ষুধার কথা ভাবি। তারা লীন হারজিত হয়ে আছে। জাগাবো না কুসুমস্বভাব। বুকের বোঁটার কুসুম। নত হয়ে আছে বোঁটার পরান। হু হু তাহলে ধরে নেব তোমার চোখের পেছনের নদীটি স্থবির? এক অবধারিত জলের ফসিল? কোনো অল্পবয়সী লীলা নেই। হু হু ধ্বনি নিয়ে তুমি আর বেশিদিন সইবে না। পিঁপড়ারা আগাচ্ছে ডুমুর ব্যঞ্জনায়। দূরবিন্দুগুলো নিকট কাঙ্ক্ষার মত জ্বলে-নেভে। হয়ত রূপে রূপে এখুনি ভেঙে যাবে খেলা। এবার পায়ে থাকা নুপূরের ধ্বনি সামলাও। সুরে সুরে একান্তে খঞ্জনির তার সামলাও। বসন্তবাসনা নিয়ে যাই দূর অভিজ্ঞানে— তুমিও নিজের যত্ন নিচ্ছ কিন্তু সুন্দর হয়ে উঠছ না। পা ক্ষয়ে গেলে নদীর কিনারে যাচ্ছ। বিরতিকাল এরকম দাড়িয়ে থাকা গন্তব্যের নাম শূন্যস্থান—পুল পার হওয়ার আগে।

নুসরাত নুসিন
জন্ম: দিনাজপুর, পার্বতীপুর, বাংলাদেশ
এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কবিতার বই
দীর্ঘ স্বরের অনুপ্রাস (২০১৮), কাগজ প্রকাশন
কামনাফলের দিকে (২০২১), বৈভব
পুরস্কার
জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার (২০১৭)
আদম সম্মাননা (২০২২), ভারত
Facebook Comments Box