তখন আমার সামনে ছিলো দুটি পথ। আমি নবীন পথিক যাত্রা শুরু করেছিলাম আলো-আঁধারির সন্ধিক্ষণে! আমি লঘুপায়ে হেঁটে আসি আলপথ,প্রান্তর তখন কতোক্ষণ ভেসে চলি কাকলি-তরঙ্গে ,সবুজে সবুজে ভেসে ভেসে যাই তিসি ফুলের ভেতর দিয়ে উড়ে যেতে থাকি পলকা মন নিয়ে, দূরের দিকে আমার তখন মনে হতে থাকে, আমার সামনে কেবল একটিই পথ! আমি তার একাকী পথিক! আমি হেঁটে যেতে থাকি। প্রান্তরে আমার পথ ছিলো একটি। আলপথ একটিই ছিলো। অরণ্যের ভেতর দিয়ে পথ আঁকাবাঁকা,একটিই। আমি পথ চলতে থাকি। চলতে চলতে উপত্যকার মুখে এসে আমি থমকে যাই। আমার পায়েরা অকস্মাৎ বিপন্ন বোধ করতে থাকে। আমার মাথার ওপরে তখন ঘনপত্রের ছায়া,তবুও আমি ছায়াময় থাকি না ! আমার দেহে তখন বিবিধ হাওয়ার পরশ ,কোমলসবুজ পরশগুচ্ছ! তবু আমি দেহ জুড়ে তখন পেতে থাকি দাহ আর অমীমাংসা পেতে থাকি। আমার চোখের কালোয় কালোয় দ্বিধা ও কুণ্ঠা কেঁপে যেতে থাকে। আমার সামনে যে দুটি পথ! আমি কোন পথে যাবো! দুটি পথ বেঁকে গেছে একই ভঙ্গীতে বেঁকে গেছে অজানা অচিনের দিকে যদিও একটি গেছে বাঁয়ে,অন্যটি দক্ষিণে কিন্তু তাদের তৃণাস্তরণ আর বাঁকে কোনো ভিন্নতা নেই আমি দাঁড়িয়ে থাকি বিমূঢ় পায়ে দু’পথের সন্ধিক্ষণে আমি কোন পথে যাবো! কোন পথে ! আমি কী বাঁয়ের পথে যাবো! আমি কি পা বাড়াবো ওই দিকে? হাওয়া উড়ে আসে-হাওয়া- সে পথের কোন সেই ভেতর থেকে আসে! আমার দিকে! সেই বাতাসে আমি নানারকম শব্দ ভেসে আসতে দেখি আমি সে- হাওয়ায় কতো গন্ধের ওঠানামা বাজতে শুনি আমি বামের বাতাসে পাই রুটি-সেঁকার গন্ধ, আমার প্রাণ চনমন করে ওঠে! উষ্ণ পানীয়ের তাজা সুবাস কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে সে-হাওয়ার ভেতর। বাজে বাসনের ঝনাৎকার, গহনার ঝঙ্কার বেজে বেজে ওঠে বাজে কণ্ঠ কার জানি প্রভুত্বভরা কণ্ঠ কার- ভেসে আসে,আসে হুকুমের তর্জন। আমি বাতাসে নতুন কাগুজে মুদ্রার গনগনে গন্ধ পাই। আলকাতরা আর ভেজা নৌকার গন্ধ পাই গৃহস্থালির টুং টাং শব্দ শোনা যায়, শোনা যায় প্রেম ও অপ্রেমের অস্ফুট স্বর। এই পথে তবে এইসব আছে! আমি এই পথে যাবো! আমি বাঁয়ের পথে পা বাড়াতে যাবার আগে ডানের পথটির দিকে চোখ রাখি কেমন বিজন নিরজন ছায়াময় ওই পথ! ওই দক্ষিণের পথ ওই পথে পথে যেনো বাজে বংশীধ্বনি নাকি বাজে পাতার শনশন,শীতল শনশন আমি তার দিকে চাইলাম বলে,যেনো সে-পথ দুলিয়ে তুললো ছায়া কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ মোড়ানো ছায়া সে-পথের নিকটে ও অনিকটে আমি-নদীর তরঙ্গ বেজে উঠতে শুনি প্রখরা তৃষ্ণাকেও যেনো আমি অই দক্ষিণ পথের তৃণগুল্মে গুল্মে ঝলকিত হতে দেখি দেখি যেনো শ্যামাভা হরিণীর মায়াঅক্ষি হয়ে হয়ে চেয়ে আছে ওই পথ ! ওই সবই আমি দেখি! দেখতে যেনো পাইই। নাকি বিভ্রম নাকি প্রতিভাস নাকি কুহক! দুপথই নিশ্চল শয়ান নিয়ে থাকে আমার দৃষ্টির সম্মুখে কোনো পথই আমাকে ডাকে না। যেনো আমাকে ফিরেও দেখে না ! আমি কোন পথে যাবো! কোন পথ আমার জন্য! কোন পথ! আমি পাখিকে বিনয় করি, ‘ বলো অথির! হে চঞ্চল,পথ বলে দাও!’ পাখি বলে,যে পথেই যাও সে-ই তো তোমার! আমি দু’পথের মোহনাকে মিনতি দিতে থাকি, পথ বলে দাও ওহে! মোহনা বলে, যে পথে যাবে সে পথ তোমার! আমি গ্রহণ করি দক্ষিণের পথ। আমি ডানের পথটির দিকে পা বাড়াই। কলধ্বনি করে ওঠে ঘাস্ফুল, নিবিড় শ্যামশ্রী নিরলতা আমার জন্য! হর্ষ কম্পিত হয়ে ওঠে আমার পা! আমার পথ আমি বেছে নিয়েছি এই পথ আমার । আমি হেঁটে চলি হেঁটে চলি পথ থেকে পথ দিবসের রাঙালঙ্কা ঝাঁজ ঝলকানো পথ,সে পথ জনহীন। অন্ধকার রাত্রির পথ হেঁটে যাই। শ্বেত কামিনীগুচ্ছের মতন সুগন্ধিময় সেসব আঁধার,চির মেঘ-মগন আঁধার! আমি হেঁটে যেতে থাকি, হেঁটে হেঁটে যাই একা একা একা একা। নিজ ছায়াসঙ্গী একা! ক্রমশ এগুতে এগুতে আমি বুঝে নিতে থাকি এই পথে রুটি-সেঁকার গন্ধের সাথে আমার কখনো দেখা হবে না । এই পথে পক্ব যবের নিথর শয়ান নেই, কোনো গন্তব্যই গন্তব্য নয় এই পথে। প্রতিটি গন্তব্যের পরে আছে আরো দূর গন্তব্য,মেঘলোক ছোঁয়া এই পথে পথে দ্রাক্ষাকুঞ্জ আছে,আছে স্রোতস্বিনী আছে মেঘ, নীল মেঘ এইখানে দ্রাক্ষাকুঞ্জের সোনালী ছায়ার ভেতরে আছে কৃষ্ণপ্রস্তর রচিত কুটির সেইখানে অনির্বাণ দীপশিখা আছে। আছে শ্লোক,আছে আরো শ্লোক রচনার বাসনা অফুরান। আছে চির নৈঃসঙ্গের নিয়তিলিখন,আছে লুপ্ত হয়ে যাওয়া আছে ধুলোর ভেতর থেকে ফের দ্যুতিময় পুন্রুজ্জীবন। আছে অখ্যাতি,আছে অনিকেত নিঃস্ব পরিব্রাজন। মাথার ওপরে কেঁপে যায় এইখানে - কৃষ্ণ নিবিড় মেঘ, ধারালো বিদ্যুৎ। বৃক্ষশাখা ছাড়া এই পথে বড়ো বেশী কিছু নেই। উষ্ণ হার্দ্য সরাইখানা এ-পথের মোড়ে মোড়ে কোথাও অপেক্ষা করে নেই। এইখানে কলগুঞ্জন,খাদ্যের তাপ ,তার উপাদেয় গন্ধ রাত্রির শয্যা আর প্রথাগত শয়ন নেই । এই পথে শুধু পথ ,শুধু বীজ রেখে রেখে যাওয়া-পথের দু’পাশে এইখানে প্রান্তরে প্রান্তরে ফলে ওঠে তৃণগুচ্ছ,ফলে ওঠে পুষ্পের বাহারী দীপ্তি সে পুষ্প কখনো মৃত্যু-মলিনতার স্পর্শ পায় না । এইখানে রাত্রিসকল - গহন প্রণয়ের মতন তরঙ্গ থরথর দেখো নক্ষত্র আর জোনাক এই রাত্রির বক্ষ জুড়ে রহস্য ও বেদনার কী শিল্প এইখানে রচনা করে চলেছে! আমি এই রাত্রির অসীম জুড়ে ফলাতে চাই আমার পুষ্প আমার নক্ষত্র আমার রঙধনু। যেমন এই পথে পথে আমার পূর্ব পুরুষেরা ফলিয়ে গেছেন! যেমন তাঁদের আঙুল বইয়ে দিয়েছে ইন্দ্রজাল,কতো রকম ইন্দ্রজাল বয়ে গেছে মধুর খরস্রোত, বয়ে গেছে ঝাঁক ঝাঁক শ্লোক আকাশ জুড়ে,হাওয়ার নিরন্তর নদী জুড়ে। এই পথে পথই চিরগন্তব্য আমি আমার পথ-নির্বন্ধ নিজেই তো বরণ করে নিয়েছি নিজের জন্য অবধারিত করে তুলেছি ধূসরিত পা,জলভরা আকাশ আর বৃক্ষছায়া। আর পরিব্রাজন! আমার হৃদয়ে ক্লান্তি নেই, কিন্তু তবু কোনখানে গোপন বেদনা বাজে। আমার প্রাণে বাসনা নেই, কিন্তু তবু কোনখানে টলোমলো স্বপ্ন বেজে ওঠে। আমার চোখে তৃষ্ণা নেই, তবুও আমার শ্রবণেন্দ্রিয় কোন জলকল্লোল শোনে! জাগরণে শোনে নিদ্রার নিভৃতে শোনে শোনে – কোন দূরে কোনখানে ডাকে পথহারা দু’একটা বাছুর কোনখানে যেনো পেকে ওঠে ললিত বাতাবি লেবু আর সূর্যোদয়-লালিম ডালিম! কোনখানে কোন কোণে বাতি জ্বলে মিটমিট,গৃহ ও শয্যার ভেতরে কোনখানে উঠোন,সেইখানে কামরাঙা গাছ সেইখানে দাঁড়কাক তার কথা মনে পড়ে! মনে পড়ে! মনে পড়ে,আর পথচলা শ্লথ হয়ে আসে। কোনখানে মাঠভরে ফলে ওঠে ধান আর কাউনের শীষ তার গন্ধ ভেসে আসে এই শ্বেতকমলের দেশে! পথচলা শ্লথ হয়ে আসে। পথ বেছে নেয়ার পর,এ-কোন আগুন পোড়ায় মনস্বী তোমাকে!
Facebook Comments Box