১.
৮.২০ বেজে যায় আমার ঢুকতে ঢুকতে। স্কুল থেকে ৫৭৩ কদম হেঁটে এসে মৃদু মৃদু জমে ওঠা ঘাম নিয়ে ক্যাফের দরজার হাতলটা ঠেলি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ততক্ষণে দেখে ফেলেছি ক্যাফের ছেলেটা ক্লোজ বোর্ডটা ঘুরিয়ে ওপেন করে দিয়েছে। আয়াতের সুর ভাসছে পুরো ঘরে। মেঝে জুড়ে লাইজলের শুশ্রূষার গন্ধ। কাস্টমার দেখতে পেয়ে ঢিলেঢালা পেশী টান টান ওদের। কম্পিউটারে একটা ক্লিকেই বেজে উঠল হিট ওয়েভসের সুর। আমাকে দেখে খুব বিগলিত হাসি হাসার কোনো কারণ নেই ছেলেমেয়েগুলোর। আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা ঝোঁকাই। দেখতে চটপটে ছোটখাটো ফর্সা ছেলেটা কখনও নিরুত্তাপ কণ্ঠ নিয়ে বলে গুড মর্নিং, ম্যাম। কখনও কিছুই না। আমিও ইশারা বুঝে প্রত্যুত্তরে বলি, গুড মর্নিং বা কিছুই না। তুলনায় হাসিমুখ নিয়ে অভ্যর্থনা জানায় মেয়ে স্টাফেরা। আর একগাল দাঁড়ি রাখা ছেলেটাও বেশ উষ্ণ জেশ্চার প্রদর্শন করে। ভালোই লাগে এসব। মাথায় সার্বক্ষণিক টুপি থাকতে হয় এদের। কর্পোরেট কালচারে ‘এক গোয়ালের গরু’ ব্যাপারটা বোঝানোর জন্যে এক রঙা পোশাক পরিধানের চল বেশ চোখে পড়ে। এরাও সেই ব্যবস্থার বাইরে নয়। তারপরও আলাদা ভ্রুভঙ্গী, হাসি, আলতো করে খাবারের প্লেট নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে আমার কাছে তারা আলাদা।
সক্কাল সক্কাল প্রথম খদ্দের হিসেবে স্টাফদের সাথে সাথে ক্যাফেটারও ধীরে ধীরে চাঙা ও ব্যস্ত হয়ে ওঠা দেখতে বেশ লাগে। কিচেনে বেকড ফুড গোছানোর খুটখাট আর সালাদের ট্রেগুলো রেডি করার মৃদু ঝন ঝন আওয়াজ ভেসে আসতে শুরু করে। তারপরে গ্রাইন্ডারে কফি পেষা শব্দ। এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ ছাপিয়ে তখন ম ম করে পার্করোড কফির তীব্র ঘ্রাণ। আমার সঙ্গে থাকে কখনও ক্রসবডি কখনও ল্যাপটপ ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর স্কিনটাইট পোশাকের মত পষ্ট হয়ে ফুটে থাকে বই আর নোটবুকের অবয়ব। প্রসাধনী, আয়না ও সুগন্ধিমুক্ত ব্যাগগুলো থেকে একে একে বেরিয়ে আসেন শ্যারন ওল্ডস, রুবী রহমান, অমৃতা প্রীতম, মীনা কুমারী নায। বেরুতে পেরে একটু শ্বাস টানেন তারা। তারপর, আমাকে দেন তাদের উষ্ণ আলিঙ্গন। ঢুকেই একটা পানি আর আমেরিকানো অর্ডার করে বসি গিয়ে আমার জন্যে নির্ধারিত সোফাটায়। প্রশস্ত। আরামদায়ক। একটা সমৃদ্ধ কাচের দেয়াল ঘিরে থাকে পুরো পরিসর। এখান থেকে শহরের ব্যস্ততা, স্থবিরতা ও এক চিলতে সবুজাভ আকাশ দেখা যায়। ছোট ছোট নয়টি চুমুকে শেষ হয়ে যাওয়া এক কাপ কফির দাম ১৮৯ টাকা রাখা ক্যাফেটার যথেষ্ট চওড়া সোফায় আমি পা তুলে বসতে পারি যতক্ষণ ইচ্ছে। কেউ গলা খাঁকারি দেবে না, তোয়ালে হাতে আশেপাশে ঘুর ঘুর করবে না এটা বোঝানোর জন্যে যে, এবার আপনাকে উঠতে হবে।
২.
বাংলা ভাষার স্নিগ্ধতম কবি রুবী রহমানের একটি কবিতা সংসারের পাকে চক্রে থেকে থেকেই মাথায় ঘোরে। কবিতাটি ২০০১ সালে লেখা। কান পেতে আছি, মৌমাছি বইটিতে অন্তর্ভুক্ত। একটি অগোপন জায়গা।
কবিপুরুষের জন্য যতটুকু জায়গা দরকার
কবিমেয়েটিরও ঠিক ততোটা জায়গাই প্রয়োজন
তার থেকে এক ইঞ্চি বেশি নয়।
এক চুল কমেও চলবে না।
……………………………………
কাজকর্মের শেষে নয়, হাতাখুন্তি নাড়তে নাড়তে নয়,
ভাবনার সমুদ্র বুকে নিয়ে সেও
নিজের টেবিলে এসে বসুক এবার।
ভাগাভাগি করা কোনো কৃপার গোপন ঘর নয়
সর্বসমক্ষে একটি অগোপন স্থায়ী জায়গা
তারও দরকার।
এ শহরে একটা অগোপন জায়গা কোথায় পাব বলুন তো? ভার্জিনিয়া উলফের ‘নিজের একটা কামরা’ মাথায় খোপ বানাতে থাকে। আহা! মনের সামান্য ইচ্ছে টুকে রাখতেই জীবন ঝরঝরে। কার বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদে মন, রোদে সেটিকে শুকাতে দিয়ে হাপুস নয়নে মাপতে হবে তা-ও। সেখানে কবিতার পথে হাঁটতে যাওয়া মানে চিতায় ওঠার রাস্তা নিশ্চিত করা। তবু মনের ভেতর প্রবল তৃষ্ণা। থাকুক জেগে কাঁটা। শৈশবে-কৈশোরে সৈয়দ মুজতবা আলী পরিচিত করালেন কাফে-রেস্তরাঁর সাথে। প্রথম পড়লাম পারীর রাস্তার পাশে কাফেগুলোয় দুর্দান্ত আড্ডার কথা। সংখ্যায় পুরুষেরা বেশি হলেও নারীদের অংশগ্রহণ দেখবার মতো। কখনও গুস্তাভ ক্লিমত আঁকছেন কাফের বিষণ্ণ নারীটিকে। কখনও কবি বন্ধুরা মারপিটে ব্যস্ত প্রণয়প্রার্থীর সাক্ষাতে বিঘ্ন ঘটায়। পড়তে পড়তে একটা স্বপ্নদর্শনের বিষয় ঘটে যায় যেন। তারপর স্বপ্নভঙ্গের পালাও আসে। জানা আছে উপমহাদেশের রোয়াকের আড্ডায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর কোনা স্থান নেই। আছে ভেতর বারান্দায়। উঠানে। শাড়িতে যশোর স্টিচ বা ব্লাউজের হাতায় নতুন শেখা গুজরাতি ফোঁড়ে নকশা তুলতে তুলতে সংসার, বিষয়-আশয়, সুখ-দুঃখের আলাপ। লিখতে এসে এই চরম সত্য পদে পদে হোঁচট খাওয়ায়। তবে এ-ও জানা, নিষেধের কাঁটাতার ডিঙিয়ে উত্তাল সময় ও তারুণ্য ম্যাজিক দেখানোর আয়োজনে সবকালেই পারদর্শী।
জানেন তো, শিল্পের পথ প্রেততাড়িত। এক অভিশপ্ত জীবনের পাকে জড়িয়ে যাওয়া যেন। প্রেতঅগ্নি পুড়িয়ে মারে। আবার শীতল করে চন্দন প্রলেপে। এ দেহ, মন ও মনন। ছারখার করে। আবার গুছিয়ে আনে পুনরায় প্রজ্বলন ঘটাবে বলে। এই যাপন ও উদযাপন প্রক্রিয়াতে কোনো স্কুলগামী শিশুর মায়ের জায়গা ঠিক কোথায়। সেই মা যে সংসার বোঝে না, প্রেমও না, হিসাব নিকাশও না। ডুবে থাকে কী যেন কী ভাবের লীলায়। জরায়। কোনো অজর প্রতীক্ষায়।
৩.
মায়েরা বলছে নানা কথা। বাবারা বলছে। প্রেমিক প্রেমিকাকে বলছে। বন্ধু বন্ধুকে। চলছে নানা আলাপ। পুঁজি ও পুঁজের শহরে খাবি খেতে খেতে ভাগ করে নেয়া পুঞ্জীভুত আবেগ, হতাশা, অবদমন কথা বলছে। প্রায়ই ৮.২০তে পৌঁছনো গ্রাহক নিজেকে অভয় দিচ্ছে এই বলে, ভয় কী? রোজকার অভ্যাস তো নয়। সপ্তায় মোট পাঁচ দিন। এটাকেও মেরে কেটে কৌশলে তিনদিনে নামিয়ে আনি। খুব বেশি খরচ হচ্ছে কিনা, ব্যস এইটুকু দেখো। সবকিছুর ওপরে মধ্যবিত্তের খুচরো হিসাব কথা বলে। সকলের মাঝে একান্ত একলা হতে পারার ক্ষমতা হাতে নিয়ে একজনের সব ঠিক লাগে। ঠিক লাগতে লাগতে এক লাগসই রোদের সকালে লেখা হয়ে যায়—
শোরগোল
পাকিয়ে উঠছে
ধোঁয়ার মত
সন্ধ্যায় রান্নাঘরের
চিমনি বেয়ে আসা
কুয়াশার ভ্রম
ছড়িয়ে যেতে যেতে
ঢেকে দিচ্ছে নীরবতা
কফি ও টেবিল
নীল একটা মাছির
উড়ে যাবার শব্দ
পাওয়া যেত টের
তাকে ছাপিয়ে
রিন রিন বাজছে
অপেক্ষায় চিক চিক
মায়েদের কথা
শিশুরা স্কুলে—
গণিতে দুর্বল
শিশুরা স্কুলে—
জাতীয় সংগীত
শিশুরা স্কুলে—
হিজাবে মোড়ানো
নরম ক্রোসেন, মাখন
কফি ও মাশরুম বোল
মায়েদের হাসি
কপট সদালাপ
শীৎকার অসমাপ্ত
চলটা তোলা নিন্দা
ছেয়ে যাচ্ছে ক্যাফে
এমাথা ওমাথা
ডায়াবেটিক–পা
ছেয়ে যাচ্ছে
পরকীয়া ও পরকাল
কাঁটা চামচ, গ্রাইন্ডার
সেমি ক্ল্যাসিকাল
শোরগোল
ক্রমশ পাকিয়ে ওঠা
শক্তিশালী একটা
অনূদিত কবিতার
রূপকের চেয়ে?
সংকেতময়
আমার ম্রিয়মান
অপেক্ষার চেয়ে?
৮.৩০এর স্টাফ
হয়তো জানে
ঠিক ৮.৪০এ
দরোজার হাতল
ঠেলে আমার
ধীর প্রবেশ
হয়তো জানে
আমার জন্যে
নির্ধারিত সোফা
ও তীর্যক রোদ
হয়তো জানে
মোদ্দা কথা
জানার ব্যক্তিটি
আমি নই।
৪.
একদিন এইসব ছুতো বাহানা শেষ হবে নিশ্চয়ই। ছেলে অথবা মেয়েটিকে স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষার অযুহাত বোনার দিন ফুরাবে। যেমন করে পথ ও পাখিজন্মের কবি ফেরদৌস নাহার টরন্টোর টিম হর্টন্সের আউটলেটে বসে নির্ঝঞ্ঝাট লিখেছেন কফিশপের গদ্যগুলো। পাশে একটা ঢাউশ কফি মগ বসিয়ে। দফায় দফায় অর্ডার দিয়ে। যেমন নিউইয়র্কে কবি অনুবাদক শামস আল মমীন ক্যাফেতে বসে দিচ্ছেন শনিবারের আড্ডা। শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্রের আলাপে ঝড় তোলা পাক্কা কফিখোর এক একজন মিলে। তেমনি শুধু লেখা হবে বলে খরচের খাতায় সদর্পে টুকে রাখবে কেউ কফি ও ক্রোসানের দাম। বহুজাতিক উন্নয়ন আর ফতোয়ার আঁচড়ে খুবলে যাওয়া শহরে এখনও বেঁচে থাকা ছিঁটেফোঁটা সবুজে ভোরবেলাগুলোয় কিংবা বিকেলে এ মাথা ওমাথা হেঁটে ঘুরে চষে কাছাকাছি পেয়ে যাবে মনমতো এক ক্যাফে। একটি অগোপন জায়গা। বসবে। হেলিয়ে দেবে মাথা। আর কখনোই না হারানো ভাবনাগুলো শব্দে বর্ণে ছড়িয়ে দিয়ে ধাঁধা বেঁধে নেবে। অথবা লিখবে—
পৃথিবীর এত কথা
লাগে না ভালো আর
শব্দে বাক্যে সংলাপে
মিহিদানা সেজে থাকে
হল্লা দম্ভ মশকরা
বসে আছি কফি
টেবিলের পাশে নীল
মাছির মত সতর্কতায়
যতক্ষণ চুপ থাকা যায়—
মাখনের অপেক্ষা
ভালোবেসে বেসে
যতক্ষণ মৌন থাকা যায়—
চাতুরী দেখে দেখে
অভিভূত বেদনায়
অহেতুক এত কথা
জমে যায় ইথারে পারদে
স্ফটিকের পাহাড় কেটে
আমিই বা এত নীরবতা
কোথা হতে তুলে আনি
কোমর নোয়ানো
মোহিত ভূমিদাস এক
পর্যাপ্ত কফি পান হলে
বরাবর নৈরাশ্য ফেলে
আমাকেও উঠে যেতে হবে
নিঃশব্দে চেয়ার ঠেলে।