সেই রাতের পর থেকে পাগলীর খুব অভিমান হয়ে আছে। কার ওপর, কেন, কিছুই ও জানে না। পাগলী শুধু জানে ও সেদিন কারোর ছায়ার ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল, ওর খুব পরিচিত ছায়া। কিন্তু ও নিজে তার কাছে অপরিচিত ঠেকলো পুরোদস্তুর। সেদিন থেকে ওর বুকের মধ্যে পাহাড় প্রমাণ অভিমান, এই গোটা দুনিয়ার প্রতি। ওর সবচেয়ে চেনা ছায়া এখন ওর কাছে সবচেয়ে অচেনা। তাহলে এতদিন সে যে এত চেনা ছিল, তা কি মিথ্যে? ছাড়খার বাইশ বছর আসলে কী দিল ওকে, আসলে সব কিছু তারা জ্বলা ছাই। পাগলী এবার আস্তে আস্তে বুঝতে শিখছে, আর প্রাণপনে চাইছে দপ করে উড়ে যাক সব স্মৃতি।
সে এখন গা ঘেঁষা স্বপ্নের কত কাছে থাকে, তাও পাগলীকে দেখতে পায় না। যখন এইসব স্বপ্নগুলো দেখার প্রহর ছিল, সেদিন পাগলীর ছায়া তার ছায়ার সাথে মিশে যেত, কিন্তু এখন সেখানে কেবল ব্যাবধান, দুর্লঙ্ঘনীয় ব্যবধান। সবকিছু কাঁটাতারে জড়ানো। পাগলী ছোটবেলায় দিদার কোলে শুয়ে শুয়ে দেশভাগের গল্প শুনত। কত কল্পনা করেছে শরীরি কাঁটাতারের ছবি। আজ পাঁচবছর হল দিদা নেই। দেশছাড়া হবার গল্প নেই, কাঁটাতারের ছবি নেই। কিন্তু কাঁটাগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠছে দিনকে দিন। বেঁচে থাকলে একমাত্র দিদাই এই আঁচড়ের ক্ষত বুঝতে পারত। কারণ, সেও কাঁটা ছিঁড়ে এসেছে, আর এই সহ্যশক্তির গুপ্ত জিন দিয়ে গেছে ওর মস্তিষ্কে। দিদাও কি তাহলে ওর মতো বোকা ছিল? তাই এত সহজে ভিটে ছেড়ে দিল, প্রথম জীবনের ভালোলাগাকে খুন করে রেখে এল নদীর ওপারে?
পাগলী আর ভেবে উঠতে পারে না। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর সময় দিনশেষের আলোগুলোয় ও শুধু নিজেকে খুঁজে নেয়। বুঝে নয়, পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব আসলে কোন এক দুর্ঘটনা মাত্র। তাও এই ক্যাম্পাস ওর কাছে কত কিছু! কেন ও নিজেই জানে না। আচ্ছা দিদার যদি এরকম একটা ক্যাম্পাস থাকত, কেমন হতো তাহলে! দিদা দিনশেষে এরকম কোন আলোর খোঁজ করত? আশ্রয় নিত এই অলিগলিতে পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলোকে দেখে? পাগলীর কল্পনা এবার ঝিমিয়ে পড়ছে, ঘাড়ে-মাথায় ব্যাথা করতে থাকে বীভৎস, পাগলী ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু সেদিন রাতেই বুঝতে শিখে গেল, জীবন মানেই স্মৃতির বিষণ্ণ দায়। ওর ভালোবাসা ওকে বোকা বানাতে পারে নি, বরং নিজেই বিস্মিত হয়ে গেছে, পাগলীর এক রাতের পরিণতি দেখে।পাগলী বুঝে গেছে, ভুলে যাওয়ার অবকাশে যারা নিজেকে খুঁজে নেয়, তারাই বেঁচে যায়। কিন্তু শেষে কি জিততে পারে? কে জানে পাগলী তো এখন আর তাদের খবর রাখতে চায় না। ওর সব বালিশ ভেজা রাত তো তাদের কাছে অহেতুক বাচালতা। পাগলী এখন বিদায় নিতে শিখছে, বিদায় দিতে শিখছে। কিন্তু কী হল তাতে? ওরা এখনো ওকে বোকা ভাববে, তা ভাবুক। পাগলী নিজের কাছে তো বেঁচে থাকবে কিছু আঁকড়ে! আয়নার সামনে দাঁড়ালেই দেখতে পাবে যে ও আসলে পাগল, বদ্ধ পাগল, একেবারে যাকে বলে উন্মাদ। আর ও পাগল, সেটাই পৃথিবীতে ওর কাছে সবচেয়ে বড়ো সান্ত্বনা।
পাগলী ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়ত, তখন ওকে সবাই পাগলী নাম দিয়েছিল, মানে ওর বন্ধুরা। আপাদমস্তক বিচ্ছু মেয়ে, উদ্ভটে ক্ষ্যাপামিতে অস্থির করে তুলত স্কুল বাড়ি। তখন থেকেই স্কুলে ওর এই নামের প্রসিদ্ধি। তারপর বাবার ট্রান্সফার, স্বপ্নের মতো ইস্কুলবাড়ি বুদবুদের মতো উবে গেল ওর জীবন থেকে। সে তখনও জানত না, সামনে আগামী সাত বছরের কারাবাস অপেক্ষা করছে কোন দমবন্ধ শাসন-শিক্ষার ব্যূহ। সেভেন-এইট, মেয়েটা হুট করে শান্ত হয়ে গেল। সবাই খুশি হল এক লপ্তে, বিশেষ করে পাগলীর মা। এই তো, মেয়ের জীবনে ডিসিপ্লিনারিয়ান ধর্মীয় শিক্ষার সার্থকতা। পাগলী এখন লক্ষী মেয়ে, পাগলী নামটাও মিলিয়ে গেছে বাষ্পের মতো। তারপরে কত আবর্তের বিন্যাস! পাগলী এখন বাইশ বছরের তরুণী। আজকাল নতুন বদনাম জুটছে, সেটা নাকি বীভৎস বাজে বকার। আগে হলে ও রাগ করত, কিন্তু এখন এসবে আনন্দ পায়। আসলে পাগলী এখন বড়ো হয়েছে, ক্রমশঃ সাধাসিধে বোকা মেয়েটা নিজের শূণ্যতা নিয়ে সারাদিন ভাবে, সেটা ভাবা যায়? ও চায় ওর সব প্রগলভ যুক্তাক্ষর চারপাশে জড়ো হোক, তারাই আজীবন আঁকড়ে থাকুক ওকে ভেঙে চুড়ে। তাই ওর কথা ছুটুক, হোক বাজে বকা, হোক অনর্থক কথার যানযট। পাগলী নিজে তো জানে, সে এখন বড়ো হয়ে গেছে আসলে কতখানি, আর কতখানি পাল্টে গেছে!
সেই রাতে বাড়ি ফিরে এসে ঘষে ঘষে চোখের কাজল তুলল, কানের আদুরী ঝুমকোদুটোকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কেউ তাকে অহেতুক নৈঃশব্দে আহত করেছে। তাদেরই ছায়ার আস্পর্ধা ওকে এত ভাবাচ্ছে, টুকরো টুকরো করছে । অথচ, কান্না নিষিদ্ধ। ওর ঘরের চারপাশ দিয়ে উঠে যাওয়া গরাদ ওকে নিষেধ করেছে। পাগলী উপুড়চুপুর স্নান করে সেই রাতে, তারপরে ঘুম।
এই দিনের পর থেকে রোজ ওর স্বপ্নে একটা ঝড় আসত। এই ঝড় ও কখনও চোখে দেখেনি। দিদার কাছে গল্পে শুনেছে। ভিটে ছেড়ে আসার সময় বর্ডারে নাকি এমন এক ঝড় উঠেছিল। দিদা প্রাণপনে ভিজেছিল সেই ঝড়ে। মনে হয়েছিল গ্ৰামে ফেলে আসা প্রেমিকের কাছ থেকে পাওয়া সেটাই শেষ আদর। তারপর কাঁটাতার, রিফিউজি ক্যাম্প, গুলি, রক্ত, নতুন বাড়ি সব একে একে এল। কিন্তু তেমন ঝড় দিদার জীবনে আর উঠল না। আর পাগলীর জীবনে তো আসেইনি। শুধু মন খারাপ হলে ঐ ঝড়ের কাছে সে ফিরে ফিরে গেছে। কিন্তু এখন আর ফিরতে হয় না, রোজ স্বপ্নে সেই ঝড় জ্যান্ত হয়ে আসে। দিদার জায়গায় পাগলী নিজে ভেজে, কিন্তু সেখানে কারোর আদর এসে পৌঁছয় না। তবু, ঐ ভিজে চলাতেই ওর শান্তি। ফিরদৌসির কবিতার শিরিন যেমন বিচ্ছেদের উচ্ছ্বাসে আপ্রাণ জলরাশিকে আলিঙ্গন করেছিল, ও সেরকম করে ঝোড়ো ধুলোবালিকে আঁকড়ে ধরে। সত্যিই, দিদা কোথায় যেন চলে গেল, ওর কাছে এই অদ্ভুত ঝড়কে ফেলে রেখে। ক্রমে ফেরত আসতে থাকে পাগলীর ইনসমনিয়া। ঘুমের ওষুধ খেতে হয় মাঝেমধ্যে। কিন্তু ওকে তো সাহিত্যের প্রশ্নোত্তর লিখে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। ইউনিভার্সিটির আইডি প্রুফ লোপাট করে উন্মাদের পরিচিতি দেখালে হবেনা। যে ছায়া সেদিন এত কাছে থেকেও ওকে পাশ কাটিয়ে গেল অবলীলায়, সেও হয়তো আবার কোন কিছুর অঘটনে আসতে চাইবে পাগলীর ছায়ার কাছে। তখন আর পাগলী থাকবে ? সিনেমার ক্লাসরুমে ‘ডুয়েল ইন দ্য সান’ এর নায়িকার ফুল হয়ে যাবার চুলচেরা বিশ্লেষণে শিউরে উঠেছিল। পাগলী জানে ও তখন পার্লের মতো এই শহরের কোন ভাঙা দেওয়ালে বট অশ্বথ্থের চারা হয়ে থাকবে। প্রতিটা হেমন্তে শিশির মাখবে, অকল্পনীয় কোন শীতে যাবে ঝরে। আবার আগামী বসন্তে নতুন শরীর, ওর পাগলাটে বিনুনীর আর একটা উন্মাদ উপাখ্যান। এখানে আর অভিমান নেই, অবলুপ্তি আছে।
Facebook Comments Box