হাজার বছর ধরে দিন দুনিয়ায় জমা যেমন হল, এই একটা সময়ে এসে পা দিয়েছি যখন অনেককিছুই খরচের খাতায়। কত প্রজাতির কীট-পতঙ্গ হারিয়ে গেল, কত পাখি, কত ধরনের প্রাণী, গাছপালা সব লোপাট হল। কেবল মানুষ টিকে গেল। সে আর কিছুতেই বিরল হবে না ঠিক করেছে, তার কি কিছুই হারাবার নেই?এই যে চারপাশে কত ধরনের চিত্রবিচিত্র পাগলরা ছিলেন, তাঁরা কোথায় গেলেন? মানুষের ভেতর যে হদ্দ বোকারা ছিলেন, তাঁরা? পাগল আর বোকা একরকম নিকট আত্মীয়। হিসেবি দুনিয়া তাদের প্রায় একই চোখে দেখে। তখন গ্রামে-গঞ্জে, শহরে নগরে হরেক পাগল দাপিয়ে বেড়ান। বলা যায় নানা ফ্রিকোয়েন্সির পাগল। জটাজুট, কৌপীনধারী বদ্ধ পাগল যেমন আস্তাকুঁড় ঘেঁটে খাবার খুঁজতে গিয়ে খবরের ছেঁড়া কাগজ পেয়ে গিয়ে রাস্তার ওপরই বসে খুব সিরিয়াস চোখমুখ করে পড়তে থাকেন। এঁরা বিজ্ঞ পাগল। ইলেক্ট্রিকের খুঁটির মাথায় উঠে আঁকড়ে ঝুলে ছিলেন এক পাগল। সেভাবেই রাস্তা দিয়ে যে যায় তাকে লম্বা জিভ বের করে ভেঙাতে থাকেন। বিপুল হৈচৈ। সরবরাহ বন্ধ রেখে বিদ্যুৎ কর্মীদের সে কী কাকুতিমিনতি। এঁরা বিদ্রোহী পাগল। বিদ্যুতের মাসুল বাড়ায় প্রতীকী প্রতিবাদে খুঁটিতে ঝুলেছিলেন কীনা কে বলতে পারে। গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকেন দার্শনিক পাগল। এঁরা বিশেষ কতা-টতা কন না। বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে গম্ভীর মাথা নেড়ে হুম বলে ওঠেন থেকে থেকে। আবার আপনার পাশ দিয়ে গটগট করে প্রায়শ যিনি হেঁটে যেতেন, বাতাসে হাত ঘুরিয়ে, জোরে কথা বলতে বলতে অথবা আচমকা অট্টহাস্য করে উঠে, তাঁরা নাটুকে পাগল। যাত্রা দলে পাঠ করতেন এক কালে। যাত্রা উঠে গেছে কিন্তু তার সংলাপ আজও তাঁর হৃদয় তোলপাড় করে। এখন পাগলের মতো একা একা কথা বলা লোকের অভাব নেই, তবে তারা সব ভেজাল পাগল কীনা চেক করে নিতে হয় কানের দু-পাশে হেডফোনের তার বেরিয়ে আছে দেখে!
বড় শহরে আর সব কিছুর মতো পাগলরাও উচ্চশ্রেণীর হন। বেছে বেছে উঁচু জায়গায় বসে থাকেন। একসময় প্রায় খবর হতো হাওড়া ব্রিজের মাথায় বসা পাগলদের নিয়ে। তাদের বাবা বাছা করে ওখান থেকে নামানো যে কি দুরূহ কাজ! কিন্তু এই যে আমরা তাঁদের পাগল বলছি, একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাবভাব করছি, পাগলরা কী তা জানেন? আমাদের চারপাশের সঙ্গে তাঁদের কাজেকর্মে বিস্তর অসঙ্গতি দেখে হাসাহাসি করা বিবেচনার কাজ নয় মোটেই। মনোবিদরা বলেন, তাঁদের নাকি একটা পৃথক মনোজগত আছে, সেই অনুযায়ী যুক্তি তক্কো আছে, বিচার বিশ্লেষণও আছে। আমরা একটা সামাজিক কাঠামোয় কিছু রীতিনীতি বানিয়ে জগঝম্প করছি বলে আমরাই স্বাভাবিক আর তাঁরা নন এটা বলা ভারি অন্যায়। এই যে তাঁদের চলমান অনুভূতির স্রোত। এই হাসেন, এই কাঁদেন, এই বকেন, এই গম্ভীর, সেই ভিন গ্রহে তখন কী চলে আমরা কি ছাই জানতে পাই?বুঝি সময়ের একটা স্তরে হেঁটেচলে বেড়ালেও তাঁদের মনোভূমি যে সময়ের অন্য রেফারেন্স ফ্রেমে নেই কে বলতে পারে। কে বলতে পারে পাগলরাই আসলে প্রকৃত টাইম ট্র্যাভেলার! ঘড়ির কাঁটাকে তাঁদের মতো করে উলটো ঘুরিয়ে তাঁরা পথ হাঁটছেন।
ইতিহাস এ নিয়ে তো কম সাক্ষ্য দেয়নি। কোপার্নিকাস থেকে গ্যালিলিও প্রাচীন বোকা পাগলের দল কোন সুদূরে বলে বসলেন পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে। কথা শুনে এমনকি প্রজাপতিও ফুলের গা থেকে হেসে উড়ে গিয়েছিল, দেয়ালের টিকটিকি করেছিল খলখল। তখন তো স্বাভাবিক মানুষের কাছে পৃথিবী ছিল স্থির, সূর্য তাকে প্রদক্ষিণ করতো এমনকি দুনিয়াটা আদৌ গোলও ছিল না, ছিল চৌকো! ক্যাথলিক চার্চ তখন সর্বেসর্বা। ব্রুনোর মতো পাগলকে পুড়িয়ে মারে! কিন্তু পাগলদের পৃথিবী যে আলাদা, যত নির্যাতন করো আর ব্যঙ্গবিদ্রূপ করো, তাঁরা চার্চও বোঝেন না, প্রচলিত রীতিনীতিও মানেন না। পাগলরা বদলে দিয়ে যান সময়ের কাঁটাকে। সাধ করে তো আর পাগলদের সময়চারী বলা হয় না! তা মানব সভ্যতায় এমন পাগলের সংখ্যা তো নেহাত কম ছিল না! অত বলতে হবে কেন, ইতিহাস বইটা খুলে বসলেই তো পারেন। কেমন অনন্য সব ঐতিহাসিক পাগলদের সাক্ষাত মিলে যাবে, যে পাগলদের হাতে সভ্য দুনিয়ার গোড়াপত্তন শুরু হয়েছিল।
কোনো এক সন্ধের বৃষ্টিতে এক পাগল ভিজছেন। ভিজতেই পারেন। তবে যে স্থানটি তিনি নির্বাচন করেছেন তা কিঞ্চিৎ অসুবিধেজনক। ব্যস্ত বাস রাস্তার একেবারে মধ্যিখানে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি বৃষ্টি-সুখ অনুভব করছেন। সারি দিয়ে বাস ট্রাক বাইক মোপেড আটকে পড়েছে। হেডলাইটের আলোতে তাঁর মুখে স্বর্গীয় হাসি। খিস্তির বন্যা বয়ে যাচ্ছে আর তিনি নির্বিকার। শেষে ট্রাফিক পুলিশ এসে একটি সপাটে গালে বসাতেই তিনি মহা অবাক হয়ে পুলিশটিকে ধমকে ওঠেন, অ্যাই শালা, পাগল নাকি! সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব তেনারা ভাঙেন কুল। কার চোখে কে যে আসলে পাগল তা সময়ই বিচার করে।
২
পাগলের খানিক লাইট সংস্করণ হলেন বোকারা। তাঁরাও এই হিসেবি দুনিয়ার ধার ধারেন না। ফারাক হল পাগলদের মতো তাঁদের তাচ্ছিল্য লোকে করে না, ঈষৎ অনুকম্পার চোখে তাকায়, আহা রে বেচারা বোকাহাবা লোকটি। ছোটবেলায় আমার এক বন্ধু সকালে উঠে খেজুর গাছের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো। গাছে পাকা খেজুরের কাঁদি। ঢিল ছুঁড়েও সে অব্দি পৌঁছয় না। সে তখন কেবলই ভগবান ডাকে, ভগমান, একটা কুই (কুল) দাও! পাখি এসে ঠোকরালে একটি আধখাওয়া কুল পড়ে। সে আবার ডাকে, ভগমান দিলে যদি খাওয়া কুল, একটা গোটা কুই দাও! আমরা তার বোকামিতে বেজায় হাসি। কলেজে পড়তে গিয়ে শুনি রাজনীতি করে বোকারা, সমাজের ভালো করতে যায় বোকারা, অন্যের কথা ভাবে বোকারা,এমনকি বাংলা বিষয় নিয়েও পড়ে বোকারা! বুদ্ধিমানরা সায়েন্স পড়ে, আর কী করে, তারা নিজের আখের দেখে,আপন প্রাণ বাঁচায়, তারাই জীবনে উন্নতি করে। বোকারা কিছুই পায় না। তাই বোকা হতে বড্ড ভয়। পঞ্চতন্ত্রের গল্প ততক্ষণে পড়া হয়ে গেছে। বোকা বামুনের গল্প। যজমান বাড়ি থেকে ছাগল পেয়ে বামুন আনন্দে বাড়ি যাচ্ছে। পথে একজনের সঙ্গে দেখা, আরে ঠাকুরমশাই, কুকুর পেলেন কোথায়, তাকে আবার ঘাড়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আশ্চর্য! কুকুর কই হে, চোখ খারাপ নাকি, আস্ত ছাগল দেখচ না?কিছু দূরে গিয়ে দ্বিতীয় জনের একই জিজ্ঞাসা। বামুনের মনে অল্প সন্দেহ, ঘাড় থেকে নামিয়ে দেখে, না, ছাগলই তো। পথে তৃতীয় জন আবার কুকুর বলতে না বলতে সেটি ঘাড় থেকে ফেলে বামুনের জলে লাফ, ছ্যা ছ্যা, আগে শুচিশুদ্ধ হতে হবে! তা সে ছাগল কাদের ভোগে লাগলো তা কি আর বলতে হয়?এটিকে মিলিত প্রোপাগান্ডাও বলা যায়। প্রথমবার উড়িয়ে দিলাম, দু-বারে মনে সংশয়, তিনে আমি সম্পূর্ণ কব্জায়! ঘোর যতক্ষণে কাটবে আমার ছাগল অন্য কারও পেটে ঢুকে,হজম হয়ে তৃপ্তির উদ্গার হয়ে বেরোচ্ছে!
ঠকে যেতে বড্ড ভয় মশাই। যেমন আমি বাজার করায় বড্ড নড়বড়ে। চোস্ত নই মোটেই। প্রায় ঠকে গিয়ে ব্যাজার মুখে ফেরত আসি। ঠকে গেলেও দমে যাই বলা যাবে না। পরের দিন থলে হাতে কঠিন শপথ করে বেরোই আজি প্রাণ বাজি, ঠকিব না কিছুতেই! প্রতিটি সবজি আনাজ ধুরন্ধর গোয়েন্দার পর্যবেক্ষণে মাপি। সবজিওয়ালার মুখ দেখি, বেশি সেয়ানা মনে হলে অন্যত্র সরে যাই। তাও কোন সে মন্ত্রবলে এমন চালুনি দিয়ে বেছে আনা আনাজপাতি ঘরে এসে থলে ঝাড়লেই পোকা বেগুণ,বয়স্ক ঢ্যাঁড়শ, পাকা কুঁদরি,পচা আলু বেরিয়ে পড়ে! ঠকে গেছি ভাবা খুবই লজ্জার। বাড়ির লোকের সর্বাঙ্গে জ্বলুনি দেওয়া হাসির মুখে দুর্বোধ্য মিনমিন করি। সেই অজুহাতগুলি যারপরনাই হাস্যকর হয়ে ওঠে। তারপরই খুব রেগে উঠি। ইচ্ছে করে বাজারের থলেটা সেই বিক্রেতার মুখে গিয়ে মারি। পেরে না উঠে গুম মেরে বসে থাকি। জীবনে যে কোনো ক্ষেত্রে ঠকে গেলে এক ধরনের নিঃসঙ্গতার ভাব আসে, নিজের প্রতি আস্থা টলে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ভাব। কীভাবে সান্ত্বনা দিই নিজেকে। সেই বোকা মানুষগুলোর কথা ভাবি। সেই মহাকবির কথা ভাবি যিনি বসে থাকা ডালটি মন দিয়ে কেটে চলেছিলেন, তিনিই তো লিখেছিলেন,মেঘদূত, কুমার সম্ভব, অভিজ্ঞানম শকুন্তলম! আর এখন চালাক লোকে মোটেই ডাল কাটে না, ভরা গ্রীষ্মে আস্ত ছায়াবহ গাছ কেটে উড়িয়ে দেয় মাথায় ডাল ভেঙে পড়ার ভয়ে, পাতা ঝরা আবর্জনার আতঙ্কে! উন্নয়নের উল্লম্ফনে। গাছ বেচতে গিয়ে নিজের প্রশ্বাস বেচে যে আসে সে বড় বুদ্ধিমান!
আর এমন এক আত্মগ্লানির সময়ে দেশজুড়ে অভাবিত সব মুহূর্ত আসে। কোনো এক বছর রাত আটটায় কালো টাকার শেকড় দেশের জড় থেকে উপড়ে ফেলতে, অর্থনীতিকে পাহাড়ি উচ্চতায় নিয়ে যেতে, নোটকে বন্দী করার আদেশ হয়। ব্যাংক, এটিএমের বাইরে অনিঃশেষ লাইন। কিন্তু কী মহান আত্মত্যাগ আমাদের। দেশের ভালোর জন্য কী প্রবল আকুতি। লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ মরে যাচ্ছে মুখে শহিদের হাসি নিয়ে। বছরের পর বছর পার হয়, কালো টাকা বহাল তবিয়তে। অর্থনীতি হাঁটুমুড়ে ধুঁকতে থাকে। আমরা কি বোকা?মোটেই না, আর কিছু না হোক চেষ্টা তো করেছি। আসে বালাকোটের সার্জিকাল স্ট্রাইক। পাকিস্তানের একের পর এক ভূখন্ড গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা। অথচ পরে জানা যায় বোমা বর্ষণে মৃত কয়েকটি পাইন গাছ আর একটি কাক! বদলে আমাদের এক উইং কামান্ডারকে বন্দী করে পাকিস্তান। তখন আমি আর একা নই,আমার সঙ্গে গোটা দেশ কেমন ঠকে গিয়ে ভ্যাবলার মতো টেলিভিশন সেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। দিনশেষে আমাদের হাতে থাকে কিছু মৃত পাইন গাছ। মনকে প্রবোধ দিই, হোক না গাছ, সে তো শত্রুপক্ষের এলাকার, শত্রু-গাছ! অতএব কোভিড মহামারীর দিনকালে আমরা দ্বিগুণ উদ্যমে করোনা তাড়াতে ছাদে উঠে কাঁসার থালা পিটে পিটে ভেঙে না ফেলা পর্যন্ত ক্ষান্ত দিই না!
আমরা কি বোকা?দেশসুদ্ধ লোক বোকা না পাগল?নাহ! আমরা আসলে একেকজন সার্ভেন্তেসের ‘দন কিহোতে’, উইন্ডমিলের মতো কাল্পনিক শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে যাই রোজ।