
ছোটবেলায় পাতার চশমা পরেছি। নারিকেল গাছের কচকচে সবুজ পাতা দিয়ে সেই চশমার ফ্রেম আর শুকনো পাতার শলা দিয়ে ডাঁট বানানো হতো। চশমার খোলা দুই দুয়ার দিয়ে তখন আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবী দেখতাম। পৃথিবীর একেকটা সুন্দর ধরতে গেলেই ওরা চপল মেঘ কিংবা দুরন্ত পাখি হয়ে উঠতো। হাতের কবজিতে বাঁধা পাতার ঘড়িতে মিছেমিছি সময় দেখে পাখির সঙ্গে আমিও পাখি হতাম আর মেঘের সঙ্গে হতাম মেঘ।
এখনো চশমা পরি। ঘড়িও। এই ঘড়ি যান্ত্রিক, সময় মাপতে কোনো কমবেশি করে না। বরং কত কদম হাঁটলাম তা ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে রাখে। আর এখন যেই চশমা পরি সেটার কাঁচ পুরু, ডাঁট সরু। নাকের ওপরে চশমাটা চাপিয়ে দিতেই থরে থরে সাজানো দৃশ্যের মতো কত কী যে সামনে দাঁড়িয়ে যায়! কিন্তু ধরতে গেলেই প্রতিটা দৃশ্য পিচ্ছিল মাছ হয়ে নদীর অনন্ত বাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর চশমার ওপাশে জলের সন্তরণ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।
চশমার কাঁচ মুছে ফের লিখতে বসি। যেই ঘরে বসে লিখি সেই ঘর লাগোয়া বারান্দায় সারি সারি টব। মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে মাথাটা একটু জাগালেই দেখতে পাই একটা মাঝারি আকৃতির টবে আরামসে বেড়ে ওঠা ক্ষীরী বৃক্ষ টগরের দুধ সাদা ফুল, পাশের টবে তারাঝরার উদীয়মান সাদা সাদা পাপড়ি। ঐ থোকা থোকা শুভ্র পাপড়ির আড়ালে গোঁজা ঘ্রাণ উন্মনা করে। মন ফিরলে কুঞ্জলতার সরু পাতার ভীরু কাঁপন দেখি, দরজায় এলিয়ে থাকা বৃষ্টিধোয়া হাওয়া স্পর্শ করি। স্পর্শ করি আঁচলে লুটিয়ে পড়া পাতার সবুজ।
এই সবুজ আনন্দ দেয়, বিহ্বল করে। দৃষ্টিসন্ধিতে বিভ্রম তৈরি করে। সবুজ সবুজ মায়া একসময় দুচোখ ঝাপসাও করে তোলে। ঝাপসা দৃশ্যপটে স্পষ্ট হতে থাকে কত শত স্মৃতি।
স্মৃতি জিনিসটাই বিচ্ছিরি; একবার যদি কেউ ভুল করেও এতে ডুব দেয়, উঠে এলেও রোমের গহ্বর চুঁইয়ে চুঁইয়ে স্মৃতিকণা ঝরতে থাকবে যা হাসাবে, কাঁদাবে, হৃদপিণ্ডে ক্ষরণ ঘটাবে। মুক্তি দেবে না সহজে।
ঢেউ কেটে কেটে জলযান যেভাবে বিবিধ গতিতে এগিয়ে চলে ঠিক সেভাবেই এগিয়ে চলছে স্মৃতির রথ। রথে চড়ে একটু একটু করে পথ এগোচ্ছি আর নাছোড়বান্দা সব ইচ্ছে মাথা চাড়া দিচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি ঘায়েল করে যে ইচ্ছে তা হলো ‘শৈশবে-কৈশোরে ফেরার ইচ্ছে।’
এই ইচ্ছেপূরণ সম্ভব না বলেই স্মৃতির কাছে ফেরা। অবেলায় তাই কত কী যে হুড়মুড়িয়ে মনে পড়ে। কোনটা রেখে কোনটা বলি, কোনটা আগে বলি; খেই হারাই বারবার। এই তো আজ ভাবছি আমাদের সময়ে শবে বরাত উদযাপনের কথা। শবে বরাতের রাতের সঙ্গে হুড়মুড় করে মনে পড়ছে ফেলা আসা সময়ের রোজা, ইফতার, চান রাত, মেহেদি ভরা হাত, নতুন জামা, ঈদের দিনের থৈ থৈ আনন্দের দিনগুলো। জানি, তাঁর অনুকম্পার ইশারায় শবে বরাতে বরাতের ফয়সালা ঠিক ঠিক হতেই থাকবে কিন্তু ওসব দিন আর ফিরে আসবে না।
ইসলামী দিনপঞ্জির অষ্টম মাস শাবান মাসের মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মধ্যবর্তী রাতে আসে পবিত্র ‘লাইলাতুল বরাত’ বা ‘শবে বরাত।’ ছোটবেলায় শুনতাম এই রাত পবিত্র রাত। বিশ্বাস করতাম, মহান আল্লাহ তার বান্দাদেরকে এই রাতে বিশেষভাবে ক্ষমা করেন আর এই রাতে বান্দার ভাগ্য নির্ধারণ করেন। এদিকে সারা বছর যেই বান্দার আমল করার কোনো খবর থাকতো না সেই বান্দাও শবে বরাতে নিজের ভাগ্য নতুন করে লেখানোর লোভে আমলে মনোযোগী হতো।
আমারও কি লোভ কম ছিল! মাগরিবের সময়ে গোসল করলে নাকি এত এত সওয়াব পাওয়া যায়, সেই সওয়াবের লোভে ঝটপট গোসল করে ফেলতাম। তারপর জায়নামাজ বিছিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে নামাজ পড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হতো। আর সারাদিনের আয়োজন, ব্যস্ততার কথা তো না বললেই না। আগের দিন থেকেই মায়ের ব্যস্ততার অন্ত থাকতো না। শুধু আমাদের বাড়িতে কেন বিশেষ দিনটিতে আশেপাশের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নানারকম হালুয়া, বরফি, চালের আটার রুটি বানানো হতো। যেই বাড়িতে কালেভদ্রে গরুর বা মুরগির মাংস রান্না হতো সেই বাড়ি থেকেও মাংস রান্নার সুঘ্রাণ ভেসে আসতো, রুটির সঙ্গে একটু মাংসের ঝোল না হলে যেন কারও মন ভরতো না।
আমাদের বাড়িও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আমাদের শখ পূরণের সাধ্যাতীত চেষ্টা ছিল বাবা আর মায়ের। সাধ আর সাধ্যের সমীকরণ মিলিয়ে তাই মায়ের রান্নাঘরের তৈজসপত্রও ঐ সময়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতো। সেই সঙ্গে ব্যস্ত হতাম আমরাও।
হালুয়া তেলে উঠে যাওয়ার পর চুলা থেকে নামিয়ে ভাঁপটা সরে যেতে যতক্ষণ, এরপর মায়ের সঙ্গে হাত লাগিয়ে আমরা বোনেরা বোনেরা কালো রঙের নকশা আঁকা সাঁজের ভেতরে চেপে গোল গোল হালুয়ায় নকশার ছাপ দিয়ে ফেলতাম। রুটি বেলার পিঁড়িতে গরম গরম হালুয়া ঢেলে নিয়ে কুসুম কুসুম ওমের মধ্যেই বরফি কাটা হতো। কাজের সময় আস্ত একটা হালুয়া কি হালুয়ার কোনা ভেঙেও মুখে দেওয়া বারণ ছিল। সব বানানো হলে তারপর যার যার ভাগ বুঝে নেওয়া চলতো। এরপর গাজর, সুজি, বুটের হালুয়া, রুটি ট্রেতে সাজিয়ে মায়ের হাতে তৈরি কুশি কাটার নকশা বোনা ঝালর দিয়ে ঢেকে মাথায় একটা ওড়না পরে প্রতিবেশিদের বাড়িতে দিতে যেতাম। আমাদের প্লেট, বাটি খালি আসতো না কখনোই। এ বাড়ির খাবার ও বাড়ি, ও বাড়ির খাবার এ বাড়িতে ভাগাভাগি করতে করতে মনের ভেতরে আনন্দ বুদ বুদ করে উঠতো, এই তো সামনেই রোজা…দেখতে দেখতে ঈদ চলে এলো বলে!
এদিকে মসজিদের সামনে সাহায্যপ্রার্থীদের দীর্ঘ লাইন বসে যেতো। বাড়িতে বাড়িতেও কড়া নেড়ে চলতো ভিক্ষুকেরা, ‘আম্মা, এট্টু হালুয়া, রুটি দেন না।’ বিস্তর সওয়াব হাসিলের লক্ষ্যে এদের খালি হাতে ফেরানো যাবে না বলে আমাদের বিস্তর ছুটোছুটি শুরু হতো। আর যেই দুষ্ট বালকের দলকে বছরে একবারও মসজিদের ত্রি-সীমানায় যেতে দেখা যেতো না তারাও আলমারিতে তুলে রাখা পাঞ্জাবি-পায়জামা নামিয়ে পরিপাটি হয়ে নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদের দিকে ছুটতো। এই ছুটোছুটির ফাঁকে আতশবাজি আর পটকার কথা ভুলতো না তারা। হৃদকাঁপানো আওয়াজে পাড়া কেঁপে উঠলে সবাই হৈ হৈ করে উঠতো। আমরা যারা বাইরে যাওয়ার অনুমতি পেতাম না তারা বাড়ির ছাদ অথবা বারান্দা থেকে আকাশ পানে ধেয়ে চলা আলোর ঝালর দেখতাম।
সবকিছু কেন অতীতকালেই লিখছি? এখনো তো শবে বরাত আসে। ইবাদতে মগ্ন হয় মানুষ। তবু কেন আজ অতীত সব?
সত্যি সবই হয় আগের মতো তবু কী যেন একটা নেই এখন, কিছু একটা নেই। এই যে চারদিকে কেমন দিনবদলের সুর। শবে বরাতের দিনে এই হালুয়া-রুটি তৈরি, এসবের বিলিবণ্টন বেদাত বলে অনেক বছর হলো অভিমত জানাচ্ছেন অনেকে। পোড় খাওয়া হৃদয়ে উপলব্ধি করি ধর্মরক্ষার নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুবিধ স্ট্যাটাস দিতে যারা ব্যস্ত থাকছেন, আমল নিয়ে তারা যেন ঠিক ততোটা ব্যস্ত নয়।
যদিও ‘ধর্ম গেল’ ‘সব গেল’ বলে কিছু মানুষ বরাবর রব তোলেন তবু এক শ্রেণীর মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঠিকই হালুয়া, রুটি বানিয়ে ভালোবাসার বিলিবণ্টন করে আজও সামাজিক সম্প্রীতিকে ধরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলে। তারপর আসে ঈদ!
ঈদ অর্থ আনন্দ। ঈদ-উল-ফিতর, ঈদ-উল-আজহা…এসব বিন্যস্ত নামে আনন্দ সংজ্ঞায়িত হতো না আমাদের মুখে। আমরা বলতাম রোজার ঈদ আর কুরবানির ঈদ।
সেই ঈদ কি আর এমনি এমনি আসতো! ত্রিশ রোজার সংযম শেষ হয়ে মেহেদি রাঙানো চাঁদ রাত পার হলে তবেই না ঈদ আসতো। তবে আমাদের শৈশব-কৈশোরে রোজার মাস এসেছে তা চাঁদ দেখার চেয়েও নিশ্চিতভাবে বলা যেতো বিটিভির সংবাদ পাঠিকাদের দেখে। রোজা এলেই সংবাদ পাঠিকাদের মাথায় মৌসুমি ঘোমটা উঠতো, আর চাঁদ রাত এলে সেই ঘোমটা গায়েব হয়ে যেতো।
শুনেছি কালে কালে সবকিছুর বদল হলেও বিটিভির বদল হয়নি। আজও এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায়নি বিটিভি। বন্ধুরা বলে, সবকিছু বদলে গেলেও বিটিভি কোনোদিন বদলাবে না। অনিঃশেষ স্বার্থপরতা নিয়ে ভাবি; না বদলাক, কিছু জিনিস স্মৃতির মতো চিরায়ত হয়ে থাকুক, যেমন অমলিন আছে পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখার পর বাবার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ‘খোশ আমদেদ মাহে রমজান’ বলার স্মৃতি।
মনে পড়ে রমজান মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে বাসার প্রত্যেকটি মানুষের দিনলিপির পরিবর্তন ঘটত। তারাবির নামাজ পড়া, কাফেলার ডাক শুনে ঘুম ভেঙে উঠে সেহরি খাওয়া, মা-বাবার কোরআন শরিফ পাঠ, ইফতারের আয়োজন…সব মিলিয়ে আশ্চর্য সব সুরেলা মুহূর্ত ঘিরে থাকতো আমাদের। এই সুর অদৃশ্য চেইনে আটকে দিতো প্রতিটা পাড়া, মহল্লা, অলি-গলির বাসিন্দাদেরও। তারাবি নামাজের ওয়াক্তে মসজিদে মসজিদে মুসল্লীদের জমায়েত বাড়তো। মাঝরাতে তারাদের সঙ্গে জেগে থাকতো একদল অত্যুৎসাহী যুবক। গলিতে হেঁটে হেঁটে তারা সুর করে হামদ-নাত গেয়ে বেড়াতো…‘সে যে আমার কামলিওয়ালা…কামলিওয়ালা…।’ এখনকার মতো রেকর্ডারের যান্ত্রিক ডাক ছিল না তখন, থেকে থেকে এই কাফেলাই সমস্বরে আহ্বান করতো, ‘উঠুন, জাগুন, সেহরি খাওয়ার সময় হয়েছে…।’
চোখ কচলে কষ্টে-সৃষ্টে আমরাও উঠতাম। ঢুলু ঢুলু চোখে সেহরি খেতাম। সেহরির সময় শেষ হওয়ার সতর্কবার্তা হিসেবে মসজিদ থেকে তীক্ষ্ম সাইরেন বেজে উঠার সঙ্গে সঙ্গে পানির গ্লাস টেবিলে ঠুকে দিয়ে নতুন করে সময় গণনা শুরু করতাম। দিন যেতো দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, ইফতারের সময় কখন হবে!
ঐ বয়সে সব রোজা রাখতে পারতাম না। পরীক্ষা না থাকলে একটা দুটো রোজা করার অনুমতি পেতাম। বাবা বলতো, রোজা রাখতে রাখতে অভ্যাস হবে। না খেয়ে থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা ঐ বয়সে তো সহজ ছিল না। তাই রোজা থাকাবস্থায় এক চুমুক পানি খাওয়ার গোপন আকুতি বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির বড়দের সামনে প্রকট হয়ে পড়তো। মাঝে মাঝে মা ভুলানোর চেষ্টা করতো, এই তো দুইটা বেজেছে-একটা রোজা হয়েই গেলো, বেশি কষ্ট হলে রোজা ভেঙে ফেল।
ওদিকে ভাইয়ের সঙ্গে অলিখিত প্রতিযোগিতা চলছে, বিছানায় পেট পেতে ঘন্টা দুই শুয়ে থাকা যাবে তবু কোনো প্রলোভনে রোজা ভাঙা চলবে না।
এভাবে রমজান মাসের একেকটা দিন গড়াতো আর মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতো অজস্র দুশ্চিন্তা…রোজা শেষ হয়ে যাচ্ছে আর ঈদের দিনক্ষণও এগিয়ে আসছে! নতুন জামা-জুতো কবে আসবে! বাবা ছুটি না পেলে তো ঈদে নানাবাড়িতে যেতে পারবো না! নানাবাড়িতে না যাওয়া হলে ঈদের কী হবে! আনন্দ তো বৃথা যাবেই, হাত ভরে মেহেদিই বা পরবো কী করে! আর ঈদ সালামি! সে-ও তো পাওয়া হবে না!
সালামি নিয়েও গল্পের শেষ নেই। ঈদের দিনে সালামি সংগ্রহ করার জন্য গলায় একটা ছোটখাট ব্যাগ ঝুলাতে হতো। লাল, সাদা বা গোলাপি পুঁতি বসানো সেই ব্যাগের নিচের দিকে পুঁতির ঝুলনি থাকতো আর থাকতো লম্বা ফিতে বা চেইন। আর ভাইটির তো সুবিধা ছিল। ওর প্যান্টের পকেট ছিল সালামি রাখার উপযুক্ত জায়গা। অতিথিদের দেখামাত্র আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই পায়ের পাতা স্পর্শ করে সালাম করতাম। তারপর তিনি সালামি দিতে চাইলে সলজ্জ চেহারায় হাত বাড়িয়ে দিতাম।
মামা, খালাদের কাছে অবশ্য লজ্জা পাওয়ার তেমন কিছু ছিল না, বরং সালামির অংক নিয়ে তাদের সঙ্গে চলত দর-কষাকষি। পঁচিশ পয়সা, পঞ্চাশ পয়সার যুগ তখন। এক টাকায় চার চারটা চকলেট পাওয়া যেতো। কিন্তু পাঁচ টাকা কিংবা দশ টাকা সালামি ঢের হলেও মন ভরতো না। রনি মামা পাঁচ টাকা সালামি দিয়ে কেটে পড়লে উচ্চৈঃস্বরে তাকে কিপটে বলতে ছাড়তাম না। যাহোক দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর সন্ধ্যায় ব্যাগের চেইন খুলে ভেতরটা ঝেড়েঝুড়ে সালামি গোনা হতো। টাকার পরিমাণ সম্মানজনক হলে ঘটতো আরেক বিপত্তি। বেশিরভাগ মা ছেলেমেয়েদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঐ টাকা নিজের হস্তগত করতে চাইতো। চুপি চুপি বলি, আমাদের মা-ও একই কাজ করতো। আবার কখনো কখনো মায়ের কাছ থেকে হিসেব-নিকেশ করে নিজেরটা বুঝে নিয়ে মাটির ব্যাংকে টুপ করে সালামির টাকা ফেলতাম। তারপর হঠাৎ হঠাৎ কানের কাছে ভারি ব্যাংক ধরে টাকা-পয়সার ঝনঝনানি শুনতাম। বছর ঘুরলে মহাসমারোহে ভাঙা হতো মাটির ব্যাংক। টুনটুনি ব্যাগে টাকা ঢুকিয়ে দম্ভভরে এদিক ওদিক তাকাতাম। শখের কিছু একটা কেনা হতো সেই টাকা দিয়ে। ঈদের ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ার মতো সঞ্চিত টাকাও একদিন ফুরাতো।
এখনো হিসেবের চক্করে থাকি। হিসেব করে করে স্মৃতির ব্যাংকে মোহরের বদলে শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলোকে সঞ্চয় করি।
ঐ তো দেখতে পাচ্ছি স্বর্ণকুটিরের ছাদের নিচে আমাদের পাঁচ-ভাইবোনের ঈদ প্রস্তুতি! বন্ধুদের জন্য ঈদ-কার্ড সংগ্রহ, নতুন জামার ডিজাইন ঠিক করা, এই ঈদে নতুন জুতো পেলে কুরবানির ঈদে জুতো পাবো কিনা সেই হিসেব-নিকেশও করা হচ্ছে।
ঈদের প্রস্তুতি তো কেবল নতুন জামা-কাপড় বানানো বা জুতো কেনার প্রস্তুতি না। ঈদের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে মায়ের সুনিপুণ হাতে ঘরদোরও সাজানো চাই। ঘরের চারদেয়ালের কোণে জমা মাকড়সার জাল থেকে শুরু করে খাটের নিচের লুকানো আরশোলা কিছুই মায়ের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বাড়তি কিছু কাজ-ঘরের তিন পাখার দুরন্ত সিলিং ফ্যানগুলো জেট পাউডারের ফেনায় চকচকে করে তোলা, শোকেসে ভেতরে সযতেœ রাখা তৈজসপত্র ঘষেমেজে নতুন করা, সেলাই মেশিনকে ঠিকঠাক তেল খাইয়ে সচল রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি।
চারদেয়ালের কোনায় কোনায় মাকড়সার দল নিরুপদ্রুবে সংসার পাতলেও ঈদ প্রস্তুতি হিসেবে আমার ঘরেও সেলাই মেশিন সচল আজ। এ এক পুরনো অভ্যেস, যায় কী করে! ঐ বাড়ি থেকে স্মৃতির মতো যেসব অভ্যাস বয়ে এনেছি সেসবের মধ্যে এটি একটি।
আমাদের শৈশব-কৈশোরে সেলাই মেশিন বলতেই ছিল সিঙ্গার সেলাই মেশিন। তখন এমন কোনো মধ্যবিত্ত পরিবার মনে হয় খুঁজে পাওয়া যেতো না যেই পরিবারে একখানা সিঙ্গার সেলাই মেশিন ছিল না। রিকশায় বেঁধে জামার কোণা ছিঁড়ে গেছে বা জামার সাইজ বাড়াতে-কমাতে হবে কিংবা টুকরো-টাকরা কাপড় কাজে লাগাতে হবে তো সেলাই মেশিনের কাছে যাও, স্কুলের গার্থস্থ্য বিজ্ঞান ক্লাসের বাড়ির কাজ জমা দিতে হবে তো সেলাই মেশিনের কাছে যাও। শুধু কি নিতান্ত অপারগ হয়ে এই যন্ত্রের ঘটঘটানির কাছে ছুটে যাওয়া? আমাদের প্রয়োজন, বিলাসিতা সবই পূরণ করতো এই সেলাই মেশিন। ছোট বাচ্চার নিমা, কাঁথা থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য সেমিজ, কামিজ, সালোয়ার, শার্ট, ফতুয়া, কুশন কভার, সোফা ম্যাট ইত্যাদি সবই তৈরি হতো মা-বোনদের সেলাই মেশিনে। আর রমজান মাসে তো এই যন্ত্রটির অবসর থাকতো না কোনো।
আমার মায়ের সিঙ্গার সেলাই মেশিনটির বয়স আমার বয়সের সমান। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি, আশি সালে বাবার পোস্টিং ছিল কুষ্টিয়াতে, সেই সময়ে মাকে সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছিল বাবা। এরপর বদলিসূত্রে কত জেলা বদল হয়েছে বাবা-মায়ের সংসারের, সেলাই মেশিনটির বদল হয়নি। সে এখনো আমার মায়ের সঙ্গী হয়ে আছে।
মাকে দেখে দেখে আমরা বোনেরাও সেলাই মেশিনে সেলাই করেছি। আমি যখন বেশি ছোট, মেশিনে হাত দেওয়ার অনুমতি মিলতো না তখন আমার বড় বোন ছিল সেলাইয়ের একজন দক্ষ কারিগর। ঈদের আগে আমাদের জন্য জামা সেলাই করে দিতো বড় আপা। আর এক রঙা সুতি কাপড়ের সাদামাটা জামা দামী আর বৈচিত্র্যময় করে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম আমরা। আমি, বড় আর মেজো আপা কালো কার্বন কাগজ দিয়ে জামায় নকশার ছাপ তুলে সুঁই-সুতার কাজ করতাম। আবার কেউ বাড়িতে পা দিয়েছে টের পেলেই ঐ জামা লুকিয়ে ফেলতে হতো। ঈদের আগে নতুন জামা দেখে ফেললে ঈদ হবে না তো!
আসলে এ ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের শৌখিনতা দেখানোর ফাঁকিভরা কৌশল। দোকানের ঝকঝকে কাচের আড়ালে থাকা বাহারি তৈরি পোশাক কেনার সামর্থ্য ছিল না যাদের তারাই রোজার আগেভাগে সুঁই-সুতা, চুমকি-পুঁতি আর গজ কাপড়ের দোকানে ছুটতো।
আমরা তখন এতই বোকা ছিলাম যে মায়ের কৌশল ধরতে পারতাম না, ভাবতাম নিজের হাত সুঁই-সুতায় নকশা তুলছি, এই জামাটাতো পৃথিবীর আর কারও হবে না, কেউ চাইলেও আমার জামার মতো জামা পাবে না।
নিজের বোকামির কথা ভেবে দুচোখ খচখচ করে, কী জানি কী আজও বোকা হতে ইচ্ছে হয় নাকি! মেয়ে এসে গলা জড়িয়ে ধরে দাঁড়ালে বলি, ‘চোখে কী যেন পড়েছে।’
ওদিকে চোখের খচখচানি কমলে ফের সরু চাঁদের রেখা দৃষ্টিসন্ধিতে আটকে যায়। ঐ তো ঈদের চাঁদ উঠেছে, বিটিভিতে শিল্পীরা দুলে দুলে কোরাস গাইছে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ/তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ/ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’
শেষ রোজার ইফতারি শেষ করে গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তখন চাঁদের খোঁজে ছুটছি…নিজের চোখে চাঁদ দেখতে না পারলে তো ঈদই হবে না। এদিকে ব্যস্ততার শেষ নেই। চাঁদ দেখে এসে শিলা খালার সামনে দুহাত পেলে বসতে হবে। সেই বসার সিরিয়াল পেলে হয়। খালা, ভাগ্নে-ভাগ্নিরা দলে-বলে তো কম নয়! কিন্তু মেহেদি দেওয়ার মানুষ কম। গাছ থেকে তুলে আনা কচকচে সবুজ মেহেদি পাতা শিল-পাটায় বেটে ঝাড়ুর শলা আর দিয়াশলাইয়ের কাঠিসহ আসর সাজিয়ে বসেছেন খালা, মেহেদি পরাবেন আমাদের হাতে।
টের পাই দলের সদস্য সংখ্যা গুনে ফাঁকিবাজি করার পাঁয়তারা করছেন খালা। কিন্তু আমরা তো আর ছোটটি নেই। দুই হাতের আঙুলে আর তালুতে গোল করে ছেলেভুলানো নকশা দিলে চলবে না। ফুল, লতা-পাতা চাই, হাতের দুই তালু ভরে চোখজুড়ানো নকশা চাই।
রাজ্যের বায়না নিয়ে মেঝেতে গাঁট হয়ে বসে হাতে হাতে মেহেদির নকশা তুলতে গিয়ে খালার পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে যেতো। ওদিকে ব্যস্ত আমরা খালাকে তাড়া দিতেই থাকতাম। আগেভাগে মেহেদি দিয়ে উঠতে পারলে ভালো, সিরিয়ালে পিছিয়ে পড়লে চোখ ঢুলু ঢুলু হলে মেহেদি লেপ্টে নকশা থেবেড়ে যাবে তো যাবেই জামা-কাপড়েও চিহ্ন আঁকা হবে। মায়ের গালমন্দ শুনতে হবে তখন।
কিন্তু হাতে নকশা আঁকা হলেই কি আর কাজ শেষ হয়? এই মেহেদি যে বড় সোহাগী, দুই হাতে সোহাগ করে ধরে অন্তত ঘন্টাখানেক বসে থাকতে হয়। এ তো এ কালের টিউব মেহেদি নয় যে পাঁচ মিনিটেই লাল হয়ে যাবে! এই মেহেদির রঙ বড় সাধ্য-সাধনা করে পেতে হয়।
এর ভেতরে নানী এসে ফোঁড়ন কাটে, ‘যার মেহেদি টকটকা হইব, তার স্বামী তত বেশি সোহাগ করবো।’ ওদিকে নানীর দিকে চোখ রাঙালেও পাতার চশমা পরে নিয়ে আড়ে আড়ে আমি মেহেদির রঙের গাঢ়ত্ব পরখ করি।
আহা! কোথায় গেল আমার সেই পাতার চশমা! কোথায় গেল সেইসব দিন!