[০৮.০২.২০১৯]
কী অদ্ভুত! কী আশ্চর্য তোমার শরীর! ভাঁজ খুললেই বেরিয়ে পড়ে জিভ—আলগা হয় শক্ত হয়ে লেগে থাকা নিপুণ মুখোশ। ঘন হয়ে নামে শ্বাস,/নিঃশ্বাস। কী বিস্ময়— কী বিস্ময়কর আয়না তোমার তুমি— উত্তল/অবতল ঢেউ— কী বিপুল সমতল তট!!—— চুঁইয়ে পড়ে লালা। বিকশিত হয় ভয়ানক চকচকে দাঁত। আমার আমাকে চেনাও তুমি। এই শেষ বিষণ্ণ বিকেল—ক্ষীণ আলোর সংলাপ আর, পৃথিবীর ধূসর ধূলোয় এমন পতন—এমন আকস্মিক মৃত্যুর সাথে শেষ চোখাচোখি— তুমিই পারো। হে নারী!, হে অগ্নি!,, হে আমার জন্মদুয়ার জঙ্ঘিণী!
[১৯.০৪.২০১৯]
আকাশের চোখ বিমূর্ত নয়। কখনওবা সেও নেমে আসে। ভাসিয়ে দেয় বুকের ভেতরে গোপন পথঘাট, মাঠপ্রান্তর সব। এমনকি রাজপথও।
আমি আর সূর্যের দিকে তাকাই না আজকাল। অনুসূর্যের ভেতর তোমার প্রতিকৃতি তোমার থেকেও উজ্জ্বল অমৃত বিষাদে ভরে গেছে। উন্মুখ হয়ে আছে জীবন ও মৃত্যুর ভেদ। আমি কেবল গানের কথা মনে করি। গান,, পৃথিবীর আয়ুর সাথে এগিয়ে চলা এক গতি। একবার.. দু’বার.. তিনবার। মনে করি সেই প্রথম কান্নায় গাওয়া গান থেকে। আমাকে জড়িয়ে ধরা মায়ের আনন্দ-অশ্রু। তখন থেকেই পৃথিবীটা আসলে পৃথিবী। আমার গান। আমাদের গান। আকাশের চোখের থেকেও আরও বিস্তারী। গহিন।…
[২৪.০৫.২০১৯]
বাতাসে বৃষ্টির ঘ্রাণে ভেঙে যায় ডিফ রিপাবলিক হঠাৎ। চোখ খুলি। বহুকাল পর রোদহীন মেঘলা আকাশ আমার। ঘন হয়ে আসা আলোর অন্ধকার যেন। যেন শেষ চৌকাঠ পেরিয়ে, এসে গেছে এই অমোঘ মৃত্যুর গম্ভীর গর্ভের ভেতর। দেখতে পাচ্ছি বেঘোর জল ও পাতাল। দেখতে পাই অন্তরাত্মা,—ভেদ করা অন্তহীন অন্তরীক্ষ। অথচ এদ্দিন আমাদের উত্থান ও পতন বলে কিছুই ছিল না এখানে। শ্বাস নিলেই গর্জে উঠতো আকাশ। শ্বাস নিলেই ভেঙে পড়া জল খসিয়ে দিতো এই বুকের মধ্যে বিঁধে থাকা স্বপ্নীল পাপ। আর এখন দেখতে পাচ্ছি বাতাস—দেখতে পাচ্ছি বৃক্ষের সমবেত নাচ ঘনিয়ে এসছে। বেদনার মধুর ছুরির মতোন এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে আমাদের কাল । কোন শব্দটি উচ্চারণ করবো এবার! আমি তো আর নতুন কোনো মাটি নই যে বিশ্বাস এখানে জন্ম দিচ্ছে না বৃহস্পতির। আমাকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াতে বলছো কেন! কেনইবা এই নৈঃসঙ্গের পার্থিব দুপুরে…আমি কি ভালো নেই তোমার একান্ত মৃত্যুর জলজ জঠোরে!!
[০৬.০৬.২০১৯]
নিজেকে শুকোনোর জন্য প্রলম্বিত করি আমার ছায়া। আর বৃষ্টিবিন্দুগুলি নেমে আসে কাঁধ বরাবর। সেই সাথে গড়িয়ে নামে আমার কান্নারাও। তুমি আজ কোন গ্রহে আছো জানা নেই। জানি না সেখান থেকে কোনো আলো এসে আদৌ পৌঁছায় কি না পৃথিবীতে। অথবা তোমার ছায়া এসে আমার ছায়ায় কোনো গ্রহণ সৃষ্টি করে কি না তা-ও বুঝতে পারি না। শুধু তোমার নামের আদ্যক্ষর আমার গড়িয়ে নামা জলের সাথে মিশে একটা হাহাকার সুর তুলতে চায় মাঝেমধ্যেই। একটা শূন্যতার শব্দের ঔরসজাত ধ্বনির থেকে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে চায়। জানতে চায় কেমন আছো তুমি। ভালো আছো তো?
সমগ্র সকাল সূর্যের নিচে দাঁড়িয়ে থেকেও আমার শুকোনো হয় না। ভেজা শরীর নিয়ে আর ভেজা চোখ নিয়ে আমি একবার আকাশের দিকে তাকাই আর একবার অন্তরাত্মার দিকে। তারপর রাত্রি নেমে এলে ঘন হয়ে আসে কবেকার সব জমাটবদ্ধ দীর্ঘশ্বাস। আমার ভালো লাগে না।…
[২১.০৬.২০১৯]
ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়লো আজ একটা উজ্জ্বল শুক্রবার ফুটে আছে বাইরে। আমার আধখোলা জানালা গলে ঢুকে পড়ছে ওর প্রাণময় দ্যুতি। বাতাসে দুলছে বৃক্ষরাজির প্রগাঢ় সম্মোহন। আর পাখিদের ডানায় মেখে আছে আজ অন্তরীক্ষের অবারিত নীল। আমাকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়তে হবে এখন। সমগ্র চৈতন্য সহ এই দিন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। প্রশ্বাসে প্রশ্বাসে মানুষ ও পাখিদের হৃদয়রাজ্যে কী এক আশ্চর্য প্রশান্তির সুন্দর যে বইছে তা আমি অনুভব করতে পারছি ঠিক। সেই সাথে শুনতে পাচ্ছি সেই আহ্বান: এসো, এই শুক্রবার তোমার জন্যই প্রস্ফুটিত গোলাপ হয়ে আছে। শ্বাস নাও। ঘ্রাণে ঘ্রাণে নেশাতুর হয়ে ওঠো জীবনের প্রতি। জীবন সুন্দর। আর সুন্দর শুক্রবার।…
[০৫.০৭.২০১৯]
যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখে নাও: নীচে, রক্তমাখা ফুল ফুটেছে। তারপর বলো তোমার নাম পরিচয়। সময় মাত্র দু’দণ্ড। এর মধ্যেই নেমে আসবো আমরা। তোমার চোখের রঙ, তোমার বীর্যের তেজ। সবকিছুই বলো ঠিকঠাক। নয়তো ওই কাঁচা রক্তে ফুল ফোটানোর দায় হবে সম্পূর্ণ তোমার। তোমাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হবে। যাবজ্জীবন জীবনদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। নিক্ষিপ্ত করা হবে মায়ার সমুদ্রে। সেখানেই ভেসে বেড়াবে আজীবন। প্রীতি, প্রণয় আর লাঞ্ছনার ঢেউ মুহুর্মুহু আছড়ে পড়বে তোমায় ডোবাতে। লালসা, হিংসা-দ্বেষ আর ঈর্ষার শকুন এসে খামচে খাবে তোমার শরীর। তখন শঙ্কাই হবে তোমার একমাত্র সাথী। বলো, কে তুমি? ফুলের ঘ্রাণে আর রক্তের উন্মাদনায় কতোটা নীচে নামতে জানো? কতোটাইবা গভীরে গিয়ে জাগাতে পারো নিভৃত ক্ষত?
[১২.০৭.২০১৯]
তোমাকে পড়তে পড়তেই ডুবে যাই। তোমাতে ডুবতে ডুবতেই ভেসে উঠি। আহ্,, কী বিপুল জলের ময়দান! আমাকে বারণ করো আমাকে বারণ করো আমাকে বরণ করো এইবার—
এই বর্ষণে, নিহত নিয়মগুলো সব, শব হয়ে ভেসে যাক দূরে। দূর পারাবার…
[১৩.০৮.২০১৯]
জলের খুব প্রয়োজন ছিল। তাই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এলো। ধীরে ধীরে ধুয়ে দিলো এই রক্তাক্ত জমিন। আর, মনে পড়লো আমার তো উৎসে ফেরার কথা। সেই সকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলাম। তারপর রক্তের দাগে ও গন্ধে অপহৃত হয়েছিলাম কখন-যে বুঝতে পারিনি। এখন ধুয়ে মুছে গেছে সব দাগ ও রাগ। পরিষ্কার পৃথিবীর পরিচ্ছন্ন আলোয় উদ্ভাসিত আমার চোখ। আমিও বৃষ্টি ভেজা পথের দিকে তাকিয়ে ভুলে যেতে চাইছি বিগত দিনের সব ক্ষুধা ও ক্ষত। একমুঠো মাটি দাও আমাকে। আমিও চাইছি একটা হৃদয় গড়ি। একটা সম্পূর্ণ নতুন আনকোরা হৃদয়। তোমার অমৃতা জলের স্পর্শে যেখানে গজিয়ে উঠবে প্রেম। তারপর তার প্রস্ফুটিত পুষ্পের ঘ্রাণে পৃথিবীটা হয়ে উঠবে এক স্বপ্নকানন।
[২২.০৮.২০১৯]
মাঝেমধ্যে কী যে হয় তোমার—কী ভেবে যে দরজা খুলে দাও হঠাৎ!—আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সচল হয়ে ওঠে আবার। মৃত নগরীতে শিথিল হয় টানা কয়েক শতাব্দীর কার্ফিউ। কিন্তু ওই সময়টাতেই সবচেয়ে হতভম্ব থাকি আমি। কিছুতেই বুঝতে পারি না যে কেন ইন্দ্রিয়গুলো সচেতন হয় আরো! সংখ্যায় দু-একটা বাড়েও বোধহয়। তোমার চোখের ভাষাটুকু পড়তে গিয়ে পরিচিত সবগুলো ভাষার অক্ষরগুলোকে রিকল করি। নেড়েচেড়ে দেখি কোথাও মেলে কিনা। যদি কিছু ভুল হয়ে যায় তাই কুকুর হয়ে বসি তোমার পায়ের কাছে। আর, শেষ পর্যন্ত কোনও ভাষাতেই না-গিয়ে নৈঃশব্দ্যের নির্ভাষ অবলম্বন করি। লেজ নাড়াতে নাড়াতে তাকাই তোমার চাঁদের দিকে পাহাড়ের দিকে। আহ্,, শিথিল শতাব্দীর রাত্রিগুলো একে একে উন্মোচিত হয় আমার চোখের সামনেই। বেরিয়ে আসে কুকুরটির লম্বা লালাময় এক জিভ।
[১১.০৯.২০১৯]
জানি না কী করে কে যে আমায় মানুষের এই দেহে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে! তারপর থেকে আয়নায় যতোবার নিজেকে দেখি—দেখি-যে: আমি নই—এক অদ্ভুত মনুষ্য শরীর দাঁড়িয়ে রয়েছে, আমার সামনেই। আমি হাত বাড়ালে সেও হাত বাড়ায়, আমি ‘হাঁ’ বললে সেও ‘হাঁ’ বলে, আমি ‘না’ বললে সেও বলে ‘না’। বিস্ময়ে হতবাক হই। কী আশ্চর্য পৃথিবী এই। কী অদ্ভুত মাথার উপরে নীল নীল আসমান আর শুভ্র সাদা মেঘেদের দল। আজ বিকেলেই ঘন থেকে আরো ঘন হয়ে গর্জে উঠছিল খুব। নেমে আসছিল জল—কান্নার তোড়ে। গজিয়ে ওঠা গাছেরা ভিজে যাচ্ছিল আমার বেলকনিতেই। কী দারুণ শিহরণ জাগিয়ে বয়ে যাচ্ছিল বাতাস। —আহ্,, পৃথিবী!—ওঃ আমার মনুষ্য দেহ!