নিলু নামের মেয়েটা যেদিন কলোনির সামনে সকাল থেকে অপেক্ষারত ঠেলাগাড়িতে একখানা সেগুন কাঠের খাট আর একখানা বাঁশের ঝুড়ি আর বিয়ের সুটকেস নিয়ে রওয়ানা হলো স্বামীর সাথে কোনো রকম কান্নাকাটি ব্যতিরেকে সেদিনই কলোনিবাসীরা বুঝল প্রেম একটি আত্মরক্ষাকারী কবজ, ইহাকে ঘৃণা করা কি ছোট করিয়া দেখিবার আর কোনো অবকাশ নাই!
ঠেলায় সেগুন কাঠের খাট ছাড়া একটা বাঁশের হাতলওয়ালা ঝুড়ি যার ভিতরে ইত্তেফাকে যত্নে মোড়ানো যাবতীয় বিষয়সম্পত্তি। কেউ যদি বিরক্ত নিয়ে মনে ভাবেন খুব দামি কী এমন বিষয়সম্পত্তি মানে উপহার সামগ্রী যে উহাতে সতর্কতা এত্তো!
আহা, দূরদেশ, সতর্কতা লাগবে না! ভেঙে গেলে! সংসার করতে যাওয়ার ঐ তো সম্বলকম্বল আমার!
হ্যাঁ, চট্টগ্রাম দূরদেশ বৈকি! না দেখা এক শহর আমার এবং আমাদের সবার। আমার কাছে তো স্বপ্নই, চিঠিতে কি মুখে পাহাড়ের উপরের ঝর্ণা সংলগ্ন বাংলো, বুনোফুল বেষ্টিত এক মহাদেশের গল্প শুনে আসছি দু’বছর! তো ঠিক সতর্কতা যা দেখছেন তা কিন্তু ভুল নয়। তবে সুযোগ দিলে সব কিছু ছাপিয়ে যে জিনিসটা আপনি আবিষ্কার করবেন সেটা হলো ভিতরের তুচ্ছ বস্তুকে মূল্যবান করার অপার চেষ্টা এবং আপাত আসল বস্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার গভীর ষড়যন্ত্র! না, দোতলা তিনতলা চারতলা কি সদ্য নির্মিত চারতলার উপরের পাঁচতলার বারান্দা থেকে আপনি সে সব বস্তুর কিছুই আন্দাজ করতে পারবেন না বলেই আমাদের মানে আমার পরিবারের গভীর স্বস্তি এবং আনন্দ। থাক না মধ্যবিত্তীয় দারিদ্র লুকানো এই ছলাটুকু, এই টুকুই তো আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভ্রম! আর সত্যি কথা, সে সব বিষয়সম্পত্তিতে কলোনিবাসীরও তো কিছু অবদান আছে!
এই সব লুকোচুরির পর যদি ‘আজি সাঁঝে যমুনায় গো’বলে বিষন্ন এক লোকালয় ছেড়ে যাই তো এ জগতে কী ক্ষতি কার! চেষ্টা করে দেখুন আপনিও বলতে পারেন কিনা!
তবু! কী আছে তাতে! এই এত এত বছর পর এখন আসলে বলে দেয়া যায়, বহু বছর অন্তরালে থাকার পর কিছু গোপন প্রকাশযোগ্য হয়ে উঠে জানেন তো, এটা সময়েরই গুণ আমার কি আপনার নয়। ভেবে দেখবেন সমসাময়িক কিছু আলাপ আপনি করতে না পারলেও সময়ের গুণে এক সময় তা হয়ে ওঠে শুধু প্রকাশযোগ্য নয়, খুব মজারও।
ভণিতা বাদ, বলি। এক সেট গেলাস, ছয়টা; ব্যবহারের অযোগ্য। কারণ ঠোঁট রাখার জায়গা এবড়োখেবড়ো এবং কিঞ্চিত ধারালো এবং সবুজাভ। তদুপরি গেলাসগুলো কিন্তু সাধারণ নয়, অপুষ্ট দরিদ্র তরুণীর কোমরের ন্যায় পেট মোচড়ানো, আলবাৎ মদের। বাড়িতে প্রদর্শনীরহিত নিশ্চিত ভাবেই। ধারনা করি প্রতিবেশী উপহার প্রদানকারী আপার যে মদ্যপ স্বামী এগুলো দিয়েছিলেন আমার বিবাহে, তিনি অহোরাত্রি পান করতেন এবং পান শেষে পানপাত্রের জীবনপাত ঘটাতেন বলেই চার ছ’আনা দামের কিছু গ্লাস বাসায় মজুত রাখতেন স্ত্রীরত্ন। রত্নই বলছি কেননা এই রত্নের মূল্য তার স্বামী অধম কোনোদিন বোঝেননি, না বোঝার খেসারতও দিয়েছে বছর কয়েক পরেই, সে গল্প বাদ। তো সে সব গেলাস থেকেই গোটা ছয়েক এই শর্মাকে দেয়ার জন্য একখানা সবুজাভ ঘোলা ওজনদার পেটমোটা জগ ক্রয়পূর্বক (!) উপহার প্যাকেট তৈরি করতে আজ্ঞা হয়। সেই সকল গেলাস আমার ব্যবহার অযোগ্য মনে হওয়ায় বিয়ের বছর তিনেক পর বাসা বদলের সময় তেলেপোকার বসতি হিসাবে আবিষ্কার হওয়ার কালে প্রথমবার টের পাওয়া যায় উহারা সত্যি মদ্যপানের পাত্র, সাধারণের পরিত্যাজ্য। এতদিনে টের পাওয়ার কারণ আমি আঠার থেকে একুশে উর্ত্তীণ হয়ে সন্তানসম্ভবা হয়েছি, ঘটে বুদ্ধিও ঘটি উপর না হলেও কিছুটা হয়েছে বৈকি! ততদিনে জলবিরহে ঘোলা জগটার সবুজাভতা এতদূর পৌঁছে গিয়েছিল যে তাকে ঘোলা নীল হিসাবে আবিস্কার করি এবং ফুললতাপাতা ভিজানোর কাজে বারান্দায় স্থাপনের চিন্তা মাথায় আসে, ভাগ্যিস মায়ের মতো কিঞ্চিত বৃক্ষপ্রেম নিয়ে বেড়ে উঠেছিলাম সংসার মায়াজালে, তাইতো কাজে লাগানো গেল ঠিকঠাক!
আরো কিছু আছে মহার্ঘ বাঁশের ঝুড়িতে, দেখুন। একসেট ম্যালামাইনের কলাপাতা রঙা কাপপিরিচ আর হাফপ্লেট, ট্রেসহ। সবকিছুই ছয়টা করে। সেটাই বোধ হয় ম্যালামাইনের আদিপর্ব এই পূণ্যভূমি বাংলাদেশে! কিঞ্চিত ব্যবহারেই কি রূপ বিরূপ রঙ ধারণ করেছে তা মনের চোখে দেখে নিন দয়া করে! ফাটা গুড়াদুধ দিয়ে কফির বোতল ধুয়ে বানালে যে রঙ হয়, সে রকম, সত্যি! সত্যি অর্থে তারপরও এটাই ছিল সর্বোচ্চ ব্যবহার্য উপহার সামগ্রী, দিয়েছিলেন বিয়ের উকিল বাবা, তিনি আমার খালুও, আবার বাবার পিরভাইও, পলাশিতে সরকারি বাসায় থাকতেন। পরিবার পরিকল্পনা অফিসের বড়ো কর্তা হলে কি হবে সংসারের চাকা নূন্যতম সচল রাখতে উঠানের একপাশে তাকেও দু’খানা চালা তুলে ভাড়া দিতে হয়েছে সাত’শ টাকায় কেননা সরকারের বেতন স্কেলের এমনি বাহার! পিরভাই মানে একই পিরের মুরিদ, যদি জানা না থাকে! বড়ো বড়ো বিপদে তিনিই আমাদের একমাত্র কাণ্ডারি, তাই ভালো উপহার দিয়েছেন। ঝুড়িতে সেমিকাঁসা নাকি পিতলের ছয় ইঞ্চি উচ্চতার ফুলদানি আছে দু’খানা। বাজার মূল্য ফুলদানি জোড়ার পনের টাকা তো হবেই! দিয়েছিলেন আজিজ কাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপুটি কন্ট্রোলার, যার পরিবারে এন্তার জনগণে ঠাসা। জনগণের সকলে অবশ্য আসতে পারেনি বিবাহ অনুষ্ঠানে, আট নয়জন এসে থাকবে, মানে পরিবারে বাস করা তাঁর যে আরো আরো কিছু পোষ্য কি আত্মীয় আছে তারা উপস্থিত হননি। আরো কিছু উপহার, নিকেল করা এ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনাসহ কারিবাটি, উপর তলায় থাকা আমার প্রেমে সাহায্যকারী বন্ধুর ( বান্ধবী শব্দটা গ্রাম্যতায় ভরা ভাবতাম) বাবা দিয়েছেন, আসল সাপের চামড়ায় বর্ডার দেয়া একখানা ফটোফ্রেম, নিচতলার আমার আরেক বন্ধু সম্পার বাবার দেয়া উপহার। ফটোফ্রেমখানা সত্যি সুন্দর এবং একমাত্র অভিজাত দ্রব্য যা বহুদিন ছবিসহ অমূল্য দর্শনীয় বস্তু হয়ে প্রদর্শিত থাকে বিবাহপরবর্তী আমার অনার্স এবং মাস্টার্স পড়া টেবিলে। আর ‘বেচারা, একটা কাটলারি সেটও পেল না’ভেবে আগের মাসে বিয়ে হওয়া বড়ো বোন বাসু ভাইয়ের ( চাচাতো ভাই) দেয়া উপহার কাটলারি সেট ভেঙে দু’খানা টেবিল চামচ দিলে তা সত্যি অন্ধের যষ্টি হয়ে হেঁসেল আলো করে চলমান থাকে যুগের পর যুগ। সবচেয়ে মূল্যবান উপহারটির কথা বলতে ভুলে গেলে চলে! দিয়েছিলেন মাসুদুল হক চাচা। সিদ্দিকা কবীরের রান্না খাদ্য পুষ্টি, বুলা পাবলিকেশন্স, তৃতীয় সংস্করণ ১৪ এপ্রিল ১৯৮০, আর হ্যাঁ, বিয়েটা হলো ১৪ অক্টোবর ১৯৮১। চোদ্দ সত্যি দারুণ!
ঊনিশ অক্টোবর রবিবার সকাল দশটা, ছুটির দিন। বিয়ের পাঁচ দিন পর, একটা রিকশা আর একটা ঠেলাগাড়ি কলোনির সামনের রাস্তায় অপেক্ষা করতে করতে প্রায় সবকটা বারান্দায় জোড়া জোড়া হতবাক চোখ জড়ো করে ফেলে, চট্টগ্রাম যাচ্ছে এই মেয়েটা, এলেবেলে অতি সাধারণ যে সে! আহা প্রেম জিনিসটা তো সাংঘাতিক ভালো! আর আমি ভাবলাম কি সাংঘাতিক একটা কাণ্ড শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেল!
গুলিস্থান বাস স্ট্যান্ড যাওয়ার প্রাক্কালে জোড়া জোড়া চোখের সাথে সে যদিও ফেলে গেল কয়েক খণ্ড তারকাঁটায় ঘেরা বাগান, বুনো লিলির ঝাড়, যার ডাটাসহ ফুল প্রস্ফুটিত হতো তার পড়ার টেবিলের গ্লাসের পানিতে সারা বর্ষায়, নাক টানলে এখনো ঘ্রাণটা ছোঁয়া যায় কিন্তু। আরো ফেলে যাচ্ছে কার্তিকের ফুলসহ মেহিদিগাছ গোটা কয়েক, একপ্রস্থ পুদিনার বুনো জঙ্গল আর আম-আদার ঝাড়। আম আদায় মায়ের তেঁতুলের টক কাঁচা আমের সুবাস ছড়াত, অপূর্ব, আর রঙবেরঙের তুচ্ছ বুনো জিনিয়া বুনোঘাসে জড়িয়ে পেঁচিয়া, ফুলে ফুলে গভীর উজ্জ্বল মায়া লাগানো প্রজাপতি। আরো আছে, বুড়িয়ে যাওয়া কিছু বিরুত মরিচ গাছ যাদের গায়ে লুকিয়ে চুরিয়ে কুঁকড়ে যাওয়া লাল হলুদ সবুজ মরিচ কিছু। উন্নিশ’শ পঁয়ষট্টিতে নির্মিত দু’খানা বিল্ডিঙের কিছু পলেস্তারা ওঠা রঙজ্বলা দেয়াল, দেয়ালের গা জড়িয়ে মরিচাধরা বাথরুম কি পায়খানার পাইপে বটপাকুড়, পাইপ জড়িয়ে মাকড়সার জাল, টিকটিকির টিকটিকসহ আরো কিছু। কিছু চূড়া ভাঙ্গা সিড়ি, আড়াই সিড়ি দোতলায় ওঠার, তাতে শিশু থেকে কিশোর হয়ে যৌবনে যাবার পদচ্ছাপ। পড়ে থাকে সিমেন্টের রাস্তা যাতে পড়ে কপাল কেটেছিল দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তে। সিরামিকের ভাঙা থালায় পা কেটে মির্জা কাকার ভেসপায় দ্বিতীয়বার ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের ইমার্জেন্সি। সেলাই দিতে গেলে বলি, আমার কি দোষ, রাস্তায় থালা ভেঙে পড়ে থাকলে আমি কি জানি! তারও বছর খানেক আগে কপাল কাটলে সেই একই হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কপাল সেলাইরত ডাক্তারকে বলেছি, বিল্ডিঙটা এসে ধাক্কা দিয়েছে আমি কিছু জানি না, সত্যি! আমি তো আসলে কিছুই জানি না! কিছু জানে শান্তশিষ্ট র্ধৈযশীল কিশোর তরুণ যুবক, আমার মতো অস্থির কেউ না।
পিছনে আরো পড়ে থাকে এক্কাদোক্কা খেলার রাস্তা, শৈশব কৈশোরের খেলার মাঠ। কলেজে পড়তে রাতে বাবার সাথে চাকতি আর গোলোক নিক্ষেপ অনুশীলন ইন্টার কলেজ প্রতিযোগিতা বলে কথা! আরো তো কিছু থাকেই, সোনারুলু কি বান্দর লাঠির চোখ ধাঁধানো ফুল, পুকুর ঢালে ভাঁট আর আকন্দ, আকাশ ছোঁয়া কড়–ই সারি সারি, তাতে সারা বর্ষায় পাউডার পাফ মেজেন্ডা কি হালকা সবুজ ফুল, বসন্তের গ্লিরিসিডিয়া, এপ্রিলের কৃষ্ণচূড়া, নিউমার্কেট, পলাশি। রমনা পার্ক, চিঠি আর চুমা সাম্প্রতিক। এ সবেরও আগেপিছে কিছু আরো, বেবাক কী বলা যায়! নাকি সবাই বলতে পারে!
তাই বলে কলোনির সব প্রেম কিন্তু ভালো হয়নি! কিছু প্রেম মাঝরাস্তায় খাবি খেয়ে পথ হারিয়েছে। কিছু ছ্যাকা খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছাদে বসে কান্না দিয়ে শেষ হয়েছে, বলা চলে এক তরফা প্রেমের রফা হয়েছে প্রেমিকার বিয়ে হয়ে। আবার কোনো প্রেম স্রেফ মায়ের কারণে ভেস্তে গেছে চুয়াত্তরের বন্যার জলের সাথে। চুয়াত্তরেই কেন! কারণ যুদ্ধে ঘটনা ঘটলেও তার ফলাফল পাওয়া গেল তিন বছর পর, প্রেমিক পড়া শেষ করে চাকরি নিয়ে অন্য শহরে চলে গেলে।
তিনতলা থেকে কিছু প্রেম বারান্দা দিয়ে দোতলা নেমেছে সকলের চোখের সামনে সকাল দশটায়, প্রেমিকার সকাশে, ছোটবড়ো অবাক বিস্ময় ভিতু চোখে ‘হা হা… কি করে কি করে পড়ে যাবে তো’ বুঝুন প্রেমের ডেনসিটি। টেকেনি সে প্রেম, সিনু যে চতুরা, গাধার প্রেম টেনে বেড়ানোর মত বোকা নয় তো সে! পরিণত বয়সে সে পাড়ি জমাবে আমেরিকা কি ইউরোপ! সিনু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজের ভবিষ্যত পড়ে ফেলেছে যে! অবসরে করা পাড়ার প্রেমকে মূল্য দিতে হবে কেন সারা জীবন! কত প্রেম কলোনিতে গড়ে ওঠে আবার মোগল সাজ্যের মত চুরমারও হয়! যে মেয়েটি দোতলায় আমাদের বাসায় আসত প্রতি বুধবার রাত পৌণে দশটায় কি রবিবার দুপুর আড়াইটায় নাটক শুনতে; রবিবার দুপুরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর আকাশবানী কোলকাতার নাটক! সত্তরের দশকের শেষভাগটা আমাদের রেডিওর নাটক! তারও মনে তবে একটু প্রেম জেগেছিল আমার ভাইয়ের জন্য! জাগলেও তা জাগ্রত হওয়ার সুযোগ ছিল না। একটা আধা পাগল চাচাতো ভাইয়ের বিয়ের প্রস্তাব তুড়ি মেরে উড়িয়ে চাচার ধানমন্ডির বাড়িগাড়িসহ বাস করার অভিলাষ ত্যাগ করার মতো শক্তি কি সাহস তার ছিল! সে কি আর জানত শেষ পর্যন্ত পনের বছর পর পাগলটার সংসার ওকে ছেড়েই আসতে হবে! ভেসে যাওয়ার আগে খড়কুটার মতো হাত ধরতে হবে স্বামীর বন্ধুর!