“এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার!! এ কি সূর্য নাকি স্বপনের চিতা, এ কি পাখির কূজন নাকি হাহাকার”
এক
চার অগাস্ট ২০১৯। পাঁচদিন হল সোহিনীকে নিয়ে অর্ক শ্রীনগরে এসেছে।মাত্র তিনমাস হলো বিয়ে হয়েছে ওদের। অর্ক কলকাতার একটি নামী চ্যানেলের সাংবাদিক।পেশাগত ব্যস্ততার কারণে বিয়ের পর এতোদিন কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি।সোহিনী একটা এ্যাড এজেন্সিতে কাজ করে।তেমন ছুটি নেই কর্মক্ষেত্রে। গত ৩০শে জুলাই দিল্লী হয়ে বিমানে শ্রীনগর পৌঁছে স্থানীয় একটা হোটেলে উঠেছে ওরা।প্যাকেজ ট্যুরে যে অর্থে ট্যুরিষ্টরা ঘুরতে আসে,ওদের ট্যুরটা সেরকম নয় একদমই।দুজনেই দিন পনেরো ছুটি পেয়েছে।ধীরে সুস্থে পুরো উপত্যকা ঘুরে ফিরে দেখে নেওয়াই উদ্দেশ্য। তাছাড়া একটা অন্য ইচ্ছেও আছে। সাংবাদিক হিসেবে এর আগেও অন্তত দুবার কাশ্মীর আসার সুযোগ এসেছিল।কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, অ্যাসাইনমেন্টটা ভেস্তে যায়।এবার ঘুরতে এসে যদি কোনও খবর সংগ্রহ করা যায়! গত পাঁচদিনে শ্রীনগরের আশেপাশে প্রায় সমস্ত দর্শনীয় জায়গা যেমন গুলমার্গ, পহেলগাঁও, সবই প্রায় ঘোরা হয়ে গিয়েছে ওদের। আজ গিয়েছিল শোনমার্গ ।এবার একটু অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে।দক্ষিণ কাশ্মীরে গেলে কেমন হয়? অর্ক জানে, এই দক্ষিণ কাশ্মীর গত তিরিশ বছর ধরেই সন্ত্রাসের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে।এই তো কয়েক মাস আগেই লোকসভা নির্বাচনের সময় দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একটা জঘন্য সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়ে গেল।আহা রে!! চল্লিশ জন সি আর পি এফ এর জওয়ান!! আর সেই হামলার প্রত্যুত্তরে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিবেশী দেশের উপর এয়ার স্ট্রাইক এবং নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়।দেশপ্রেমের জোয়ারে বিরোধীরা ভেসে গেল একদম।কিছু দুষ্ট লোক অবশ্য সবদিনই থাকে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্য কথা বলেছিল।অর্ক ওসবে কান দেয়নি অবশ্য।তার মনে আছে, সে ওইসময় চ্যানেলের পক্ষ থেকে দক্ষিণ ভারতে আসন্ন নির্বাচনের জনমত সার্ভে করতে ব্যস্ত।
শ্রীনগরে এই পাঁচদিনের অভিজ্ঞতায় অর্ক দেখতে পেয়েছে,শহরটার ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে পুলিশ, আধাসেনা আর সেনার টহল।একমাত্র ডাল লেকের ভেতরে হাউসবোট ছাড়া শহরের যে কোনও দিকে দশপা হাঁটলেই পাথুরে চোখের জলপাই উর্দির উপস্থিতি। স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে দেখেছে,কেউই মুখ খুলতে রাজী নয়।সবাই যেন কীরকম ভীত, সন্ত্রস্ত।এতো সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে তা কোথাও যেন বেমানান মনে হয়।শুনেছে, সমস্ত উপত্যকায়ই নাকি নিরাপত্তার এরকমই কড়াকড়ি। নিজের চোখে দেখেছেও অনেকটা।ফ্লাইট থেকে নামার পর অন্তত দুবার ব্যাগেজ চেক হয়েছে ওদের। এমন ব্জ্র আঁটুনিতে একটা প্রাইভেট গাড়ী কিভাবে সি আর পি এফ এর কনভয়ে ঢুকে পড়ল, তা চমকে দেয় বইকী।
অর্করা যে হোটেলে উঠেছে সেই হোটেলের মালিক স্থানীয়।মধ্যবয়সী, নাম মনজুর ভাট। খুব হাসিখুশী ও সজ্জন ব্যক্তি।অর্ক লক্ষ্য করেছে, এখানের হোটেলের ব্যবসা মূলত স্থানীয়রাই চালান।ভাট সাহেব প্রায় তিরিশ বছর ধরে হোটেল চালাচ্ছেন।একথা সেকথার পর প্রসঙ্গ তুলতেই এই হাসিখুশী মানুষটিকে কেমন ম্লান দেখায়। বলেন “ছোড়িয়ে সাহাব,শায়দ এহী হমারা তকদির হ্যায়। খুদাকা মকসদ ক্যয়া হ্যাঁয় কৌন জানে”
শ্রীনগরে সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নামে।আজ একঘণ্টা হলো, ওরা শোনমার্গ থেকে ফিরেছে।প্রায় আড়াই ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টা পাঁচ ঘণ্টার জার্নিতে সোহিনীর খুব মাথা ধরেছে। পথে ছবির মতো দৃশ্য ছিল।সোহিনী সেভাবে উপভোগ করতে পারেনি।হোটেলের রুমে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।অর্ক পরীক্ষা করে দেখেছে, না,জ্বর আসেনি। বাঁচা গেল।কাল বিশ্রাম নিয়ে পরশু আবার বেরোতে হবে।
অর্ক এককাপ কফির অর্ডার দিয়ে লবিতে নামল।এখানে স্থানীয়রা জাফরান দিয়ে কাওয়া বলে একরকম চা খায় ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে। অর্ক খেয়ে দেখেছে খারাপ না।তবে চায়ের কোনও বিশেষত্ব নেই সেই হাল্কা হলুদ বর্ণের পানীয়তে।সোহিনী বিশ্রাম নিক।ধকল গেছে অনেকটা। শোনমার্গে পাহাড়ে চড়তে গিয়ে দুবার পিছলে পড়েছে। যদিও এই অগাস্টের প্রথমে পাহাড়ে তেমন বরফ নেই।তবু রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হয়ে আছে।কলকাতা ছেড়ে আসার পাঁচদিন হল।তেমনভাবে তারপর আর খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি।অফিসে কিছু কাজ বন্ধু শান্তনুকে হ্যান্ডওভার করে এসেছে।সেগুলোর কি হল,খবর নিতে হবে।দেখেছে,এখানে তাদের চ্যানেল সম্প্রচার হয় না।বেশীরভাগই স্থানীয় চ্যানেল।তাছাড়া তন্ময়দাকেও একটা ফোন করা দরকার।বস বলে কথা!বাড়ীতে মা রয়েছেন।রোজই ফিরে এসে ফোন করে।এখন কফি খেতে খেতে জরুরি কলগুলো সেরে নেওয়া যাবে।
ফোন বের করে অর্ক দেখতে পেল, টাওয়ার কাজ করছে না।এখানে অনেক জায়গায়ই ঘুরতে গিয়ে দেখতে পেয়েছে, টাওয়ার পাওয়া মুস্কিল।এখানে বি এস এন এল বাদে অন্য নেটওয়ার্ক তেমন কাজ করে না।কখনও অল্প আসে, কখনও আসে না।তাই বলে খোদ শ্রীনগরে এরকম! অর্ক রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেল।রিশেপশনে বছর পঁচিশের একটা ছেলে বসে আছে।অর্ক এই হোটেলে কোনও মহিলা কর্মচারী দেখেনি।সবাই পুরুষ৷ নেটওয়ার্কের সমস্যা শুনে ছেলেটা জানাল,বিকেল থেকে হোটেলের ল্যান্ডলাইনও কাজ করছে না।তবে এ সমস্যা এখানে নতুন নয়।আগেও হয়েছে।কখনও দু চার ঘণ্টায় ফিরে আসে। কখনও এক দু দিন লেগে যায়।
সোহিনীকে অল্প কিছু খাইয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল অর্ক। মাথাধরা অল্প কমেছে।সোহিনী সুস্থ থাকলে রাতের দিকে হয়তো ডাল লেকের ধারে একটু ঘুরতে যেত দুজনে।হোটেল থেকে লেকের দূরত্ব হাঁটাপথে তিন মিনিট। সে রাতে আর নেটওয়ার্ক ফিরল না।অর্ক অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল।
দুই
পরদিন খবরটা জানতে পারল অর্ক। নেটওয়ার্ক যথারীতি ফেরেনি।হোটেলের পরিবেশ আজ যেন অন্যরকম। কর্মচারী থেকে শুরু করে অন্য বোর্ডাররাও যেন ভীত ও সন্ত্রস্ত।কোথাও কি আশেপাশে জঙ্গি হামলা হলো আবার ? অর্ক জানতে পারল, হামলা নয়, সংবিধানের ধারা ৩৭০ অনুচ্ছেদ যা জম্মু কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দিয়েছিল,ও ধারা ৩৫এ,তুলে নিয়েছে ভারত সরকার।এরপর থেকে কাশ্মীরের এই বিশেষ মর্যাদা যা কাশ্মীরকে ভারতের অন্য রাজ্যের থেকে পৃথক রেখেছিল এতোদিন,আর থাকল না।আজ সংসদে পাশ হয়ে গেছে এই বিল।শুধু তাই নয়,জম্মু কাশ্মীরের বিধানসভা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে।জম্মু কাশ্মীর থেকে আলাদা করা হয়েছে লাদাখকে।রাজ্যের তকমা হারিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে রাজ্যের এই দুই অংশ।প্রতিক্রিয়া ও বিক্ষোভ রুখতে শহরে শহরে কার্ফু জারী করা হয়েছে।বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সমস্ত রকমের যোগাযোগ মাধ্যম।যাতে এই অঞ্চলের খবর দেশের অন্যান্য অংশে পৌঁছতে না পারে।বন্ধ করা হয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের দপ্তর। আটক করা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী সহ অন্যান্য নেতা নেত্রীদের।একমাত্র সরকারী বিবৃতি ছাড়া অন্য যে কোনও সংবাদ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে কাশ্মীরে।
হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে অর্ক। পুরো ট্রিপটাই বেকার হয়ে গেল।এখন ফিরে যাওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।লবিতে পৌঁছে দেখে,বাট সাহেব বসে আছেন।মুখ গম্ভীর ও বিষণ্ণ। কাছে যেতে বললেন, “খুব খারাপ হয়ে গেল আমাদের জন্য।আমার পরিবার সোপোরে থাকে।অনেকটা পথ।আমি যেতে পারছি না।সারা শহরে সেনাবাহিনীর টহল, কার্ফু।কোনও খবরও নিতে পারছি না।সবকিছু ওরা বন্ধ করে দিয়েছে।আল্লাহ জানেন কি হবে আমাদের!!” একবার বিড়বিড় করলেন “আগেও ওরা বহুতবার জুল্ম করেছে।আমাদের অসংখ্য মানুষ মারা গেছেন।তবে এবার যা করল ওরা, এতোটা বেইমানি …” থমকে গিয়ে একটু সামলে নিলেন নিজেকে।বল্ললেন,”দেখুন জনাব, আমার কর্মচারীরাও তাদের পরিবারের কোনও খোঁজখবর নিতে পারছে না। তবে আপনারা আমাদের মেহমান।আপনাদের কোনও আদর যত্নের ত্রুটি হবে না এটুকু বলতে পারি।আমাদের হোটেলের ব্যবসায় প্রায়ই এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।গা সহা হয়ে গেছে এখন।তবে এবারের মতো আগে কোনওদিন হয়নি।আপনাদের কোনও অসুবিধা হবে না এখানে।শুধু মেহেরবানি করে হোটেলেই থাকুন।বাইরে বেরোবেন না।কিছু হলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো।পরিস্থিতি একটু ঠিক হলেই ফেরার ব্যবস্থা করে দেব আপনাদের।
তিন
১০ অগাস্ট ২০১৯।রাত ১২-২৪ ।অর্ক শ্রীনগরের নুরা জেনারেল হাসপাতালে বসে আছে।আজ বিকেল ৬টা নাগাদ সোহিনীকে ভর্তি করাতে হয়েছে হাসপাতালে। সকাল থেকে চার পাঁচবার বমি হয়েছে ওর। সঙ্গে মাথায় অসহ্য ব্যাথা। অর্ক ভয় পেয়ে গিয়েছিল।শহরে নিষেধাজ্ঞা বলবত চলাফেরায়।বাট সাহেবের অনেক চেষ্টায় অবশেষে এ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতাল পর্যন্ত সোহিনীকে নিয়ে আসতে পেরেছে।ডাক্তার সোহিনীকে দেখেছেন। সোহিনী এখন ঘুমুচ্ছে।অনেকটাই সুস্থ সে।কাল সম্ভবত ছেড়ে দেওয়া হবে তাকে।অর্ক সোহিনীর বেডের পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে।পাশের বেডটা ফাঁকা।ইচ্ছে হলে একটু গড়িয়ে নিতেই পারে।কিন্তু ঘুম আসছে না।সোহিনীর যদি তাকে কোনও দরকার হয়!
সামনের দরজা দিয়ে একটা স্ট্রেচার এগিয়ে আসছে অর্কের দিকে।রাত এখন ১২-৪৫ ।সামনে এলে অর্ক দেখতে পেল ক্ষতবিক্ষত একটা লোক। দলামোচা করে মানুষটাকে শুইয়ে দেওয়া হল সোহিনীর পাশের বেডে।মানুষটার জ্ঞান আছে বলেই মনে হল অর্কর।চোখ দুটি খোলা।মুখে শুকনো রক্ত জমাট বেঁধে আছে।বাঁ চোখে এমন আঘাত করা হয়েছে যে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে চোখটা। স্ট্রেচার নামিয়ে বাহকেরা চলে গেছে।লোকটা নড়াচড়া করতে পারছে না প্রায়।একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ কানে এলো অর্কর। লোকটা কি মরে যাবে?মারাত্মক জখম সে তো বোঝাই যাচ্ছে।অর্ক এগিয়ে যায় লোকটার বেডের ধারে। লোকটা কি কিছু বলতে চাইছে? কান পেতে রইল অর্ক কিন্তু কিছু শুনতে পেল না।“ক্যয়া তকলিফ হো রহে হ্যাঁয় আপকো ?ক্যয়া হুয়া থা আপকে সাথ?” লোকটা শুনতে পেয়েছে মনে হলো।দু একবার বিড়বিড় করে উঠতে চেয়েও যেন পারল না।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল।
“কী শুনতে চান আপনি রিপোর্টার সাব?” পিছনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার ফারুক আন সারি। সোহিনীর চিকিৎসা ইনিই করছেন।সম্বিত ফিরে পেয়ে অর্ক দেখল, এই অনুজ্জ্বল আলোর ঘরে ডাক্তারের মুখে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে,মুখের হাসিটা কেমন যেন তাচ্ছিল্যের মনে হল অর্কের।ডাক্তার শান্ত স্বরে বলে ওঠেন “এই পেশেন্টের নাম নূর আহমেদ।পুলওয়ামা জেলার পরিগাম গ্রামের এক সরকারী স্কুলের শিক্ষক।বাড়ীতে বাবা,মা, বিবি, আর দশ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। ঘটনার শুরুয়াত ৬ অগাস্টের রাতে।রাতের খাবার শেষ করে যখন এই পরিবার শুয়ে পড়ার তোড়জোড় করছে,ভারতীয় সেনার ১৫ জনের একটি দল নূরের বাড়ীতে ঢুকে পড়ে। তখন আনুমানিক রাত এগারোটা। তাদের মধ্যে একজন নূরকে প্রশ্ন করে এই যে জম্মু কাশ্মীরের স্পেশাল স্ট্যাটাস সরিয়ে দেওয়া হল,এ বিষয়ে তার মতামত কি? ভয়ার্ত নূর জবাব দেয়,এই সিদ্ধান্ত খুবই ভালো। তবে তারা নূরের এই কথায় বিশ্বাস করে না।নূরকে জওয়ানরা ঘর থেকে বাইরে আসতে বলে।তাদের সঙ্গে নিয়ে চলে নূরকে।রাস্তায় যেতে যেতে তারা নূরকে বন্দুকের সামনে বাধ্য করে সব জামাকাপড় খুলে ফেলতে।ভীত সন্ত্রস্ত নূরের এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না।শুধু নূরই নয়,তাদের গ্রামের আরও চার পাঁচজন যুবককে একইভাবে নগ্ন করে নিয়ে যায় জওয়ানরা৷ চলতে চলতে নূরের নিম্নাঙ্গে লাঠি দিয়ে বারবার আঘাত করতে থাকে।নূর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়।দুজন জওয়ান তাকে তুলে ধরে রাখে।অন্য একজন চোখের বাঁপাশে ঘুষি চালিয়ে দেয়।তারপর ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তার যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেয় সেনারা।প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।জ্ঞান ফিরলে আবার একই পদ্ধতিতে অত্যাচার চলে তার উপর।তার সঙ্গে আটক অন্যদেরও একইভাবে অত্যাচার করা হয়।
নূর মারা যেতেই পারতো।কিন্তু মারা যায়নি।বরং সেনার উপরমহলের নির্দেশে তার ঠাইঁ হয়েছে এই সরকারী হাসপাতালে।
ডাক্তার থামলেন। অত্যন্ত সুদর্শন এই ডাক্তারের চোখের দিকে চাওয়ার সাহস হলো না অর্কের।শরীর হটাৎই খারাপ লাগছিল তার।ডাক্তার এগিয়ে এসে নূরের শরীরের উপরের কাপড় সরিয়ে দিলেন।অর্ক দেখল ……হটাৎ প্রবল বমির বেগ এলো তার।ডাক্তার মনে হয়, তার অবস্থা বুঝতে পারলেন।কাঁধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বললেন,” রিপোর্টার সাব,এভাবে আপনাকে এসব বলা বা দেখানো আমার উচিত হয়নি মনে হয়।গুস্তাখি মাফ করবেন।ডাক্তারী এথিক্সের বাইরে বেরিয়ে আসা আমার উচিত হয়নি।কিন্তু, আমরাও মানুষ তো।তাই মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। অবশ্য হিন্দুস্তানীরা আমাদের মানুষ ভাবে না হয়তো! হ্যাঁ এটা ঠিক, আমাদের মাটিতে হিন্দুস্তানের ভূমিকা এক দখলদারের বেশী আর কিছু নয়।কাশ্মীরের বাচ্চা বাচ্চা এ কথাই বিশ্বাস করে।তা আপনি তো সাংবাদিক! স্টোরির তলাশ করেন।দেখাতে পারবেন এই স্টোরি ?পারবেন না, জানি”।একটু থামলেন ডাক্তার।নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলেন হয়তো।তারপর বল্লেন”আসলে কি জানেন, সবাই তো জেহাদী হতে পারে না।আর ইসলামে আত্মহত্যা হারাম।তাই বেঁচে থাকতে হচ্ছে আমাদের।নইলে ……।।আমার নিজের কথা বলতে হলে বলি,আমার যখন আট বছর বয়স, তখন আমার আব্বুকে জঙ্গি সন্দেহে গুলি করে মেরেছিল সেনাবাহিনী।সেই থেকে আমি সেনাদের সহ্য করতে পারি না।আর হ্যা,কাল সকালেই আপনার স্ত্রীকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে।She is fine now.শুভরাত্রি।
চার
১৫ অগাস্ট ২০১৯।ভারতের ৭২তম স্বাধীনতার উদযাপন। সোহিনীকে নিয়ে অর্ক কলকাতা ফিরে গেছে। হাসপাতালের ওই ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে।মনে হচ্ছে,কিছু করা দরকার।সেই ঘটনার অডিও ও ছবি তন্ময়দাকে আসার পরেই পাঠিয়ে দিয়েছে সে।কবে তা ব্রডকাস্ট হবে,সে বিষয়ে আজ গিয়ে তন্ময়দার সাথে কথা বলে নেবে সে।আজ ছুটির দিন,তন্ময়দা তাকে বাড়িতে লাঞ্চে ডেকেছেন।তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়ে তন্ময়দার গলফগ্রীনের বাড়িতে পৌঁছে গেল সে।লাঞ্চ দারুণ হয়েছে। বউদি অনেক কিছুই বানিয়েছিলেন।তবে একটা অবাক বিষয়, অর্ক ছাড়া অফিসের আর কেউই আমন্ত্রিত নয়।লাঞ্চের পর প্রসঙ্গটা তুলল অর্ক।“দাদা, আমি আপনাকে যে অডিও আর ভিকটিমের ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম,সেটা কবে দেখানো হবে আমাদের চ্যানেলে?” তন্ময়দা বললেন,” ভাবছি অর্ক, এবার কাশ্মীরে সোহিনীকে নিয়ে তোমার ট্রিপটা ঠিক কমপ্লিট হলো না।অনেক কমপ্লিকেশন এসে গেল।তাছাড়া মেয়েটা অসুস্থও হয়ে পড়ল খুব। সামনে পুজো আসছে,এবার পুজোয় তোমরা বরং মালয়েশিয়া ঘুরে এসো।আমি সব আ্যরেন্জ করে দেবো। কোনও সমস্যা নেই। সোহিনীরও ওই সময়টায় কোনও এ্যাসাইনমেন্ট নেই,আমি ওর সাথে কথা বলে নিয়েছি।“ অর্ক বলল, “ঠিক আছে দাদা, যাবো নাহয়,তবে আমার ওই খবরটার কি হল?কবে দেখাবে চ্যানেলে?” তন্ময় বললেন, “ডোন্ট বি সিলি অর্ক, ওটা দেখানো যাবে না।আমি ওটা নষ্ট করে দিয়েছি।“ “আপনি নষ্ট করে দিয়েছেন?” অর্ক বুঝতে পারল সে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। “এটা আপনি কিভাবে করতে পারলেন দাদা?এরকম একটা জঘন্য বর্বরতার খবর আমরা দেখাবো না?বেশ, ঠিক আছে,আমার কাছে এই ছবি ও অডিও ফুটেজের কপি রয়ে গেছে।আমি এটা অন্য চ্যানেলে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেবো। এই বর্বরতা মানুষ দেখুক,আমি চাই।“ তন্ময় হাত রাখলেন অর্কের পিঠে। আস্তে আস্তে বললেন, “আদর্শ, আবেগ, এসব আমাদের প্রফেশনের জন্য ক্ষতিকর তুমি জানো।ডোন্ট বি আ্যন ইমোশনাল ফুল।তুমি জানো, দশ বৎসর লেগেছে আমার চ্যানেলকে এই জায়গায় দাঁড় করাতে।আমাদের চ্যানেলের ভিউয়ার, টি আর পি ভারতের প্রথম চারটে নিউজ চ্যানেলের মধ্যে।এই খবর দেখিয়ে সে সব আমি নষ্ট করে দিতে পারি না অর্ক।এই খবর দেখালে সরকার আমাদের চ্যানেল বন্ধ করে দিতে পারে।আমাদের জেলে পুরতে পারে সরকার।আর যদি তা হয়,সব কিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাবে।বছরে এতো কোটি টাকার সরকারী বিজ্ঞাপন……আমরা নিঃস্ব হয়ে যাবো।আর তোমাকে একটা কথা বলে রাখি,কোনও চ্যানেলই এই বিস্ফোরক ফুটেজ দেখানোর ঝুঁকি নেবে না।আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ালে তোমার এই চাকরি তো যাবেই,কারণ সরকারী মহল থেকে চাপ এলে তোমায় আমি রাখতে পারবো না,প্লিজ ট্রাই টু আণ্ডারস্ট্যাণ্ড।তোমার জীবন সংশয়ও হতে পারে।সদ্য বিয়ে হয়েছে তোমার, মেয়েটার কথাও ভাবো একটু।তোমার কম বয়স ,এই বয়সে আদর্শবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে,অন্যায়ের প্রতিবাদে গর্জে উঠতে ইচ্ছে করে।কিন্তু তা দিয়ে তো ব্যবসা হয় না অর্ক।তোমায় বুঝতে হবে, তুমি আমি কিছুই বদলানোর ক্ষমতা রাখি না।“
পাঁচ
তন্ময়দার বাড়ী থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে অর্ক৷ অডিও ও ছবিগুলো ডিলিট করে দিয়েছে।সামনের মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন,সেই সফরের exclusive কভারেজের এর দায়িত্ব তন্ময়দা অর্ককেই দিয়েছেন।রাস্তায় একটা গাড়ী একটা কুকুরকে চাপা দিয়েছে।.তা হোক, কতো কুকুরই তো গাড়ী চাপা পড়ে ৷ আচ্ছা, পুজোয় মালয়েশিয়া না গিয়ে ইতালি গেলে কেমন হয়? অর্কের ইতালি যাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিন।সোহিনীকে বলা যাবে না এখন।সারপ্রাইজ দিতে হবে।