শুধু বাড়িটিই নয়, তার চারপাশও খুব জমজমাট হয়ে উঠেছে আজ। শ্রীহীন বাড়িটিকে পুরোদস্তুর উৎসবের আমেজ দিতে বাড়ির মানুষ দু’টো বলতে গেলে সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে। এর সাথে গ্রামের অন্য সব মানুষদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তা বাড়ির পাশের আকলিমা খালাই হোক কিংবা ক’ঘর দূরের নীপেন ঠাকুর, সবাই যেন নিজেদের সবটুকু সামর্থ নিয়ে বাড়িটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে।
সাহায্য না করে উপায় আছে? এমনিতেই সক্ষম মানুষের অভাবে বাড়িটি ধুকছে দীর্ঘদিন, অন্যদিকে এলাকার সম্মান বলেও তো একটা কথা আছে। সেই কতদূর থেকে অনেকদিন পর মানুষটি আসবে, সেই মানুষটির জন্য তো কিছু না কিছু তো করতেই হয়। এই যেমন আকলিমা খালা বললেন,
সে তো নতুন গুড়ের শিরনি খুব ভালো খাইতো সাথে ঘন দুধের ফিরনি……
কথা শেষ হবার আগেই নীপেন ঠাকুর গলা খাকরি দিয়ে বলে ওঠে,
সেবার আমার দুধেল গাই সের সের দুধ দিতো। হাঁড়ি ভরা দুধ দিয়ে যেতাম তাকে……
এটুকু বলতে না বলতেই পাশের আঙিনার মোমেনূল চাচা হু হু করে কেঁদে উঠলো,
সে বছর গাছ ভরা ছিল সিন্দুরী ফজলি আম….কত যে স্বাদ করে খাইতো সে…….
এখন দুধেল গাই কোথায় পাবে নীপেন ঠাকুর আর অসময়ে সিন্দুরী ফজলি আমই বা কোথায় পাওয়া যাবে। তা বলে কি সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? মোমেনুল চাচা কান্না ভরা কন্ঠেই ফোন দিলেন শহরে থাকা ছেলের কাছে। আবদার একটাই,
তোমাগো শহরে তো বাজান সারাবছর সব ফলফলাদি পাওয়া যায়, বাড়ির ঠিকানায় কতক সিন্দুরী ফজলি পাঠাও জলদি।
আর নীপেন ঠাকুরও বাথানে লোক পাঠালেন,
খুঁজে দেখে দুধেল গাভীর ননীওয়ালা দুধ নিয়ে আসো।
আর যে বাড়িকে ঘিরে সবার এতো আয়োজন সে বাড়ির বয়োবৃদ্ধ মানুষ দুটি এই বয়সেও নতুন টিন ফেলে ঘরের চালে, নতুন মাটিতে ধারি বাঁধে ঘরের।
আসলে শুধু ঘর নয়, এই বাড়িটিই তো অনেকদিন পর অন্যরকম আনন্দ দেখছে। বাড়ির কর্তা ব্যক্তি হাসিবুল রহমান বয়সের ভারে ঠিকমতো হাঁটতে চলতে না পারলেও আজ ঠিকই এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন,
বটতলার মোড়ে আসি নামবি, ওখান থিকি পথ চিনতি পারবি না, আমার তোলা জামাখান বাইর করি রাখো, তারে আনতি যাতি হবি।
স্বামীর কথা শুনে জামিলা বিবি ফিক ফিক করে হাসেন,
পথ চিনলেও আপনেরে চিনতি পারবি নানে, বড় দাড়ি আর কুইজ্যা ঘাড়ে আপনেক এখন অন্যরকম দেখায়।
হাসিবুল রহমান বিবির কথায় খানিক থমকে যান,
বিশু নাপিত ঘর খুললি যাবা নে, চুলেও ক্ষুর পড়ে না মেলাদিন।
কথাগুলো বলতে বলতে হাসিবুল রহমান ভেবে নেন শুধু নিজে সাজলেই হবে না জামিলা বিবির জন্যও একটা নতুন কাপড় কিনতে হবে। কবে জামিলা বিবির জন্য তিনি কিছু কিনেছিলেন তা ঠিকঠাক মনে করতেও পারেন না এখন।
মনে করবেন কীভাবে? সেই কবে থেকেই তো স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই শুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে আছেন। সংসারে থাকতে গেলে যতটুকু না করলেই নয়, তাই করেন দু’জনে। নইলে দু’জনেই জানেন সেদিনের পর থেকে দু’জনের মনেই সন্ন্যাস ভর করেছে।
তবে এমন হবার কথা ছিল না। বয়সকালে এ বাড়ির মতো তারা দু’জনেও নবীন ছিলেন। নবীন সংসারে প্রাচুর্য ছিল না বটে, তবে আনন্দের অভাবও ছিল না।হাসিবুল রহমান এ দোকানে ও দোকানে মাস খেটে যা পেতেন তা দিয়ে সংসারের সব প্রয়োজন মিটতো। আর অন্যদিকে জামিলা বিবি নানা পরবে বিভিন্ন বাড়ির হেঁশেলে যোগানদারী করে যতটুকু আনতেন তা হতো সংসারের উপরি।
তবে ওই যে কথায় আছে না, সুখের সময় হুট করেই চলে যায়। এ বাড়িতেও তাই হলো। প্রাচুর্যের অভাব যে বাড়িতে অন্ধকার নামাতে পারেনি একজন মানুষের অভাব সেই বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দিলো। সে দিনটি নিয়ে গ্রামের পুরাতন মানুষদের কথাগুলো এরকম,
আহারে, কত আছারিবিছারি করি কাঁন্দিছিলো জামিলা বিবি সেদিন। আর হাসিবুল তো এ গ্রাম ও গ্রাম দৌঁড়াতি দৌঁড়াতি আধাপাগল হই গেছিলো। মানুষ দুইটার শোক দেইখ্যা গ্রামের সবতি চোখের পানিত বুক ভাসাইছিলো।
তবে গ্রামের মানুষগুলো যে শুধু জামিলা বিবি আর হাসিবুল রহমানের দুঃখে কাতর হয়েছিলো তা নয়, তাদের নিজেদেরও কি শোক হয়েছিলো বিস্তর। আরকিছু না হোক এ গ্রামের সবাই একে অন্যকে অন্তর দিয়ে আগলে রাখে জানে। তাই তো যখন এত আগলের মধ্যেও ব্যাপারটা ঘটে গেলো তখন তারা নিজেদেরকেও অপরাধী মনে করেছিলো। ভেবেছিলো হয়তো নিজেদের অসাবধানতাতেই এমন ঘটনা ঘটলো।
তাই এতদিন পর যখন নিজেদের দোষমুক্ত করার উপায় এসেছে তখন সবাই কোনো না কোনোভাবে এই বাড়ির আনন্দে নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে যুক্ত থাকতে চাইছে,
আমার ঘরের পোষা মোরগ দিইয়্যা সালুন রাধবা আজ জামিলা বু….
পাশের বাড়ি থেকে আবদার আসতে না আসতেই চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে এলো এক থামা সুগন্ধি আতপ,
এই দিনে নতুন চালের বিরন না করলি গ্রামের সম্মান থাকে না হাসিবুল চাচা।
সারা গ্রাম যে মানুষটির আগমনের অপেক্ষায় আয়োজনের সমাহার ঘটাচ্ছে সেই মানুষটির প্রস্তুতিও কিন্তু কম নয় এখানে ফিরে আসার।
যেদিন থেকে মানুষটি বুঝতে পেরেছে শত সহস্র ক্রোর দূরে তার আপন মানুষগুলোর বাস সেদিন থেকেই সে মনে মনে পণ করে ফেলেছিলো এই দূরত্ব মেটানোর। দূরত্ব সে তো পথের, মনের ব্যবধান তো কখনও তৈরীই হয়নি। তা না হলে বাড়ির কথা মনে আসতেই মানুষটি বাড়ি ফেরার জন্য এমন উতলা হয়ে উঠতো না।
তবে শুধু উতলা হলেই তো হয়না, এতদিন পর ফিরবে এজন্য নয় নয় করে প্রস্তুতিও তো কম নিতে হয় না। বাড়ি সে তো খুব ছোট শব্দ আসলে প্রাচীরবিহীন পুরো গ্রামটাই তার কাছে আপন। তাই কারোও জন্য মন্ডা মিঠাই তো কারো জন্য গাছের সফেদা, আবার কারো জন্য বিন্নি ধানের খৈ তো কারো জন্য হাঁড়িভরা পিঠে বানিয়ে ফেললো মানুষটি।
এখনও চোখ বন্ধ করলে গ্রামটি চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে তার। ওই তো বাড়ির আঙিনায় বর্ষার বিল, ওই তো পাকুর গাছের গোঁড়ায় বাঁধা বাপজানের নাও, ওই তো বিলের ডাঙায় কুমড়োর মাঁচা আর ওই তো শীতের শুকনো বিলের বুকে সর্ষের ক্ষেত।
শুধু কি বিল আর ক্ষেত, সেই যে পাশের বাড়ির খালা, গ্রামের সীমান্তে ঠাকুরবাড়ির কাকা সবাইকেই মনে রেখেছে সে। মানুষগুলোকে এতদিন পর দেখতে পাওয়ার আনন্দ যতটুকু তার থেকেও অনেকবেশী আনন্দ সেই মানুষগুলোর সাথে নিজেকে সত্যিকারভাবে ফিরে পাবার। নয়তো এতগুলো দিন জীবন এগোলেও তা ছিল আসলে নিতান্তই বেঁচে থাকা । যে বেঁচে থাকায় নিজেকে নিজের মতো পাওয়া যায় না, তাকে কি আসলে জীবন বলে?
না, এসব প্রশ্নে নষ্ট করার মতো সময় নেই মানুষটির হাতে। কাল ভোরেই রওনা করতে হবে। শেষবেলায় মানুষটি আরেকবার তালিকা ধরে ধরে মিলিয়ে নিতে বসলো সবার জন্য নেওয়া উপহারগুলো।
টিনের বাকশো ভরা কত জিনিষ। হাতে আসে আম্মার জন্য নেওয়া জরিপাড়ের নকশী শাড়ি, সুগন্ধি তেল, বাপজানের জন্য নতুন একটা জায়নামাজ আর আরব দেশের আতর। বাপজান মানেই তো চওড়া কাঁধের সমর্থ মানুষ। শখ করে প্রতি শুক্রবার যিনি কানের পেছনে আতর মেখে মসজিদে যান। আর আম্মাও বাপজানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুপুরের উনুন নিভিয়ে বিলের জলে চুল ভিজিয়ে জড়িপাড়ের নকশী শাড়ি পড়ে চিলমচি পাশে নিয়ে বসতেন। জুম্মা পড়ে বাপজান ফিরতেন বাড়িতে। শ্রাবণের বাতাসে বাপজানের আতরের সুবাস আর আম্মার সুগন্ধি তেলের ঘ্রাণ মিলেমিশে বিলের উপর ঘুরে বেড়াতো।
আহা, কতদিন পর আবার সেই সুবাসে ভাসবে মানুষটি।
সময়ের তো দায় একটাই, বিন্দু বিন্দু করে নির্দিষ্টের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
হ্যাঁ সেই দায় মেটাতেই সত্যি সত্যি দিনটি এসেই গেলো। যে দিনটি শত সহস্র ক্রোর দূরত্বকে মুছে দেবে নিমিষেই। যে দিনটি অপেক্ষার প্রলম্বিত সময়কে থামিয়ে দেবে হুট করেই।
আর হলোও তাই। কে বলে সময় মানুষকে দূরে নিয়ে যায়? যদি সত্যিই তাই হবে তাহলে আজ ফুলবানু বটতলার মোড়ে নামতেই নীপেন ঠাকুর চেঁচিয়ে উঠতো না,
ওই যে ওই আমাদের বেটি……..
আর ঋজু মোমিনূল চাচাও হৈ হৈ করে বলে উঠতো না,
নাইওর বেটিক নতুন ধান আর দূর্ব্বায় বরণ করতি হয়।
এই গ্রাম যেন তার অপেক্ষাতেই ছিল অনন্ত সময়।
বলতে গেলে গ্রামের সকলের ভিড়ে বটতলায় নিজের মেয়ের কাছে ভিরতেই পারলেন না হাসিবুল রহমান। এতে তার আক্ষেপ নেই মোটেও। সারা গ্রাম যে তাঁর আত্মজার জন্য এমন আকুল হয়ে ছিলো তা দেখে হাসিবুর রহমানের আনন্দে চোখ ভিজে আসে।
বটতলা পেরিয়ে বিলের ধার, এরপর শতবর্ষী কালীমন্দির ছাড়িয়ে ইটপাতা রাস্তা শেষ হলে বিরান ক্ষেত। সেই ক্ষেতের আইল ফুরালে ঢালু বেয়ে খানিক উপরে উঠলেই বাড়িটা।
ফুলবানু ঢালু বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে দেখতে পায় একচালা ঘরখানা। নতুন টিনেও ঘরখানা অনেকটাই জীর্ণ। মনে মনে হাসে ফুলবানু, এতদিন পর সব কি আর আগের মতো থাকে? এই যেমন বিলখানাও শুকিয়ে বাড়ি থেকে বেশ খানিক দূরে চলে গেছে। আসলে বিল আর ঘর নয়, ফুলবানু তো এসেছে মানুষগুলোর কাছে, ফিরে এসেছে আপন সবার কাছে।
তাই সময় ক্ষেপন নয় মোটেও, ফুলবানুর দু’চোখ অনবরত খুঁজে চলেছে আম্মা আর বাপজানকে।
বাড়ির বাইর আঙিনায় ভীড়ের স্রোত থামতেই জমিলা বিবি বেরিয়ে এলো। হাতে একঘটি জলের উপর সাতটি আমপাতা, আরেক হাতে কুলোয় ধান-দূর্বা। সাথে আকলিমা খালা। হাতের বাটিতে নতুন গুড়ের শিরনি,
মিঠা খাওয়া শুভ মানে আমগের গ্রামের লোক…..
হ্যাঁ শুভ তো শুধু এই সময় নয়, শুভ ফুলবানুর আগত সামনের সকল সময়। নিজেকে ফিরে পাবার মতো শুভ আর কি কিছু হতে পারে?
সেই যে সেই কবে ফুলবানু নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলো। সে বছর গ্রামে বাসন্তী অপেরা এসেছিলো।
সেবার গ্রামে অগ্রহায়ণের ধান উঠে গেলে যাত্রাপালার আয়োজন হয়েছিলো। সেখানে বাসন্তী অপেরার রহিম বাদশা আর রূপবান পালা দেখে বছর আটেকের ফুলবানু এতটাই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলো যে সন্ধ্যা রাণীকে সত্যি সত্যি রূপবান ভেবে বসেছিলো। শুধু ভাবলেও ঠিক ছিল, কিন্তু যখন সন্ধ্যা রাণীর পেছন পেছন চলা করলো বিপত্তি তখনই হলো। বিল পেরিয়ে গঞ্জের পথ ধরতেই বাসন্তি অপেরার সবাই যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো। কারণ সে বছর ওটাই ছিল বাসন্তী অপেরার শেষ বায়না।
তখনও ফুলবানু সন্ধ্যা রাণীর পিছু ছাড়েনি। সে অনুসরণ করেই চলেছে সন্ধ্যা রাণীকে। তারপর পদ্মা পেরিয়ে সন্ধ্যা রাণী পাবনার বাসে চড়ে বসলো। আর ঠিক তখনি ফুলবানুকে হাত ধরে কারা যেন অন্য বাসে তুলে নিলো। আর ফুলবানুও বুঝতে পারলো সে হারিয়ে গেছে। বাপজানের নাম ধরে চিৎকার করতেই যাবে তার আগেই কেউ একজন ফুলবানুর মুখ হাত দিয়ে বন্ধ করে দেয়।
এরপর তেমনকিছু মনে পড়ে না ফুলবানুর। শুধু কেমন একটা তন্দ্রা সময়ের মতো মনে পড়ে। অনেক খারাপ কিছু হতে পারতো ফুলবানুর সাথে। তবে সেই বাসে বয়স্ক এক লোকের চোখে অচেতন ফুটফুটে মেয়ে হিসেবে ফুলবানু পড়ে বলে রক্ষা। সেই বৃদ্ধ লোকমান আলি ফুলবানুকে নিজের নাতিন পরিচয়ে বড় করে। আর ফুলবানুর কাছে লোকমান আলি ওরফে দাদাজানই একমাত্র আপন মানুষ হয়ে ওঠে সেদিনের পর।
তা না হয়ে উপায়ও ছিল না, কারণ কারণ যে বা যারা অচেতন করেছিলো ফুলবানুকে তাদের মাত্রা অতিরিক্ত চেতনানাশক ব্যবহারের কারণে সব স্মৃতি হারিয়ে ফুলবানু তখন অন্য মানুষ। যার কাছে লোকমান আলি তার সত্যিকারের দাদাজান। লোকমান আলির বাড়িই তার বাড়ি। আর স্ত্রী-সন্তান হারা লোকমান আলির কাছেও ফুলবানুই তখন একমাত্র আপনজন।
হ্যাঁ, এই ফুলবানু নামটিও লোকমান আলির দেওয়া। ফুলবানুর আসল নামটি এই গল্পকথকের জানা নেই। আর নাম দিয়ে কীইবা হবে। গল্পটি তো মূলত মানুষের। হারিয়ে ফেলা আর ফিরে পাওয়া মানুষের গল্প।
যাইহোক, এতদিন পর সবাই যখন আপন মানুষকে ফিরে পেয়েছে তখন সময় তো যাবে চোখের পলকেই। হলোও তাই। নীপেন কাকার হাতে সফেদা না পড়তেই বিন্নি ধানের খৈ পড়লো কলাপাতায়। আবার মোমেনুল চাচা সিঁদুর রঙের আম ফুলবানুর হাতে ধরিয়ে দিতেই টিনের বাকশো থেকে বেরিয়ে এলো আরব দেশের আতর। এ যেন দেওয়া নেওয়া নয়, এসবের আড়ালে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা সেই হারিয়ে ফেলা সময়কে।
জমিলা বিবি নিজের হাতে মোরগের সালুন রাঁধেন, আতপের বিরন রাঁধেন……
এতদিন পর মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ গিয়ে মেশে রান্নার সুবাসে। নয় নয় করেও সারাগ্রামের প্রায় সব এসে জড়ো হয়েছে এ বাড়ির আঙিনায়। কতদিন পর এমন জৌলুস দেখছে বাড়িটি। যেন এত বছরের বাকী থাকা আনন্দ সব সুদে আসলে মেটাতে চাইছে এই সুন্দর মুহূর্ত।
ফুলবানু ভিড় বাঁচিয়ে একবার বাপজানের গা ঘেঁষে বসতে চায় তো আবার কখনো উনুনের পাড়ে আম্মার পাশে। তাদের অপলক দেখেও নয়নের আঁশ মেটে না ফুলবানুর। আর যতবার বাপজানের বৃদ্ধ হাত দু’টো ফুলবানুকে ছুঁয়ে দেয় কিংবা আম্মার আটপৌরে মুখে ভাঁজগুলো দেখে ততবারই মনে মনে দাদাজানকে স্মরণ করে সে। দাদাজানের জন্যই আজ ফুলবানু নিজের গ্রামে নিজের মানুষের কাছে ফিরতে পেরেছে।
ধুম জ্বরে সেদিন কী হয়েছিলো তা এখনও অস্পষ্ট ফুলবানুর কাছে। তবে জ্বরের ঘোরে সেদিন বারবার ‘বাপজান, বাপজান’ করে ডেকেছিলো ফুলবানু। আর সে ডাকেই অশীতিপর বৃদ্ধ লোকমান আলি বুঝেছিলো, ফুলবানুর ফেরার সময় হয়েছে। তাই নানাভাবে ফুলবানুর আগের জীবনের কথা মনে করানোর চেষ্টা করেছিলেন। ডাক্তার পথ্যি করে চেষ্টা করেছিলেন ফুলবানুকে তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে।
তবে যত ফুলবানু একটু একটু করে আগের স্মৃতি ফিরে পেয়েছে ততই বুঝতে পেরেছে লোকমান আলি পর হলেও তার জীবনের পয়গম্বর। আর সব হারানো লোকমান আলির জীবনের শেষ মানুষ এই ফুলবানুই। তাই দাদাজানকে ফুলবানু কথা দিয়ে এসেছে বাপজান আর আম্মাকে দেখেই ফিরে যাবে তাঁর কাছে।
এত অল্প সময়ে কী এতদিনের বাকী পোষানো যায়? বাড়ির মানুষ তো দূরহস্ত গ্রামের মানুষেরই তো মন ভরে না,
ও আম্মা, এতদিন পর বাড়ির পথ খেয়াল পড়িলো……
আকলিমা খালা গুড়ের শিরনি হাতে করে এসে দাঁড়িয়েছে। আর নীপেন ঠাকুর কলস ভরা দুধ এনে ফুলবানুর সামনে রাখে,
এই দুধের ক্ষীর হবি আইজ, তুমি শীতে জমা ক্ষীর কলাপাতায় করি খাবা…. এই দৃশ্য না দেখলি সারাজীবন পরান পুরবি মা।
ফুলবানুর চোখের কোনে জল জমে। আবছা চোখে দেখে বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। বাপজান পাশে এসে দাঁড়ায়। ফিসফিস করে বলে,
আইজ রাতে বিলের পাড়ে বসি কবিগান শোনাবো তোমাক, সাথে সারা গ্রাম থাকবি। তুমি থাকি যাও।
ঠিক ছোটোবেলার মতো কোনো বাঁধা না মেনে চোখের কোল বেয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে ফুলবানুর। ফিরে পাওয়া জীবন এত আনন্দের হয়, এত স্নেহের আধিপত্য হয়?
প্রশ্নগুলোর উত্তর তো এখন ফুলবানুর কাছে জলের মতো পরিস্কার।
তবে যত স্নেহই হোক আর উৎসব হোক, আজ ফিরে যেতেই হবে। নইলে দাদাজান অন্তরে না জানি কত কষ্ট পাবেন একা ঘরে থেকে।
তাই দুধের ক্ষীরও হলো আর আকলিমা খালার শিরনিও খাওয়া হলো বিকেলের আগেই। শহরের শেষ বাসটা ধরতে হলে ফুলবানুকে সন্ধ্যার আগেই বিল পেরোতে হবে। জামিলা বিবি নিজের হাতে বিরন খাওয়ান মেয়েকে। গাছের দু’টো পেয়ারা, এককাথি কলা, রূপার বাউটি জোড়া সব গুছিয়ে দেয় ফুলবানুর জন্য,
আমাগের কবরে ফাতিহা পড়ার জইন্যি তুমি ফিরে আসিছো আম্মা, পরানে আর কুনু দুঃখু নাই।এরপর বিলে পানি কমলি আইসো ছই পিঠা বানামু…….
মা-মেয়েকে বাড়ির কোনায় একসাথে দেখে হাসিবুল রহমানও এগিয়ে আসেন। হাতের মুঠোয় রাখা একটা মাদুলীতে দোয়া পড়ে ফুঁ দেন,
ধরো এইখান, আর কুনু আগাবিগা আইসবো না আম্মা…….
পাশের জমিতে সূর্য ডুবু ডুবু করছে। এই মানুষগুলো, এই গ্রাম ফুলবানুর ফিরে যাওয়া পায়ে বারবার স্নেহের বেড়ি পরাচ্ছে। তবুও সব আগল খুলে ফিরতে হবে দাদাজানের কাছে। ফিরতেই হবে।
সামনের অগ্রাহয়ণে আবার ফিরবে কথা দিয়ে ফুলবানু শেষ বাসে গিয়ে বসলো।
যে বাড়িতে আজ সারাদিন উৎসবের আমেজ ছিল, জমজমাট আনন্দ ছিল সেই বাড়িটি আবার একলা হয়ে উঠেছে। একলা সেই বাড়ির আঙিনায় এখনো বিরনের সুবাস, কলাপাতার টুকরো, সিন্দুরী আমের টুকরো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাারাদিনের কোলাহলের পর বাড়িটি এখন অদ্ভুত রকমের শান্ত।
শান্ত সে সময়ে নীরব জামিলা বিবি আর হাসিবুল রহমান মনে মনে ভাবছেন,
ক্ষুধার জ্বালায় আট বছরের মেয়েটাকে কেন বিক্রি করি দিছিলাম, না দিলি সেও এমুন করিই ফুলবানুর মতই নাইওরে আসিতো।
মানুষ দু’টোর ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে তালগাছের মাথায় হ্ঠাত ডেকে ওঠে হুতুম পেঁচা,
হুট…….হুট…….হুট
আর ওদিকে শেষ বাসে বসা মেয়েটি ভাবছে,
বাপজানের বামগালের জন্মদাগের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তুক আম্মার লক্ষ্মীট্যারা চোখদু’টোর দেখাও তো পাইলাম না কোথাও।