
১ পাথর ভাঙতে বসে শেষ হলো আমাদের প্রতিভা, সঞ্চয়, শক্তি। কখন যে ভোঁতা হয়ে গেছে ছেনি, বাটালি, হাতুড়ির ঘায়ে শব্দ ওঠে না মর্মর। নিজের মূর্তি ভেঙেছি। সহাস্য দিনগুলি টুকরো টুকরো করে ভেঙে এ কোন দুর্বিপাক রচনা করেছি আমি কোন প্রেত, নিজেরই অবিকল প্রেতমুখ, রিক্ত রাক্ষস এমনই ছিলাম আমি? কাশির দমকে ওঠা রক্ত? পাঁজড়ে যুদ্ধের পচা ঘ্রাণ? বাহুদুটো বেহালা বাদকের দীর্ঘ হাতের কঙ্কাল? নিজের ক্ষতকে আজ সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি । রমণীয় প্রেম উদাস ঈশ্বর আর পরমাণু চুল্লির মতোন সত্য এই পরাজয়। এই হতবম্ব বসে থাকা। এই দিন যায় রাত্রি যায় সময়ের পায়ে নাচে তারার ঘুঙুর যে খই বাতাস ওড়ায় তাকে উড়তে দাও হে মূর্খ পথচারী সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৩ এসো এই ভাঙা পাত্রে ওষ্ঠ রাখো, জিভে আর ঠোঁটে রক্তারক্তি করে ভালোবাসো। কী যে শৌখিনতায় ডুবে থাকো, ভালোই লাগে না। যে জেনেছে এই রিক্ততা, পাহাড়ী শূন্যতা, তার জ্ঞান তাকে একা করে ফেলে গেছে অজ্ঞান ট্রাফিকে। এই এত চাকার ঘুর্ণন, অনপেক্ষ প্রেম, অফিসবাড়ির সারা দেহে মার্কিনি স্থাপত্য --ভালো লাগছেনা কিছু। ধীরোদাত্ত স্বর হারিয়ে ফেলেছি। তুমিও গিয়েছ ভুলে ধীরে ধীরে কথা কওয়া, সমুদ্রের নির্বাক বালুতে তোমার নীরব পদচ্ছাপ গতকাল স্বপ্নে দেখেছি। দিন ছিলো প্রাচীন রেডিও। রাত্রি ছিলো বাতিল বেশ্যার কণ্ঠে বিদ্যাপতির প্রার্থনাপদ। দুপুরের গায়ে দুপুর গড়িয়ে পড়েছিল চৈতমাসের ঋজু নারকেল গাছ। গুঁড়িতে কান পাতলে তার বারিপতনের শব্দ শোনা যেত। আজ সারাদিন বৃষ্টি পড়ে থেমে থেমে। গণিকার অশ্রু যেন, যত দূর জীবনযন্ত্রণা, ঠিক তত দীর্ঘস্থায়ী নয়। আজ সারাদিন ভল্লুকের জ্বরে জানালার কপাটগুলিও উদাসীন হয়ে আছে। দূরে দেখা যায় জলস্রোতে কাগজের নৌকো ভেসে আসে দুটি, কোন শিশুদের দেশ থেকে। ওরা পিছুপিছু ভাসে, পাশাপাশি ভাসে, এ ওকে অতিক্রম করে যাবে দ্রুত এ ওকে ধাক্কা দেবে, ডুবে যাওয়ার আগে মরণোম্মুখ... জুলাই ২২, ২০২৩ শিশুটি খেলছে আর নৃত্যরত বালিকার প্রতি ছুঁড়ে দিচ্ছে প্রজাপতি, ফুল। এই দৃশ্যে আমি তন্ময়। আমি ধ্যানমগ্ন হয়ে আছি। আমি লিখতে ভুলে যাব। আমার চিন্তাসূত্র সমকালের থেকে ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজনীতি মণিপুর মালদহ রক্তখাকী দেবী তন্ত্রের উৎসব সব ছিন্ন হয়ে গেছে। আমি তিনদিন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছি। কী সরল নিষ্পাপ আর জড়বুদ্ধি হলে মানুষ ব্যালট গিলে ফেলে! আমি করুণায় বধির হয়ে থেকেছি তিনদিন। চিন্তা মানুষের শৌখিন অসুখ নাকি চিন্তা আমাকে পথের মিছিলে ঠেলে দেয় না আর। একদিন দিত। কত স্বার্থপর কূট হুজুগে আর অনুভূতিপ্রবণ মানুষের সাথে মিছিলে হেঁটেছি আমি আমি ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছি --এই শুয়ারের বাচ্চা আমি ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছি – নিপাত যাও আমি ক্রদ্ধ হয়ে বলেছি --এই নাও ঘৃণা তারপর একদিন বুঝেছি মানুষ ঘা খেয়ে সম্মিলিত হয় তারপর ক্ষত শুকিয়ে গেলে স্বার্থ নিয়ে ঢুকে পড়ে ছোটো ছোটো লোভনীয় রেস্তোরাঁয় রাত্রিমেঘ আজ চন্দ্রালোকে ধুয়ে যাচ্ছে একটি তারার পাশে আরেকটি তারকা তারা কথা হয় তারা যুগযুগান্ত ধরে কথা কবে -কেমন আছ? - যেমন রেখেছ তুমি। একটি তারার থেকে আরেকটি তারায় সংবাদ পৌঁছতে কোটি আলোকবর্ষ পার হয়ে যাবে। ততদিনে খসে যাবে ওপারের তারা মাঝের পথশ্রম আজ দীর্ঘ অপেক্ষার মতো ছেয়ে আছে আমার চিন্তাসূত্রে। আমি যেন অনেক দূরলোকে তুমি যেন অনেক দূরলোকে এপারের পৃথিবীতে বালকটি খেলছে, আর নৃত্যরত বালিকার প্রতি ছুঁড়ে দিচ্ছে প্রজাপতি, ফুল আগস্ট ২৬, ২০২৩ বানিয়ে যা লেখা হয়- তাই কবিতা। কারণ এই যে ঘৃণ্য জীবন, প্রবাসে পড়ে আছি ভাড়া করা বাসায়, ভাড়া করা পাইখানায় হাগছি, ভাড়া দিই বলে গাছে ফুল ফোটে, পাখি ডাকে, লিজ নেওয়া ছাতে উদিত হন সূর্যসবিতা - আমি তো এসব বানাই নি। একে বানিয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের প্রমোটার। আমি ফিতে হাতে বসে নাই। মৃত পশুর চুলে নির্মিত তুলি হাতে বসে আছি জীবন্ত রচয়িতা। এই যে বানিয়ে তুলেছি এই ভবজলধি, যা মূলত চৌবাচ্চা নামে অভিধানে লিখিত। ফুসকুরি নাকের উপর, আমি ঘৃণা করি। তার 'পরে এক ফোঁটা ঘাম। যেন টিলার উপর মেঘ। তাকে ইতস্তত সিগারেটের ধোঁয়ায় বিরক্ত করতেই নাকের সরণী বেয়ে সে নেমে এলো উপরের ঠোঁটে। চেটে খেয়ে নেওয়া গেল বিনিপয়সার এই লেমোনেড সোডা। আকাশে চন্দ্ৰমা নেই তাই চকোরি আজ নিজেরই শ্রান্তি নিজে পান করে আর উল্লসিত হয়। পান করে, উল্লসিত হয়। কেননা ব্যর্থতা পুজোর নতুন জামা, ফিরে ফিরে আসে। কেন না মুক্ত চন্দ্ৰমা আজ সরকারি চাঁদ হলো – এই কৌতুকে হেসে ওঠে কবি। রঙিন বিছানা ভালো লাগে। তোমার হলুদ পিঠে শ্বেত জোছনা নিজেকে বিলিয়ে দেয়। ওই গৌর তরঙ্গমালা আমার কবিতাকল্পনালতা। তাকে বানিয়ে তুলেছি মিথ্যা কথা আর মিথ্যা আশাবাদে এই সাদা বিছানার হাসপাতাল কে চায়! ব্যর্থ মিলনের শ্রান্তি ভালো লাগে ঢের। শ্রান্তি যত ভারী হবে, ঘুম তত গভীর হবে। জানি । ২৪-০৬-২০২২, মাঝরাত দেবতার স্মিতহাস্য আজ পাইন বনে কুয়াশা হয়ে নামে। আমি আসবো বলে অ্যাতো আয়োজন? আমি পথশ্রমে শ্রান্ত হইনা জেনে নীল পাখি মেঘে ঝেরে নেয় ডানা। রাত্রিজাগা ঘোর আজ সমস্ত নাস্তিক্যকে অবিশ্বাস করছে, তিস্তার পাথুরে ঘাটে ঘাটে আজ পুনর্জীবিত হচ্ছে সেই ছেলেবেলায় প্রথম দেখা, লুকিয়ে দেখা বড়োদের প্রেমের সিনেমা। আরও একবার পেয়ালা ভরে দাও হে নেপালী কিশোর। আরও একবার আমাকে বিশ্বাস করতে দাও আমাদের ফিরে যাবার রেলগাড়ি বাতিল হয়েছে। আরও একবার এই গুঁড়ো গুঁড়ো বাসমতি চালের ভাত তার ঘ্রাণে, রৌদ্রে, আমাদের সভ্যতাকে পবিত্র করুক। সাম্রাজ্যবাদ আমাকে পুনরায় খুন করবে কাল সুপ্রভাতে। পাহাড়ী বৃষ্টিতে আজ ভিজে আছি। সমস্ত পাপ খাদ গড়িয়ে নেমে যায় ঢাল বরাবর আরও গভীর কোনো নরকের দিকে। বিস্তৃত পাহাড়দুটি পড়ে আছে আমারই দুই শোকার্ত ফুসফুস। তার বুক চিরে চলে গেছে মানুষের প্রকৃতিপ্রেম, ট্যুরিজম্, খনিজ ও মালগাড়ির ইতিহাস। ২০-০৬-২০২২, রাত্রি তোমার বাহুজোড়া ত্রাণ, আমাকে কি ডাক দেবে সংসার-আশ্রমে? দিন জুড়ে বেহিসাবি পথশ্রম রাত্রি নামছে ধূর্ত দালাল। আমাদের ঘুম নেই, চন্দ্রালোক মাঠে মারা গেল, ব্যর্থ হলো মৌতাত। কেউ নেই যে এই দানবলোক থেকে পথ করে দেবে ওই দৈববাগানের। চালধোয়া জল ঘোলা তারচেয়ে ঢের বেশি ঘোলা হল রাত্রি, হাসপাতাল, চিকিৎসা লাভের ভ্রম। রাত্রির পথে পথে আমি আজ হেঁটে চলেছি কামেশ্বরতলা, আমাদের প্রাচীন গৌরীপুর। যেহেতু আমাদের শহরের ডাকঘরগুলো মৃত, যেহেতু তোমাদের ত্রাণশিবির ঘিরে রয়েছে বড়লোক নাৎসী সৈন্যরা যেহেতু তোমার কপালের ওই মঙ্গলগ্রহ- টিপ পুনরায় তোমাকে পরিয়ে দিতে হাত কেঁপে যেতে পারে। ছাল ওঠা কুকুরটি আজ সঙ্গী হয়েছে। ওকেই 'দেশি' 'দেশি' বলে আলিঙ্গন করি, চুমু খাই। বাংলাদেশেরহৃদয়হতে বেরিয়ে এসে এই সারমেয় আজ দেশজ কবির রাত্রিসহচর। এই প্রলাপ, ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য, বালখিল্য দৃশ্য দেখে ফেলে - মুর্ছা গেল লাইনের বেশ্যা, প্রহরার পুলিশ, জানালায় খিল আঁটা নাৎসী মধ্যবিত্ত। আর তোমাকেই মনে পড়ে ত্রাহিরবে চিৎকার করে অন্ধ কুকুর, অন্ধ বাতাস, অন্ধ পথশ্রম ২৮-০৫-২০২২ তার দিকে চেয়ে থাকি বলে নীরব দেবতারা আজ আমাকে মূর্খ পরিহাস করে। নির্জনতার অছিলায় যাই আরও দীর্ঘদিন জ্বর নিয়ে পড়ে থাকি শুভ্র বিছানায়। শুভ্র বিছানা আছে নাকি এই ঘরে? হাসপাতালে দেখেছি। ছয়দিন সান্নিপাতিক জ্বরে আমি দেখেছি ভারতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আজকাল নীল চাদর পেতে শুই। তাকে নীল নীচোল ভেবে আমি বহুদীর্ঘ মান থেকে অভিসারে হুলুস্থুলু করি। আমার কান্নায় বাড়ে মানিপ্ল্যান্ট, বিদেশি কচুর সম্মোহন। দেবতা এসব জানে মধ্যবিত্তি রোগ। তার প্রবল কাজ সারাদিন, দিনমান, ওই সুদূরের পথে, মহাকাশে। আমি বাক্যরচনা ছেড়ে নীরব নক্ষত্রসন্ধানী হব, তার কবেকার সাধ তবু তোমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে আমি শাপগ্রস্থ ভূপর্যটক। জরিপের যন্ত্রপাতি নিয়ে বসেছি এই রাত্রিপুকুরের পাশে। আকাশে গোলাপী চাঁদ সূর্যের গোলামী করে, আমি দেখেও দেখছি না। দেবতার অবাধ্যতা, আমার কয়েকটি সন্ধ্যার প্রেম। ১৪-০৫-২০২২, বিকাল নুর তুমি অবিশ্রাম ফোনে কথা বলছ কেন? এই জলপারে বসে নিজের বৈদগ্ধ্যকে বিশ্বাস হয়। দ্যাখো, আজ মুনির স্বভাবে স্তব্ধ হয়ে আছি। ভিতরে ভিতরে শুধু আলোকিতা হাওয়া। তার পথধ্বনি কোন পাড়া থেকে কোন পাড়া মিলিয়ে যাচ্ছে তার হদিশ নিই না আর। অথচ আমার শিকড় ছিলো। হাওয়ায় ছিলো শ্যামকল্যাণ দুলে ওঠা। বুদ্ধগয়ায় হেঁটেছি আমি। সেদিনও আমি ছিলাম ডোমজুড় কাকদ্বীপ কামদুনি বগটুই। এত দীর্ঘ অবিশ্বাসে পায়ের শিরারা সব ফুলে উঠে হরতাল করেছে। মানুষ মানুষকে খাবে, ছিঁড়ে খাবে সুস্বাদু রেস্তরাঁয়, এই তার অনন্ত নিয়তি। তবু এই জলের পাশে বসলে নুর, এক আলোকিতা হাওয়া, তার চিকুর আমারই হাতে কাদাছেনে গড়া। আমি তার কিছুই সমাদর করিনি। তুমি শ্যাম্পু করে দিয়েছিলে আমার অবৈতনিক চুলে, হোটেলের পবিত্র বাথরুমে। সেই স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে এই জারুলের বেগুনি শ্বাস, জলের কেঁপে ওঠা বুক। চুপ কর বাঞ্চোৎ নুর। এখন এই স্মৃতির এগজিবিশনে এত হল্লা করে না।

তথাগত
জন্ম: ১৯৯২।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : বাজিল রাক্ষসবাদ্য’ (সপ্তর্ষি, ২০১৭), ‘চৈত্রে, গৌরীপুর’ (বিদুর, ২০১৯), সুরুল কুঠির গান (বিদুর, ২০২২)।
Facebook Comments Box