দুর্গা পূজা বলতেই আমাদের মনে একটা বিবাহিতা নারীর কথা মনে আসতো। যেন বা ঘরের মেয়ে। টানা টানা বড় বড় চোখ। সিঁদুর রাঙা কপাল। আলতা পেড়ে শাড়ি। আলতা রাঙা পা।
ফি বছর একবারই বাপের ঘরে আসে সে। নিজের বেশ কয়েকটা ছানাপোনা নিয়ে। কত পথ পেরিয়ে, কত জায়গাতে থেকে থেকে। মহা পঞ্চমীর দিন এতখানি পথ অতিক্রম করে বাপের বাড়ি পৌঁছোতে না পেরে কুমোরের মাটি নেওয়ার গর্তেই থেকে যেতে হয়। কাটাতে হয় রাত। মহা ষষ্ঠীর দিন রাতে থেকে যেতে হয় ন্যাড়া বেল তলায়। তারপর মহা সপ্তমীর দিন এসে পৌঁছায় বাপের বাড়ি। ততক্ষণে বাপের বাড়ির প্রতিটা দুয়ার সেজে ওঠে গেরু পাথর (লৌহ আকরিক যুক্ত পাথর) ঘষা গেরোয়া রঙে। ঘরের মেয়েকে স্বাগত জানানোর এই এক সহজ উপায় তার বাপের বাড়ির লোকের, বাংলার বাঙালির। মানভূমবাসীর। আমাদের।
সপ্তমীর সকাল। মা আদেশ দিতেন,”গেরু পাথরটা খুঁজে নিয়ে ঘষবি যা। দুয়ারে রঙ দিবি। আজ ঠাকুরাইন ঢুকবে।”
আমি আর দিদি আমাদের খড়ের ঘরের চালার মাটির পাঁচিলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করতাম গেরু পাথর। শিলে হালকা জল দিয়ে তাকে ঘষে ঘষে রঙ তৈরি করতাম। তারপর সামান্য নেকড়ার থুপি তৈরি করে প্রতিটা দুয়ারে সুন্দর করে দিয়ে দিতাম।
আমি তখন ছোট। আমাদের পরিবারে বাবা-মা এবং আমরা পাঁচ ভাই বোন। রোজগার বলতে সামান্য চাষবাস থেকে উঠে আসা ফসল এবং বাবার রাজমিস্ত্রির কাজ থেকে আসা নগদ কিছু উপার্জন। সেই উপার্জনের উপর নির্ভর করেই এগিয়ে যাওয়া আমাদের। খাওয়া-দাওয়া, কাপড়কানি, কুটুম-কুটমালি, পড়াশোনার খরচ এবং পরব-তিহার। ফলে খুব একটা কেনাকাটার দিকে মন থাকতো না তখন। বলতে গেলে, দুর্গা পূজাতে নতুন জামাকাপড় কিনতেই হবে তেমনটা ছিল না। তবে দশমীর দিন গুড়পিঠে বানানো হবে এটা ছিল নিশ্চিত। সেদিন ছোট উরমার মেলা দেখে আসার পর সে এক আলাদা আনন্দ।
তখন শহুরে পূজার দিকে খুব একটা আকর্ষণ ছিল না। এখনকার মতো ঢাউস ঢাউস পেন্ডেল, চারপাশকে চিত্রায়িত করে তোলা বা রঙ বেরঙের আলোর খেলাও ছিল না শহরে। ফলে গ্ৰামের দিকের মেলাগুলোর প্রতি আলাদা একটা টান থাকতো সকলের। বহুদিন দেখা সাক্ষাৎ না হওয়া কুটুম আত্মীয় বা বন্ধু বান্ধবদের সাথে প্রায় ক্ষেত্রেই সাক্ষাৎ কথা হতো এই মেলার মাঠেই। হতো সুখ দুঃখের আদান প্রদান।
বাচ্চাদের পকেটে খুব একটা টাকা থাকতো না। বলা ভালো পরিবারের প্রধানের হাতেই ছিল না আর্থিক সচ্ছলতা। কোনমতে কয়েক টাকা পেয়ে গেলে সে ছিল ভাগ্যের ব্যাপার।
ওই টাকাতে একটাই হতো। খাওয়া, না হয় খেলনা কেনা। আমরা খাওয়াটা বাদ দিয়ে খেলনা কিনতাম। দীর্ঘদিন ধরে মনে পূষে আশা বাসনাটা পূর্ণ হতো আমাদের। তবে ফিরে আসতে হতো খালি মুখেই। তখনকার বেশিরভাগ ছেলে মেয়ের ক্ষেত্রেই তাই হতো। কারণ অর্থনৈতিক সচ্ছলতা প্রায় কারোরই ছিল না।
নবমীর দিন কাড়া কাটার মেলা (মহিষ বলি দেওয়ার)। সেদিন মেলা দেখতে গেলে পরের দিন হবে না। তাই দশমীর ভাসান টাঁড়ের মেলা দেখতেই গিয়ে থাকতো সবাই। সেদিন গিজগিজ করতো লোকে। ৩২ নং জাতীয় সড়ক থেকে শুরু করে রেল লাইন, সেখান থেকে ভাসান টাঁড়। প্রায় দেড় কিলোমিটার জায়গাতে তিল ধারণের জায়গা থাকতো না সেদিন।
কোথাও জিলিপি, চপ, সিঙ্গাড়া প্রভৃতি খাওয়ার জিনিসের দোকান তো কোথাও মনোহারি দোকান। কোথাও আবার তাজা তাজা আঁখ। আর বাঁশি ওয়ালা বেলুন ওয়ালাদের কথা বলে কে? মেলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত সুর করে করে ঘুরে বেড়াতো তারা।
তখনকার দিনে লোকসাহিত্য টুসু, অহিরা, ঝুমুর, বিহার গীত, করম গীত প্রভৃতি গানের বই প্রকাশের একটা কেন্দ্রস্থল ছিল এই গ্ৰাম্য মেলাগুলো।
গীতিকাররা নিজের লেখা গানের বই ছাপিয়ে নিয়ে এসে সুর করে করে গাইতো মেলার মাঠে। আর সারা বছর ধরে মুখিয়ে থাকা লোকসাহিত্য প্রেমীরা কিনে নিয়ে যেত গীতিকারের কাছ থেকেই। হতো আলাপ পরিচয়।
বেলা তখন অস্তগামী। অযোধ্যা পাহাড়ের গায়ে আড়াল হওয়ার অপেক্ষা। ঝিঙেফুলে রোদ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। মেয়েদের গায়ের রঙ ও মুখকে করে তুলছে সুন্দর থেকে সুন্দরতর। সেই মুহূর্তে মন্দির থেকে বের করা হয় দুর্গা প্রতিমা। গরুর গাড়িতে চাপিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মেলার দিকে। মানুষে টেনে টেনে। সঙ্গে কাতারে কাতারে দর্শকের ভিড়। কেউ প্রতিমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছে, কেউ সেখান থেকে সিঁদুর নিয়ে তিলক আঁকছে। কেউ আবার নিজের কেনা সিঁদুর কৌটোর সামান্য নিবেদন করছে মাকে। উদ্যেশ্য, মায়ের মতো সদা সুহাগন থাকা।
এক সময় রেল লাইনের কাছে গিয়ে পৌঁছায় মূর্তি। তারপর দুই দিকের রেল স্টেশন বরাভূম এবং কাঁটাডির স্টেশন মাস্টারকে রেলগাড়ি বন্ধ করার জন্য ফোন করিয়ে নেওয়া হয় উরমা স্টেশনের স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে। গাড়ি না আসা নিশ্চিত করে রেল লাইন পের করানো মূর্তিকে। আর আমাদের পালা দশ হাত নিয়ে আকাশ বিদির্ণ করে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তির উদ্যেশ্যে দূর্বাঘাস ছুঁড়ে দেওয়া আর প্রণাম করা। তারপর পাঁচ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হাঁটতে ঘরে ফেরা।
এই দিনের আরও এক বিশেষত্ব ছিল, সন্ধ্যার সময় বিজয়া প্রণাম। পাড়া প্রতিবেশীর বড়দের বা বয়োজ্যেষ্ঠদের চরণ স্পর্শ করে আশীর্বাদ নেওয়া। এখন এই রেওয়াজ ধীরে ধীরে তলানির দিকে। অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নত হওয়ার সাথে সাথে মানুষের সাথে মানুষের নির্ভরশীলতা কমে আসায় সামাজিক বন্ধন নেই বললেই চলে। এখন কেউ কাউকে তোয়াক্কা করে না। কেউ কাউকে সম্মান করে না সেভাবে। সবাই নিজের নিজের অহংকার নিয়ে বাঁচে। সবাই নিজের নিজের আমিত্ব নিয়ে বাঁচে। কেউ কারোর কাছে মাথা নোয়াতে চায় না।
অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নত হওয়ার সাথে সাথে গ্ৰামাঞ্চলের মেলার যে গরিমা তা কমে আসে। অন্যদিকে শহরাঞ্চলের দেখানেপোনা উৎসবের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়। শুরু হয় পূজাকে ঘিরে প্রতিযোগিতা। কার কত বড় পেন্ডেল, কার কত সুসজ্জিত পেন্ডেল, কার কত জৌলুস পূর্ণ প্রতিমা ইত্যাদি। আর এসব করতে গিয়ে পূজাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় চাঁদা তোলার জোর জুলুমও। তবে আসল কথা, এসব করতে গিয়ে পূজার প্রতি যে আন্তরিকতা তা বিনষ্ট হতে হতে বর্তমানে শেষ পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।
শুধু যে বড়দের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে তাই নয়, বাচ্চারাও আগের সেই বাচ্চাদের মতো নেই। সীমায়িত এবং নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত বাচ্চারা আগের দিনের বাচ্চাদের থেকে অনেক বেশি হিসেব বুঝে চলে।
সাধারণ মানুষের এই মানসিকতার পরিবর্তনের বর্তমান পর্যায়ে এসে দুর্গাকে নিজেদের দেবী বলতেও অ স্বীকার করছে অনেকেই। বিশেষ করে আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষেরা দেবী দুর্গাকে উচ্চবর্ণের (আর্যদের) একজন প্রতিনিধি হিসেবেই দেখতে শুরু করেছে। তার জন্য বিভিন্ন ধর্ম গ্ৰন্থের চুল চেরা বিশ্লেষণ যথোপযুক্ত যুক্তিও খাড়া করছে তারা। আর একইভাবে যুক্তি দেখিয়ে মহিষাসুরকে নিজেদের বংশধর হিসেবে দেখাচ্ছে। ফলে এই দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে সমাজে স্পষ্টভাবেই দুটি দলের সৃষ্টি হয়েছে। নষ্ট হয়েছে সৌভাতৃত্বের। ফলে দুর্গাপূজা আসার আগে আগমনীর যে সুর বেজে উঠতো ঘরে ঘরে এখন আর সেই সুর অনেক ঘরেই সেভাবে পৌঁছায় না। ধর্মীয়, আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক পরিবারেই দুর্গা আর সেই পরিবারের মেয়ে হিসেবে ধরা দিতে পারছে না ইদানিং কালে।