=========================================================
=========================================================
এক
“ Education is the vaccine of violence” —–Edward James Olmos
যে কোনও জাতির মেরুদণ্ড গঠনের প্রধান উপকরণ হলো শিক্ষা। এটা কোনও নতুন কথা নয়।এও নতুন নয় যে যে জাতির শিক্ষার হার যতো বেশী সেই জাতি ততো উন্নত। সেই জাতিতে হিংসা ও রক্তক্ষয়ের প্রবণতা ততো কম। আমাদের দেশে বর্তমান সময়ে সরকারের সহযোগিতা ও প্ররোচনায় শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দশম ও একাদশ শ্রেণীর সিলেবাস থেকে ছাত্রদের পঠন পাঠনের সুবিধার অজুহাতে বাদ দেওয়া হয়েছে ভারতের ইতিহাসের মোগল আমল , বাদ পড়েছে চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের থিওরি এমনকি মেণ্ডেলিফের পিরিওডিক টেবলও ।আরও অনেক বিষয় যা এই সুমহান গণতন্ত্রের গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়াতে সহায়ক বাদ পড়েছে সে সব বিষয়ও ।অবশ্য ছাত্রদের সুবিধার অজুহাতেই । কিন্তু কেন ? কেন বেছে বেছে এই সব বিষয়ই সরিয়ে দেওয়া হলো ? তা কি কেবলই Random selection ? না , এই সিলেবাস পরিবর্তনের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য সরকারের ? তা বুঝতে গেলে অনেকটা পেছনে তাকাতে হবে ।
দুই
সরকারের এই সিদ্ধান্তে স্বাভাবিক ভাবেই গেল গেল রব উঠেছে শিক্ষামহলে। প্রতিবাদে মিছিলও করেছেন বামপন্থী ও প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ মানুষজন । তাতে যে সরকার নিরুৎসাহ হয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে, তেমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এই বিষয়ে বিশদ আলোচনার আগে বিগত প্রায় একশো বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে হবে।
বর্তমানে ভারতের মসনদে যে দক্ষিণপন্থী দলটি আসীন তার রাজনৈতিক ইতিহাস তেমন প্রাচীন না হলেও অন্য নামে তার উপস্থিতি কিন্তু স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই। হিন্দুমহাসভা নামে জন্ম নিয়ে জনসঙ্ঘ হয়ে তার এই বর্তমান রূপ । চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং সংখ্যালঘু ও দলিত বিরোধী এই দলের বিষয়ে যদি উইকিতে সার্চ করেন তবে তার সাম্প্রদায়িক চেহারার কিছুমাত্র চিহ্ন পাবেন না। এই দলটার উত্থান নব্বইয়ের দশকে রামরথ যাত্রা ও অযোধ্যায় রামজন্মভুমি ও রামমন্দির প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দিয়ে। এই আন্দোলনের চরম পরিণতিতে পরবর্তীতে যখন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয় , তখন এই দলের নেতারা তাদের দায়ভার ধুয়ে ফেলেন এবং সাফাই দেন , তাদের সর্বাত্মক ও ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও তারা উন্মত্ত জনতার হাত থেকে মসজিদ রক্ষা করতে পারেননি ।পরবর্তী সময়ে শাসনক্ষমতায় এসে ২০০২ এ গুজরাত গণহত্যার সময় ( প্রায় আড়াই হাজার সংখ্যালঘুকে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়, তাঁদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তিনদিন ধরে এই নারকীয় বর্বরতা চলে) তাদের মুখে প্রায় একইরকম বক্তব্য শোনা যায়। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে এই দল ক্ষমতাচ্যুত হয়। আবার প্রত্যাবর্তন ঘটে ২০১৪ সালে। এবং সেই থেকে টানা নয় বছর এরা শাসন ক্ষমতায় । এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মতো এক নতুন ভারত এরা নির্মাণ করতে পেরেছে। যে ভারতে হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উধাও। যে ভারত অসহিষ্ণু যে ভারতে সংখ্যালঘুরা আর নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারছে না। যে ভারতে সংবাদপত্র থেকে বিচারব্যবস্থা সব কিছু প্রায় শাসকের আওতায়। যে ভারতে প্রতিবাদের শাস্তি বিনা বিচারে জেল হাজত। যে ভারতে সংখ্যালঘুর ঘরবাড়ী যখন তখন বুলডোজারে গুঁড়িয়ে ফেলা যায় । যে ভারতে মিছিল বের হয় ধর্ষিতা নয় , ধর্ষকের সমর্থনে । যে ভারতে নীচুজাত বলে দলিত হত্যা নিত্তনৈমিত্তিক বিষয় ।
এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এই সব ঘটনার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সম্পর্ক কি ?কেউ এ প্রশ্নও করতে পারেন , সরকার কেন মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে না ? এই সরকারের দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য কি ?সে প্রসঙ্গে ঢুকছি এবার ।
তিন
উনবিংশ শতকের গোড়ায় অবিভক্ত ভারতের ঢাকায় মুসলীম লীগ( ১৯০৬) প্রতিষ্ঠার মাত্র নয় বছর পরে ১৯১৫ সালে মুসলীম লীগের কাউন্টার হিসেবে জন্ম নেয় হিন্দু মহাসভা । তার আগে অবধি ভারতের একমাত্র স্বীকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে ছিল কংগ্রেস । উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য এই দলের তেমন তৎপরতা ছিল না । তারা চাইছিল স্বায়ত্তশাসন । মহাত্মা গান্ধী তখনও দক্ষিন আফ্রিকা থেকে আসেননি। মুসলীম লীগ ও হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠার পরে ভারতের রাজনৈতিক আকাশে কংগ্রেসের প্রতিস্পর্ধী দুটো দল তৈরী হলো। মুসলীম লীগ এক বিরাট সংখ্যক মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠল যেহেতু মুসলমানরা কংগ্রেসকে মূলত হিন্দুদের দল বলে মনে করত। সেই তুলনায় হিন্দু মহাসভা হিন্দুদের মনে তেমন দাগ কাটতে পারেনি যেহেতু তাদের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশই হয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিল অথবা কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। স্বাধীনতা নিয়ে হিন্দু মহাসভার তেমন মাথাব্যাথা ছিল না। পরবর্তী সময়ে তাদের এই মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়েছে।
ধান ভানতে শিবের গীত অনেক গাওয়া হলো । এবার মূল বিষয়ে আসি। কথা হচ্ছিল বর্তমান ভারতের শিক্ষানীতি নিয়ে। ১৯২৫ সালে ডঃ কে বি হেডওয়ারের নেতৃত্বে নাগপুরে জন্ম নেয় একটি হিন্দুত্ববাদী অরাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন “ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ “। যাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন ইংরেজ উপনিবেশিক শাসনের ও মুসলমান জাতীয়তাবাদের বিরোধীতা । ক্রমে ইংরেজ বিরোধীতার রাস্তা থেকে সরে এসে মুসলমান বিরোধীতাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ।তাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে ভারতকে এক হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে এই সংগঠন গোটা ভারতে তাদের বিভিন্ন শাখা বিস্তার করে । এমনকি দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তেও এই সংগঠন পৌঁছে যায় । ততোদিনে গান্ধীহত্যা হয়ে গিয়েছে ও এই সংগঠনের প্রত্যক্ষ যোগসাজসের প্রমাণ থাকার ফলে এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জরুরী অবস্থা ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেও এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যাইহোক , পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এই সংগঠন নিজেদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য ভারতের প্রায় সর্বত্র অসংখ্য স্কুল, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে এদের পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা সারা ভারতে প্রায় বারোহাজার। এছাড়াও এদের স্বেচ্ছাসেবকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ করে থাকে। বর্তমান ভারতে এরা একলক্ষেরও বেশী কৃষি, স্বাস্থ্য্ গ্রামীণ ও আদিবাসী উন্নয়ন , দুঃস্থ ও গরীব বাচ্চাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি কাজে যুক্ত ।
চার
এই সংগঠন (রা.স.স) গঠনের উদ্দেশ্য , কার্যপদ্ধতি ও মতাদর্শ নিয়ে কথা হলো এতোক্ষন । শিক্ষাক্ষেত্রে এই সংগঠনের লক্ষ্য কি ? শিক্ষা যে সমাজগঠন ও সেই গঠিত সমাজের পরিমণ্ডলে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সহায়ক তা এরা অনেক আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিল। এবং তা কার্যকর করার কাজে নেমেও পড়েছিল । তবে এই শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তচিন্তার কোনও পরিসর স্বভাবতই এরা রাখেনি, নিজেদের এজেণ্ডা চরিতার্থ করার জন্য। হিন্দুদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী শ্রেণী তৈরি করাই এই শিক্ষার উদ্দেশ্য । এবং ভবিষ্যৎ লক্ষ্য এই শ্রেণীকে ব্যবহার করে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা । বর্তমান ভারতের চালচিত্র দেখে বোঝা যায় এদের এই উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল । ঠিক যেরকম অনেক ইসলামিক দেশে আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি।
এই শিক্ষা প্রসারের জন্য সঙ্ঘ অনেক অনুসারী সংস্থা তৈরী করেছে ভারত জুড়ে ।যেমন “ বিদ্যাভারতী” । এরা সারা ভারতবর্ষে সর্বাধিক বেসরকারী স্কুল পরিচালনা করে । এই সংস্থার হেডঅফিস লখনৌতে । মূলত নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের পড়ুয়ারাই এদের টার্গেট । এছাড়া “ বনবাসী কল্যাণ ভারতী “ (যারা আদিবাসী বাচ্চাদের শিক্ষাদানের কাজ করে) “সেবা ভারতী”( দলিত শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা প্রসারের কাজ করে) এবং “ একল বিদ্যালয়” (মাত্র একজন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত) যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রি স্কুল বাচ্ছাদের শিক্ষাদানের কাজ করে। অর্থাৎ মগজ ধোলাইয়ের কাজ শিশু বয়স থেকেই শুরু হয়ে যায় ।
অতীতের গৌরবময় ইতিহাস ও আদর্শকে এই সময়ে পুনঃস্থাপিত করা এবং বর্তমান কালের ঘটনাবলীকে অতীতের আলোকে দেখা ও ব্যাখ্যা করা সঙ্ঘের এজেণ্ডায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । তারা এক নতুন হিন্দু ভারত স্থাপন করতে চায়, এবং সেজন্য হিন্দুদের সংগঠিত করার জন্য পরিকল্পিত শিক্ষানীতি ও অনুশাসনের উপর তারা মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এমনকি তাদের পরিচালিত শিক্ষায়তনের শিক্ষাদানের দায়িত্বে
যারা শিক্ষক তাঁদেরও কঠোরভাবে সঙ্ঘের ভাবাদর্শ ও অনুশাসন মেনে কাজ করা বাধ্যতামূলক । এমন কেউ শিক্ষক হিসেবে গ্রহনযোগ্য নন , যিনি বা যাঁরা সঙ্ঘ অনুগামী নন প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে ।আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এইসব স্কুলে পঠন পাঠনের সঙ্গে extra curriculam activityর ওপর বেশী জোর দেওয়া হয়। শারীরিক কসরত, লাঠিখেলা , ছোরাখেলা ইত্যাদি শেখানো হয় সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলে। কারণ ? কারণ একটাই , এক মতাদর্শ প্রাণিত সুশৃঙ্খল এক বাহিনী তৈরী করা, যাদের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর মতো ব্যবহার করা যাবে। সঙ্ঘ মনে করে সমস্ত ভারতবাসীর সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন।
এটা ঘটনা যে সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলের পঠন পাঠনের মান সরকারী বিদ্যালয়ের চেয়ে বেশ ভালো । ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারী স্কুলের অপ্রতুলতা এবং দুর্বল পরিকাঠামোর কারণে নিন্মবিত্ত ও নিন্মমধ্যবিত্ত শ্রেনীর অভিভাবকদের মধ্যে মিশনারি স্কুলের পাশাপাশি সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি করার প্রবণতা বাড়ছে । আর্থিক কারণে যেসব বাচ্চারা মিশনারি স্কুলে পড়তে পারছে না, তারা ভর্তি হচ্ছে সঙ্ঘ পরিচালিত এইসব স্কুলে ।
পাঁচ
এখন কথা হলো ,সঙ্ঘ পরিচালিত এই স্কুলগুলোতে শিশুদের কি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয় ? পঠন পাঠন ছাড়াও এই সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থায় ( যদিও এই বেসরকারী স্কুলগুলো NCERT র অন্তর্ভুক্ত ও অনুমোদিত ) শিশুদের শৃঙ্খলা , নিয়মানুবর্তীতা এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অবহিত করা হয় । প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও গৌরবের এক আবহ তৈরী করা হয় শিশুদের মননে। এই ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়া হয় সর্বাধিক । ইতিহাসে হিন্দু রাজাদের যেসব কীর্তি ও গৌরবময় আখ্যান আছে, পড়ুয়াদের কাছে সেসব ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলে ধরা হয়। অপরপক্ষে অহিন্দুদের যে সমস্ত কীর্তি ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে, সে সব ঘটনার পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্তি তাদের নাপসন্দ । কারণ তা তাদের একজাতি একদেশ তত্বকে কার্যকর করার পরিপন্থী ।ফলে ছাত্রদের কাছে সংখ্যালঘুদের মূলত উপস্থাপন করা হয় এই দেশের লুটেরা ও আক্রমণকারী হিসেবেই।
ফ্যাসিবাদী শিক্ষানীতির মূল ভিত্তি দুটো । এক, নিজেদের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এক বৃহত্তর পরিসরে ( যা অনেকাংশেই কাল্পনিক) শিক্ষার্থীদের কাছে প্রকাশ করা ও দ্বিতীয়ত সংখ্যালঘু ও অন্যান্য জনজাতির সমাজে যাবতীয় conttibution কে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা , অথবা নগণ্য ও মিথ্যাচার হিসেবে দেখানো । সত্যকে অর্ধসত্য অথবা বিকৃত ভাবে পেশ করা। যার ফলে শিক্ষার্থীদের মনে ঘৃণা জন্ম নিতে পারে। NCERT র পাঠক্রম থেকে মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বাদ দেওয়াকে এই আলোকেই ব্যাখ্যা করতে হবে।
আর বিবর্তনবাদ পাঠক্রম থেকে বাদ কেন ? কারণ সহজেই অনুমেয় । বিবর্তনবাদ সরাসরি ধর্ম বিরোধী । কারণ বিবর্তনবাদ পৃথিবীতে প্রাণের রহস্য ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। কিন্তু যদি এককোষী প্রাণী থেকে এই বিশাল জীবজগৎ সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোনও ভূমিকাই না থাকে, তবে ধর্ম ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে ঘৃণা অথবা বিভাজন তৈরী করা তো সম্ভব নয়। তাই ডারউইন পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ। শাসক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রতি শাসকের দৃষ্টিভঙ্গীও বদলায়। শাসক তার নিজস্ব ধ্যান ধারণা বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে চায় জনসাধারণের উপর। ফলে শিক্ষা সংস্কারের অজুহাতে এই অন্ধ শিক্ষানীতির প্রচলন।
আর মেণ্ডেলিফের পিরিওডিক টেবল ? ভারতবর্ষের মানুষ যুগ যুগ ধরে তন্ত্র মন্ত্র কবচ তাবিজ জ্যোতিষী আংটি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। পিরিওডিক টেবল পড়ার ফলে শিক্ষার্থীরা জেনে যাচ্ছে সেই বুজরুকির পেছনের গল্পগাথা। প্রকৃতিতে গ্রহরত্নের উৎস গঠন ও তার উপাদান বিষয়ে তারা জেনে যাচ্ছে । জেনে যাচ্ছে যে মন্দভাগ্য ফেরাতে গ্রহরত্ন কোনও উপকারেই আসে না। ফলে ভাগ্যবদলের স্বপ্ন দেখিয়ে গ্রহরত্ন বিক্রী করা সম্ভব হচ্ছে না। পাঠ্যসূচী থেকে মেণ্ডেলিফকে সরানোর এটাই লজিক্যাল ও গ্রহণযোগ্য কারণ আমার মনে হয়েছে।
সবশেষে একটা প্রশ্ন । সঙ্ঘের সিংহভাগ স্কুলেই মাধ্যমিক ও দ্বাদশ শ্রেণী অবধি পরিকাঠামো এবং পঠন পাঠন নেই। বেশীরভাগ স্কুলের পরিধি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত । বিজ্ঞানের পরিবর্তে বৈদিক বিজ্ঞান। অঙ্ক যতোটুকু না জানলেই নয় , ততোটুকুই। তাহলে যে সব ছাত্রছাত্রীরা সঙ্ঘ পরিচালিত স্কুল থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে বেরিয়ে আসছে , পরবর্তীতে তাদের ভবিষ্যৎ কি ? আগেই বলেছি , বেশীরভাগ ছেলে মেয়েরাই অনগ্রসর ও নিন্মবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে। তাদের পরিবারে অধিকাংশ সময়ই বাচ্চাদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ থাকে না। ফলে তাদের চাকরির চেষ্টা করতে হয়। এদের সিংহ ভাগেরই নিযুক্তি হয় সেনাবাহিনীতে । কারণ , সেনাবাহিনীর নিয়োগে উচ্চশিক্ষা এদেশে বাধ্যতামূলক নয় । ফলে সেনাবাহিনীতে কট্টর ভাবাপন্ন অংশের সংখ্যা বিগত কয়েক দশকে বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। এবং স্বভাবতই এরা একটি বিশেষ ধর্মের ( পড়ুন হিন্দুধর্মের ) প্রতি সহানুভূতিশীল । উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , সম্প্রতি খবর হিসেবে জানা গিয়েছে যে , কাশ্মীরের একটি মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে গিয়ে সেনাবাহিনীর এক মেজর পদমর্যাদার অফিসার স্থানীয় একজন গ্রামবাসীকে “ জয় শ্র্র্রীরাম” বলার জন্য জোর জবরদস্তি করে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে পরে যদিও সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারেরা গ্রামে গিয়ে ক্ষমাপ্র্রার্থনা করেন, কিন্তু এই ঘটনায় সেনাবাহিনীর এক অংশের মনোভাব ও অসহিষ্ণুতা প্রমাণিত । এমন দিন খুব কষ্টকল্পিত নয় যে অদূর ভবিষ্যতে আমরা আমাদের দেশ যা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র , এক ফৌজি রাষ্ট্রে বদলে যেতে দেখবো , এবং সে দিন বোধহয় আর খুব দূরে নয়। এমনও নয় যে এসব আমাদের অজানা। কিন্তু আমরা ভারতীয়রা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত আর আত্মমুগ্ধ যে
খাঁড়ার উপস্থিতি অনুভবই করতে পারছি না , যতোক্ষণ না আরও এক “হলোকাষ্ট” এর মুখোমুখি হচ্ছি। সময় কিন্তু ফুরিয়ে আসছে দ্রুত।