================================================================

================================================================
স্টকহোম-সিনড্রোম আর হলোকাস্ট-ডিনায়ালের মধ্যে দুলে চলেছে একটি গ্রহ; দুলতে দুলতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সম্ভবত। মানুষের কল্পনা যতদূর যেতে পারে, এমনকি তা ‘গ্রটেস্ক’ হলেও, ততদূর অস্তিত্ব রয়েছে কল্পিত বস্তু বা দৃশ্যের। এটি আমি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করি। এ বিশ্বাসের পথ ধরে আমার কাছে এ মাল্টিভার্সের কোথাও সত্যি সত্যি অবিকল ভ্যান গগ-এর ‘দ্য স্টারি নাইট’-এর ঘূর্ণি রয়েছে।
ঠিক এমনই এক বিশ্বাস আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে এ ছায়াপথের কোথাও রয়েছে ইনফার্নো। সেখানে প্রবেশ করবার কাছাকাছি একটি জায়গায় রয়েছে আমাদের গ্রহ; খুব দ্রুত প্রবেশ করবে সে ইনফার্নোর মধ্যে। শুধু ভারতবর্ষ নয়, সারা পৃথিবীর ‘রাজনীতি’ই ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইনফার্নোর মধ্যে প্রবেশ করবার। লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠছে; সম্ভবত ইতিহাসের অন্য কোনও সময়ে দুর্লক্ষণগুলি এত বেশি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়নি। ভারতবর্ষের রাজনীতি ও রাজনীতির ভারতবর্ষ নিয়ে অতি-অবশ্যই কয়েকটি (প্রায়-চর্বিতচর্বন যদিও) কথা বলা যাবে; কিন্তু তার আগে দু-তিনটি বিষয়ের দিকে একবার দৃষ্টি দিতেই হবে। বিষয়গুলি আপাতভাবে অসংলগ্ন মনে হলেও গভীর সংযোগ রয়েছে তাদের মধ্যে। যদিও এটিও আমারই মত, এর সঙ্গে সহমত হবার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই পাঠকের, সঙ্গত-কারণেই।
২০১২ সালের ১৬ অগাস্ট সাউথ আফ্রিকার পুলিশ জোহান্সবার্গের কাছে মারিকানা প্ল্যাটিনাম খনিতে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শ্রমীকদের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে, প্রাণ হারান চৌঁত্রিশজন খনি-শ্রমিক। তাঁদের দাবি ছিল মাসিক বেতন পাঁচ-শো ইউরো থেকে বেড়ে হাজার ইউরো করা হোক; দাবি মানা হয়েছিল। তবে বেতন বেড়েছিল মাত্র পঁচাত্তর ইউরো। (Capital in Twenty First Century – Thomas Piketty)
ধরে নেওয়া হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বহুকিছু ঘটবে, কিন্তু ‘থার্ড’ রাইখ-এর (হিটলার) পর ‘ফোর্থ রাইখ’-এর আগমন ঘটবে না। বার্লিনের বাঙ্কারে হিটলারের দ্বগ্ধ দেহ, মিলানে মুসোলিনির ঝুলন্ত দেহ শুধু দুই ফ্যাসিস্টের মৃতদেহ ছিল না। তাদের প্রতীকী গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ইতিহাসবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকদের একাংশ ঘোষণা করে দিয়েছিলেন ‘ফোর্থ রাইখ’-এর আগমন আর ঘটবে না। ফ্যাসিজমের গায়ে চেপে থাকা ফ্যাসিস্ট-দ্যুতির সমাপন ঘটেছে হিটলার দ্বগ্ধ ও মুসোলিনির ঝুলন্ত মৃতদেহের মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু বাস্তবতা, গত দু-তিন দশকের বাস্তবতা কি সে কথা বলছে? এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন Robert O. Paxton তাঁর The Anatomy of Fascism গ্রন্থে। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেছেন ‘Is a Fourth Reich or some equivalent in the offing?’
বাক্যটির শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন’টি যে লেখকের আশঙ্কা’কে সূচিত করছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁরই দেওয়া কিছু তথ্যে।
তিনি লিখছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মনে করা হয়েছিল বিশ্ব-অর্থনীতির ‘বিকাশ’, ‘individualistic consumerism’ এবং ‘the diminishing credibility of a revolutionary threat’-এর কারণে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিকাশ আর সম্ভব নয়। বিপ্লবের ‘থ্রেট’ ক্রমশ কমে আসার প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। ওটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু গত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকে একের পর এক এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে পৃথিবী জুড়ে যে ফ্যাসিস্ট শক্তির নবরূপে বিকাশপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। লেখক তার মধ্যে উল্লেখ করছেন বলকান অঞ্চলে ‘এথনিক ক্লিনসিং, পোস্ট-কম্যুনিস্ট পূর্ব-ইউরোপে ‘ন্যাশানলিজম’-এর দ্রুত বিকাশ, ইতালি, জার্মানি, ব্রিটেন ইত্যাদি জায়গায় ‘স্কিনহেড’ ভায়লেন্স বেড়ে যাওয়া, নিও-ফ্যাসিস্ট পার্টির বিকাশ ও ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া ইত্যাদি’কে।
ফ্যাসিজমের অ্যনাটমি করে লেখক যে প্রবণতাগুলির দিকে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন বিগত তিন-দশকে ভারতের রাজনীতিতে প্রায় সমস্ত বিষয়গুলিরই উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। ধীরে ধীরে ‘বাক-রুদ্ধ’ করে দেবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে; ছোট ছোট পাওয়ার-পকেটস তৈরি করা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে। বারবার পুঁজি, ধর্ম ও উগ্র-জাতীয়তাবাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে ডান-বামের একটা বড় অংশ। ফল হয়েছে মারাত্মক।
এই বাক-রুদ্ধ করে দেবার প্রস্তুতি যখন চলছে তখন কি আমরা যথেষ্ট ‘সতর্ক’ ছিলাম? এ লেখা যাঁরা পড়বেন তাঁদের বাইরেও যে এক বৃহৎ ‘ভারতবর্ষ’ অপেক্ষা করে রয়েছে সে খবর কি আমরা রেখেছিলাম ঠিকঠাক? আমাদের (ভারতীয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ জনগণ) মধ্যেই ছিল এবং রয়েছে এমন কিছু সুপ্ত মানসিকতা, এমন কিছু ‘আত্মপ্রতারণা’ যার ছিদ্র দিয়ে এ অবস্থা তৈরি করা সহজতর হয়েছে।
একদিকে ভারতবর্ষের মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকা ভাববাদ’কে আমাদের অনেকেই চিনতে ভুল করেছি, অপরদিকে পলিটিক্যাল হিন্দুত্ব আমাদের অনেকের কাছে ‘ভাববাদ’ হয়ে প্রথম প্রথম ধরা দিয়েছে। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ধর্মাচারণের ক্ষেত্রটিকে আমরা নির্ধারিত করতে পারিনি। শ্রেণীর প্রশ্নে ধর্মাচারণ’কে আমরা ধরাবাঁধা কয়েকটি ‘ফর্মুলা’ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি। সংখ্যালঘুর ধর্মান্ধতা ও ‘জেহাদ’ নিয়ে আমরা নীরবতা প্র্যাকটিস করেছি। কংগ্রেস ও বামপন্থীদের একটি বড় অংশ ঊর্বর জমি প্রায় ছেড়ে দিয়ে গেছে সঙ্ঘ-পরিবার’কে, দিনের পর দিন তারা তৈরি করেছে ‘পপুলার’ কিছু ডিসকোর্স।
যে এলিট, শিক্ষিত-সম্প্রদায় ভাস্কর-পণ্ডিত ও বর্গি’দের ‘হিন্দু’ হিসাবে চিহ্নিত করতে পারে, অনুধাবন করতে পারে হিন্দুর হাতে হিন্দুর অত্যাচারের বিষয়টিকে তারা অনেকেই কালেক্টিভ সাইলেন্সের আশ্রয় নিয়েছে বিশেষ বিশেষ সময়ে। ফলে তারা দ্রুত সরে গেছে সে সব প্রান্তিক মানুষজনের থেকে যাদের ঘরে ঘরে এক সময়ে ঘুরে বেড়াত হাহাকার, ‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?’ উপনিবেশের দীর্ঘ ছায়া ভেতর হয়তো এমনই হবার কথা ছিল, রাজনৈতিক হিন্দুত্ব’কে রেস্টোরেটিভ নস্টালজিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া সহজতর হয়েছে।
ইতিহাসের ধারা বেশ জটিল, সংখ্যা-গরিষ্ঠের প্রকট বা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া কোনও ফ্যাসিস্ট শক্তি কোনও দিন ক্ষমতায় আসেনি। পরে বিশ্লেষণের সময়ে পুঁজি ও কায়েমি শক্তির মদত লক্ষ করা গেছে; কিন্ত এখানে মনে রাখা জরুরি- পুঁজি বা কায়েমি শক্তি সাধারণত অনুর্বর-ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োজিত করে না। তাদের ঘ্রাণ-শক্তি প্রবল। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন যদি নিজেদের ‘ভাবধারা’কে কাজে লাগিয়ে আজ ‘বাক-রুদ্ধ’ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে তবে আমাদের অনেকের’ই ব্যর্থতা স্বীকার করে নেবার সময় এসেছে।
বারবার মনে হয়, ভারতবর্ষের আজকের রাজনীতি’তে ধর্মের ছায়া যে এত দীর্ঘ হয়ে আছে তার পিছনে রয়েছে আমাদের আত্মপ্রতারণার দীর্ঘ ইতিহাস। আমরা রাষ্ট্র-ধারণা থেকে ধর্ম’কে বিযুক্ত করতে পারিনি। আবার একই সঙ্গে প্রগতিশীলতার মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’কে। এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে; আপাতত একটি দেওয়া যাক। পশ্চিমবঙ্গে আটের দশকে খোদ মহানগরে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে শনিকালীমন্দিরের বাড়বাড়ন্ত। ভারতবর্ষের যে রাজ্যে আইপিটিএ-র মতো সংস্থা বছরের পর বছর কাজ করে গেছে সেখানে এ ঘটনা আপাতভাবে ‘অবিশ্বাস্য’। কিন্তু ট্র্যাজেডি এটাই যে এই ঘটনা বড় বেশি বাস্তব। পরিকল্পিত ইসলামোফোবিয়া দূর করতে আমরা বিশুদ্ধ মেধাচর্চার দিকে চলে গেছি অথবা মুখ ঘুরিয়ে থেকেছি বাস্তবতার থেকে। এক দিকে পাকিস্তান ও অন্য দিকে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে মৌলবাদের। হিন্দুরা যে ‘বিপন্ন’ বারবার সে কথা গোপনে ছড়াতে কসুর করেনি সঙ্ঘ-পরিবার।
অন্যদিকে আর একটি ট্র্যাজিক উল্লাস লক্ষ করেছে ইতিহাস। ভারতবর্ষের রাজনীতির লাগাম ধরা থেকেছে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতেই, মুখ্যত। শিক্ষানীতির মধ্যে দিনের পর দিন অজড়-অনড় ব্যবস্থা বজায় থেকেছে। সংখ্যালঘুর ভাবাবেগে আঘাত লাগতে পারে ভেবে সেখানে ‘হাত’ দেওয়া হয়নি। ভোট-ব্যাঙ্ক হিসাবে সংখ্যালঘুদের গণ্য করার ফল হয়েছে মারাত্মক। এক ধরণের সিউডো-এমপাওয়ারমেন্টের বলি হয়েছে তারা। এই এমপাওয়ারমেন্টের একটা নমুনা দেওয়া যাক; লেখক হিসাবে তসলিমা নাসরিনের মূল্যায়ন এখানে অবান্তর। এটিও দুর্বল যুক্তি যে রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদের ঘটনায় (৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২) পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু এটি ইতিহাস, তসলিমা’কে আমরা দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছি। মনে পড়ে কবি জয়দেব বসু লিখেছিলেন, সে সময়ে তসলিমার সপক্ষে সব থেকে বড় মিছিলটা হওয়া দরকার ছিল বামপন্থীদের তরফ থেকেই। কিন্তু ঘটেছে ঠিক উলটো; ঠিক যেমন বহু ইসলামিক দেশের থেকেও আগে ভারতবর্ষে রুশদি ব্যানড হয়ে গেছিলেন। এগুলিকে অনেকেই ‘বিক্ষিপ্ত’ ঘটনা বলে দেগে দিতে চান, সে প্রবণতা আরেক মৌলবাদী প্রবণতা। আসলে আমাদের ভেতর শিকড় চারিয়ে দেওয়া আত্মপ্রতারণা আমাদের গর্ভগৃহে আঘাত করতে বাধা দিয়েছে। আমাদের রাজনীতির কাঠামো কখনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়ে।
কিন্তু পাশপাশি এটিও মেনে নেওয়া দরকার, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এমন বাক-রুদ্ধ অবস্থা আগে আসেনি। জরুরি-অবস্থা নিশ্চিত জারি হয়েছিল, বেছে বেছে সরকার-বিরোধী স্বর’কে দমন করা হয়েছিল। জেলে পোরা হয়েছিল। এমনকি দেশ-জোড়া নামডাক এমন শিল্পীদের গান আকাশবাণী থেকে সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছিল। হাতে হাতে ফল পেয়েছিলেন ইন্দিরা, ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল সাধারণ মানুষ। এ উদাহরণ একটু কান-পাতলেই শোনা যায় ট্রেনে-বাসে।
এখানে একটাই কথা বলার, সে সময়ের রাষ্ট্রশক্তির থেকে এ সময়ের রাষ্ট্র অনেক বেশি শক্তিশালী। দেশীয় পুঁজি আর গ্লোবাল-পুঁজির মধ্যে পার্থক্য আর নেই। পোস্টট্রুথ জমানায় সংবাদ ম্যানুফ্যাকচার করার বিষয়টি প্রায় শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে। যে পরিমানে ইনফরমেশন এ মুহূর্তে আদানপ্রদান হচ্ছে তা ইতিহাসে আগে ঘটেনি। রাষ্ট্রশক্তি এখন জর্জ অরওয়েলের ‘1984’-কেও অতিক্রম করে গেছে। রাষ্ট্র এখন জানে কীভাবে দাঙ্গার সময়ে নেটওয়ার্কে বন্ধ করে ফলস-ইনফরমেশন ছড়ানোর হাত থেকে ‘জনগণ’কে বাঁচিয়ে সেটিকে মিস-ইনফরমেশনে রূপান্তরিত করতে হয়। ভারতবর্ষের মিডিয়ার পিছনে, সমীক্ষা জানাচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৃহৎ-পুঁজির অর্থ লগ্নি রয়েছে। বৃহৎ-পুঁজিকে সারা বিশ্ব জুড়ে নিও-ফ্যাসিস্ট বাতাবরণ স্থিতাবস্থা দিচ্ছে, কারণ এ বাতাবরণ সব থেকে প্রথমে ‘credibility of a revolutionary threat’-কে খতম করতে চায়। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ বাতাবরণে সঙ্ঘ-পরিবারের কাছে কংগ্রেসের থেকেও আর্বান-নকশাল নামক এক বিষয় বেশি মাথাব্যথার কারণ। এমনকি দেশের সুরক্ষার প্রশ্নেও যে আর্বান-নকশাল নামক এক কল্পিত বিষয় সব থেকে বেশি বিপদজনক তা বারবার ঘুরে-ফিরে আসছে তাদের কথায়।
দেশীয় স্তরে যে ফ্যাসিস্ট-শক্তি নিয়ে আমরা অনেকেই আতঙ্কিত, সে শক্তির বিরুদ্ধে আমরা কি যথেষ্ঠ প্রতিরোধের ও যথার্থ রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে পেরেছি? ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থার এ এক করুণ পর্ব। আমাদের রাজ্যের শাসকদলের দিকে তাকালে পরিস্থিতি অনুধাবন করা সহজতর হয়। কংগ্রেসের অন্দরে ক্ষমতাবিন্যাসের টানাপোড়েন থেকে জন্ম নেওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষেন রাজ্যবাসীর রাজনৈতিক সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন নেই। পপুলার কালচার ও পলিটিক্সের এক আদর্শ উদাহরণ হয়ে থাকবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, ‘শাসকের’ বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী অবস্থান নেবার বদলে সে শক্তি’ও অচিরে পরিণত হয়েছে ‘প্রচ্ছন্নভাবে নিরঙ্কুশক্ষমতাপন্থী’ শক্তি হিসাবেই। ‘প্রচ্ছন্ন’ শব্দটি তার ক্ষমতার নিরিখে ব্যবহৃত, লক্ষণ হিসাবে নয়। বিরোধী স্বরকে পিষে দেবার নানাবিধ উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে এমন এক উত্তুঙ্গ শৃঙ্গে স্থাপন করা হয়েছে যা দেখে অনেক একনায়ক’ও শীতঘুম থেকে উঠে লজ্জা পেতে পারেন। রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী না-হয়েও এ ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল চূড়ান্ত ক্ষমতা ‘এক্সারসাইজ’ করবার যে ধারা তৈরি করেছে তা ভবিষ্যতের গবেষণার বিষয় হতে পারে। প্রশ্ন করবার সমস্ত পরিসর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া, বিরুদ্ধ স্বর’কে দমন করা ইত্যাদি বিষয়ে এ শক্তি’কে প্রথাগতভাবে ফ্যাসিস্ট হিসাবে চিহ্নিত করতে কারও কারও অসুবিধা হলেও জনান্তিকে তারাও স্বীকার করেন যে বেশ কিছু প্রবণতা একশো শতাংশ মিলে যায়। বিপুল রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে ধারবাহিক রাজনৈতিক ‘শিক্ষা’ আর সংস্কৃতির মেলবন্ধন না-ঘটলে সম্ভবত এ জিনিসই সৃষ্টি হয়।
শুধু কি এ রাজ্য’ই? ‘আঞ্চলিক’ দলগুলিকে যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল, মূলত কংগ্রেসের একাধিপত্যে ফাটল ধরাতে, তা কি সূক্ষ্ম অ্যনার্কি’র পথ ধরেই নির্মিত?
বড়-ফ্যাসিস্ট কি এমনই ‘শক্তি’র অপেক্ষায় থাকে? যে শক্তি অ্যনার্কি’র, যে শক্তির ভিত মূলত প্রথিত হয়ে রয়েছে ভেস্টেড-ইন্টারেস্টের মধ্যে?
ফ্যাসিস্ট শক্তি কি এ ধরণের শক্তি’র উপস্থিতিতে ভেতরে ভেতরে উল্লসিত হয়ে ওঠে? এমনকি সে মদত’ও দেয় সে শক্তি’কে? শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। ফ্যাসিজম যে কত ধুর্ত এবং কত গূঢ় যে তার চলাচল সে দিকে একবার নজর দেওয়া যাক। এখন বিষয়গুলির দিকে তাকালে বেশ ‘মজা’ই লাগবে। উনিশ-শো চল্লিশের সেপ্টেম্বরে গেজ্যেটা জাডোস্কা জারির পরেও ইহুদি ঘেটোয় গানবাজনার স্বাধীনতা ছিল। ওয়ারশ-এ একে একে গড়ে উঠেছিল থিয়েটার, সেখানে ক্যাবারে, ট্যাংগো হত নিয়মিত। এর থেকে বেশ কিছু মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল যে ইহুদিরা বেশ বহালতবিয়তে আছে। এমনকি ঘেটোগুলিতে তাদের বেঁচে থাকা আগের থেকে আরও বেশি মধুর- এমন ধারণাও কারও কারও মনে দানা বেঁধেছিল। আসলে সুৎজস্টাফেল বাহিনী সে সব নিরীহ শিল্পের দিকে ফিরেও তাকাত না। সে ফ্যাসিস্ট শক্তির সময়কাল থেকে সাতটা দশক অতিক্রম করে গেছে পৃথিবী। ফলে তার কর্মপদ্ধতি যে আরও গূঢ় হয়েছে তা বলাইবাহুল্য।
প্রতিপক্ষ নির্মাণেও তার ভূমিকা এখন অমোঘ। তুলনায় ছোট; ফ্যাসিস্ট-সুলভ ক্ষমতার পকেটস নির্মাণ করাও এখন তার ‘কাজ’।
কিন্তু এ পরিস্থতি থেকে মুক্তির পথ কি সত্যিই নেই? আছে; এবং সে পথ কোনও শর্টকাট পথ নয়। নিছক ক্ষমতা দখলের রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক লড়াইয়ের জমি প্রস্তুত করা, যার অন্যতম উপাদান গণ-সংস্কৃতি, এ মুহূর্তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ধর্ম ও তাকে কেন্দ্র করে বাইনারির আশ্রয় নেওয়া সারা পৃথিবীজুড়ে ফ্যাসিস্ট শক্তির অন্যতম হাতিয়ার এখন। রাজ্য ও কেন্দ্রে সে খেলা সমানে চলছে। এই অ্যকশন-রিঅ্যকশনের চোরাবালিতে ডুবে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ করার অবকাশ রয়েছে। আর, পপুলার ডিসকোর্স নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা অনেক সময়েই কাঁচা আবেগের বশে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো দিবাস্বপ্ন দেখি। সে কাঁটা যে কীভাবে আমাদের বুকপকেটে নিয়ে ঘুরতে হয় দিনের পর দিন, সে ইতিহাস ক্রমশ পাপোষের তলায় চলে যেত থাকে। ফ্যাসিজমের প্রশ্নে তুলনামূলক ‘ঋণাত্মক’ আলোচনা আসলে ফ্যাসিজমকেই প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে।
আর এসব জটিল প্রশ্নের বাইরে রইল ব্যক্তিমানুষের চিৎকার… এই পুঁজিদানবের পৃথিবীতে এককের চিৎকারও কিন্তু আজ ‘গুরুত্বপূর্ণ’। কারণ, সেও আপাত-শান্তিকল্যাণের বিরুদ্ধেই চিৎকার করছে।
প্রত্যেক একক মানুষের চিৎকারও আজ ভীষণ জরুরি।