
================================================================
মণিপুর, দিল্লি থেকে অনেক দূর। এই দূরত্ব মানচিত্রগত, মনোভূমিগত। বড় মনোহর উত্তর পূর্বাঞ্চলের এই ‘নয় পাহাড় এক উপত্যকার’ প্রদেশটিকে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কোনোদিনই সর্বভারতীয় চেতনা দিয়ে ছুঁইনি আমরা।
আহা! এ যে চিত্রাঙ্গদার দেশ! কত চন্দ্রালোকিত বসন্ত আগে বীর অর্জুনের হৃদয় হরণ করেছিলেন এক রাজপুত্রী। যোদ্ধৃ সেই নারী তাঁর মোহিনী রূপ আর তেজস্বিতায় জয় করে নিয়েছিলেন গান্ডীবধন্বা পান্ডবকে। তারপর, কুরুক্ষেত্রের আগে, বৃহত্তর সর্বভারতীয় রাজনীতির স্বার্থে আলোকসামান্যা এই নারী খুলে দিলেন তাঁর ব্যক্তিগত নিবিড় বাহুডোর। সম্মোহনী আকর্ষণ অথচ নির্লিপ্তি, অপরূপ মঞ্জুল প্রেমে জড়িয়ে ধরা, অথচ ততোধিক নিরাসক্তিতে জাতীয় স্বার্থে ব্যক্তিগতকে বিযুক্ত করার পুরাণ-কিংবদন্তীর অলৌকিক মায়াজালে আটকে রেখেছি চিত্রাঙ্গদার মণিপুরকে।
এর বাইরের মণিপুরকে একেবারেই চিনি না আমরা, চিনবার চেষ্টাই করিনি, এটাই সত্য।
হঠাৎই আলোকে ঝলকে ভূলোকে দ্যুলোকে—
মনিপুরে চরম বর্বরতা ঘটে গিয়েছে! হঠাৎ করেই চেতিয়ে চাগিয়ে উঠলাম আমরা। দুটি মেয়েকে নগ্ন ক’রে হাঁটানো হয়েছে। মেয়েরা গণধর্ষণের শিকার। ঘেন্না, ভীষণ ঘেন্নায় শিউরে উঠছি সবাই। ফেসবুকের ডিপি কালো করে দিচ্ছি। কার্টুন পোস্ট কবিতার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছি নিজেকে, অন্যকে, সব্বাইকে,
আর
হঠাৎ, “বঁধূ কোন আলো লাগলো চোখে!”
হঠাৎ জানছি,
দু-মাস ধরে না কি ওখানকার নেট পরিষেবা বন্ধ ছিল! মাই গড!
আপনি জানতেন? ওহ্! জানতেন! প্রশ্ন করেছেন কেন বন্ধ? করেননি। আহা, কেনই বা করবেন, কেনই বা! আপনি তো আর মণিপুরে বেড়াতে যাচ্ছেন না। মনিপুরী নেট বা মণিপুরী ফেট নিয়ে আপনার আমার কী!
একটু খোঁজ খবর নিয়ে এখন পরিস্থিতিটি সম্যক জেনেছেন-শুনেছেন? তবে আর কী! শঙ্খনাদীয় “বলো তারে শান্তি শান্তি” করে দিন। এই ‘শূন্য’ ঝট করে তার বিপুল জট খুলে দেবে।
“বাজনা বাজে, চৌকিদার, বাজনা বাজে কেন ?
নীলদুয়ারে ঘা দিল ভাই মেঘের সেনাগুলো।
বাজনা বাজে, চৌকিদার, বাজনা বাজে কেন ?
. ভয়ের দুয়ার-বন্ধ ঘর কাঁপছে জড়োসড়ো— বাজনা বাজে, চৌকিদার, বাজনা বাজে বড়ো।”
(শঙ্খ ঘোষ)
মণিপুরে ঘটেছিল কী? ঘটছেটা কী, হ্যাঁ!
দু’-মাসের কলুষময় স্তব্ধতার পর এখন একটি একটি করে তথ্য-প্রতিবেদন-ভাষ্য বিভিন্ন নৈঃশব্দের গর্ভ থেকে প্রত্নলিপির মতো উঠে আসছে।
গত সাতাশে এপ্রিল মণিপুর রাজ্য সরকারকে মণিপুর হাইকোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল, মৈতেইদের তফশিলি জনজাতির মর্যাদা দিতে হবে।
মণিপুর সরকার অবশ্য এই বিষয়টি নিয়ে সেই মুহূর্তে টু শব্দ করেনি। জনজাতির অধিকার-আবেগ-অহং সম্পর্কে সরকার তার মানে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিল। হাইকোর্টের এই রায়, মৈতেই-দের স্বীকৃতি ব্যাপারটা যে অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো ভালো চোখে দেখবে না, সম্ভবত সেটা বুঝেই সরকার ‘চুপচাপ জলমাপ’ নীতি নিয়েছিল।
এই স্তব্ধতা আদতে ঝড়ের পূর্বাভাস। একটি গোষ্ঠীর স্বীকৃতি আসলে অন্য গোষ্ঠীগুলোর বিপন্নতা— জল-জঙ্গলের অধিকার বিপন্ন না হলেও বিপন্নতা, হীনমন্যতা, অধিকার খর্ব হওয়ার যন্ত্রণা তৈরি করবে— তা বুঝতে খুব বেশি মেধাশ্রমের দরকার পড়ে না। কিন্তু, ঠিক ওই সময়ে মণিপুরের বিদগ্ধ সমাজ কীভাবে দেখছিলেন এই গুমোট মেঘপুঞ্জকে, জানতে কৌতুহল হয়।
সেই কৌতুহল খুঁড়তে খুঁড়তে অপার বিস্ময়ে দেখছি,
চৌঠা মে দুই মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানোর ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে ১৯ জুলাই। কিন্তু এফআইআর হওয়ার বহু আগে ১১ জুনই দেশের মহিলা কমিশনের প্রধান রেখা শর্মা সামগ্রিক ঘটনাটি জেনে গিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে শ্রীমতী রেখা শর্মা সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘নর্থ আমেরিকান মণিপুর ট্রাইবাল অ্যাসোসিয়েশন’ জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রধান রেখা শর্মাকে কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের মহিলাদের লাঞ্ছনার বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লিখিত আকারে জানায়।
এর থেকেও চমকপ্রদ খবর হল জুনের আগে, গত ২৯ মে মণিপুরের একদল মহিলা তাঁর কাছে সশরীরে এসে এই ঘটনাটির বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে গিয়েছিলেন।
অবাক তস্য অবাক ব্যাপার হল,
বিষয়টির সত্যাসত্য যাচাই ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার অনুরোধ জানিয়ে শ্রীমতী রেখা শর্মা গত তিন মাসে তিনটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন মণিপুর সরকারকে। কিন্তু মণিপুরের প্রশাসনিক মহল সেই চিঠিপত্রের প্রাপ্তিস্বীকার পর্যন্ত করেনি।
অর্থাৎ বিদগ্ধমহল একেবারে অন্ধতমসায় ছিল না। কিন্তু তাঁদের উদ্বিগ্নতা মণিপুর সরকার তথা পুলিশ-প্রশাসন কোনো অজ্ঞাত কারণে এইসব উদ্বেগকে পাত্তাই দেয়নি।
ফলত, তাবৎ বৈদগ্ধ হোঁচট খেয়ে লুটিয়ে পড়েছিল রাষ্ট্রের চৌকাঠে।
বস্তুত, সরকার চুপচাপ থাকলেও সাতাশে এপ্রিলের ওই আদালতীয় ফরমানটি জনগণের গোচরে এসে গিয়েছিল। এবং তার অব্যবহিত পরেই অবাঙমনসগোচর অরাজকতা শুরু হয়ে যায়।
‘আদালতের নির্দেশ মানছি না মানবো না’—, এই ইস্যুভিত্তিক একটি মিছিল, একটি ট্রাইবাল সলিডারিটি মার্চ হয়েছিল ৩ মে। মিছিলে ছিল কুকি-নাগা-জোমি সম্প্রদায়।
আর, সেদিন রাত থেকেই মণিপুরে গোষ্ঠী সংঘর্ষ শুরু হয়। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তীব্রতা এতোই মারাত্মক ছিল, যে ৩ এবং ৪ মে, মাত্র দুদিনেই মৃতের সংখ্যা ৭০ ছাড়িয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় নেট পরিষেবা। আধুনিক ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান অগণিত মানুষ।
সব কুকি, সব নাগা, জোমি-রা অবশ্যই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে চাননি। জাতীয় মহিলা কমিশনের সঙ্গে মণিপুরের একাংশের আপ্রাণ যোগাযোগের সদিচ্ছা তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। একটি অখন্ড বাঙালি সত্তার মতোই একটি অখন্ড ‘মণিপুরী’ ধারণা এই অরাজকতার মধ্যেও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু চলতি মে মাসে যখন নেট পরিষেবা বন্ধ হয়ে উপত্যকাভূমিটি কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, প্রতিবাদী স্বরগুলো আর মণিপুরের বাইরে আসতেই পারলো না।
মণিপুরের অন্তর্জাল-ছিন্নতা নিয়ে আমাদের এ ভাবিত হতে হয়নি। আসলেই এতে আমার আপনার জাস্ট কিছু যায় আসলো না। চুল নখ কাটলে যেমন ব্যথা লাগে না, ঠিক তেমনি কোথাও ব্যথা বাজলো না।
‘ছিঃ’ বলবার আগে, নগ্নতার প্রতিবাদ করবার আগে এই সত্য স্বীকার করে নিই, বস্তুত, আমরা আসলেই তাদের কোনোদিন আমাদের জন বলে ভাবিইনি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতম প্রত্যঙ্গও নয়, মণিপুরসহ গোটা উত্তর পূর্ব ভারত আমাদের কাছে ওই স্নায়ুবিহীন নখ চুলের গ্রাহ্যতা পেয়েছে।
যাগ্গে যাক। গতস্য শোচনা নাস্তি, আগে কহি আর।
শিডিউল কাস্ট ভার্সেস শিডিউল ট্রাইব সংঘর্ষ তৈরির জমিকে পোক্ত করার জন্যই বাজারে একটা ফেক ভিডিয়ো ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিমতি সে ভিডিও?
সেটিও একটি বলাৎকার ভিডিও। সেখানে একটি ধর্ষণ দৃশ্যেরই ব্লুপ্রিন্ট। ঘটনার দিন হিসেবে উল্লিখিত হলো ওই তেশরা মে তারিখটিই। একজন মৈতেই নার্স ধর্ষিত হচ্ছেন। ৩ মে রাতে কুকি-নাগা অধ্যুষিত চূড়াচান্দপুরের একটি হাসপাতালের মেইতেই নার্সকে কুকিরা ধর্ষণ করছে।
যা ঘটলো, যা ঘটছে, সবই আপাতদৃষ্টিতে এই ভূয়ো ভিডিওর বদলা। আগুন জ্বললো এর পরেই। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের লেলিহান আগুনে পুড়ছে মণিপুর। আগুন ছড়িয়েছে দ্রুত।
পরবর্তী ঘটনাক্রম ঠিক কী ছিল?
৪মে থৌবল জেলায় নংপোক সেকমাই থানার অদূরে একটি কুকি গ্রামে মেইতেইরা হামলা চালায়। নির্যাতিতা একুশ বছরের তরুণীর ভাষ্য অনুযায়ী,এই হামলাকারীরা অত্যাধুনিক এ.কে.ফর্টি-সেভেন, ইনসাস, এসএলআরে সশস্ত্র ছিল।
এই আধুনিকতর অস্ত্রসম্ভার এতো দ্রুত একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর হাতে এলো কী ভাবে? ইনসাস, বা সেল্ফ লোডিং রাইফেল অথবা এ.কে-৪৭, কোনোটাই খোলা বাজারে পাওয়া যায় না। এমনকি রাজ্য পুলিশের হাতেও এই অস্ত্রসম্ভার থাকার কথা নয়।
এই সমরাস্ত্র কে বা কারা এতো দ্রুত এতো বিপুল পরিমাণে সাধারণ মৈতেই গোষ্ঠীর হাতে পৌঁছে দিলো?
এই অতর্কিত আক্রমণের পাঙ্গা নিতে অক্ষম গ্রামবাসী বাধ্য হয়ে পালাতে থাকে। এই পলায়নপর জনতার মধ্যেই একটি কুকি পরিবার সকন্যা আশ্রয় নেয় পাশের একটি জঙ্গলে। তাঁদের সঙ্গে ওই গ্রামের আরও দুটি নারী ছিলেন। নির্বিচার অগ্নিসংযোগ, অত্যাচার, খুন এড়িয়ে জঙ্গলে ঢোকাও কঠিন ছিল। সম্ভবত, তাদের আদিবাসী সত্তার সহজাত সংস্কারই তাদের অরণ্যমুখী করেছিল।
গোটা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরের দিকে গ্রামে ফিরতে থাকে ওই পরিবারটি। ফেরার সময় এই কুকি পরিবার নংপোক থানার একটি পুলিশের গাড়ি দেখতে পায়। সন্ত্রস্ত ভীত পরিবারটি অতঃপর পুলিশের কাছে আশ্রয় চায়। পুলিশ-ভ্যান তাদের তুলে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
কিন্তু থানায় ফেরার পথে রাস্তায় দুষ্কৃতীরা তাদের ঘিরে ফেলে। একুশ বছর বয়সী নির্যাতিতার ছাপ্পান্ন বছর বয়সী বাবা এবং তরুণ ভাইকে হামলাকারী জনতা পুলিশের সামনেই বিনা বাধায় খুন করে। নির্যাতিতার বয়ান অনুযায়ী, তিন মহিলাকে খুনের ভয় দেখিয়ে জোর করে বিবস্ত্র করানো হয়। এরপর সবার সামনে দুই মহিলাকে নগ্ন করে নিয়ে যাওয়া হয় ধানখেতে। সেখানে তাঁকে বলা হয়, “শুয়ে পড়ো। তোমাকে ধর্ষণ করব, তোমাদের পুরুষরা আমাদের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে।”
তবে শেষপর্যন্ত দু-একজন পরিচিত হওয়ার সূত্রে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়নি।
নগ্ন করে হাঁটানোসহ শরীরে যত্রতত্র হাত দেবার দৃশ্যটির ভিডিয়ো টুইটারে পোস্ট হয়।
দুই মহিলাকে যখন নগ্ন করা হচ্ছিল, যখন ‘পোশাক খুলে ফেলো, নইলে খুন করবো’— হুমকি দেওয়া হচ্ছিলো, পুলিশ নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে কাছেই দাঁড়িয়েছিল। বস্তুত, ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসবার আগে স্বয়ং পুলিশ তথা রাষ্ট্রই যাবতীয় কার্যকলাপের প্রথম সাক্ষী।
অতএব ৪ মে, ওই ঘটনার পর কেটে যায় স্তম্ভিত চোদ্দদিন। তারপর গত ১৮ মে কঙ্গপোকপি জেলার বি ফাইনম গ্রামের প্রধানের সাহায্যে ওই জেলারই সাইকুল থানায় নির্যাতিতা ‘জ়িরো এফআইআর’ দায়ের করেন। ২১ জুন মণিপুর পুলিশ এফআইআর করে, এবং মহৎ কর্তব্য সেরে ফেলেছি গোছের তৃপ্তি নিয়ে জাস্ট ঘুমিয়ে যায়! নিশ্চিন্ত ঘুমে কেটে যায় আরো ত্রিশ দিন। জ্বলতে থাকে মণিপুর। সর্বভারতীয় জনতা আবহমানকালের নির্লিপ্ততায় ওই বহ্নিমান মণিপুর দেখেন আর পাশ ফিরে শোন।
ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর প্রথম খবর করে “ইন্ডিয়া টুডে”। মোটামুটি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই এই নগ্নতা, এই বিকট নির্লজ্জ ঘটনা গোটা দেশের জিভকে লজ্জায় দশ হাত বের করে দেয়।
মণিপুরের পুলিশ-প্রশাসন-মুখ্যমন্ত্রীর প্রলম্বিত নিদ্রা ভাঙে। এবং, রাত দেড়টায় একেবারে তড়িঘড়ি মাত্র একটি ছেলেকে এই বাবদ গ্রেফতার করা হয়।
অথচ দুই নগ্ন নারীকে অন্তত ৭-৮ জন লোক জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, প্রত্যেকের মুখ রীতিমত স্পষ্ট, ভিডিওতে তা দিব্যি পরিস্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। একটু খোঁজাখুঁজি করলেই এদের প্রত্যেককে পাওয়া যাবে।
ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘটনার আটাত্তর দিন পর মণিপুর সম্পর্কে মাত্র আঠাশ সেকেন্ড সময় খরচ করেছেন। সংসদের বাইরে অবশ্য বলেছেন, এই ঘটনায় তিনি বিচলিত, ব্যথিত এবং ক্রুদ্ধ। যা ঘটেছে তা সভ্যতার লজ্জা। দোষীদের কড়া শাস্তি হবে, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইত্যাদি। (সংসদের বাইরে বলা এই কথা-প্রতিক্রিয়ার লোকসভায় কোনো রেকর্ড কিন্তু লোকসভায় রইলো না।) সবটাই অফ দ্যা রেকর্ড!
ঠিক এখানে, এখানেই “বিস্ময়ে জাগে আমার প্রাণ”!
এই ঢাক ঢাক গুড়গুড় ঠিক কেন! কেন্দ্র রাজ্য দুটি ক্ষেত্রেই যেখানে সরকার এক, সেখানে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এমন ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছে গেল কীভাবে? মণিপুরে যা চলছে, তা কি আদৌও কোনো সংঘর্ষ? ‘সংঘর্ষ’ হতে গেলে দুটো স্পষ্ট পক্ষ লাগে। মৈতেই এবং কুকি কি দুটো পক্ষ? না কি এটা বৈষ্ণব ভার্সেস খ্রিস্টান দ্বন্দ্ব? যুযুধান পান্ডব কৌরবদের যুদ্ধটি ঠিক কী নিয়ে? কী সেই দাবী, যা ‘সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে নেয়’? একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজেও তাহলে নারীই অধিকারযোগ্য বিপণনযোগ্য, ক্রয়যোগ্য অবজেক্ট?
দুই বা তিনজন নারীর অত্যাচারকেই হাইলাইট করতে গিয়ে আরো বড়ো কোনো ইস্যু চাপা পড়ে যাচ্ছে না তো? মৈতেইরা তফশিলি জাতিভুক্ত হলে কুকিরা ক্ষেপে যাচ্ছে কেন? কী সেই ভয়, যা তাদের রাস্তায় নামিয়ে আনে? কুকি নাগা জোমি একযোগে সলিডারিটি মার্চ করে? তাদের যূথবদ্ধতা কেন মৈতেই— তথাকথিত এলিটদের ত্যক্ত করে? এতোটাই উত্যক্ত হয় তারা যে যাবত্ মেধা বোধ চেতনা শিকেয় তুলে ফটাফট ইনসাস, এ.কে-ফর্টিসেভেন নিয়ে কুকিদের গ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে!
“পলাশ শিমূল অশোক ভালোবাসা
ঋতুর মাঝে শ্বদন্ত দেয় উঁকি ;
বাসন্তী রং দেয় না জীবন খুঁজে ,
তোমায় ভোলায় প্রকান্ড বুজরুকি।
তবুও এই তাসের দেশেই বাঁচো ,
নিয়মমতে চলো সঠিক মাপে ;
কারা যেন ওপরতলায় বসে
হিসাব মেলায় নিখুঁত খাপে খাপে” (রণদেব দাশগুপ্ত)
এই বিভৎস ‘লজ্জিত’, ‘ছিঃ’, ‘নক্কারজনক’ প্রতিক্রিয়ার উচ্চকিত আবেগে আসলে কি আরো কোনো বড় সত্য চাপা পড়ে যাচ্ছে? গুলিয়ে ঘুলিয়ে যাচ্ছে আরো বড় কোনো রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচারিতা? মণিপুর কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা, না কি গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে ধরা সমকালীন নৈরাজ্য, যে চক্রান্তকে চিনতেই পারছি না আমরা?
আমরা, ভদ্রলোকেরা ভুলেই যাই, এই বিশাল ভারতের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ আজো আরণ্যক যাপনকে বুকের গভীরে নিয়ে বাঁচেন। ‘ভদ্রলোকের সপ্তাহান্তের শৌখিন জঙ্গলাভিযান’ নয়, অরণ্য তাদের অহং অস্মিতা স্পর্ধাসঞ্জাত আবেগ। সেই দু’শতক আগে লর্ড ডালহৌসি বনাঞ্চল দখলের যে কূটনৈতিক আইন প্রণয়ন করেছিল, স্বাধীনোত্তর ভারতে ইদানিং সেই জবরদখল আইনের মাঝেমধ্যেই পুনর্নবীকরণ ঘটছে এবং গত ২৮ জুন পরিবেশ মন্ত্রক এক সার্কুলার জারি করে বলেছে, বেসরকারি সংস্থা ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের প্রয়োজনে এখন জঙ্গল কেটে ফেলতে পারবে। সুতরাং, অরণ্যের অধিকার চাইলে, বুক দিয়ে জঙ্গল বাঁচাতে চাইলে গোটা দেশের যেকোনো নাগরিকের মতোই কুকি, জোমি, নাগারা এখন দেশদ্রোহী।
তাহলে, মৈতেই সম্প্রদায়কে তফশিলভুক্তির ‘সুবিধা’ দিয়ে, মণিপুরী এলিটদের সন্তুষ্ট করে রাষ্ট্রের তরফে খুব চেনা সেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি চালানোর চেষ্টা চলছে কি?এ কি এক পরিকল্পিত ‘এথনিক ক্লিনজিং’ পদ্ধতি? খুব ঠান্ডা মাথায় খুব সিস্টেমিকালি ‘পাশাখেলা, ‘বস্ত্রহরণ পর্ব’-কে সামনে রেখে ঘুঁটি সাজানো হচ্ছে। নজর ঘুরানোর বিচিত্র সেই নব্য মহাভারতে ‘খান্ডবদহন’ আর মনে থাকছে না আমাদের! আমরা খেয়ালই করছি না, কুকি ট্রাইবের বাসভূমি, মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলের নীচে সঞ্চিত রয়েছে বহুমূল্য খনিজ সম্পদ। চীনা দখলদারিত্ব, ক্রমাগত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ, ভারতীয় বেনিয়াগোষ্ঠীর সন্তর্পণ সম্ভাব্য অধিকারের ত্রহ্যস্পর্শে আসলে গোটা মণিপুর বিপন্ন। বিপন্ন মণিপুরের গণতান্ত্রিক অধিকার।
এই বিপন্নতা ছোঁয় আমাদের?
মণিপুর কার? ভারতের না চীনের? অরণ্য কার? কুকি নাগা জোমি না বেনিয়াদের? মণিপুর ঠিক নারীর মতোই “অবজেক্ট অব ডিজায়ার” যাকে ক্রমান্বয়ে কেবলই কামনা করা হয়। কে তাকে কর্ষণ করবে, কে হবে তার প্রভু— আমাদের নির্বিকারত্বের অন্তরালে দড়ি টানাটানির সেই খেলা বহু যুগ ধরে চলেই আসছে। মণিপুর কী চায় , তার কী ডিজায়ার, ভাবেনি রাষ্ট্র। আমরা, গণতন্ত্রপ্রিয় সহনাগরিকরাও ভাবিনি।
তাহলে, আজ রোদনভরা বসন্তের উপত্যকার রক্তাক্ত উঠোনে হঠাৎ ওপরপড়া হয়ে শান্তিকল্যাণের শশব্যস্ততা, মিডিয়া-আলোর এই ঝলক উদ্ভাস আদপেই তো কোনো সমাধান হতে পারে না!
প্রথম দ্বিতীয় নুপিলানের (বিদ্রোহ) ‘মৈরি পাইবা’ বা ‘ইমা’দের বীরাঙ্গনাকাব্যের পৃষ্ঠা ঝলসে গেছে আজ। মণিপুর রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে এই মুহূর্তে যে শিকার দৃশ্য তৈরি হচ্ছে, সেখানে মণিপুরী মায়াবী পেনা-বাঁশির সুর নেই। নির্মায়িক রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বোনা প্রায় সারা। সংখ্যাগুরু মৈতেইকে সঙ্গী করে সঙ্গোপন ভূমিজ-খনিজ লুঠের মহরা চলছে।
আর সময় নেই। আর সময় নেই! এবার, এখনই যুগ যুগান্তের ক্ষমাহীন নির্লিপ্তি স্বীকার করে অগ্নিগর্ভ মণিপুরের কাছে হাঁটু গেড়ে বসতেই হবে।
কুকি রমণী নয়, আসলে ধর্ষিত ভারতের গণতন্ত্র। আসলে লুঠ হয়ে যাচ্ছে প্রতিবাদ। কুম্ভকর্ণ-ঘুম ঘুমিয়ে যাচ্ছে বিরুদ্ধস্বর।
আপনি আমি আমরা এখনো চুপ থাকবো! একবার, অন্তত একবার গর্জে উঠবো না? প্রশ্ন করবো না, “বাজনা বাজে চৌকিদার, বাজনা বাজে কেন?