
আমার জন্ম গ্রামে, অতিশৈশবও কেটেছে গ্রামের বাড়িতে, তারপর গ্রাম ও মফস্সল মিশিয়ে শৈশব ও কৈশোর। শৈশব ও কৈশোরের পড়াশোনা মফস্সলের ইস্কুলে হলেও শীত, গ্রীষ্ম ও পুজোর ছুটিতে আমি গ্রামের বাড়িতেই ঠাকুরদা-ঠাকুমার সাথে কাটাতাম। তারপর ১৯৬৯ সালে আমার দাদু মারা গেলেন। এর পরে দু-একবার গেছি হয়তো, কিন্তু ১৯৭১-এ হায়ার সেকেন্ডারি দেওয়ার পর পুজোয় আর আমার দেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি প্রায় অর্ধ শতক। চাকরিতে অবসরগ্রহণের পর, ২০১৬ সাল থেকে আবার নিয়মিত বাড়ির পুজোয় যাওয়া শুরু হয়েছে।
আমাদের বাড়ির পুজোটি শুরু হয়েছিল বাংলার ১১০৭ সনে, প্রায় ৩২৩ বছর আগে। দামোদর অববাহিকায় মুণ্ডেশ্বরী নদীর গায়ে নদীনালা জলাভূমি ঘেরা এই গ্রামটি প্রায়শই বন্যাবিধ্বস্ত, যে কারণে সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা অতীতে সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি। আর একই কারণে প্রায় সমস্ত পারিবারিক সদস্য কর্মসূত্রে ছিন্নমূল, পরবাসী হতে হতে গ্রাম থেকে ক্রমশ বিলীন হয়ে গেছে, ফলস্বরূপ এই পারিবারিক জনপদ এখন প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে। বাড়ির কিছু বিশ্বস্ত কাজের লোকজন ও চাষি যারা উত্তরাধিকারসূত্রে বাবুদের দেখাশোনা করে এসেছে, তাদের দু-একটি পরিবার বাবুদের স্থাবর সম্পদ রক্ষার সঙ্গে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ নিয়ে এখানে থেকে গেছে। আর কিছু সদস্য মাঝেমধ্যে, কখনোসখনো গ্রামে যায়, বাড়ির চাবি খুলে হাহুতাশ করে। জনহীন ঘরবাড়িগুলো সময়ের সাথে জীর্ণ ও কঙ্কালসার হয়ে আস্তে আস্তে মুখ থুবড়ে পড়ছে। শুধুমাত্র পুজোর সময়—যারা এখনও অতীতের মোহ মায়াজাল কাটিয়ে উঠতে পারেনি, সেই অমোঘ টানে চলে আসে দিন তিন-চারেকের জন্য। পুজোবাড়ি কিছুটা হলেও জমজমাট হয়ে ওঠে।
অতিশৈশবের অতীত মনে নেই, তবে শৈশব ও কৈশোরের বাড়ির পুজোর কথা খুব মনে পড়ে। আমাদের আগের প্রজন্মের বাবা-কাকা-জ্যাঠারা, তাঁদের একটা বড় অংশ চাকরি করতেন কলকাতায়, থাকতেন শহরে বা মফস্সলের বাসা-বাড়ি বা মেসে। কেউ কেউ অবশ্য পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলেন, ঘর-বাড়ি বানিয়ে সপরিবার তাঁরা শহর-মফস্সলেই থাকতেন। আর কিছুজন থাকতেন গ্রামে দাদু-ঠাকুরদা-পরিবারের সঙ্গে, গ্রামেই মাস্টারি করতেন বা চাষবাস জমিজমার দেখাশোনা। তবে পুজোর সঙ্গে সবার যেন নাড়া বাঁধা থাকত। সে-সময় আবার সদলবলে গ্রামে। পঞ্চাশ-ষাটজনের বাড়ি পুজোয় এক-দেড়শো লোকে ভরে যেত। পুজোয় গ্রামের বাড়ি যাবার আনন্দে আমরা সবাই আনন্দে অধীর হয়ে থাকতুম। প্রায় একমাস আগে পোস্ট-কার্ডে দাদুকে জানিয়ে দেওয়া হত আমরা কবে যাচ্ছি। আমাদের ভিটের অবস্থানটি হুগলি জেলার খানাকুল অঞ্চলে—হাওড়া জেলার সীমারেখা থেকে পাঁচ-ছ কিলোমিটার দুরে। যাবার উপায়ও ছিল হরেক রকমের। বিভিন্নভাবে গন্তব্যে পৌঁছবার সময়, খরচ ও শারীরিক কসরতও ছিল বিভিন্ন রকমের। তুমি একা যুদ্ধ করতে করতে যাবে তো প্রথমে মার্টিন রেলে আমতায় পৌঁছোও, তারপর দামোদর পেরিয়ে বেতাই বন্দর থেকে গাদাগাদি করে অস্টিন মোটরের ছাদে বসে ঝিখিরায় পৌঁছে ক্রোশ তিনেক হেঁটে সাড়ে পাঁচ থেকে ছ ঘণ্টায় অনেক কম পয়সায় বাড়ি পৌঁছে যাবে। তারপর বসুদেবকে ধরে গা হাত-পা একটু দলামচা করে নিলেই হবে। আর যদি বাবা আর আমি বা বাবা আর মা যায়, তাহলে ট্রেনে তারকেশ্বর, সেখান থেকে হরিণখোলা, নৌকোয় মুণ্ডেশ্বরীতে ফেরি পেরিয়ে আবার গড়ের ঘাটের বাসে চক্রপুর, তারপর রিক্সায় গণেশপুর, শেষে গণেশপুর থেকে প্রায় এক মাইলের মত হাঁটা, এরমধ্যে দুবার মুণ্ডেশ্বরী পেরোতে হত। মা অসুস্থ থাকলে পালকির ব্যবস্থা করা হত। তবে চার-সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি পৌঁছনো যেত। তবে সদলবলে যাওয়াটা আমাদের কাছে ছিল খুব আনন্দের, যার জন্যে আমরা মুখিয়ে থাকতাম। তার ব্যবস্থা আবার অন্যরকম। আবার সেই তারকেশ্বর, সেখান থেকে হরিণখোলা, তারপর নৌকোয়… না এবার পেরিয়ে ওপারে নয়—দক্ষিণের উজানে আমাদের গ্রামে নৌকো ছুটবে। এখানে মাঝিদের সঙ্গে দরদস্তুর করতে একটু সময় লাগত। তাই নৌকোয় চাপতে চাপতে বেলা এগারোটা। এই সময়টা আমি উত্তেজনায় টগবগ করতাম। ছই লাগানো একটা মজবুত নৌকোয় আমাদের যাত্রা, আমি তালে থাকতাম ছইয়ের নিচে একটা ধারের-জায়গা নেবার জন্যে, যাতে বাবার চোখ এড়িয়ে হাত বাড়িয়ে জল ছুঁতে পারি। তিন-চারজন মাঝিমাল্লা থাকত, একজন হালে আর দুজন লগি ঠেলার জন্যে। তারপর জয়দুর্গা বলে আমাদের ভাসা শুরু হয়ে যেত। মাইল দশেকের নদীপথ, জোয়ারের সময় উজান আর দোখনো বাতাস ঠেলে যেতে ঘণ্টা চারেক লেগে যেত। মা ব্যাগ থেকে বিস্কুট, মিষ্টি বার করে সবাইকে দিতেন। বাবা হরিণখোলার দোকান থেকে চাল ডাল তেল আলু সব কিনে নিতেন। ভাসা শুরু হলেই তদ্বির করতেন, মাঝিদের উনুনে আঁচ দিয়ে কত তাড়াতাড়ি খিচুড়িটা বসানো যায়। হালের অন্য প্রান্তে কয়লার উনুন জ্বালানো হত। হাওয়ায় নৌকোর গতিটা কিছুটা ঢিমেঢালা থাকত বটে, তবে উনুনটা ধরত তাড়াতাড়ি। মাঝিদেরই একটা মাঝারি হাঁড়িতে তেলে শুকনো লঙ্কা আর জিরেফোড়ন জ্বলে উঠতেই তার গন্ধে আমাদের মনটা চড়ুইভাতির মজায় মশগুল হয়ে উঠত। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খিচুড়ি রেডি। মাঝিদের খানচারেক কলাই-করা থালা আর দু-তিনটে অ্যালমিনিয়াম কাঁসি নদীর জলে ধুয়ে, হাওয়ায় খিচুড়ি জুড়িয়ে নিয়ে আমাদের খাওয়া শুরু। এই জলময়, ভাসমান, উন্মুক্ত আকাশের ছায়া আর রোদের মধ্যে আমাদের অপরিকল্পিত চড়ুইভাতি আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় আজও উজ্জ্বল।
তারপর আমরা আমাদের গ্রাম, চিংড়ার ঘাটে পৌঁছে যেতাম বিকেলের সামান্য কিছু আগে। ঘাটে দাদু আগে থেকেই লোক পাঠিয়ে দিতেন। বাক্স-প্যাঁটরা মাল-পত্র নামিয়ে আমরা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করতাম। মিনিট দশেকের পথ, মনে হত রাস্তা যেন ফুরোয় না। বাড়ি ঢুকেই আমি সোজা ছুটতাম দুর্গাদালানে। একপাশে গাদা করা খানচারেক হ্যাজাক, দু-তিনটে ডে-লাইট—তার মধ্যে একটা মুছে, ম্যান্টেল লাগিয়ে তেল ভরে রেডি করা হচ্ছে—জ্বলে উঠলে প্রতিমাসজ্জার বাকি কাজ শেষ হবে। প্রতিমায় রঙ, চোখ-আঁকা, শাড়ি ও চুল পরানো ততক্ষণে শেষ, চালচিত্রের গায়ে পটচিত্রও আঁকা হয়ে গেছে, চালচিত্রের মাথায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের ক্ষুদ্রাকৃতি মুর্তি স্থাপন করা হচ্ছে। আলো জ্বললে প্রতিমাকে পরানো হত রাংতার ডাকের সাজ। তারপর প্রতিমাকে ঘাম তেলে চর্চিত করা। অতসীবর্ণা রূপের ছটায় সসাজ প্রতিমা হ্যাজাকের আলোয় দীপ্তিময়ী হয়ে উঠলে কারিগররা নিষ্কৃতি পেতেন।
প্রতিপদের দিন সকালে পরিবারের গৃহদেবতা শ্রীধরের মন্দিরে ঘট প্রতিষ্ঠা, পুজো ও চণ্ডীপাঠ শুরু হয়ে যেত। আমাদের নবরাত্রি মতে পুজো তাই প্রতিপদ থেকেই পুজোর শুরু। তবে বাড়িতে সেদিন থেকেই যজ্ঞিবাড়ির ব্যস্ততা। আমাদের বড় মরাই, যেখানে শেষ-ভাদ্রে পাড়া নারকেল, গুড়ের পাই আগে থেকে মজুত করে রাখা থাকত, তা উঠোনে নামিয়ে জড়ো করা হত। মুড়ি-ভাজার দিদি সকাল থেকে মুড়কির খই ভাজতে বসে যেতেন। দাওয়ার উনুনে মাটির বড় গামলার বালিখোলায় খই ভাজা হত। মা-কাকিমারা বসে যেত নারকোল কুড়তে। ধামা বা ধুচুনির চালুনিতে ভাজা খই হালকা ঘষে নিলে ধানের খোসাগুলো বেরিয়ে যেত। এদিকে বড়পিসি ও ঠাকুমা বড় রান্নাঘরে কাঠের জ্বালের উনুনে গুড় জ্বাল দিতেন। তারপর গুড়ের পাকে ঠিকঠাক চিট ধরলে ঠাকুমা গরম গুড় বড় হাতায় তুলে ধামার খইয়ে ঢালতে থাকতেন। বড়পিসি একটা বড় কাঠের ফ্ল্যাট স্পাটুলায় গুড়-দেওয়া খই ভালো করে মাখতেন আর মাঝে মাঝে গোলমরিচের গুঁড়ো আর ঘরে তৈরি ঘি চামচে করে দিতেন। এই মুড়কি তৈরি হয়ে গেলে তা একটা বড় আড়াই-মনি বস্তায় বেঁধে রাখা হত। তারপর শুরু হতো নারকেল নাড়ু তৈরি।
এদিকে দিন যতই পুজোর দিকে এগোয়, বাড়িও দিনে দিনে ভরাট হতে থাকে। শহর থেকে কাকা-জ্যাঠা-পিসি-পিসো আর তাদের ছেলেপুলের দঙ্গল পঞ্চমীর মধ্যেই পৌঁছে যায়। চতুর্থীর দিন বিকেলে কুমোর-বাড়ি থেকে আসত পোড়ামাটির প্রদীপ, পিলসুজ, ধুনুচি, যাগপ্রদীপের হাঁড়ি, ঘট, দ্বারঘট—পুজোয় বাকি সব মাটির সরঞ্জাম। হোঁচা মালাকার নিয়ে আসত চাঁদমালা, শোলার ফুল ও ঝারা। দুর্গাদালানের পাশে বড় বেলগাছের তলাটি বোধন ও বিল্ববরণের জন্য আগে থেকেই পরিষ্কার করে ঘিরে রাখা হত।
তবে বাবা এসবের ধারেকাছে থাকতেন না। শহর থেকে একাঙ্কি, ঘোড়াবচ ও পিঁপড়ের ডিম কিনে নিয়ে আসতেন, বসুদেবকে ধরে সরষেখোল-পচার সঙ্গে বাসি ভাত আর মশলা মিশিয়ে চার তৈরি করতেন। আর পাঁউরুটি, ঘিয়ের পোড়া গাদের সঙ্গে পিঁপড়ের ডিম মিশিয়ে তৈরি হতো টোপ। তারপর সদরপুকুরের পাড়ে হুইল ছিপ নিয়ে বসে যেতেন। আমিও কখনোসখনো বাবার পাশে এসে বসতাম। তবে অনেক ক্ষণ ধরে এই চুপচাপ বসে থাকাটা বেশ অসহ্য লাগত আমার। আমি সদরে দুর্গাদালানে চলে আসতাম। তবে বেলা বেড়ে তিনটে বাজলে বাবা উঠতেন। সঙ্গে একটা-দুটো পোয়া ওজনের কালবোস। মা খেপে লাল হয়ে যেতেন। অন্য কাকা-জেঠারা টিপ্পনি কেটে বলতেন, ‘চণ্ডিদা কটা পুঁটিমাছ ধরলে গো, সবার হবে তো ?’
ষষ্ঠীর দিন ভোরবেলা আমি আর আমার দু-তিনজন সমবয়সি তুতো ভাইবোন মিলে ফুলের ডালি নিয়ে মাইলখানেক দূরের দিগবাঁধের শেতলা মন্দিরের ফুলের বাগানে চলে যেতাম ফুল তুলতে। মন্দিরবাগানে ঢোকার মুখে খালের ওপর একটা বাঁশের সাঁকো ছিল যেটা পেরোতে আমি খুব ভয় পেতাম। আমার পিসতুতো বোন অপু আর এক তুতো ভাই ফ্যালা আমাকে আগলে নিয়ে সাঁকো পেরোত। সে বাগানে হরেক গাছ, কতরকমের জবা, স্থলপদ্ম, কলকে, করবী, গোলঞ্চ তুলে ডালি ভরে নিয়ে আসতাম। বাড়ি ফিরে দেখতাম ঢাকি-ঢুলির দল এসে গেছে। অন্য কাজের লোকেরা দেবদারু পাতা দিয়ে গেট তৈরি করছে। মনটা বেশ খুশি খুশি করে উঠত। ঢাকে কাঠি পড়লেই ছেলেপুলের দল হুটোপটি, নেত্য শুরু করে দিত। আমি তক্কে তক্কে থাকতাম কাঁসরটাকে কীভাবে কব্জা করা যায়। আমি গোবেচারা, রুগ্ন, অন্য ভাইদের সঙ্গে পেরে উঠতাম না। তবে মাঝেমধ্যে তারা আমাকে একটু-আধটু বাজাতে দিত।
ষষ্ঠীর দিন সন্ধেয় বোধনের আগে নতিবপুরের আচার্যিবাড়ি থেকে নবপত্রিকার কলাগাছ, অন্যান্য সমূল গাছ ও বেল এসে যেত। তন্ত্রধারক সেই সব গাছকে কলাগাছের সঙ্গে লাল সুতো ও অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে তাতে দুটো বেল বেঁধে তাঁতের লাল কোরা শাড়ি পড়িয়ে নবপত্রিকা (যাকে আমরা কলাবউ বলতাম) প্রস্তুত করে বিল্বমঞ্চে রাখতেন। বিল্ববরণ ও বোধন শেষ হলে মূল মণ্ডপে পুজো শুরু হত।
সপ্তমীর ভোরে ঢাকের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত। তাড়াতাড়ি মুখ-হাত-পা ধুয়ে সদরে এসে দেখতাম, মণ্ডপের সামনে খড়ের দোচালায় আর তার চারপাশ ঝাঁট দিয়ে গোবরছড়া দেওয়া হচ্ছে। দুজন পুরুত মিলে নবপত্রিকা স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাধবকাকা পুজোর বেনেমশলা, পূজোপচার ও ফলমূল মণ্ডপে কলাপাতায় সাজিয়ে রাখছেন। মালাকার বাড়ি থেকে প্রতিমার মালা ও ফুল এসে পৌঁচ্ছচ্ছে। ইতিমধ্যে বাড়ির সবাই মণ্ডপে এসে জমায়েত হয়েছে। সকাল সাতটা নাগাদ ঢাকের বাদ্যি উঠলে শুরু হল কলাবউয়ের সপরিবার যাত্রা মহাস্নানে, সদরপুকুরের ঘাটে। প্রথমে একজন গাড়ু নিয়ে রাস্তা ধুয়ে যেত, তারপর পুরুতঠাকুরের কাঁধে লাল শাড়ি পরা কলাবউ, তারপর তন্ত্রধারক—হাতে মহাস্নান উপচার। তারপর বাদ্যির দল এবং শেষে পুরো পরিবার। স্নানশেষে নবপত্রিকার মণ্ডপে প্রত্যাবর্তন—প্রতিমামূর্তির চালচিত্রের বাঁদিকে গণেশের পাশে, জয়ার পেছনে এই কলাবউ স্থাপন করা হয়। তারপর রায়পরিবারের বংশধরেরা পুকুরে স্নান করে প্রতিমার ১৮টি ঘটে জল ভরে মণ্ডপে এনে রাখলে মূল পুরুত তা প্রতিমার সামনে সাজিয়ে বসাতেন। মণ্ডপে প্রতিমার আশেপাশে মেঝেয় অন্তত ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটা নৈবেদ্য সাজানো হত—মূল নৈবেদ্যটি একটি বড় পেতলের থালায় বাকি সব কলাপাতায়। প্রতিটি নৈবেদ্যতে কিলোখানেক আতপচাল চুড়ো-করা—তার মাথায় একটা নারকেল নাড়ু আর চারপাশে কুচনো ফল, খেঁজুর আর বাতাসা। মা’র মুখে শুনেছিলাম আগে আমাদের পাঁচ-মণ ধানের আতপচালের নৈবেদ্য হত। তার মধ্যে সতেরটি দেব-দেবী ও তাঁদের বাহনদের। আর বাকি সব বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের।
অষ্টমীপুজোর জাঁকজমক ছিল অন্যরকমের। সন্ধিপুজোর আগে থেকে ত্রাহি ত্রাহি রব। যেন বিরাট কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, একটু এদিক ওদিক হলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। বলির খাঁড়ায় রক্তচন্দন ও পুষ্প চর্চিত করে প্রতিমার সামনে রাখা হত। প্রতিমার মূর্তি থেকে বলিকাঠের দূরত্ব প্রায় বাইশ গজের মতোই হবে, উইকেট-পিচের মতোই দড়ির বন্ধনী দিয়ে ঘিরে রাখা, যাতে এই দৃষ্টিপথের মধ্যে কাকপক্ষী প্রবেশ না করতে পারে। এইস্থান শুধুমাত্র দুইজন আম্পায়ার, তন্ত্রধারক ও পুরোহিতের নিয়ন্ত্রণে। একপ্রান্তে যূপকাষ্ঠে আধকেজি ওজনের নারকোল নাড়ু সিঁদুর ও বিল্বপত্র চর্চিত, খড়্গ হাতে কাপালিক তার দিকে একাগ্রনয়নে চেয়ে, অন্যপ্রান্তে ত্রিনয়নী মহামায়া। মাঝখানে তন্ত্রধারক ওয়েস্টক্লক্সের টাইমপিস ধরে বসে সেকেন্ডের কাঁটায় অবিচল তাকিয়ে সন্ধিক্ষণটির অপেক্ষায়। যেন পঞ্চাশ ওভারের শেষ বল বাকি—একটা বাউন্ডারি বা একটা উইকেটে আসমুদ্র হিমাচল প্রাণ ফিরে পাবে। এদিকে পুকুরপাড়ের পাশে জাম ও তেঁতুল গাছের ডালে নারকেল সাইজের গাছবোম ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে ইঞ্চি ছয়েকের পলতে—মশাল জ্বালিয়ে আমার দু-তিনজন কাকা দাঁড়িয়ে রয়েছেন হুইশেলের অপেক্ষায়। চারদিক নিস্তব্ধ, সবাই নির্বাক রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে বলিমঞ্চে। আর সেই মাহেন্দ্রমুহূর্তে তন্ত্রধারক ‘জয় মা মাগো’ বলে গগনভেদী চিৎকার করে উঠতেন। সঙ্গে সঙ্গে যূপকাষ্ঠের বৃহদাকার নারকোল নাড়ুটি খড়্গের এক-কোপে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেত। ঝমাঝম বাদ্যি, কাঁসর ঘণ্টা বেজে উঠত, গাছবোমগুলো দমাদম ফেটে কান ঝালাপালা করে দিত। বাবা-কাকারা সবাই মা দুর্গাকে প্রণাম করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতেন। যেন সারা বছরের একটা যুদ্ধে আমরা সবাই জিতে গেছি। তারপর একশ-আট প্রদীপ জ্বেলে মায়ের আরতি—ধুনো, প্রদীপের ধোঁয়ায়, ঢাকের আওয়াজে মণ্ডপ গমগম করে উঠত।
নবমীর পুজোয় অনেকরকমের আচার—বামুনবাড়ি থেকে শেতলা ও মনসা আসবেন পুজো নিতে, নয় নয় করে বলি হবে নটা, কুমারী পুজো, শেষে হোম-যজ্ঞ। আমাদের শাকম্ভরী মতে পুজো, জীববলি এ-পরিবারে নিষিদ্ধ। তার জায়গায় আখ, চালকুমড়ো, সমূল আদা গাছ, গোড়ালেবু আর পেল্লাই সাইজের পাঁচটি নারকোল নাড়ুর প্রাণ যাবে। কুমারী ব্রাহ্মণ কন্যা, যে এখনও ঋতুমতী হয়ে ওঠেনি—তিনি নতুন শাড়ি-গয়না, মালা-মুকুট পরে মাতৃরূপে উচ্চাসনে আসীন হবেন, ধূপধুনোর ধোঁয়ায়, প্রদীপের আগুনের তাতে ক্রমশ প্রাংশু হতে হতে পুজো গ্রহণ করবেন।
একবার নবমীর দিন সকালে দেখি, সদরপুকুরের পাশে কলকে গাছের গোড়ায় দড়ি দিয়ে দুটো ছাগল বাঁধা, কাঁঠালপাতা চিবোচ্ছে। ছোটকাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ-দুটো কী হবে, ছোটকা?’ ছোটকা শুধু বললে, ’উৎছুগ্গু হবে’। সেবার ডিভিসি জল ছাড়ায় বন্যা হয়ে গিয়েছিল। তবে ভয়াবহ না হওয়ায়, বাড়ির চত্বরে জল ঢোকেনি, মাঠঘাট ডুবে গিয়েছিল। বাড়ির পেছনের ডোবাও বানের জলে ডুবে মাঠের জলের সঙ্গে মিশে একাকার। সেখানে আমাদের বাড়ির পানসিটা বাঁধা ছিল। তিন-চার জন মিলে ছাগল দুটোকে পানসিতে তুললো। ছাগল-দুটো ততক্ষণে চারদিকে এত জল দেখে ব্যা-ব্যা চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। আর আমিও বায়না শুরু করে দিলাম যাবার জন্যে। বাবা কাছেপিঠেই ছিলেন, আমার বায়না শুনে তিনিও পানসিতে উঠে পড়লেন আমাকে সামলানোর জন্যে। পানসিতে মাঠ পেরিয়ে আমরা সবাই মস্তাফাপুরের বাঁধে নামলাম। শুনে যা বুঝলাম, ছোটকা জোড়া পাঁঠা মানত করেছেন, বাঁকারায়তলার মন্দিরে এদুটিকে জবাই করা হবে। তাই হল। কিন্তু বাবা আমাকে বলি দেখতে দিলেন না। তারপর জবাই-করা পাঁঠা-দুটো বস্তায় ভরে পানসিতে তুলে বাড়ি নিয়ে আসা হল। বস্তার গায়ে চাপ চাপ রক্ত দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। নবমীর দুপুরের মাংস-ভাত আর খেতে পারলাম না।
আর একবার নবমীর সকালে বাবা তাঁর একনলা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন পাখি শিকারে। সঙ্গে বসুদেব আর বোঁচা। বাড়ির পেছনে পুনির ডাঙার জঙ্গল আর দ—সেখান থেকে খান চারেক ডিগরি-হাঁস মেরে নিয়ে এলেন। এদিকে বাড়িতে শ্রীধর নারায়ণ আছেন, মুরগি বাড়িতে ঢোকা বারণ, ডিগরি-হাঁসেরও একই দশা হল। গোয়ালঘরের পেছনের মাঠে কাঠের আগুনে সেই মাংস রান্না করে সেখানেই খাওয়া হল।
পুজোর সন্ধের কটা দিন গ্রামের বাড়িতে একদম ভালো লাগত না, ঘরে হারিকেনের আলোয় কাটাতে হত। বর্ষাশেষের সন্ধে-রাতে সাপখোপের ভয়। মা একা মণ্ডপে যেতে দিতেন না। সন্ধ্যারতি সাতটার মধ্যে শেষ হয়ে যেত। দু-একজন বড় ছাড়া বাড়ির আর কেউ খুব একটা সন্ধের পর থাকতেন না। তবে দু-জন পুরুত মশাই আর নাপিত (যে পুজোর জোগাড় করত) তারা মণ্ডপসংলগ্ন ঘরে রাতে থাকতেন। একবার, সম্ভবত নবমীর দিন যাত্রাপালার আসর বসেছিল খড়ের নাটমন্দিরের দোচালায়। সেবার মায়ের কোলে বসে পালা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মাঝেমধ্যে কাকাজেঠারা মিলে নাটক করতেন, তবে সেটা হত দশমীর পরে—কালিতলার মাঠে, স্টেজ করে সাইড স্ক্রিন ও সিনারিওলা ব্যাকড্রপ দিয়ে। ‘বঙ্গে বর্গি’ বা ‘কেদার রায়’ এসব নাটকের নাম শুনতাম তাঁদের মুখে। তবে কখনো দেখার ভাগ্য হয়নি।
দশমীর দিন সকালে দধিকর্মার সঙ্গে দেবী-আরাধনার সমাপ্তি, বিকেল থেকেই শুরু হয়ে যেত বিসর্জনের প্রস্তুতি। এই কদিন জাতপাতের বিচারে যাদের মণ্ডপে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তারাই আজ প্রতিমাকে নিচে নামায়। তারপর সন্ধেয় শুরু হয় প্রতিমাবরণ ও সিঁদুরখেলা, বড়দের ধুনুচি নিয়ে নাচ। তারপর গ্রামের ওস্তাদ লেঠেলদের লাঠিখেলা। আমার এখনও মনে আছে সঞ্জিরাম আর রোজোরাম, দুই ভাই য়ের লাঠি খেলা। এইসব তথাকথিত নিম্নবর্গের লোকজনদের জন্যে মদ ও সিদ্ধির ব্যবস্থা করা হত। তাদের থেকে দু-এক পাঁট আমাদের কাকাদের দু-একজন ভাগ নিত লুকিয়েচুরিয়ে। বরণপর্ব শেষ হলে, প্রতিমাকে চতুর্দোলায় তোলা হত। দুদিকে দশ-বারোজন করে লোক বাঁশের দোলায় প্রতিমাকে তুলে আস্তে আস্তে ঘাটের দিকে নিয়ে যেত। তবে আমরা, বাচ্চারা কপালে লাল টিপ পরে যারা উদ্গ্রীব হয়ে থাকতুম বিসর্জন দেখার জন্যে, তাদের মণ্ডপদালানেই ঘেরাটোপের মধ্যে থাকতে হত। অন্ধকারে ভরা পুকুরের ত্রিসীমানার মধ্যে যাওয়ার অনুমতি পেতাম না। জয়ধ্বনি, হট্টগোল আর চেঁচামিচির মধ্যে প্রতিমা ভাসান হয়ে যেত। কুলপূরোহিত ঘটের জলে আমপল্লব ডুবিয়ে সবাইকে শান্তিবারি দিয়ে মণ্ডপের বেদিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতেন। তারপর সবশেষে শুরু প্রণাম, কোলাকুলি ও মিষ্টিমুখ।
সেই পুজো আজও চলছে—৩২৪ বছরে পা দেবে এবার। মাঝখানে জৌলুস অনেকটা কমলেও, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় অনেকেই পুজোয় অন্তত একদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে আসছেন। এখন আর যুদ্ধ করে গ্রামে আসতে হয় না, ছোট চার-চাকা বাড়ির ভেতরে চলে আসে। গ্রামে বিদ্যুৎ এসে যাওয়ায় হ্যাজাক-হারিকেন আর লাগে না। রাতে আলোয় ভরে ওঠে মণ্ডপ। সেই খড়ের দোচালা আর নেই, নতুন কংক্রিটের নাটমন্দিরে পাখার তলায় বসে এখন পুজো উপভোগ করা যায়। পুজোর আচার-উপচার সব মানা হয় বটে, তবে নিয়মরক্ষায় সেই নিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ আর নেই। কিছুটা গয়ংগচ্ছ। এখন পুজোয় বাড়িতে নারায়ণও থাকেন, আর তার মন্দিরের সামনের চালায় বসে মুরগির মাংসও খাওয়া হয়। মণ্ডপে প্রবেশাধিকারে জাতপাতের বিচার আমাদের সবার প্রতিরোধে কিছুটা প্রতিহত হলেও পুজোর হর্তাকর্তা অনেক শিক্ষিত লোকেরও যে সে গরিমা এখনও কাটেনি তা তাদের ব্যবহারে মাঝেমধ্যে প্রকট হয়ে পড়ে।
তবুও এই পুজোয় এখনও নিম্নবর্গের সমাজবন্ধু মানুষজনদের জন্য আলাদা নৈবেদ্য দেওয়া হয়, নাপিত, কামার, কুমোর, মালাকার, ধোপা, তাঁতি আরও অনেকে—তারা নানা জাতের, নানা সম্প্রদায়ের। তাতে নৈবেদ্যের চাল, ফল, মিষ্টি ও সঙ্গে একটি শাড়ি বা ধুতি থাকে। পূজাশেষে তা তাদের প্রদান করা হয়। অনেক পরে বুঝেছিলাম, মা এদেরকেই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড বলে ছোটবেলায় আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এখনও কিছুটা হলেও আমরা বহন করে নিয়ে যেতে পারছি, এটাই আনন্দের।
একাদশীর দিন সকালে আবার সদলবলে শহরে ফেরা—মণ্ডপ নাটমন্দির পেরিয়ে সদরপুকুরের দিকে তাকাতেই জাম, তেঁতুলগাছের ছায়ায়, পুকুরের জলে আধ-ডোবা, চিৎ হয়ে থাকা কাঠামোর দিকে চোখ থমকে দাঁড়ায়। চাঁদমালা আর চালচিত্র থেকে খসে ভেসে যাওয়া দু-একটা রাংতার টুকরো রোদের আলোয় চিকচিক করছে পঞ্চাশ বছর আগের মতই—যার কোনো হেরফের হয়নি আজও।
1Comment
October 22, 2023 at 7:08 pm
Ato tai monograhi lekhar bunon ta, j porte porte cokher samne puro chobi ta vese uthlo. Excellent !