বিজনের নাম বিজন কি-না আমি জানি না। জানার চেষ্টাও করিনি কোনোদিন। আজ যখন বিজনের কথাগুলো গল্প হিসেবে বলতে হচ্ছে, তখন নাম ভাবতে গিয়ে বিজন ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। বিজন আমার কাছে জোছনা বিক্রি করেছিল ম্লানবদনে।
মোটামুটি এগারোটার মধ্যে অটো স্ট্যান্ডে পৌঁছে যাওয়া আমার রুটিন। মিনিট দশেকের মধ্যে মেট্রো। তার আধা ঘণ্টা পরেই অফিস। সারাদিনের বেশিরভাগ সময় যে নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপের মধ্যে কাটে, সেখানে ঢুকে পড়া।
প্রথম যেদিন বিজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেদিন আমার পৌঁছতেও দেরি, অটো ছাড়তেও দেরি। চারজন হচ্ছিল না বলে দাঁড়িয়ে আছে অটোওলা। ঘনঘন হাঁক দিচ্ছে। আমার বিরক্ত লাগছে। একবার ঘড়ি আর একবার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি কতক্ষণে লোকজন আসে। এমন সময় বিজন এসে হাজির। ভেবেছিলুম, একজন অন্তত এলো। ও মা! কোথায় কী, বিজন খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে স্যার না দাদা বলে ডাকব? এমনধারা কথা আমি আগে শুনেছি কি-না মনে করতে পারলাম না। একজন অপরিচিত লোক ডাকবে তো ডাকবে, কী বলে ডাকবে, তা-ও জেনে নিচ্ছে, -ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত ঠেকল আমার কাছে।
সম্ভবত আমার ভুরু কুঁচকে গিয়েছিল। চোখ দুটো একটু সরু হয়ে গিয়েছিল কী! হতে পারে। তবে মুখে যে বিরক্তির ভাব ছিল এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, কেননা আমার সত্যিই খুব বিরক্ত লাগছিল। আমি পালটা জানতে চাইলাম, কেন ডাকবেন কেন? কী দরকার? বিজন একটুও বিরক্ত না হয়ে বলল, আসলে অনেকক্ষণ থেকেই আপনাকে দেখছিলাম। মনে হল, আপনাকেই বলা যায়। এই শুনে আমি মনে মনে আরও বিরক্ত হলাম। ভালো রে আমার রবীন্দ্রনাথ এলেন! ‘এমনও দিনে তারে বলা যায়’ শোনাতে এসেছেন এখন! আমি আর জবাব দেওয়ারই প্রয়োজন মনে করলাম না। উলটোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
এক দু লহমা কেটেছে হয়তো, দেখি বিজন ডাকছে,-দাদা, ও দাদা? আমি মুখ ঘুরিয়ে বললাম, কী বলবেন বলুন তো ভ্যানতারা না করে! দেখি বিজন তার পিঠ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে একটা বোতল বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে, আর বলছে, এক বোতল জোছনা কিনবেন দাদা? নকল নয়, আসল। ঠকবেন না কিন্তু।
কেন যে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল ‘পাগল নাকিআপনি!’, আমি জানি না। আমি বলতে চাইনি, জানি, কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি। কিন্তু ঘটনা হল, আমি ওই কথাটাই বলেছিলাম। বিজন হেসে বলেছিল, সে যা মনে করবেন আপনি! আমি বললাম, মুরগি বানানোর আর লোক পেলেন না! এক বোতল জোছনা বিক্রি করছ, তাও আবার এই কাঠফাটা রোদে! ভাই, আপনাকে তো ঢপবাজিতে নোবেল দেওয়া উচিত। বিজন একই রকম দাঁত বের করে বলল, আপনারই মতো আর একজন বলেছিলেন, নাকি ঢপশ্রী দেওয়া উচিত। আমি বললাম, একজ্যাক্টলি সো, ঠিকই বলেছিলেন ভদ্রলোক। এবার মানে মানে বিদেয় হোন তো।
এর মধ্যেই অটোয় লোক হয়ে গেল। বিজনকে দেখে অটোওলা জানতে চাইল, সে-ও যাবে কি-না? বিজন মাথা নেড়ে খানিকটা যেন ত্রস্তভাবে সরে গেল। আমি দেখলাম, খুব দ্রুত সে বোতলখানা ব্যাগের ভিতর পুরে নিল, যাতে কেউ না দেখতে পায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি অফিস ঢুকে পড়লাম। বিজনের আর কোনও চিহ্ন থাকল না আমার জীবনে।
পরদিন অবশ্য আমার আর দেরি হল না। অটোর কাছে পৌঁছাতেই তবু কোথা থেকে যেন উড়ে এল বিজন। এবার আমি তাকে দেখে হেসেই ফেললাম। বললাম, তুমি কি আমাকে ঠকাবে বলেই বসেছিলে নাকি? কেন আজ বিজনকে ‘তুমি’ করে বললাম, জানি না। বিজনের অবশ্য তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। সে পালটা হেসে আমায় বলল, না দাদা, কেনাকাটা তো আপনার খুশি। আমি শুধু একটা কথা বলব বলে তখন থেকে বসে আছি। সম্ভবত এবারও আমার ভুরু কুঁচকেছিল। আমি জানতে চাইলাম, আবার কী? বিজন বলল, এই কাঠফাটা রোদে কতবার তো গান বাজতে শুনেছেন – জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে – তখন কি আপনার অসুবিধা হয়েছে, দাদা? আমি বললাম, আচ্ছা যা হোক একটা কথা বললে। একটাজ্যোৎস্নারাতের গান বাজছে রাস্তায় আর তুমি আমায় জ্যোৎস্না গছাচ্ছ দিনেদুপুরে, দুটো এক জিনিস হল? বিজন মুখে হাসিখানা ঝুলিয়ে রেখে বলল, হল না?
এইবার আমি বেশ ধাঁধায় পড়লুম। জবাব দিতে পারলুম না। ‘সরো তো’বলে অটোয় উঠে গেলাম।
কিন্তু বিজনএবার আমাকে আর ছাড়ল না। অফিসে যতক্ষণ থাকলাম, বাড়ি ফিরলাম – মাথার মধ্যে খালি বিজনের কথাই ঘুরছে। বিজন যেন একটা কাঁকড়ার মতো। তার দাড়া দুটো দিয়ে আমার ভাবনা কামড়ে ঝুলে থাকল। সারাদিন, সারারাত। আমি ঠিক করলাম, পরদিন বিজনের সঙ্গে দেখা করে একটা ফয়সালা করতেই হবে।
পরদিন, তার পরদিন, তারও পরদিন… পরপর বেশ ক-দিন বিজনকে আর দেখতেই পেলাম না। সে যেমন আচমকা এসেছিল, যেন তেমন করেই মিলিয়ে গেল।
(২)
চুল্লির কোনও এসকেপ রুট হয় না, জানোতো। ডান দিক, বাঁ দিক, উপর, নিচ – সর্বত্র কেবল আগুন আর আগুন। একটা আস্ত শরীর তার ভিতর ঢুকে পড়বে, আর বেরিয়ে আসবে কয়েকটা হাড়গোড় হয়ে। মনে রেখো, স্রেফ কটা হাড়। সেই হাড় দিয়ে কিন্তু বজ্র তৈরি হবে না। অতএবসেই হাড়ে আত্মত্যাগের গল্পও লেখা হবে না। মাঝখান থেকে তুমি খালি পুড়ে ছাই হয়ে গেলে। তোমার পালাবার কোনও পথ নেই। তুমি বিস্ফোরণে ফেটে পড়তে পারো, কিন্তু সে বিস্ফোরণ এমন কিছু ঘটাবে না যাতে তুমুল কিছু হয়। একবার চুল্লিতে তুমি ঢুকে পড়লে, জানবে, তোমার আর কোনও ভূমিকা নেই। তখন আগুন কেবল তোমাকে খাবে। বুঝলে? – কমলদা এইসব কথা যখন বলে যায়, তখন আমরা খুব হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। বলি, কমলদা, এসব বোলো না তো। এই একটা চাকরি-বাকরি করেযাহোক টিকে আছি, এসব শুনলে মনে হয় যেন এখুনি খাদে গিয়ে পড়ব।
কিন্তু কমলদা কথা শুনলে তবে তো!ঠিক তক্ষুনি বলতে শুরু করবে, আগুনের খিদে কি না-বুঝলে চলবে, ভাইসকল? বেলা থাকতে আগুন চিনে নেওয়া ভালো। মনে রেখো, তোমাকে খাবে বলে সে কিন্তু দিনের পর দিন অপেক্ষা করেআছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুমি অপ্রস্তুত হলেই ধরা পড়ে যাবে, তখন কিন্তু আর আগুনকে দুষতে পারবে না।
আমরা, অফিসে যারা একসঙ্গে আড্ডা দিই মিনিট কয়েক, কমলদাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলি, ছাড়ো তো। আগুন তো খাবে মরে যাওয়ার পর। তখন কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা আর কে দেখছে!আপাতত বেঁচে তো থাকতে দাও।
আমাদের কথা শুনে কমলদা হেসে ফেলে। বলে, তোমরা সিওর যে, তোমরা বেঁচেই আছ? আমরা নিজেদের দিকে তাকাই। বলি, বেঁচে নেই! কী যে বলো, কমলদা! বেঁচে নেই মানেটা কী!কমলদা প্রশ্নটা এবার ঘুরিয়ে করে। বলে, তোমরা কি নিশ্চিত যে, তোমরা মরে যাওনি? এবার আমরা আর সমান সপ্রতিভতায় জবাব দিতে পারি না। একটু আমতা আমতা করি। বলি, কী জানি! হয়তো মরেই গেছি!কমলদা বলে, তাহলেই বোঝো! চুল্লির ভিতর যে তুমি অলরেডি ঢুকে পড়োনি, এমন নিশ্চয়তা তুমি নিজেও নিজেকে দিতে পারছ না। তুমি কি বলতে পারো, যে আগুন তোমাকে রোজ খাচ্ছে না! তোমার মাংস, রক্ত, মাথা, ঘিলু সব খেয়ে শেষ করে যে দিচ্ছে না, এ কথা কি জোর দিয়ে বলতে পারো, বলো?
এরপর আমরা কেউআর কমলদার সামনে দাঁড়াই না। দুড়দাড় করে যে যার জায়গায় ফিরে যাই। এইসব প্রশ্নের সামনে থেকে পালানোর রাস্তা যে আপাতত খোলা আছে, এটাই আমাদের কাছে বড় বেঁচে যাওয়া বলে মনে হয়। আমরা পিছন থেকে শুনতে পাই, কমলদা হাসতে আর খানিক গলা তুলে আমাদের উদ্দেশে বলছে, যেটাকে তোমরা এসকেপ রুট বলে ভাবছ, সেটা রাস্তা নয়। মনে রেখো, চুল্লির কোনও এসকেপ রুট থাকতে পারে না।
কমলদার কথাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি, যদিও কথাগুলো আমার মাথায় ভাঙা কাচের মতো বিঁধে থাকে। আমি অফিসের কাজ করি। বাড়ি যাই। আবার অফিসে আসি। বাড়ি যাই আবার। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না, আমি বেঁচে আছি কি-না। আমি এও বুঝতে পারি না, আমি মরে গেছি কি-না। কেননা আমি জানি, এই যে জীবনটা আমি বাঁচছি বলে মনে করছি, সে ঠিক আমার ইচ্ছেয় বেঁচে থাকার জীবন নয়। অনেকের করুণায় বেঁচে থাকা একটা জীবন।
সত্যি বলতে, ইচ্ছের জীবন বলে যে আদৌ কিছু হয়, সেটাই আমি এখন আর বিশ্বাস করি না। আমারও মনে হতে থাকে, একটা মস্ত চুল্লির ভিতর আমি ঢুকে পড়েছি, আর আগুন যখন যেভাবে যেদিকে আমাকে দৌড় করাচ্ছে, আমি সেদিকেই দৌড়াচ্ছি। আসলে আমি প্রতিদিন পুড়ে যাচ্ছি। কিন্তু সেই জ্বালা যাতে আমি না টের পাই, তার জন্য বেঁচে-থাকা নামে একটা মলম আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আমার এই গোটা জীবনটায় আমার হাতে আর কী আছে! কোনওরকম স্বাধীনতা কি আমার করায়ত্ত, যা আমি আমার বলে দাবি করতে পারি! পারি না! তাহলে!
সামান্য কথা যে এমন করে পেড়ে ফেলতে পারে, আমি জানতাম না। এইরকম সময়ে আসলে আমি মনে মনে ভারি অস্থির হয়ে উঠি। একা একা বলি, উফফ কমলদা, এই বিষগুলো মগজে কেন যে ঢালো! দু-দণ্ড শান্তি দিতে পারো না, রাজ্যের অশান্তি এনে হাজির করো শুধু!
এই সব ভেবে আমি যখন বেশ বিরক্ত, আচমকা খেয়াল করে দেখি, আমার পাশে পাশে হাঁটছে, বিজন। ভূতের মতো সে যে কখন আমার সঙ্গে সেঁটে গেছে বুঝতে পারিনি। আমি তাকে দেখে একটু হকচকিয়ে যাই। বলি, এ কী বিজন তুমি এখানে কী করছ? বলতে বলতে আমি খেয়াল করলাম, বেশ রাত হয়েছে। আর অটো ধরব বলে অফিসফেরতা আমি মেট্রোর বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। এর আগে আমার বিজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে এই অটোপথের উলটো প্রান্তে। সে আচমকা এখানে এত রাতে কেন? তবে কি আমাকে বিজন ফলো করছে! পরক্ষণেই ভাবলাম, আমাকে ফলো করার মতো ছাতার মাথা আছেটাই বা কী!
বিজন বলল, আমি তো দাদা চাদ্দিকে এমনিই ঘুরে বেড়াই। কখন যে কোথায় দেখা হয়ে যায়, তার ঠিক নেই। বিজন এইসব যখন বলছে, আমি দেখলাম একটা মাত্র অটো দাঁড়িয়ে আছে। লোক না হলে ছাড়বে না, নইলে অনেক ভাড়া চাইবে। আমি এই ফাঁকে বিজনের সঙ্গে একটু কথা বলি। বলি, বিজন তুমি কি আজও জোছনা ফেরি করতে বেরিয়েছ? বিজন হেসে বলে, হ্যাঁ দাদা, আছে তো কাছে। নেবেন নাকি? গলাটা একটু নামিয়ে সে বলতে থাকে, একটা দারুণ জিনিস আছে, রাসপূর্ণিমার জোছনা। জানেন তো, এইদিন গোপীরা কৃষ্ণের সঙ্গ করেছিল। সেই মাটিতে আজও গোপীদের পদরেণু লেগে আছে। আর আমি বলি কি দাদা, এই জোছনাই তো গায়ে মেখেছিল সেদিন গোপীরা, তাই এই জোছনাও ভারি পবিত্র।
আমি হাসি। বলি, দারুণ ক্যানভাসার কিন্তু তুমি। জোছনাকে কীরকম প্রসাদের মতো বেচে দিচ্ছ বলো? আচ্ছা, নেব নাহয় তোমার জোছনা। একটা কথা বলো দিকি। তুমি কি বরাবর এই কাজ করো? বিজন দুদিকে ঘাড় নাড়ে। বলে, না দাদা, আগে আমি একটা অফিসে কাজ করতাম। ভালো কাজই করতাম। একবার মাইনেও বেড়েছিল। তারপর একদিন, অফিস বলল, আমি যে কাজ করি সেগুলো এরপর থেকে কমপিউটর করে দেবে, আমাকে আর দরকার লাগবে না। সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলাম, যে কাজ আমি মন দিয়ে শিখেছিলাম, করতাম, সেই কাজ আর আমার কোনও কাজে লাগবে না।
বিজনের কথার মাঝে আমি একটু গলা খাঁকারি দিই। আমার মনে পড়ে যায়, একদিন কমলদা বলছিল, এ-আই আসছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসে মানুষকে অনেকখানি রিপ্লেস করে দেবে। যেভাবে মানুষ এসে একদিন এই পৃথিবীর সবকিছু পালটে দিয়েছে। সেভাবে মানুষেরই তৈরি জিনিস এসে নাকি একদিন হটিয়ে দেবে মানুষকেই। এই পৃথিবীতে এমন প্রভাব-প্রতিপত্তি যে মানুষের, সে যদি গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, তবে কী হবে? কেউ তা জানে না। সেই না-জানা স্রোতের ভিতর যে যে বাঁচতে শিখে নেবে, সে সে টিকে যাবে। নইলে অন্য পথ। কিন্তু সেই অন্য পথটা যে কী,তা-ও কেউ জানে না আপাতত।
এই অব্দি শুনেই আমরা কমলদাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, তোমার খালি বাড়িয়ে বাড়িয়ে ভাবনা। যে সময়টায় আছ, তার কথা একটু বলো না বাপু! কমলদা তার সেই ট্রেডমার্ক ডায়লগটা একটু ঘুরিয়ে বলেছিল, সিভিলাইজেশনের কোনও এসকেপ রুট নেই রে ভাইটি! সে মানুষকে তাড়িয়ে, ঘুরিয়ে একশা করে ছাড়বে।
বিজনের কথায় আমার কমলদাকে মনে পড়ে গেল। আপাতত আমি মাথা থেকে সেসব সরিয়ে বিজনের কথায় মন দিই। সে বলছে, তখন আমি ভাবলাম – কী করি? কী করি? যা টাকাপয়সা ছিল হাতে, তাই দিয়ে একটা ছোট দোকান দিলাম। টুকিটাকি সব পাওয়া যায়, মনোহারি দোকান আর কী! মোটের উপর চলছিল একরকম। তারপর…
এইটুকু বলে খানিক চুপ করে যায় বিজন। আমিও চুপ করে থাকি। বিজন বলে, আপনি শুনছেন দাদা? আমি বলি, হ্যাঁ, শুনছি তো। তুমি থামলে কেন? বিজন পালটা প্রশ্ন করে, আপনি দোকান গিয়ে বাজার করেন? আমি মাথা নাড়ি, তারপর বলি, দোকান ছাড়া আর কোথায় বাজার করব! তবে এখন সময়পাই না তো, তাই অ্যাপে অর্ডার দিয়ে দিই। বিজন আমার মুখের কথা লুফে নিয়ে বলল, সেইটাই তো দাদা। সবাই অ্যাপে বাজার করছে। বাঘে যদি দোকান থেকে মাংস কিনে খেত, বনের কী হাল হত বলুন দিকি!
বিজনের কথা শুনে আমি ভিতর ভিতর একটু চমকাই। বোধহয়টের পায় বিজন। সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, আপনাদের দোষ নেই দাদা। আমাদের কারুরই দোষ নেই। আমরা তো নিজের ইচ্ছায় কিছু করি না। কার ইচ্ছায় কী যে করে চলি, সেইটেই যা বুঝতে পারি না।
আমি বলি, তুমি কিন্তু দারুণ কথা বলো বিজন। আমাদের অফিসে কমলদা বলে একজন আছে, অনেকটা তার মতো। বিজন হেসে বলে, ফেরিওয়ালা তো দাদা আমি, কথা বেচেই তো খাই। এ ছাড়া আর আমার কী আছে বলুন!আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি জোছনা ফেরি করা শুরু করলে কবে থেকে? বিজন জবাব দেয়, দোকানটা একদিন উঠেই গেল। রাখতে পারলাম না, জানেন। খুব মুষড়ে পড়লামক-দিন। মনে হয়েছিল, সুইসাইড করি। মেট্রোর ভিতর নামতাম, কিন্তু কী মনে হত কে জানে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে যেতাম। তারপর একদিন ভাবলাম, যে আমার চাকরি খেল, দোকান খেল, সেই-ই এখন আমার জীবনটাকে খেতে চাইছে। আমি নাহয় তার সঙ্গে খানিক চালবাজিই করি। যে ক-দিন পারি তাকে ফাঁকি দিয়ে এমন একটা ব্যবসা শুরু করি, শালা যার হদিশও জানে না। ব্যস, শুরু করে দিলাম জোছনা বিক্রি। কোনও অ্যাপে পাবেন না দাদা, শুধু আমার কাছে, স্পেশাল।
আমি বলি, কিন্তু এ কি কেউ কেনে? যা অঢেল পাওয়া যায়, তা লোকে কিনবে কেন? আর এই করে তোমার পেট চলে? বিজন বলে, চলে না তো। আমি বলি, তাহলে? বিজন বলে, তখন বিষ বিক্রি করি। ইঁদুর-মারা, পোকা-মারা বিষ। বিষ বিক্রি হয়ে যায় বুঝলেন তো দাদা, জোছনা বিক্রি হয় না। তবু সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। আপনার মতো কাউকে পেলে বোঝাই। আমি একটু অবাক হই। বলি, আমার মতো মানে? আমার মধ্যে কী আলাদা দেখলে তুমি? বিজন হাসে, বলে, সে তো বুঝিয়ে বলা যাবে না দাদা। ফেরিওলার চোখ এমনিই অনেক কিছু দেখে বুঝে নেয়।
অটোওলা এতক্ষণে লোক পেয়ে ‘আর একজন’ বলে ডাকাডাকি করছিল। এবার আমাকেই জিজ্ঞেস করল, আপনি যাবেন না? আমি তাকে হ্যাঁ বলি। আর বিজনকে বলি, দাও তো দু-বোতল রাসের জোছনা। কতকাল যে চোখ তুলে পূর্ণিমা দেখিনি, কে জানে! বিজন আমার হাতে বোতল দুটো দিতে দিতে বলে, এইটাই তো বলছিলাম দাদা। যা অঢেল আছে, তাই কি আমরা হাতে পাই নাকি! দেখবেন, একদিন আকাশ, চাঁদ সব বিক্রি হয়ে যাবে। আমি পয়সা বের করতে করতে বলি, হ্যাঁ চাঁদে তো লোকে জায়গাও কিনছে। বিজন বলে, তাহলেই বলুন সে তার জোছনা আপনাকে দেবে কেন? দিলেও আপনাকে দাম দিয়ে কিনতে হবে।
আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাই। লোকটা উন্মাদ না সেয়ানা! বুঝে পাই না। বিজন তখন আপনমনে বলে চলেছে, পাবেন না দাদা, আর কিছুই পাবেন না। সব চুরি হয়ে যাচ্ছে। নদী, মাটি, বালি, আকাশ, পূর্ণিমা – সব লুটেপুটে নিয়ে কারা যেন চলে যাবে। এরপর ভেজাল আসবে। দেখেননি ভেজাল গঙ্গাজল বিক্রি হয়। ভেজাল পাহাড়, ভেজাল ঝরনা সাজানো থাকে কত জায়গায়। জোছনাতেও জল মিশবে, দেখবেন। ব্যবসা হলে কিছুই আর খাঁটি থাকে না। এই খাঁটি জিনিস আমি আপনাকে দিচ্ছি। দেখবেন,একদিন কেমন কাজে লাগে।
আমি সেদিনআর কথা বলতে পারিনি। সত্যি বলতে কী কথা বলা উচিত ছিল, তা আমার জানা ছিল না। ভেবেছিলাম, পরে কখনও দেখা হলে বিজনকে জিজ্ঞেস করব, সে আসলে কী বলতে চাইছে! কিন্তু বিজনের সঙ্গে আর কখনও আমার দেখাই হয়নি।
(৩)
বিজনের গল্পটা যে বলতে হবে, তা আমি আগে কখনও ভাবিনি। এতদিনে কেন বলছি সেটুকু বলে দেওয়াই আপাতত আমার কাজ।
অনেককাল আগে একটা ব্যাপার হতো, জানেন। অনেক সময় দেখা যেত, কোনও বাচ্চা হয়তো মায়ের দুধ খেতে চাইছে না। সবাই ভাবত যে, বাচ্চাটার উপর নিশ্চিত অপদেবতা ভর করেছে। তখন বাচ্চাটাকে একটা ঝুড়িতে ভিতর রেখে গাছের ডালে টাঙিয়ে দেওয়া হত, অপদেবতা যাতে চলে যায়। দু-তিন দিন পর গিয়ে যখন খোঁজ নেওয়া হত, ততক্ষণে বেশিরভাগ বাচ্চা মরে কাঠ হয়ে যেত। যদি কেউ বেঁচে যেত, তাহলেই মনে করা হত যে, অপদেবতা ছেড়ে গেছে। বাচ্চাটাকে তখন ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত। বিজনের গল্পটা যখন আপনাদের হাতে গিয়ে পড়বে, জানবেন, ততক্ষণে রটে গিয়েছে যে আমার উপরেও অপদেবতা ভর করেছে আর আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে নির্বাসনে।
আমি শুনেছি, একজন অপদেবতা নাকি আছে, যে আমার বাপ, চোদ্দ পুরুষকেও খেয়েছে নানা ছলাকলায়। কেউ তাকে দেখেনি, তবুসে নাকি থেকে থেকেই ভর করে আমাদের উপর। তারপর যে চাষ করছিল, তাকে বলে ওটার আর কোনও গুরুত্ব নেই, তুমি চাকরি করো। কিছুদিন পর সে আবার ভর করে বলে, চাকরি করে কিছু হবে না,তোমার কাজ যন্ত্র করে দেবেখন, তুমিবরং ব্যবসা করো। আরও কিছুদিন পরে বলে, ব্যবসা করে তুমি বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছ না, তুমি আসলে একখানা মাকাল। যাও, তুমি গিয়ে ফের চাষ করো! কিন্তু তখন আর মানুষ চাষ করবে কী করে! তার জমি নেই, হাল নেই, লাঙল নেই, এমনকী গায়ে শক্তিও নেই। সে তখন সেই যার অস্তিত্ব আছে কি-না জানে না, সেই অদৃশ্য অপদেবতার কাছেই করুণা ভিক্ষা করে বলে, আমাকে কোনক্রমে বেঁচে থাকতে অন্তত দাও। কেউ কেউ তাই কোনক্রমে বেঁচে থাকতে পায়। বাকিরা গাছে ঝোলানো শিশুর মতো দিন কাটায়। জানে সে, মায়ের দুধ না-খেতে চাওয়ার অপরাধ যখন হয়েই গেছে, তখন তার হাতে আর কিছু নেই। রটনা হোক বা সত্যি, অপদেবতা এবার এখানে আসবেই। এখনএইঝুলন্তঅবস্থায় যদি বেঁচে থাকে তো থাকবে, নয়তো হয় অনাহারে, নয় বন্যপ্রাণীর আক্রমণে তাকে মরতেই হবে। সেই অপদেবতা নাকি আমাকেও ধরেছে। আমি বুঝতেই পারিনি, অপদেবতার কথা শুনে চলা ভালো, নাকি তাকে অমান্য করা উচিত। তবে শেষমেশ বুঝেছি, যা-ই করি না কেন, হার আমারই হতো।
কমলদা বলত, মানুষকে খুব শিগগির হারিয়ে দেবে কয়েকজন মানুষ আর তাদের যন্ত্র । সভ্যতা নাকি সেদিকেই এগোচ্ছে। আরসভ্যতায় কোনও এসকেপ রুট নেই। আমরা সেই কথার গনগনে আঁচ থেকে পালাতে চাইতাম। যেন আমরা ইচ্ছে করেই খেতে চাইনি মায়ের দুধ। সেই কারণেই কি আমিবা আমরাসত্যি সত্যি কোনও অপদেবতার গ্রাসে পড়লাম। আগে ভাবতাম, এখন আর আমি সেসব ভাবি না।
আমি শুধু ভাবি এখন, সেই বহুকাল আগেগাছের ডালে ঝুলন্ত ঝুড়ির ভিতর ঘুম ভেঙেছে কোনও শিশুর। দেখল সে তার আশেপাশে মা নেই। কেউ কোত্থাও নেই। শিশু ভয়ে খুব কাঁদল খানিকক্ষণ। একসময় কেঁদে কেঁদে তার গলা শুকিয়ে এল। কেউ জানত না, সেইসব নিষ্ঠুর দিনে কেবলআকাশের গা থেকে ঝরে পড়ত ঘন জোছনার দুধ। সারা শরীর ভেসে যেত শিশুর। সেই দুধ গলায় নিয়ে আরও খানিকক্ষণ বেঁচে যেত শিশুটি। ওটুকুই মাত্র স্বান্ত্বনা। যতক্ষণ না বনবিড়াল কি ভামের হাতে সে মারা পড়ছে পাকাপাকি, ততক্ষণ জ্যোৎস্নার আদরটুকু অন্তত তার জন্য বরাদ্দ ছিল। এই ভাবতে ভাবতেই আমার বিজনের কথা মনে পড়ে। মনে হয়, আজ যখনআমার উপর অপদেবতা ভর করেছে বলে রটেই গেছে, তখন এই নির্বাসনের ভিতর বসে বিজনের দেওয়া সেই জ্যোৎস্নাটুকু নাহয় আমি গলায় ঢেলে নিই। গায়ে মাখি।
তখনই আবার আমার অন্য একটা কথা মনে হয়। মনে হয়, যখন বুঝেই গেলাম যে, কিছুই আমার হাতে থাকবে না কিছুতেই, এমনকী আমার মৃত্যুটা পর্যন্ত, তখন একটা কাজ অন্তত আমি করি, যা আমার থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আপনারা বিশ্বাস করবেন কি-না জানি না, তারপর থেকেই আমি এই গল্পটা ফেরি করি। সবাইকে অবশ্য নয়। ফেরিওলার চোখ তো, মুখ দেখলেই লোক চিনতে পারি এখন। অটোস্ট্যান্ডে, বাসের টার্মিনাসে গিয়ে আমি বিজনের গল্পটা হাতে করে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াই, কেননাবিজন বা বিজন নয় – সেই লোকটার গল্পের ভিতরই বেঁচে আছে জোছনাটুকু। আমার ধারনা, অনেকেরই এখন জোছনার সান্ত্বনাটুকু দরকার পড়বে। এই করে অবশ্য পেট চলে না আমার। তখন যাহোক একটা বিক্রি করি। বিজন বলেছিল, বিষ বিক্রি হয় সবথেকে ভালো। সে কথা হাড়ে হাড়ে এখন টের পাই আমি।
তবে সত্যি বলতে কী জানেন, আপনারা যারা সত্যিকার জোৎস্না চিনলেনই না, তাদের জন্য মায়া হয় আমার। ইচ্ছে হয়, এই গল্পটা আপনাদের এমনিই দিয়ে দিই। গল্পটা বিজনেরই। কিন্তু বিজনের কাছে তো পুরো গল্পটা নেই। তা ছাড়া বিজনের সঙ্গে আর আমার কোনোদিন দেখাও হয়নি যে তার গল্পটা তাকে ফিরিয়ে দেব।
গল্পটা এখন তাই শুধু আমি-ই ফেরি করি।
একা।