সেদিন ছিল এক তুমুল বৃষ্টির সন্ধ্যা, অন্যসব ঘোরলাগা বৃষ্টিদিনের সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা যেমন হয়। অফিসফিরতি পথে সেই সন্ধ্যায় আমি আটকা পড়েছিলাম মাঝরাস্তায়, ঠাঁই বলতে কেবল রাস্তার পাশে গড়ে উঠতে থাকা একটা আধখেচড়া দোকানের চাল আর মানুষ বলতে সেখানে আমি ও আমার মোটরসাইকেল চালক, মহসীন। সেদিনের সন্ধ্যায় আমরা দুইজন যেন নিজেদের পরিচয় ভুলে হয়ে উঠেছিলাম জন্ম জন্মান্তরের বন্ধু কারণ আমাদের আর কেউ ছিলো না সেই ঘরঘোর অন্ধকারের পৃথিবীতে।
সেই সন্ধ্যাতেও নিশ্চয়ই স্বর্গ নেমে এসেছিল অনেক ঘরে, উঠানে ভেসে যাচ্ছিলো আদরের নৌকা। আর কারো কারো ঘরের ফুটো ছাদ দিয়ে ঢুকে পড়েছিলো পাগলা জলের তোড়, বরাবরের মতো। তবু সবার ঘর তো ছিলো নিজের নিজের মতো। অথচ আমার ঘরই ছিলো না সেদিন, ছিলো কেবল এক নিঃসীম বিস্তীর্ণ চরাচর। সেই তেপান্তরের ওপারের চরাচরে অন্ধকারের পরীরা কী দারুণ নেচেছিলো আমার শ্রান্ত চোখের সামনে! আমি মুগ্ধতায় চোখ বুজে ছিলাম অনেক অনেক ক্ষণে, যেন চোখ খুললই হারিয়ে যাবে ওরা, মিলিয়ে যাবে কোন দূরের মোহনায়।
প্রলয়ের মতোন সেই সন্ধ্যায় ত্র্যস্ত মহসীন বুঝি খুব করে চেয়েছিলো বৃষ্টি থেমে যাক। অথচ আমার ভেজা গায়ে তখন হাওয়ার মাতন, চোখের তারায় সর্ষে তবু বর্ষা থামুক চাইনি একটিবারও। থেকে থেকে সেদিন কেবলই মনে হচ্ছিলো- আমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই, সারা বছর ধরে মেঘ জমায় কেউ ভালোবেসে। তার বাস দূর আকাশের ওপারসীমায়। সেই সন্ধ্যায় বাতাসের ফিসফিসানিতে অনেক কথা হয়েছিলো তার সাথে। আহারে! কতোদিন আমাকে অমন ভালোবেসে দুটো ভালোমন্দ কথা কয়নি কেউ। আমি তাই আরো বেশি করে ভিজে যাচ্ছিলাম ভাঙ্গাচোরা বাতাসের ভেতর নিবিড় হয়ে আসা আঁধারজলের ধারায়, শুনছিলাম বাতাসের ফিসফিসানি।
আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম, উড়ে যাচ্ছিলাম সেই চরাচর ভাসানো বৃষ্টির গভীরে। চোখে জমাটবাঁধা অন্ধকার অসহ্য হয়ে উঠলে আমার নামে মেঘ জমানো মানুষটা বিদ্যুতকে পাঠাচ্ছিলো সঙ্গী হতে। তাই তো তার অতো কড়কড়ানি শব্দে আমার কানে আরাম লাগছিলো খুব, অসহ্য আলোতেও ঝলসে যাচ্ছিলো না চোখ। শুধু চারদিক থেকে ধেয়ে আসা মেঘগন্ধী বৃষ্টিতে আরো বেশি করে ভিজে যেতে যেতে আমার মনে হয়েছিলো আমি নিজেও মেঘ হয়ে যাই, সারাবছর ধরে জমে জমে এমন অঝোরধারায় ঝরে পড়ি এখানে সেখানে গাছে পাহাড়ে সাগরে নদীতে আর নাম না জানা কারো আদরগন্ধী ঘরের চালায়।
সেই বৃষ্টিসন্ধ্যা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিলো। প্রবল বর্ষণে ভিজে ভিজে কীভাবে নদী হয়ে যেতে হয় শিখেছিলাম। নিজের দেয়ালবন্দী ছোট্টো ঘরের বদলে এক বিস্তীর্ণ চরাচরের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে গেলে কেমন লাগে তাও জেনেছিলাম। তবে সবেচেয়ে নিবিড় করে জেনেছিলাম প্রবলতম একাকীত্বকে। অতোখানি বর্ষায় ভেতরে-বাইরে হিম হয়ে যেতে যেতে আমার ইচ্ছে করেছিলো তোমাকে সঙ্গে নিয়েই উড়ি এক আকাশসমান উড়ান। অথচ তোমার ঘরে তখন অজস্র জোনাকির আগমনে বাহারি আলোর বন্যা, তোমার বুকপকেটে একগুচ্ছ বেলির ঘ্রাণ আর চোখে কোনো এক বিগত জন্মের স্বপ্নালু ঘোর। আমার বুকের ভেতর ছায়া ঠোঁটে করে উড়ে যাওয়া এক আঁধারপাখির বিপরীতে তুমি তখন এক আলোকময় পৃথিবীর অধিশ্বর।
সেই সন্ধ্যার গাঢ়তর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে খুব ইচ্ছে করছিলো তোমার থেকে কিছু আলোর বিন্দু নিয়ে চারপাশটা আনন্দে ভরিয়ে তুলি। কিন্তু সে আলোকবৃত্তের বহু বাইরে থাকা আমার প্রবেশাধিকার ছিলো না তোমার অন্দরমহলে। তবু নিজের ভিজে যাওয়া চোখের তারায় সকল বিষাদ ধরে রেখেও আমি চেয়েছিলাম- ‘ভিজুক অলিগলি রাজসড়ক, শুধু না ভেজে যেন তোমার চোখ’। দোমহলা আলোকরাজ্যের অধিশ্বরের চোখ সামান্য বৃষ্টিজলে ভেজে না- তা আমার জানা হয়েছিলো আরো বহু বহু দিন পরে। তবে সেই সন্ধ্যায় আমি কী করে যেন বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের বাস পৃথিবীর সুদূরতম বিপরীত মেরুবিন্দুতে। কোন গোপনে সেই প্রবলতম বর্ষাসন্ধ্যার আকাশ বাতাস এক করে নেমে আসা বৃষ্টিতে আমি নিশ্চিত জেনেছিলাম, আমাদের একাকীত্বও আলো ও আঁধারের মতোই বিপরীতপন্থী।

গল্পকার
সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন
জন্ম: ১০ সেপ্টেম্বর, রংপুর