=========================================================
=========================================================
আমরা আগেই জেনেছি পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, লেখক কবি ও চিন্তক নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়ে প্রায় সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পরে কেউ কেউ হয়তো নিজের স্বদেশে ফিরেছেন আবার অনেকেই ফেরেননি। সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করেননি বলেই। এই মুহূর্তে অ্যালবেনিয়ার জীবিত লেখক ইসমাইল কাদারে-র কথা মনে পড়ছে যিনি প্যালেস অব ড্রিম লেখার পরে স্বৈরাচারী হোক্সা সরকারের কুনজরে পড়ে দেশত্যাগ করেন এবং ফরাসি দেশের প্যারিস শহরে আশ্রয় নেন। ২০০৮ সালে দ্য মেন বুকার পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার পরে বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে নজর কেড়ে নেন। বাংলাদেশের লেখিকা তসলিমা নাসরিন নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর থাকার বিষয়ে কোনো প্রকার ঝুঁকি নিতে পারেননি। ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থেকে নিজের জীবনকে প্রায় যাযাবরের মতো করে তুলেছেন। নোবেল লরিয়েট সলমন রুসদি এই প্রসঙ্গ থেকে ব্যতিক্রম নন। এ ছাড়া অতীতের অনেক উদাহরণ আছে কলমের মাধ্যমে নিজের স্বাধীন মতামতকে ব্যক্ত করতে গিয়ে ধর্মীয় আমলাদের ও রাজনৈতিক আমলা বা রাষ্ট্র নায়কদের রোষানলে পড়ে নিজের দেশ ও স্বদেশ পরিত্যাগ করে ভবঘুরের মতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেরিয়েছেন। একসময় তো কথিতই ছিল প্যারিস হল মুক্ত চিন্তার খোলা উঠোন। অনেক লেখক ও সমাজচিন্তক ফরাসি দেশে আশ্রয় নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। কালে কালে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ লেখক ও কবি সাহিত্য রচনার মাধ্যমে প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাষ্ট্রের রোষানলে পড়ে নিজেরাই নিজেদের বিপন্ন করে তুলেছেন।
ষাট সত্তর দশকে আমরা সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল বলে কি আদৌ কিছু জানতাম অথবা দেখেছিলাম? বৈদ্যুতিন মাধ্যম আসার পরে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ ভাবে বেশ কিছু নির্বাচিত ও পছন্দের মানুষকে নাগরিক সমাজ নামে একটি বৃত্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। অর্থাৎ তারাই এই সমাজ ও দেশকালের একমাত্র সুচিন্তক ও পুরোহিত। অভিজ্ঞতায় দেখেছি এমন অনেক লেখক ড্রামাটিস্ট ও পদ্যকার ইতিহাসবিদ চিত্রকর পরবর্তীকালে স্বৈরাচারী সরকারের কার্যকলাপের সঙ্গে থেকে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা উপভোগ করছেন। এবং যে স্বৈরাচারী সরকার অনাচার হত্যা দুর্নীতি সাধারণ জনসমাজে আতঙ্ক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে শাসন ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখছে সেই সরকারকে সমর্থন করে মানুষের মনে বিভ্রম সৃষ্টি করে নিজেদের সমর্থন কতটা সঠিক বোঝাতে চাইছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নীরব থেকে অনাচার ও স্বৈরাচারকে সমর্থন করে, রাজনৈতিক আমলাদের দ্বারা টিকিয়ে রাখতে চাইছেন মধ্যযুগীয় বর্বর শাসনব্যবস্থা।
আমি এখানে বসে এই প্রসঙ্গে যে কথা বলছি, সেখানকার অনেক সাম্প্রতিক জীবিত ও বিখ্যাত লেখক কবি নিজেদের শ্রেষ্ঠতম লেখাগুলিকে নিজেরাই হত্যা করে চলেছেন নিজেদের মেরুদণ্ডহীনতার জন্য। কারণ নিজের দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত অনাচারী ও স্বৈরাচারী সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে তারা তাদের অস্তিত্বকে বিক্রি করে, সরকারি সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে, একটি জাতির রসাতলে যাওয়ার কুনাট্য দিনের পর দিন প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছেন, দেখে চলেছেন। এখন কথা হল নিজেদের লেখাকে তারা কি ভাবে হত্যা করলেন? আসলে তিনি যা লিখলেন বেঁচে থাকার পদ্ধতির মধ্যে তিনি তার নিজের আদর্শের (অন্তত লেখায় যে আদর্শের কথা বলেছেন) বিরুদ্ধ আচরণ করলেন। নিজের লেখার মধ্যে দিয়ে বিস্তর ন্যায় নীতির কথা বলেছেন, দেশকালের বা শাসকের অন্যায় ও অমানবিক আচরণের কথা বলেছেন। তাঁর রচনা পড়ে সাধারণ জনসমাজ একদিন প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু সেই লেখক একটি অনাচারী ও স্বৈরতান্ত্রিক দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রক্ষমতাকে সমর্থন করে নিজের সাহিত্য রচনার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেরই চরিত্রকে সর্বস্বান্ত করলেন।এই প্রসঙ্গে যে লেখকের প্রতি আপনার আঙুল অজান্তেই ইঙ্গিত করবে, তারা তথাকথিত বিখ্যাত বা বড়োজন হলেও মেরুদণ্ডের অস্থির ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মূক ও বধির হয়ে গেছেন। সাহিত্য রচনায় লেখক ও কবি ন্যায় নীতির কথা বলেন, বলেন সুন্দর ও মানবিক পৃথিবীর কথা। কিন্তু বাস্তবে তারা একটি লোভী কুৎসিত রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ নিয়ে নিজের লেখালেখির বক্তব্যকে সর্বনাশ করে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের কাছে দেউলিয়া হয়ে গেলেন। আমরা জানি ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তি লেখক সত্ত্বার প্রতিদিন সংঘর্ষ হয়। বিরোধ হয়। এই নিয়ে নানারকম জটিল বিশ্লেষণ আছে। লেখক কবিদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সরকারি তোষামোদের মধ্যে থেকে নিজেদের গুরুত্বকে বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেন। সেই ক্ষেত্রে নানারকম সরকারি অনুষঙ্গ আছে।রাষ্ট্রযন্ত্রের এই গ্রে এরিয়ার লেখকদের সম্পর্কে একপ্রকার ভবিষ্যত মুল্যায়ন থাকে বৈকি।
গোটা পৃথিবী জুড়ে দেখা যাচ্ছে একমাত্র ইউরোপ মহাদেশেই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি বুদ্ধিমান মানুষের এই প্রকার আচরণ স্বাভাবিক নয়।যেমন নরওয়ে, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, সাম্প্রতিক কালের জার্মানি ও পর্তুগাল। ইতালি রাষ্ট্রে যদিও শাসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের নানারকম সন্দেহ আছে, কিন্তু তাই বলে আমাদের মতো এত দীন অবস্থান নয়, যা নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহলের ভূমিকা নিয়ে নানারকম চাপা মশকরা চলতে পারে। ফ্রান্স যেখানে আন্তর্জাতিক স্তরে নানারকম সমকালীন দার্শনিক সন্দর্ভের চাষ হয়, সেই রাষ্ট্রের মধ্যেও রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ে অনেক উদার প্রশ্ন আছে।একমাত্র এশিয়াটিক দেশগুলিতে শাসকের শাসন নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ দুর্গতি ও বঞ্চনার শিকার হয়ে আতঙ্কিত পরিবেশের মধ্যে ভয়াল জীবনের অংশীদার হয়ে উঠেছে। আমাদের এখানে বুদ্ধিজীবী মানুষদের রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি আত্মসমর্পণ দিনে দিনে যে ভাবে স্বাভাবিকত্ব অর্জন করছে তাতে করে আগামীদিনে আমরা যে খুব সুস্থ একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশীদার হয়ে উঠতে পারব, সেই রকম নিশ্চয়তার আলো দেখা যাচ্ছে না। এখানে আমি গ্রেট ব্রিটেনের প্রসঙ্গ সযত্নে তুলে রাখলাম, কারণ সেখানকার রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে একেবারেই যুক্তিহীন গন্ধ নেই, কিন্তু গোটা বিশ্বজুড়ে ঘৃণিত ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করার জন্য সেরা থিওরিটিশিয়ান তারাই। গ্রেট ব্রিটেনে বুদ্ধিজীবী মহলের রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে মতামত অনেক দেশের তুলনায় অধিক সমৃদ্ধ। বাকি থাকল আফ্রিকা মহাদেশ। যে মহাদেশের সাহিত্য রচনা আমার অধিক প্রিয়। একমাত্র এই মহাদেশের লেখকরাই নিজেদের ঘৃণার কথা, যন্ত্রণার কথা সংঘবদ্ধভাবে বলতে চাইছে। কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশের রাষ্ট্রগুলির অবস্থা শোচনীয়। রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা পরিচালিত মাফিয়া রাজ, সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্র প্রায় ছারখার করে দিচ্ছে। মিশরের প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারক যিনি একনায়কতন্ত্র কায়েম করে জনগণের দুর্দশার কারণ হয়ে উঠেছিলেন তার বিরুদ্ধে মিশরীয় জনগণ একটি অভিনব উপায় অবলম্বন করেছিলেন– “অকুপাই কায়রো”। এটি একটি আধুনিক পদ্ধতি স্টেটের সমস্ত সাধারণ মানুষ একসাথে জড়ো হয়ে কায়রো শহরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। বুদ্ধজীবী মহলের নীরবতা অনাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সপক্ষে একটি মোক্ষম হাতিয়ার যা অনৈতিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে বলীয়ান করে তোলে। তবে একটি রাষ্ট্রের সব থেকে বড় সম্পদ হল, সাধারণ মানুষ। তাদের যতই নিপীড়ন করা হোক না কেন তারাই একটি শাসনের যন্ত্রকে বদলে দিতে পারে। বদলে দিতে পারে গণতন্ত্রের নামে এক স্বৈরাচারকে। বর্তমান দুনিয়া কেন, অতীতেও এই বিশ্ব অনেক স্বৈরাচারীকে দেখে থাকলেও আধুনিক বিশ্বে একনায়কতন্ত্র ও দুর্নীতি একটি বড় ব্যাধি আকার ধারণ করেছে। আমাদের রাষ্ট্র রাজ্য তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়। আমাদের রাষ্ট্র ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে- দেশ হারিয়ে যাচ্ছে।