‘স্পেক্যুলেটিভ ফিকশন’-এর বিষয়ে যেসমস্ত বাঙালি পাঠকের কিঞ্চিৎ জ্ঞানগম্যি আছে তাঁরা নিশ্চয়ই এতোদিনে শিবব্রত বর্মনের ‘বানিয়ালুলু’ নামক গল্পের বইটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছেন।ওই বইয়ের আট নম্বর গল্পটিকে অবলম্বন করে আমার বন্ধু নন্দলাল একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছে। সে নাটক দেখতে দেখতে এক জায়গায় এসে শুনি চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে এক ভয়ানক ঝড়।কোনওরকম সতর্কবাণী না দিয়ে হঠাৎ আছড়ে পড়া এই ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হচ্ছে বন্দর।সেই দৃশ্য দেখতে দেখতেই মনে পড়ল জ্যঁ আঁতুর র্যাঁবোকে। সত্যিই তো pure poetry নিয়ে লিখতে বসে মালার্মের কথা বলব, মালার্মের সঙ্গে ভেরলেনের সংযোগের কথা বলব আর বিশ্বকবিতায় ঝড় হয়ে আছড়ে পড়া র্যাঁবোর কথা বলব না,এটা হয় কীভাবে?আলোক সরকারের বিশুদ্ধ কবিতা নিয়ে এই প্রবন্ধের গত অধ্যায়ে আলোচনা করেছি অনেক।এও দেখিয়েছি যে যতই তিনি নিজেকে মালার্মের থেকে পৃথক বলে দাবি করুন না কেন, আসলে মালার্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল তাঁর প্রবল; কিন্তু আগের অংশে যাঁর কথা একেবারেই উল্লেখ করিনি তিনি হলেন র্যাঁবো। ভেবে দেখুন,পল ভের্লেন যে কবিকে নিয়ে সোচ্চার সেই মালার্মের সঙ্গে প্রায় একইসঙ্গে আলোচিত হয় এই ভের্লেনের নাম, বিশেষ করে সেটা যদি হয় বিশুদ্ধ কবিতার ক্ষেত্র নিয়ে কথাবার্তা। আবার দেখুন,সেই ভেরলেনই র্যাঁবোর পার্টনার।র্যাঁবোর সঙ্গে তাঁর প্রেম,প্রেমে প্রতারণা, ডুয়েল লড়ার থ্রিলিং জার্নি পেরিয়ে এসে সেই ভেরলেনই র্যাঁবোকে বিশ্বকবিতার দরবারে চিরকালীন আসনে বসিয়ে যেতে সাহায্য করলেন সর্বপ্রথম এবং সার্থকভাবে।যদিও র্যাঁবোর চেতনায় pure poetry – র থেকে বেশি কাজ করেছিল পুরোনো ধাঁচাকে ভেঙে কবিতার নতুন পথরেখা উন্মোচন, কিন্তু তাঁর লেখাকে আমরা কি বিশুদ্ধ কবিতার অন্তর্ভুক্ত করব না? এই প্রশ্ন শুনলেই বাংলার কিছু মহাকালমুখী কবি রে-রে করে উঠবেন জানি, কিন্তু ভাবুন তো আরেকবার pure poetry -র বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কী বলছেন এডগার এলান পো? ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে লেখা তাঁর বিখ্যত বই ‘The Poetic Principle ‘ সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে Maria Popova সেই বই থেকে Pure poetry সম্পর্কে পো-এর যে মতামতগুলোর উল্লেখ করেছেন তার কিছু অংশ আসুন আমরা একটু পড়ে নিই…
After discussing a couple of examples of poems that elevate the soul, Poe takes a stab at what he considers to be the most perilous cultural misconception about poetry and its aim, a fallacy that profoundly betrays the poetic spirit:
It has been assumed, tacitly and avowedly, directly and indirectly, that the ultimate object of all Poetry is Truth. Every poem, it is said, should inculcate a moral; and by this moral is the poetical merit of the work to be adjudged. We Americans especially have patronized this happy idea; and we Bostonians, very especially, have developed it in full. We have taken it into our heads that to write a poem simply for the poem’s sake, and to acknowledge such to have been our design, would be to confess ourselves radically wanting in the true poetic dignity and force: — but the simple fact is, that, would we but permit ourselves to look into our own souls we should immediately there discover that under the sun there neither exists nor can exist any work more thoroughly dignified — more supremely noble than this very poem — this poem per se — this poem which is a poem and nothing more — this poem written solely for the poem’s sake.
তাহলে এই অংশে লিখিত পো-এর মতামতগুলোকে বিশ্লেষণ করে যদি আমরা মূল কয়েকটা বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করি তাহলে দেখব পো আসলে বলতে চান…
১) বিশুদ্ধ কবিতা চিত্তের সমুন্নতি নিয়ে আসবে।
২) কবিতা সত্যের খোঁজ ছাড়া আর কিছুই নয়।
এবং
৩)বিশুদ্ধ কবিতা কেবল কবিতার জন্যই লিখিত হবে। ‘Poem for Poem’s shake’ ছাড়া বিশুদ্ধ কবিতার অন্য পথ নেই।
এবার ভাবুন, এই কথারই প্রায় প্রতিধ্বনি কীভাবে আমরা পাই র্যাঁবোর লেখা চিঠিগুলোতে। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই মে শার্লভিল থেকে জর্জ ইজামবার্ডকে লেখা চিঠিতে র্যাঁবো লিখছেন, “যা অজ্ঞাত অথবা যে অজ্ঞাত তার কাছে পৌঁছতেই হবে,এবং তার জন্য সমস্ত ইন্দ্রিয়তাকে বিশৃঙখল করে দিতে হবে। ” আবার মাত্র দুদিন পরেই ১৫ই মে -তে পল ডেমেনিকে লেখা চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘আমি বলতে চাই যে,তোমাকে একজন ভূয়োদর্শী মানুষ হয়ে উঠতে হবে।সমস্ত ইন্দ্রিয়তাকে দীর্ঘ, অসীম এবং সুশৃঙ্খল বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কবি নিজেকে ভূয়োদর্শী বানিয়ে তোলেন।’
এই ভূয়োদর্শনের কথাকেই কি এলান পো একটু অন্যভাবে চিত্তের সমুন্নতি বলতে চাইছেন না?
আবার দেখুন,ওই একই চিঠিতে র্যাঁবো লিখছেন, ‘ ভাষাটাকে হতে হবে অন্তরাত্মার ভাষা এবং তা প্রত্যেকটি জিনিসকে আত্মস্থ করে নেবে। সুগন্ধ,সুশব্দ,সুবর্ণ,চিন্তার আলিঙ্গনে চিন্তা।সর্বজনীন আত্মায়, তাঁর সময়ে, যে-অজ্ঞাত ভেসে উঠছে, কবিই তার নির্ভুল পরিমাণ নির্ণয় করে দেবেন;তাঁর ধ্যান-ধারণার ফর্মুলাটার চেয়ে বেশি, তাঁর নিজের প্রাগ্রসরণের চেয়ে বেশি, তিনি দিয়ে দেবেন। ‘
আচ্ছা বলুন তো, এই কথা কি উপনিষদের “ঈশাবাস্য মিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগত’-কে মনে করিয়ে দেয় না? এ কি সেই সত্য নয় যাকে লালন তাঁর মনের মানুষের মধ্যে খুঁজেছেন?তাহলে বাংলা কবিতায় বিশুদ্ধতা চর্চাকারীরা একইসঙ্গে লালনকে চোখের মণি করে নেন আর র্যাঁবোকে গালি দেন কীভাবে? ক্ষুদ্র স্বদেশী-দর্শন প্রীতি ব্যতীত অন্য কোনও অভিপ্রায় তো এর মধ্যে আমি খুঁজে পাই না।
যাই হোক, এবার দেখি এলান পো উল্লিখিত ওই ‘Poem for Poem’s shake’ প্রসঙ্গে র্যাঁবোর মতামত কী?
এতক্ষণ যে চিঠির উল্লেখ করেছি সেই চিঠিরই এক জায়গায় এসে র্যাঁবো লিখছেন,
‘ দ্বিতীয় প্রজন্মের রোম্যান্টিক কবিরা সত্যিকার ভূয়োদর্শী। থিয়োফিল গতিয়ে, লেকঁতে ডি লিসলে,থিয়োডর ডি বার্নভিল।কিন্তু বদল্যেয়ার হচ্ছেন প্রথম ভূয়োদর্শী কবি,কবিদের রাজা,সত্যিকার ঈশ্বর। এই হল pure poetry -র আদিগুরুদের সম্পর্কে তাঁর অভিমত।আর পারনাসিয়ান কবিদের কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন,’পারনাসিয়ান কবিদের যে নতুন ঘরানাটা, তাতে দুজন কবি আছেন,আলবেয়া মেয়া এবং পল ভেরলেন,এঁরা সত্যিকারের কবি।’
মনে রাখবেন এই চিঠি লেখার তারিখ পর্যন্তও ভেরলেনের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়নি র্যাঁবোর।এবার দেখুন এই পারনাসিয়ান কবিদের নতুন ঘরানা বলতে কাকে নির্দেশ করছেন র্যাঁবো? তিনি আসলে নির্দেশ করছেন ওই Pure poetry movement -কেই। অতএব ‘বিশুদ্ধ কবিতা’ নিয়ে আলোচনা হবে আর র্যাঁবো বাদ যাবেন সেটাই বা হয় কীভাবে?
এখন কথা হল,র্যাঁবোকে আমাদের ধরিত্রীপুত্রাদি বিশুদ্ধ কবিতার পুন:প্রচারকরা তাহলে আক্রমণ করেন কেন?আধুনিকতাকে আক্রমণ করতে গিয়ে তাঁরা মনে হয় প্রাথমিক ঝামেলাটা তৈরি করেন।তাঁদের সমস্যা হল,তাঁরা ডেকাডেন্সকে মান্যতা দেন না এবং মনে করেন,আধুনিক কবিদের ডেকাডেন্স চর্চা আমাদের সর্বনাশ করে দিয়েছে আর এটা করতে গিয়েই তাঁরা সত্য থেকে দূরে সরে যান। সত্যের পথ কোনওদিন কন্টকহীন হতে পারে না, একথা কী বাংলার কবিরা ভুলে যাবেন!বিশেষ করে যে বাংলার উত্তরাধিকার বৈষ্ণব পদাবলীর?বৈষ্ণব পদাবলীর কথা এখানে আনলাম কেন?বিদ্যাপতির সেই লাইনটা একটু মনে করিয়ে দিতে শুধু।
‘ কন্টক গাড়ি কমলসম পদতল চলতি হি অঙ্গুলি চাপি’। মানবাত্মার প্রতীক রাধাকে পরমাত্মা কৃষ্ণের কাছে পৌঁছতে গেলে কীভাবে কাঁটাবিছানো পথ পেরোতে হয় সেটাই বলা হয়েছে এই পঙক্তিতে। সুতরাং পরম সত্যের কাছে পৌঁছাতে হলে ‘নরকে এক ঋতু’ কাটাতেই হবে কবিকে, এমনই ছিল র্যাঁবোর অভিমত আর সেই ভাবনাই বছরের পর বছর,দশকের পর দশক বাংলার একটা বৃহত্তর অংশের কবিকে অক্সিজেন জুগিয়ে গিয়েছে।
পাঁচের দশকে কৃত্তিবাসী কবিদের মধ্যে যে বোহেমিয়ান জীবনকে আদর্শ মনে করার প্রবণতা দেখা যায় সেই বোহেমিয়ানগিরির বীজ নাকি বিটনিকদের থেকে তাঁরা আহরণ করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন। তবে এই সূত্রে একটা কথা মনে পড়ে গেল যে এই শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে আমরা আমাদের ‘পদ্যচর্চা’ পত্রিকার জন্য কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার নিই। সেখানে আমাদের প্রশ্ন ছিল যে,বিট জেনারেশনের কবিরা কীভাবে প্রভাবিত করেছিল কৃত্তিবাসী কবিদের? উত্তরে শরৎদা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ” আমার তো মনে হয় গিনসবার্গ ভারতে আসার অনেক আগে থেকেই আমাদের ভিতরে কাজ করেছিল এই বোহেমিয়ানা।আর লেখালেখির দিক থেকে দেখলে ও যত না প্রভাবিত করেছে আমাদের তার থেকে ওর ওপরে আমাদের প্রভাব বেশি। ‘এই উত্তরের দ্বিতীয় অংশটা নিয়ে আমাদের মধ্যে দ্বিধা থাকলেও, কৃত্তিবাসীদের জীবনাচরণ যাঁরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানবেন যে,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের মধ্যে এই বোহেমিয়ান জীবন শিকড় চারিয়েছিল বিটনিকদের সঙ্গে পরিচয়ের আগে থেকেই। তাহলে কার প্রভাব পড়েছিল তাঁদের আচরণে?অবশ্যই দুজন যুগান্তকারী কবির, তাঁরা হলেন বোদল্যের এবং র্যাঁবো।
আমার কথায় যাঁদের মনে সন্দেহ থেকে যাবে তাঁদের বলব যে,আপনারা Lilian Lozak-এর লেখা মতামতের এই অংশটা পড়ে দেখতে পারেন,
‘ The Beatniks paralleled French Bohemian culture and the Romanticism period, though more in morals than in timeline. Poets Arthur Rimbaud and Charles Baudelaire had previously explored these forbidden waters during their lives in France.’
এবার বলুন যে,কৃত্তিবাসের কবিদের কি আমরা Pure poetry-র অনুগামী হিসেবে ধরব না? বোদল্যেরের ছানা বলতে যদি আমরা র্যাঁবো কথিত এই ‘পারনাসিয়ান কবিদের নতুন ঘরানা’, যা কিনা ‘বিশুদ্ধ কবিতা’র কবিদের নির্দেশ করতে চায়, তাকেই বোঝাই। তবে বুদ্ধদেব বসুর সূত্রে বোদল্যেরকে জানা এবং অরুণ মিত্র,লোকনাথ ভট্টাচার্যদের সূত্রে র্যাঁবোকে জানার অব্যবহিত পরেই তাঁদের বিপুল প্রভাব যে বোহেমিয়ানার দিকে কৃত্তিবাসীদের আরও বেশি করে আকৃষ্ট করবে এতে আর আশ্চর্য কী!এখন কথা হল, র্যাঁবো কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে দোলা দিয়েছেন কৃত্তিবাসী কবিদের ঠিক পরের দশকে লিখতে আসা বাংলার হাংরি কবিদের এবং সেইসঙ্গে তুষার রায়,শামসের আনোয়ার থেকে আরও পরের সাতের দশকের তুষার চৌধুরী হয়ে আটের কবি প্রজিত জানাকে ছুঁয়ে একেবারে শূন্য দশকের নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও।সুতরাং বাংলা কবিতার ঐতিহ্য বলতে এই ফরাসি এবং আমেরিকান কবিদের Pure poetry movement -কেও অন্তত সামান্য জায়গা দিতেই হবে।
এখন আসল কথাটা হল, তাহলে এই ডেকাডেন্সের বিরুদ্ধে হঠাৎ এমন খাপ্পা হয়ে উঠলেন কেন অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র এবং অমিতাভ গুপ্ত আর তাঁদের অনুগামীরা? এটার কারণ আমি আগের লেখায় খোঁজার চেষ্টা করেছি।এই লেখায় আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলতে চাই যে,কবি গৌতম বসু এবং অমিতাভ গুপ্ত দুজনের মূলত আপাত ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলাদা পথের মনে হলেও তাঁদের মূল জায়গাটা কিন্তু এক। সেটা হল,তাঁরা মনেই করেন না যে কবিতা হল সত্যের খোঁজ। ‘কবিতা কি সত্যের খোঁজ?’এই শিরোনামে ঐহিক পত্রিকা আয়োজিত একটি আলোচনা-সভায় গৌতমদার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেই আলোচনায় গৌতমদা স্পষ্টই বলেন যে, সত্য বলে কিছু আছে বলেই তিনি মনে করেন না।এটাই যদি সত্য সম্পর্কে তাঁর অভিমত হয় তাহলে তাঁকে এই Pure poetry movement -এর সন্তান বলা যায় কী?এই প্রশ্নে এসে আমিও থমকাই কারণ বাকি বৈশিষ্ট্যগুলির ক্ষেত্রে তাঁর কবিতা এবং ভাবনাচিন্তাগুলো হুবহু Pure poetry -র আদলের সঙ্গে মিলে যায়। এবার কথা হল, অমিতাভ গুপ্ত তাঁর উত্তর-আধুনিক কবিতা সংক্রান্ত স্বঘোষিত তত্ত্বে এই গৌতম বসুকে লগ্ন করে নিয়েছেন। অমিতাভ গুপ্তর উত্তর-আধুনিক অধুনা উত্তর-চেতনা নাম নিয়েছে;কিন্তু সেই ব্যাপারটায় কেন যে বিশুদ্ধতাবাদী কবিরা থাকবেন, সেটা আমার চেতনার প্রশ্নে কোনও উত্তরই দিতে পারে না।
সে যাই হোক,এখন কথাটা হচ্ছে মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, ফাল্গুনি রায়ের কবিতায় কি Pure poetry movement -এর উত্তরাধিকার নেই?অবশ্যই আছে।চিৎকার করে অস্বীকার করলেই কোনও বাস্তবতা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে না। আমরা এই সূত্রে যদি মলয় রায়চৌধুরীর লেখা ‘জ্যঁ আঁতুর র্যাঁবো’ বইটা পড়ে নিই তাহলে বুঝতে পারব যে কতো গভীর শ্রদ্ধায় তিনি র্যাঁবোর এই জীবনীমূলক বইটি লিখেছেন।বাংলায় যে বিশুদ্ধতাবাদীরা হাংরিদের প্রতি খড়্গহস্ত তাঁদের মূল সমস্যা হল কবিতায় যৌনতাকে খোলাখুলি বিষয়ীকরণ।তাঁদের এমন একটা সন্ন্যাসীভাব যেন যৌনতা ব্যাপারটা সত্যের থেকে বিচ্যুত। তাঁদের আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ফ্রয়েডিয়ান মনস্তত্ত্ব।এই ঘটনাটা ঘটে সম্ভবত মনস্তত্ত্ব ব্যাপারটাকেই মন দিয়ে না পড়ার কারণে। তাঁরা দেখি ফ্রয়েড থেকে লাকাঁ কারোর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেই খুশি নন। এমনকি ফুকোর কথা উঠলেই তাঁরা রে-রে করে ওঠেন। অথচ একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেই দেখবেন যে,তাঁদের কবিতায় কীভাবে যৌনতাজাত ক্ষমতা অথবা ক্ষমতাজাত যৌনতার সংক্রমণ এবং প্রতিরোধের বিন্দুগুলো ঝলমল করছে। ফেসবুকের কল্যাণে আবার ইদানীং তাঁদের কাউকে কাউকে বিভিন্ন পোস্ট দিতেও দেখা যায়। এঁদের পোস্টগুলো একটু পুঙখানুপুঙখ বিশ্লেষণ করলে তাঁদের ওই ক্ষমতা আর খ্যাতিলিপ্সার প্রবল কামেচ্ছাকে আপনি অনুভব করতে বাধ্য।
যাক সেসব কথা।এখন ব্যাপারটা হচ্ছে যে,এই যে ডেকাডেন্স চর্চার বিরুদ্ধমত যা কিনা এই ২০২৩ সালেও কোথাও কোথাও প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি পড়ছে তা তার জন্মমুহূর্তে সে কেমন নিন্দাবাদের সম্মুখীন হয়েছিল সেটা নিশ্চয়ই আপনাদের স্মরণে থাকবে।সেইসময় অন্তত এই বাংলার কল্লোল যুগের কবিদের বিরুদ্ধে যে অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল তার উত্তর দিয়েছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র।’যেখানে দাহ সেখানেই তো দ্যুতির সম্ভাবনা, যেখানে কাম সেখানেই তো প্রেমের আবির্ভাব।’ — লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র ; কিন্তু কেউ বলতেই পারেন যে,ভারতীয় ঐতিহ্য তো কামের কথা বলে না,বরং বলে, ‘ আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা তারে বলি কাম/কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা ধরে প্রেমনাম।’ তাহলে সত্য তো কামের ভিতরে নেই, কৃষ্ণরূপী সত্য তো প্রেমের ভিতরে!এই কথার উত্তরে বলি যে,ঐতিহ্য বলতে যদি আদিকাল থেকে বয়ে আসা সংস্কৃতিকে বোঝায়, তাহলে দেখতে হবে যে ভক্তিবাদী এই কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছার তত্ত্বও এসেছে যে তত্ত্ব থেকে সেটি হল উপনিষদ।সেখানে আবার বলা হচ্ছে, ‘ স: অহম’ অর্থাৎ সে-ই আমি। তাহলে আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছার স্থূল ধারণায় আটকে না থেকে আসলে আত্মার গভীরে ডুব দেওয়াকেই ঐতিহ্য -অনুসারে সত্যের পথ বলা যায় না কি? ভারতীয় তন্ত্রদর্শনেও তো এই তনুকে ত্রাণ করার কথাই বলা হয়েছে। একইসঙ্গে বলতে হয় যে,তন্ত্রচর্চায় আবার কাম যোগসাধনার একটি পথ।এই কাম সম্পর্কে মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণই বা কী বলেছেন। তিনি অর্জুনকে বলছেন যে,সন্ন্যাস মানে যে ত্যাগের প্রতীক সেই ত্যাগ আসলে কর্মের যতি নয়, বরং কর্মফলের আশা না করে কর্ম করে চলার মধ্যেই ত্যাগের স্ফূর্তি।সুতরাং হে বিশুদ্ধতাপ্রিয় বঙ্গকবিগণ অহেতুক ইউরোপের দর্শনচর্চাকে ভয় পাবেন না,মনে রাখবেন যে,ভারতীয় দর্শনের অমৃত থেকেই তাঁরা নিজস্ব চেতনায় উন্নীত হতে পেরেছেন।তাই,ভারতীয় দর্শনকে যাঁরা এগিয়ে দিলেন তাঁদের গন্তব্যসীমাকে অতিক্রম করে যদি নতুন কিছু ভাবতে হয়, তবে তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে পাঠ ও অনুধাবন করার চেষ্টা করাটা জরুরি।
প্রসূন মজুমদার
পেশা – বিদ্যালয় শিক্ষকতা
প্রকাশিত কবিতার বই —
১) অসুখ ও আরোগ্য (২০০৬)
২) অধরে গোখুরদন্ত ( ২০১৫)
৩) রাত্রিচর বুনোচাঁদ ( ২০১৭)
৪) নিষ্ফলতাপ্রিয় ফুল ( ২০১৯)
৫) গন্তব্য ধূসর বুনোহাঁস ( ২০২২)
প্রকাশিত প্রবন্ধের বই
১) অপরাপর কবিতাসফর ( ২০১৮)
২) বাংলা কবিতার জয় — শংসা ও সংশয় (