ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে ৭০ হাজার বছর আগে। সে ঘটনায় আগ্রাসনকারীর ভূমিকায় ছিল আফ্রিকার একদল মানুষ, বিজ্ঞানীরা যাদের প্রথম অঙ্গসংস্থানিকভাবে আধুনিক মানুষ (First Anatomically Modern Human বা AMH) হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন এবং আগ্রাসিতের ভূমিকায় ছিল তাদেরই জিনতুতো বেরাদার নিয়ানডারথল মানুষরা (হোমো নিয়ানডারথলেন্সিস)এবং অন্যান কিছু মানবগোষ্ঠী। আগ্রাসনকারী এবং আগ্রাসিত, সকলেই ছিল হোমো বর্গের (Genus Homo)। কেবল আলাদা আলাদা প্রজাতি (Species)। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা উন্নত জীবনের খোঁজে বার বার অতিক্রম করে গেছে মহাদেশের সীমা। সেই মাইগ্রেশন বা পরিযানগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই ছিল খুব বড় আকারের। যেমন কুড়ি লক্ষ বছরের আগে আফ্রিকা থেকে হোমো ইরেক্টাসদের পরিযান। এদের একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এশিয়ার ভূখণ্ডে। তারা এসেছিল এখন যেখানে লোহিত সাগর সেই এলাকা দিয়ে। সে সময় হিমযুগের কারণে সম্ভবত লোহিত সাগর জমাট বেঁধে ছিল। [ইয়োসিন যুগে (৫.৬-৩.৩৯ কোটি বছর আগে) আফ্রিকান প্লেট এবং আরব প্লেটের মধ্যে ফাটল দেখা দেয়। সেটাই চওড়া হতে হতে আজকের লোহিত সাগর তৈরি হয়েছে।] কিন্তু হোমো ইরেক্টাসদের দল এশিয়া এবং ইউরোপের বহু অঞ্চলে পৌঁছোলেও সমস্ত পৃথিবী দখল করতে সফল হয়নি।
সাধারণত পরিযানগুলো ঘটত অপেক্ষাকৃত সহনযোগ্য জলবায়ুতে (ব্যতিক্রমও ছিল)। ২৬ লক্ষ থেকে ১১,৭০০ বছর আগে পর্যন্ত ছিল শেষ হিমযুগ। হিমযুগে পৃথিবীর জলের অনেকটাই বরফ-বন্দী ছিল (বরফের চাঙড়গুলো হত দু-তিন মাইল বা তার থেকেও বেশি মোটা আর লম্বায় চওড়ায় একেকটা মহাদেশের সমান)। ফলে বাস্পীভবন হত কম, বৃষ্টিও কম। চারিদিকে ধূ ধূ বরফের মরুভূমি। সবুজের চিহ্ণ নেই কোথাও। এইরকম চরম আবহাওয়া পরিযানের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। কিন্তু দীর্ঘ হিমযুগগুলোর মধ্যেও এমন কিছু সময় থাকত যখন শীতের প্রকোপ কিছুটা কমত। এগুলোকে বলা হয় ইন্টারগ্লেসিয়াল বা অন্তর্হিমযুগ। যেমন ২ লক্ষ ৪৩ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৯১ হাজার বছর এবং ১ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ৭১ হাজার বছর পর্যন্ত ছিল দুটি অন্তর্হিমযুগ। এই দুই সময়কালে আফ্রিকা থেকে ইউরেশিয়ায় হোমো সেপিয়েন্সদের দুটো বড় পরিযানের ঘটনাকে চিহ্ণিত করা গেছে। সে যুগে না ছিল পাসপোর্ট না ভিসার ঝামেলা। ফাঁকি দিতে হত না সীমান্তরক্ষীর উঁচনো হাতিয়ারকে। তাই যাতায়াত যে লেগেই থাকত তা বলা বাহুল্য। একটা কথা মনে রাখতে হবে, কোথাও পৌঁছোনোর নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে পরিযানগুলো ঘটত না। আদিম মানব কেবলমাত্র জীবনধারণের প্রয়োজনে নিজেদের বিচরণভূমির বিস্তার ঘটাত। ফলে পরিযানগুলো ঘটত ধীরে ধীরে, হাজার হাজার বছর ধরে। তার মধ্যে ফৌত হয়ে যেত কত কত প্রজন্ম।
৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে এশিয়ার দিকে হোমো সেপিয়েন্সদের (AMH) যে আউট অফ আফ্রিকা (AoA) মাইগ্রেশনটি ঘটেছিল, সামগ্রিক প্রভাবের দিক থেকে তারচেয়ে বড় কোনো আগ্রাসনের ঘটনা মানবেতিহাসে নেই। এই গোষ্ঠীটিরই উত্তরাধিকারী আমরা, অর্থাৎ আধুনিক মানুষ। হোমো সেপিয়েন্সদের তার আগের যে বিস্তারের কথা উপরে বলা হল তারা শেষমেশ বিবর্তনের লড়াইতে টিকে থাকতে পারেনি। আমাদের সঙ্গেও তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
AoA যে সময়ের ঘটনা সেসময় ইউরোপ এবং ইউরেশিয়া জুড়ে রাজত্ব করছে নিয়ানডারথলের দল। চেহারায় তারা সেপিয়েন্সদের তুলনায় বড়সর। শক্তিশালী সুগঠিত পেশী। উঁচু ভ্রূ-রেখা। বিবর্তনের ধারায় ৩.৫ – ৪ লক্ষ বছর আগে এরা আলাদা হয়ে গিয়েছিল সেপিয়েন্সদের থেকে [এ বিষয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০১৭ সালে মরোক্কোর সাফি সহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জেবেল ইরহোউদ (Jabel Irhoud) গুহা থেকে যে করোটিটি উদ্ধার হয় সেটি হোমো সেপিয়েন্সের বলে বিজ্ঞানীরা চিহ্ণিত করেন। এটির বয়স নির্ধারিত হয় ৩ লক্ষ বছর যা এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হোমো সেপিয়েন্সের প্রাচীনতম চিহ্ণ]। এছাড়াও নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য অন্যান্য মানবগোষ্ঠী যাদের অনেককে আমরা খুঁজে পেয়েছি (ডেনিসোভিয়ান, হোমো ফ্লোরিসিয়েন্সিস ইত্যাদি) আবার অনেকেই এখনও আত্মগোপন করে আছে ভবিষ্যতের পুরাতাত্ত্বিক খোঁজকে পুরস্কৃত করার অপেক্ষায়।
বর্তমানে পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী সকলেই যে আফ্রিকান বংশদ্ভুত তার জেনেটিক প্রমাণ প্রথম দেন অ্যালেন উইলসন এবং সহবিজ্ঞানীরা (১৯৮৭)। মানুষের মাইটোকনড্রিয়ায় উপস্থিত ডিএনএ-র সিকোয়েন্সিং-এর মধ্যমে তাঁরা মানব-বিবর্তনের শাখাপ্রশাখাগুলোকে আবার নতুন করে আঁকেন। মোটামুটি ২ লক্ষ বছর আগে বাকি হোমোদের থেকে হোমো সেপিয়েন্স গোষ্ঠী আলাদা হয়ে গিয়েছিল। প্রথম নারী যাঁর সন্তানসন্ততি সেপিয়েন্স শাখার সৃষ্টি করেছিল বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছেন ‘মাইটোকনড্রিয়াল ইভ’। এই শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন রজার লিউইন নামে এক সাংবাদিক (১৯৮৭)। পরবর্তী সময়ে আরও সূক্ষ্ম হিসেবনিকেশ করে দেখা গেছে ২ লক্ষ নয়, মোটামুটি ১ লক্ষ ৬০ হাজার বছর আগে মাইটোকনড্রিয়াল ইভ, আমাদের আদি মাতা, পৃথিবীর বুকে বিচরণ করেছিলেন।
মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ-র গুরুত্ব এই প্রেক্ষিতে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক। আমাদের নিউক্লিয়াসে যে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে তার প্রতিটা, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত একটিই ডিএনএ ডবল হেলিক্স। ডিএনএ তৈরি হয় অ্যাডেনাইন, গুয়ানাইন, থায়ামিন এবং সাইটোসিন— এই চাররকম রাসায়নিক অণু (নিউক্লিওটাইড) পর পর জুড়ে। একেকটা ক্রোমোজোমে কয়েক কোটি এইরকম অণু থাকে। প্রাকৃতিক কারণে (অথবা কৃত্রিম উপায়ে) এই অণুগুলি পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন ধরা যাক যেখানে অ্যাডেনাইন ছিল সেই জায়গা গুয়ানাইন দখল করল। এই ঘটনাকে বলে মিউটেশন। নিউক্লিয়াসের মত কোষের মাইটোকনড্রিয়াতেও কিছু ডিএনএ থাকে। সেগুলো দেখতে চুড়ির মত, গোলাকার। মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ মায়ের শরীর থেকে সন্তানসন্ততির শরীরে সঞ্চারিত হয়। ছেলে বা মেয়ে কেউই বাবার মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ পায় না। মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ-’র দৈর্ঘ্য যেহেতু তুলনামূলকভাবে বেশ কম সেহেতু বিজ্ঞানীদের পক্ষে এটি সিকোয়েন্সিং করে নিউক্লিওটাইডের শৃঙ্খলে কার পর কে উপস্থিত আছে তা নির্ধারণ করা সহজ হয়েছিল। ১৯৮০ বা ১৯৯০-এর দশকের প্রযুক্তিতে মানুষের পুরো জিনোম (এক সেট ক্রোমোজোমকে বলা হয় জিনোম। মানুষের ক্ষেত্রে ২৩টি) সিকোয়েন্সিং সম্ভব ছিল না। মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ-’র মিউটেশন রেট মোটামুটি নির্দিষ্ট হওয়ার কারণে মিউটেশন সংখ্যার তারতম্য দেখে দুটি জীব বিবর্তনের পথে কতদিন আগে পরস্পরের থেকে পৃথক হয়ে গেছে তা নির্ণয় করা সম্ভব। একে বলা হয় ‘মলিকিউলার ক্লক’।
প্রাথমিকভাবে মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ পর্যবেক্ষণ করেই আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশনের সময় নির্ধারণ করা হয়। সেটা কেমনভাবে করা হয়েছিল, আসুন দেখে নিই। জিনে একটি নির্দিষ্ট মিউটেশন বহনকারী সমস্ত মানুষকে একটি হ্যাপ্লোগ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়। নন-আফ্রিকান সমস্ত মানুষ L3 নামে একটি মাইটোকনড্রিয়াল হ্যাপ্লোগ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। ৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকাতে এই হ্যাপ্লোগ্রুপটির উৎপত্তি। এছাড়াও সেখানে আরও প্রাচীন ১৫টি হ্যাপ্লোগ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন, L0, L1, L1a, L1c ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর কোনোটিরই অস্তিত্ব আফ্রিকার বাইরে কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে নেই। অর্থাৎ, আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশনের ঘটনাটি কোনোভাবেই ৭০ হাজার বছরের আগের ঘটনা হতে পারে না। L3-এর দুটি সাবহ্যাপ্লোগ্রুপ অর্থাৎ, শাখা রয়েছে— N ও M । N-এর উদ্ভব ৬১ হাজার বছর আগে এবং M-এর ৪৫ হাজার বছর আগে। N-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাখা R যা আরও পরবর্তী সময়ের উদ্ভব। বর্তমান এশীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে N, M এবং R— তিনটি হ্যাপলোগ্রুপের অস্তিত্ব থাকলেও ইউরোপের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে M অনুপস্থিত। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে এশিয়া থেকে পরিযায়ীদের যে শাখাটি ইউরোপে প্রবেশ করেছিল সেটি ৪৫ হাজার বছরের আগেই মূল গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
Y ক্রোমোজোমের তথ্যও মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ-র তথ্যকে সমর্থন করে। Y ক্রোমোজোম পিতা থেকে পুরুষ সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। আফ্রিকা থেকে উদ্ভব ঘটা CT হ্যাপ্লোগ্রুপের তিনটি সাবহ্যাপ্লোগ্রুপ C, D এবং F-এর যেকোনো একটি পৃথিবীর বাকি অংশের পুরুষদের মধ্যে উপস্থিত। অর্থাৎ, যে মানুষটার মধ্যে প্রথম CT হ্যাপ্লোগ্রুপের উদ্ভব ঘটেছিল তিনিই আমাদের সকলের আদি পিতা (আফ্রিকায় CT হ্যাপ্লোগ্রুপের বাইরেও পুরুষ রয়েছে)।
পথেই হবে পথ চেনা
এবার দেখা যাক আফ্রিকা থেকে সেপিয়েন্স গোষ্ঠীর নিষ্ক্রমণ ঘটেছিল কোন পথে। আফ্রিকা থেকে ইউরোপের মাটিতে পৌঁছোনোর মোট চারটি সম্ভাব্য রাস্তা। মরোক্ক থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে স্পেন; অথবা তিউনিশিয়ার উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে সরু অংশ টপকে সিসিলি পৌঁছোনো। কিন্তু এই দুটি পথ যে আফ্রিকা থেকে পরিযানের জন্য কখনও সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আরেকটি হল স্থলপথ— ইজিপ্ট থেকে সিনাই পেনিনসুলা হয়ে আজ যেখানে সুয়েজ খাল সেই ভূখণ্ডের উপর দিয়ে লেভান্ট (Levant: সিরিয়া, জর্ডন, লেবানন এবং ইজরায়েল)। চতুর্থটি জলপথ— লোহিত সাগরের একেবারে দক্ষিণ বিন্দু বাব এল মানডেব খাঁড়ি পেরিয়ে ইয়েমেন। পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য অনুযায়ী এই দুটি পথ বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যে সময়ের কথা হচ্ছে সে সময় আবহাওয়া মোটেই নতুন দেশে পাড়ি দেওয়ার উপযুক্ত নয়। তখন সবেমাত্র অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ার একটি পর্ব সমাপ্ত হয়ে (১ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ৭১ হাজার বছর ) আবার চরম শীতের রাজত্ব শুরু হয়েছে। কিন্তু তাও পরিযান ঘটল কেন? বিজ্ঞানীদের মতে আবহাওয়া প্রতিকূল হলেও শীতের কারণে জল যেহেতু বরফ অবস্থায় ছিল সেহেতু সাগর মহাসাগরের জলস্তরও নেমে গিয়েছিল অনেকটা। বর্তমানে বাব এল মান্ডেব তিরিশ কিলোমিটার চওড়া। হিমযুগে এর বিস্তার আরও কম ছিল। কিন্তু এমন কোনো পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনও পর্যন্ত নেই যা থেকে দাবী করা যায় যে ওই মানুষরা নৌকা বা ভেলা জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে জানত। কিন্তু এটা অনুমান করাটা বাড়াবাড়ি হবে না যে উপকূলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী হিসেবে তারা জলে ভাসমান কিছুর ব্যবহার জানত।
এখন প্রশ্ন হল ইজিপ্ট-লেভান্ট এবং বাব এল মান্ডেব— দুটি পথই কি ব্যবহৃত হয়েছিল? ২০১৮ সালে পুরাতাত্ত্বিকরা ইজরায়েলের মিসিলিয়াতে (Misiliya) চোয়াল এবং দাঁতের অস্তিত্ব খুঁজে পান যা ১ লক্ষ ৮০ হাজার বছরের পুরনো। এর আগে আফ্রিকার বাইরে আধুনিক মানুষের যে অস্তিত্ব জানা ছিল তা ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার বছরের প্রাচীন। সেই ফসিলও আবিষ্কার হয়েছে ইজরায়েলের Shhul এবং Qafzeh গুহায়। এই সবগুলোই আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশনের সময়কালের থেকে বহু আগের ঘটনা! আমরা আগেই দেখেছি যে আমাদের আলোচ্য আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশনের আগেও হোমো সেপিয়েন্সদের একাধিক আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশন ঘটেছিল। এই ফসিলগুলো তাদেরই স্মৃতি বহনকারী। ইজরায়েল অঞ্চলে হোমো সেপিয়েন্সের অস্তিত্ব থেকে অনুমান করাই যায় যে এশিয়ায় তারা প্রবেশ করেছিল তৃতীয় পথ অর্থাৎ ইজিপ্ট-লেভান্টের পথে। কিন্তু এদের অবলুপ্তি ঘটল কেন? ভূতাত্ত্বিক সক্ষ্য অনুযায়ী মোটামুটি ৮০ হাজার বছর আগে সিনাই এবং সাহারা অঞ্চল পরিণত হয় ভয়ঙ্কর মরুভূমিতে। ওদিকে উষ্ণ আবহাওয়ার খোঁজে নিয়েনডারথলদের ক্রমাগত দক্ষিণমুখী পরিযান ঘটছিল। পিছিয়ে আসার পথ মরু-রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় শক্তিশালী নিয়ানডারথলদের সঙ্গে লড়াইয়ে সেপিয়েন্সদের অবশ্যম্ভাবী হার হয়েছিল। লেভান্ট অঞ্চলে এর পর সেপিয়েন্সদের যে অস্তিত্ব পাওয়া গেল তা আরও ৩০ হাজার বছর পর অর্থাৎ, ৫০ হাজার বছর আগে।
অন্যদিকে ২০১৮ সালে উত্তরপূর্ব আরবের আল উয়স্তা (Al Wusta) নামে একটি প্রাগৈতিহাসিক লেকের কাছে ৮৮ হাজার বছরের প্রাচীন আধুনিক মানুষের আঙুলের ফসিল আবিষ্কার হয়। এখন আরব জুড়ে মরুভূমি হলেও সেসময় সেখানে দশ হাজারেরও বেশি মিষ্টি জলের লেকের অস্তিত্ব ছিল। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের পুরাতত্ত্ববিদ মাইকেল পেট্রাগ্লিয়ার জানিয়েছেন যে এই লেকগুলির আশেপাশে বহু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের অস্তিত্ব রয়েছে। এক্ষেত্রেও এটা কষ্টকল্পনা হবে না যে হোমো সেপিয়েন্সের দল চতুর্থ পথ অর্থাৎ, বাব এল মান্ডেবও ব্যবহার করেছিল। কিন্তু এরাও মুখোমুখি হয়েছিল গণঅবলুপ্তির। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে ৮০ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলটিও সবুজ থেকে ক্রমশ ধূসর মরুভূমিতে পরিণত হয়। ফলে সেপিয়েন্স গোষ্ঠী জীবনধারণের উপকরণের খোঁজে সম্ভবত দক্ষিণের পথ ধরে। হয়তো তারা ভারত, পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকী হয়তো অস্ট্রেলিয়াতেও। কিন্তু অনেকগুলি কারণের সম্মিলিত প্রভাবে তাদের সম্পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে। কারণগুলির মধ্যে প্রধান ছিল ৭০ হাজার বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার টোবা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত । গত ২০ লক্ষ বছরের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের ঘটনা। এর প্রভাব এশিয়াতে তো বটেই আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। পুরু ছাইয়ের আস্তরণে ঢেকে গিয়েছিল সমস্ত অঞ্চল। বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব হয়েছিল মারাত্মক।
হোমো সেপিয়েন্সদের মতই অন্যান প্রাচীনতর হোমো প্রজাতিগুলোও সম্ভবত এই দুটি পথ ব্যবহার করত। ইউরোপ ও এশিয়ায় যাদের উত্তরাধিকারী ছিল নিয়েন্ডারথল, ডেনিসোভিয়ান ইত্যাদি মানবগোষ্ঠী।
৭০ হাজার বছর আগের আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশনটি কোন পথে ঘটেছিল সেটা অনুমান করতে হলে দুটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথমটি অবশ্যই জলবায়ুর অবস্থা। অর্থাৎ সেসময় কোনো ইন্টারগ্লেশিয়াল চলছিল কি না। দ্বিতীয়টি হল নিয়ান্ডারথলদের উপস্থিতি। এটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেপিয়েন্সরা যদি ল্যাভেন্টের পথে এশিয়ায় প্রবেশ করত তবে অবশ্যই তাদের আগের পরিযায়ীদের মত নিয়ান্ডারথলদের মুখোমুখি হতে হত। ইউরেশিয়ার প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সেপিয়েন্সদের তুলনায় নিয়ান্ডারথলরা অনেক বেশি অভিযোজিত ছিল। ফলে আগের মত এবারেও সেপিয়েন্সদের পরাজয়ের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। তাছাড়া এই পথে যদি তারা আসত তবে তার কিছু চিহ্ণ হয়তো পাওয়া যেত। কিন্তু ওই অঞ্চল থেকে ৫০ হাজার বছরের বেশি প্রাচীন AMH-দের উপস্থিতির কোনো প্রমাণ এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।
আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশনের সময়টিতে কোনো ইন্টারগ্লেসিয়াল চলছিল না। ফলে ওই সময় বাব এল মান্ডেব খাঁড়ির ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য হ্রাস পেয়ে মোটামুটি ১০ কিলোমিটার মত হয়েছিল। তাছাড়া উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় এলাকাটি ছিল অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এবং বৃষ্টির কৃপাধন্য। তাই এই পথেই সেপিয়েন্সদের এশিয় ভূমিতে পদার্পণ ঘটেছিল বলে বিজ্ঞানীদের দৃঢ় অনুমান। পরবর্তী আলোচানায় আমরা দেখব পৃথিবীর অন্যান অঞ্চল থেকে সংগৃহীত পুরাতাত্ত্বিক তথ্য এই অনুমানকেই সমর্থন করে।
সেপিয়েন্সের দল আরব ভূমিতে পা তো ফেলল। তারপর?
জীবনপুরের পথিকরে ভাই…
২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরে Madjedbebe গুহায় আবিষ্কৃত হয় আধুনিক মানুষের ব্যবহৃত খল নুড়ি কুঠার ইত্যাদি। অস্ট্রেলিয়ায় যেহেতু আগে কোনোদিনই কোনো হোমো প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল না সেহেতু ওগুলো যে সমুদ্র পেরিয়ে বসতি স্থাপন করা হোমো সেপিয়েন্সদেরই ব্যবহৃত জিনিস সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। জিনিসগুলোর বয়েস নির্ধারিত হয়েছে ৫৯ হাজার ৩০০ বছর থেকে ৭০ হাজার ৭০০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ এই টাইম স্কেলের মধ্যবিন্দু ৬৫ হাজার বছর ধরে নিলে সে সময় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সেপিয়েন্সদের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
আবার ওই ২০১৮তেই ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের লিডা আজের (Lida Ajer) গুহা থেকে উদ্ধার হওয়া আধুনিক হোমো সেপিয়েন্সের দুটি দাঁতের বয়েস নির্ধারিত হয়েছে ৬৩ হাজার থেকে ৭৩ হাজার বছরের মধ্যে।
এই দুটি তথ্য থেকে বলা যায় যে আফ্রিকা থেকে ৭০ হাজার বছর আগে নিষ্ক্রান্ত হয়ে সেপিয়েন্সের দল পাঁচ-সাত হাজার বছরের মধ্যেই অতিক্রম করেছিল এক দীর্ঘ পথ। এই অনুমানের সপক্ষে কি অন্য আর কোনো প্রমাণ রয়েছে? সে আলোচনায় আমরা পরে আসছি।
আগে দেখে নেওয়া যাক আরবের পশ্চিম প্রান্ত ইয়েমেন থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত তারা কীভাবে গিয়েছিল। সম্ভবত তারা এগিয়েছিল উপকূল বরাবর। উপকূলীয় পথের দুটি সুবিধা। প্রথমত, এই পথে জীবনধারা এবং খাদ্যপ্রণালীর খুব একটা পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে না। সমস্ত পথ জুড়ে মোটামুটি একইরকম আবহাওয়া এবং খাদ্য উপলব্ধ। পথের সাথী সমুদ্র সরবরাহ করে মাছ, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, দিক নির্ণয়ের ঝামেলা থাকে না। পথ হারিয়ে একই জায়গায় ঘুরপাক খাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয় উপকূল থেকে ভিতরে ঢুকে এলে।
এই মানুষের দল যে দ্রুত গতিতে এগিয়েছিল তার প্রমাণ রয়ে গেছে আমাদের জিনে। যেমন ধরা যাক ভারতে প্রবিষ্ট জনগোষ্ঠীটির মধ্যে M হ্যাপ্লোগ্রুপটি রয়েছে। এরা যদি কয়েক হাজার বছর এখানে বিশ্রাম নিত তাহলে মিউটেশনের ফলে M থেকে অনেকগুলি সাবহ্যাপ্লোগ্রুপ তৈরি হত। পরবর্তী পরিযানে যে মানবগোষ্ঠী বেরোত তাদের মধ্যে সেই সাবহ্যাপ্লোগ্রুপগুলি উপস্থিত থাকত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে M হ্যাপ্লোগ্রুপটিতে তেমন উল্লেখযোগ্য মিউটেশন জমা হওয়ার আগেই তা পৌঁছে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। এই সমস্ত সূত্র একত্রিত করেই বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ভারতের মাটিতে আধুনিক মানুষের পদার্পণ ঘটে মোটামুটি ৬৫ হাজার বছর আগে।
এ তো গেল দক্ষিণ এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার কথা। কিন্তু ইউরোপের কী হল? ৪৫ হাজার বছরের আগে সেখানে আধুনিক মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ নেই। আরবের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে ইউরোপে প্রবেশের দুটি প্রবল দুটো প্রবল বাধা ছিল। বিশ্বের বৃহত্তম মরু রাব আল খালি এবং ইরানের জাগরোস ও টরাস পর্বত। বিজ্ঞানীদের মতে সেপিয়েন্সদের একটা অংশ এই পথ ব্যবহার না করে পূর্ব দিকে হেঁটে আজকের পাকিস্তান, সিন্ধু উপত্যকা হয়ে মধ্য এশিয়ায় পৌঁছোয়। আরব পেনিনসুলায় রয়ে যাওয়া অংশ ৫৭ হাজার বছর আগে ফের একটা ইন্টারগ্লেসিয়াল শুরু হলে পশ্চিম দিকে এগিয়ে জাগরস পর্বত পেরিয়ে টার্কি সিরিয়া ইজরায়েল এবং শেষমেশ ইউরোপে প্রবেশ করে। আধুনিক মানুষের এটাই ইউরোপের মাটিতে প্রথম পা রাখা। ওদিকে মধ্যে এশিয়ায় পৌঁছোনো গোষ্ঠী দ্বিতীয় আরেকটি পরিযানের মধ্যমে ৩০ হাজার বছর আগে ইউরোপের মাটি ছোঁয়।
মধ্য এশিয়া থেকে আরেকটি দল এগিয়েছিল উত্তরপূর্বে বেরিনজিয়ার দিকে। আজকে সাইবেরিয়া এবং আলাস্কার মধ্যে যে বেরিং প্রণালী তা অত্যাধিক শীতের কারণে তখন জমাট অবস্থায় ছিল। ফলে তা ছিল এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যে সহজ যোগাযোগের রাস্তা। এই পথেই হোমো সেপিয়েন্সের দল ১৬ হাজার বছর আগে আমেরিকায় প্রবেশ করে। তবে পূর্ব এশিয়ার মানবগোষ্ঠীগুলিও সাইবেরিয়া অঞ্চলে পরিযান ঘটিয়েছিল। মধ্যেশিয়া থেকে আগত মানুষদের সঙ্গে এদের সংমিশ্রণ ঘটে। এই কারণে আমেরিকার আদি মানবগোষ্ঠীগুলির মধ্যে মঙ্গোলীয় প্রভাব বর্তমান। আমেরিকা প্রবেশের দুহাজার বছরের মধ্যেই তারা পৌঁছে গিয়েছিল একেবারে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম বিন্দুতে। এবারেও সম্ভবত সেই উপকূলীয় পথ ধরেই।
অ্যাডভান্টেজ হোমো সেপিয়েন্স
৭০ হাজার থেকে পরবর্তী ৫৫-৬০ হাজার বছরের মধ্যে সমস্ত পৃথিবীতে হোমো সেপিয়েন্সের ছড়িয়ে পড়ার পিছনে কারণ কী ছিল? অন্য হোমো প্রজাতিগুলো কেন সে কাজে সফল হল না? ২০০২ সালে প্রখ্যাত জিনতত্ত্ববিদ Svante Pääbo এবং সহবিজ্ঞানীরা মানুষের FOXP2 জিনে দুটি মিউটেশন খুঁজে পান। তাঁরা অনুমান করেন যে মিউটেশন দুটি সম্ভবত হোমো সেপিয়েন্সেদের অন্য প্রজাতির উপর অ্যাডভান্টেজ দেয়। এই জিনটির মিউটেশনের ফলে যে সিনড্রোমের সৃষ্টি হয় তাতে মানুষের বোধবুদ্ধি (cognitive abilities) স্বাভাবিক থাকলেও জটিল বাক্য তৈরি করার ক্ষমতা থাকে না (হ্যাঁ, এরকম মিউটেশনও ঘটে যাতে জিনটি অকেজো হয়ে যেতে পারে)। অর্থাৎ ভাষার ব্যাকরণ ব্যবহারের ক্ষমতা প্রায় পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। এই জিনটি যে প্রোটিনটিকে কোড করে সেটি গত প্রায় ১০ কোটি বছর ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে (ইঁদুর এবং শিম্পাঞ্জি এই সময়-বিন্দুতে বিবর্তনের ধারায় আলাদা হয়ে গিয়েছিল)। FOXP2 জিনে মিউটেশন দুটি ঘটেছিল যখন এক সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি দুটি আলাদা শাখা হিসেবে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ, এই মিউটেশন দুটি নিয়েন্ডারথল এবং সেপিয়েন্স দুই প্রজাতিতেই উপস্থিত কিন্তু শিম্পাঞ্জিদের নেই। তাই এগুলো সেপিয়েন্সদের অ্যাডভান্টেজ দিয়েছিল একথা বলা যায় না। পরে Pääbo এবং সহবিজ্ঞানীরা বর্তমান সময়ের সেপিয়েন্সের FOXP2 জিনে তৃতীয় একটি মিউটেশন খুঁজে পান যা নিয়ানডারথলের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এটি নিয়ান্ডরথল থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সেপিয়েন্সদের বিবর্তনের অভিমুখ নির্ণয়কারী সম্ভাব্য একটি মিউটেশন হতে পারে। তবে ২০১০ থেকে ২০১৩-এর মধ্যে Pääbo এবং সহবিজ্ঞানীরা নিয়ান্ডারথলের মত অবলুপ্ত মানবগোষ্ঠীগুলির সম্পূর্ণ জিন সিকোয়েন্সিং করে দেখান যে আধুনিক মানুষের জিনে এমন লক্ষ লক্ষ মিউটেশন রয়েছে যা নিয়ানডারথলদের ছিল না (২০১০-এর আগে এই কাজ সম্ভব ছিল না কারণ সেসময় Ancient DNA Technology উন্নত ছিল না)। এই মিউটেশনগুলির কারণেই যে সেপিয়েন্সরা অ্যাডভান্টেজ পেয়েছিল তা বোঝা গেলেও এখনও অব্দি আমরা সেই জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হইনি যা দিয়ে বুঝতে পারব যে মিউটেশনগুলির কারণে জিনের প্রোডাক্ট অর্থাৎ প্রোটিনে কী কী পরিবর্তন এসেছিল এবং তার সুনির্দিষ্ট ফলাফল কী হয়েছিল। এর উত্তর পেতে হলে ম্যানহাটন প্রোজেক্টের মত বিশাল একটি গবেষণা-উদ্যোগ দরকার। যদি সে উদ্যোগ নেওয়া সম্ভবও হয় তাহলেও যে ফলাফল পাওয়া যাবে তা এতই জটিল হবে যে খুব কম মানুষের পক্ষেই তা বোধগম্য হবে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং Ancient DNA Technology গবেষণার সুপরিচিত নাম ডেভিড রিচের মতে এত গবেষণার পরেও হয়তো আধুনিক মানুষের বিহেভিয়রাল মডার্নিটির পিছনে উপস্থিত মলিকিউলার মেকানিজমের কোনো সদুত্তর পাওয়া কখনও সম্ভব হবে না।
মদনের ফুলশর, প্রজাপতি নির্বন্ধ অথবা চিড়িয়াখানা
শত্রুর শেষ রাখতে নেই— এই নীতি মেনেই হয়তো সেপিয়ান্সরা ঝাড়েবংশে শেষ করে দিয়েছিল নিয়ান্ডারথলদের। অথবা প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়ে প্রাকৃতিকভাবেই অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তারা। দুটি কারণের একই সঙ্গে সক্রিয় থাকাই বেশি সম্ভব। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও নিয়ানডারথলরা পরাজিত হয়েছিল সেপিয়েন্সদের দলগত শক্তি এবং উন্নততর মেধার কাছে। দল গঠন এবং পরিচালনার জন্য সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার প্রয়োজন। তার জন্য প্রয়োজন জটিল বাক্য বিন্যাসের। কিন্তু নিয়ান্ডারথলদের তা আয়ত্বে ছিল না। পৃথিবীর বুকে নিয়ান্ডারথলদের শেষ চিহ্ণ পাওয়া গেছে ৩৯ হাজার বছর আগে। অর্থাৎ, আধুনিক সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথল পাশাপাশি বসবাস করেছে কুড়ি পঁচিশ হাজার বছর। তাহলে এই সময় তাদের মধ্যে শুধুই কি ছিল বিসংবাদ? নাকি হৃদয়ে হৃদয়ও বাঁধা পড়েছিল? সেপিয়েন্স তরুণীর কটাক্ষে বুকে তীর বিঁধেছিল নিয়ান্ডারথল তরুণের অথবা উলটোটা? স্পষ্ট উত্তর জানা নেই। কিন্তু দুই প্রজাতির মধ্যে যৌন সম্পর্ক যে গড়ে উঠেছিল তার প্রমাণ রয়ে গেছে নন-আফ্রিকান প্রতিটা আধুনিক মানুষের জিনে। আমাদের জিনের গড়ে দু-শতাংশ নিয়ানডারথল উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। ভাবুন, এমন ঘটনাও ঘটা সম্ভব ছিল যাতে দুটি প্রজাতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠতে পারত নতুন এক প্রজাতি। কিন্তু বিবর্তনের লড়াইতে ততটা সৌহার্দ্য আশা করা অনুচিত হবে।
তবে এমনটা হতেই পারত যে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত না হয়ে নিয়ানডারথল টিকে রইল এই সময় পর্যন্ত। কিন্তু একটা মাত্র পৃথিবীতে দুটো মনুষ্য প্রজাতি! বড় বারাবারি হয়ে যেত না? একটির মধ্যেই হানাহানি কাটাকাটির শেষ নেই!
তাও যদি ধরি টিকেই যেত— কেমন হত তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক? আমরা কি চিড়িয়াখানায় শিম্পাঞ্জির খাঁচার পাশে আরেকটা খাঁচা বাড়াতাম?
তথ্যসূত্র
Tony Joseph. Early Indians. Juggernaut, 2018.
David Reich. Who we are and how we got here. Oxford University Press, 2018.
চিত্র-১ আফ্রিকা থেকে ইউরোপ এবং এশিয়ায় প্রবেশের চারটি সম্ভাব্য পথ। ৭০ হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সের আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশনে ১ ও ২ নং পথ ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। ৩ নং পথটি দিয়ে যদি কিছু মানুষ প্রবেশ করেও থাকে তবে নিয়ানডারথলদের সঙ্গে লড়াইতে তারা অবলুপ্ত হয়ে গেছে বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। পরিযানের মুখ্য পথটি ছিল ৪ নং পথটি। লোহিত সাগরের বাব এল মান্ডেব পেরিয়ে।
চিত্র-২ আদিম পৃথিবীর মুখ্য পরিযানগুলির পথ ও সময়কাল।
চিত্র সৌজন্যে https://pleistoproject.wordpress.com/human-geography/migration/ Accessed 28.09.2021.