‘হাওড়া ব্রিজের চুড়োয় উঠুন
নীচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান –
দুটোই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’
(পাগল / শঙ্খ ঘোষ)
বোকাদের সঙ্গে চালাকি করা বিপদজনক; তার থেকে অনেক বেশি নিরাপদ চালাকদের সঙ্গে চালাকি করা। বোকাদের সঙ্গে চালাকি বেশিরভাগ সময়েই ঘাতক তির হয়ে ফিরে আসে। জন্ম দেয় এমন সব প্রশ্নের যার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল।
এ প্রসঙ্গে কিছুটা পরে আসা যাবে; প্রথমেই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন সেরে নেওয়া যাক। ইংরেজিতে Intelligent, Clever, Cunning শব্দগুলির যেমন পৃথক পৃথক দ্যোতনা রয়েছে বাংলায় বোকা ও নির্বোধ শব্দ দুটির মধ্যেও তেমন সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। বোকা সব সময়ে নির্বোধ নয়; বৃহত্তর সত্যের নিরিখে দেখলে বোকা অনেক সময়েই বিশুদ্ধ Intelligent হতে পারে। এবং তার কাছেই ধরা দিতে পারে জীবনের মহত্তম সত্য। আবার Intelligence মহাকালের নিরিখে আমাদের কোনও বাড়তি সুবিধা আদৌ দিয়েছে কি না সে নিয়ে ‘অদ্ভুত’ ও মারাত্মক প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন স্টিফেন হকিং। ফলে বোকা-চালাক ইত্যাদি নিয়ে যে বিতর্ক তা এক মাত্রিক হতে পারে না। বরং বলা যায় পৃথিবীর গূঢ় দর্শনের একটি ধারা হয়ে উঠেছে সেটি।
‘ফুলস’দের নিয়ে পৃথিবীতে হাজার হাজার উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে; তারা সবাই বিশুদ্ধ ‘ফুলস’। অনেক সময়ে তারা মারাত্মকভাবে জিতেও যায়। চালাকদের পৃথিবীতে যে কত রকমের ছিদ্র রয়েছে, রয়েছে কত কত প্রকারের ফাঁদ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তারা। সে সব উদাহরণ কম-বেশি আমাদের সকলেরই জানা। ঠিক সে ধরণের উদাহরণ নয়; এ লেখার শুরুতে এক অদ্ভুত ‘বোকা’র উল্লেখ করা যাক। তিনি সুফি সাধিকা রাবিয়া-আল-আদাইয়া; অষ্টম শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পৃথিবীর সুফি-সাধনায় তাঁর নাম জ্বলজ্বল করছে।
একবার রাবিয়া ও তাঁর এক সঙ্গিনী উপবাস পালন করছেন। দিনের পর দিন উপবাস চলছে; ঘনিয়ে এল উপবাস ভঙ্গ করার সময়। রাবিয়া ও তাঁর সঙ্গিনী উপবাস ভঙ্গ করবার জন্য খাবারের আয়োজন করতে শুরু করলেন। খাবার প্রস্তুত করতে পেঁয়াজের দরকার; সঙ্গিনী কাছের প্রতিবেশীর কাছ থেকে পেঁয়াজ আনতে ছুটল। তার সাধারণ চিন্তাভাবনা তাকে এই শিখিয়েছে। বাধ সাধলেন রাবিয়া, তিনি চল্লিশ বছর আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নিজের জন্য কারও কাছে হাত পাতবেন না। তিনি সঙ্গিনী’কে বাধা দিলেন।
রাবিয়ার মতো একজন মানুষের বাধার বিপক্ষে যাওয়া অসম্ভব; সঙ্গিনী সে চেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত করলেন।
এ সময়ে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল একটি পাখি; তার ঠোঁট থেকে পেঁয়াজ খসে পড়ল পাত্রে। পরম করুণাময়ের করুণা ছাড়া এ ঘটনা কিছুতেই ঘটতে পারে না; রাবিয়ার সঙ্গিনী অসম্ভব খুশি। সে বারবার রাবিয়া’কে সে কথা বলতে লাগল। রাবিয়া চুপ; তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ‘তাঁর করুণার প্রকাশ হিসাবে এ ঘটনাকে গণ্য করবার কিছুটা কারণ রয়েছে; কিন্তু আমি শুধু ভাবছি তিনি কি শেষ পর্যন্ত পেঁয়াজের কারবারি হিসাবে আমাদের কাছে ধরা দিলেন?’
কথাটির মধ্যে বৃহত্তর এক সত্য রয়েছে; রয়েছে বৃহত্তর সত্য-সন্ধান প্রক্রিয়া। প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর যুক্তি-প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গেলে, রাবিয়া দু’বার বোকামি করেছিলেন। যেখানে প্রতিবেশীর কাছ থেকে সহজেই পেঁয়াজ পাওয়া যেত সেখানে তিনি সঙ্গিনীকে বাধা দিয়েছিলেন সেটি আনতে। এবং পাখির ঠোঁট থেকে যখন পেঁয়াজ খসে পড়েছিল তখন সেটিকে করুণাময়ের ‘কৃপা’ হিসাবে গণ্য করার পরিবর্তে গভীরতর অনুসন্ধানের দিকে চলে গিয়েছিলেন। সাধনার জোরে তাঁর পাত্রে স্বয়ং করুণাময় প্রার্থিত বস্তু নিক্ষেপ করেন পাখির ঠোঁটের মাধ্যমে- এমন একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে নিশ্চয় তাঁর সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ত।
কিন্তু তিনি তো বিরলতম বোকাদের একজন; তিনি পাখির ঠোঁট থেকে হঠাৎ প্রার্থিত বস্তু পাত্রে এসে পড়লেও তাকে করণাময়ের কৃপা বলে ভাবতে পারেন না। তাঁর কাছে করুণাময়ের রূপ যে আরও গভীরতর কিছু; আরও কঠিন তাঁর সন্ধান পাওয়া। এ গভীরের সন্ধানে সত্তার চারপাশে বোকামির আবরণ পরে নেওয়া আবশ্যক হয়তো। খুব চালাক মানুষের সন্ধান ওই পাত্রে প্রার্থিত বস্তুর নিক্ষেপ পর্যন্ত’ই সীমাবদ্ধ থেকে যায়; তার বেশি এগিয়ে যেতে পারে না।
এই প্রক্রিয়ার হাত ধরেই কি জন্ম নিয়েছে কালিদাসের বোকামি সংক্রান্ত লৌকিক কাহিনিগুলি? এ কিন্তু এক গুরুতর প্রশ্ন। শুষ্ক জ্ঞান যে সত্যের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে এবং শিল্প সম্ভবত তারও থেকে দূরের কোনও গন্তব্য। সেখানে যেতে গেলে প্রথাগত জ্ঞানের পথ পরিহার করা ছাড়া অথবা তাকে (সিস্টেমের মধ্যে থাকা পদ্ধতিটিকে) অস্বীকার করা ছাড়া আর কোনও পথ নেই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, কালিদাসের সব বোকামিই শিল্প-সৃষ্টির পূর্বে। পরবর্তী সময়ে তাঁর বোকামির কোনও লৌকিক কাহিনি বিদ্যমান নেই। কালিদাস’কে বোকা হিসাবে প্রতিপন্ন না-করলে তাঁর সৃষ্টির পথটিকে উন্মুক্ত করা যেত না। শুষ্ক জ্ঞানের সঙ্গে বোকামিকে juxtaposed না-করলে শিল্পের বৃহত্তর গণ্ডিটিকে চিহ্নিত করা যেত না।
এবার ইন্টালিজেন্সের প্রশ্নে স্টিফেন হকিং যে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন সে দিকে একবার দৃষ্টি দেওয়া যাক, Is There Other Intelligent Life in the Universe? অংশে তিনি লিখছেন, It is not even clear that intelligence has any long-term survival value. Bacteria, and other single-cell organisms, may live on if all other life on Earth is wiped out by our actions. Perhaps intelligence was an unlikely development for life on Earth, from the chronology of evolution, as it took a very long time—two and a half billion years—to go from single cells to multi-cellular beings, which are a necessary precursor to intelligence.
(Brief Answers to the Big Questions)
-যে ভাবে আমরা এখানে ‘বোকা’ ও ‘বোকামি’কে চিহ্নিত করতে চাইছি তার সঙ্গে হয়তো intelligence -এর সম্পর্ক লিনিয়ার নয়। হতে পারে ইন্টালিজেন্স এবং ‘বোকামি’ দুটি কাছাকাছি অবস্থিত; কিন্তু পৃথক বিষয়। কিন্তু সারা পৃথিবীজুড়ে ইন্টালিজেন্ট মানুষের যে সোনালি অবস্থান তার ভিত্তি’ও কি কেঁপে ওঠে না হকিং-এর কথার অভিঘাতে? হকিং নিশ্চিত নন ইন্টালিজেন্সের লং-টার্ম সারভাইভ্যাল ভ্যালু সম্পর্কে। হয়তো বিবর্তনের পথে ইন্টালিজেন্স একটি আনলাইকলি ডেভলপমেন্ট। আমাদের চালাক মানুষের পৃথিবী থেকে একদিন মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে; কিন্তু তারপরেও থেকে যাবে এক-কোষী প্রাণী, ব্যাকটেরিয়া। অর্থাৎ প্রাণের অস্তিত্বের প্রশ্নে ইন্টালিজেন্স সব থেকে আগে পরাজিত হবে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে; তথাকথিত ইন্টালিজেন্ট মানুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবার সম্ভাব্য কারণের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে পারমাণবিক যুদ্ধ। বোকা তার ধুলোমলিন পায়ে ঘুরতে পারেন পথে পথে একতারা নিয়ে; সুর নিয়ে। তিনি রাজার আমন্ত্রণ হেলায় ফিরিয়ে দিতে পারেন। চালাক মানুষ পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে পারে। বস্তুকে শক্তিতে রূপান্তরিত করার খেলা জানার পর সে নিজেকে উড়িয়ে দিতে পারে তার বিপুল চালাকি দিয়ে। হকিং-এর কথাগুলি পড়তে পড়তে মনে হয়, বিবর্তন মানুষের চালাকির সঙ্গে এ প্রবণতাও বুনে দিয়েছে, হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই।
২
কিন্তু যে কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল লেখাটি- বোকা মানুষের সঙ্গে চালাকি করা বিপদজনক; কখনও কখনও ঘাতক তির হয়ে, গূঢ় প্রশ্ন হয়ে এসে ছারখার করে দিতে পারে স্থিতাবস্থা।
নয়ের দশকের একদম প্রথম দিক; বাংলার গ্রামে গ্রামে একটা-দুটো করে টিভি প্রবেশ করছে। সাদাকালো টিভি; কিছুদিনের জন্য হলেও একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছিল ‘টিভিওয়ালা বাড়িতে সান্ধ্য জমায়েত’-এর। বাড়িতে টিভি রয়েছে অথচ গ্রামের কিছু মানুষ সন্ধেবেলা ভিড় করল না, এটা ভাবা বেশ কঠিন ছিল। এবং বাড়ির দরজাও মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যেত না। বাংলার সামাজিক কাঠামোর তুমুল বিবর্তন তার কিছুটা পর হবে।
সে সময়ের একটা ঘটনা; এক বোকা মানুষের ঘটনা। ব্যক্তিগতভাবে দেখা ও জানা। সন্ধ্যার ‘বাংলা-অনুষ্ঠান’ শেষ হলে দূরদর্শনের রাশ চলে যেত দিল্লির হাতে, শুরু হত হিন্দি-অনুষ্ঠান।
এক আত্মীয়ের বাড়ি টিভি এসেছে বেশ কিছুদিন; নিয়মিত এক প্রৌঢ়া আসেন। গল্পগুজব ও টিভি-দর্শন চলে। অনুষ্ঠান শেষ হলে তিনি বাড়ি চলে যান অন্ধকার পেরিয়ে। কয়েকদিন ধরেই তাঁর মুখে শোনা যাচ্ছে, ছেলে টিভি কিনবে। এবং একদিন সে ঘটনা ঘটল।
প্রৌঢ়া বাড়ি ফিরে দেখলেন অ্যন্টেনা খাটিয়ে টিভি চলছে বাড়িতে; বেশ উৎসব উৎসব আবহাওয়া।
প্রৌঢ়া রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করেছিলেন; ‘ওদের বাড়িতে ‘বাংলা-টিভি’ কিনেছে, আর তুই ‘হিন্দি-টিভি’ কিনে নিয়ে এলি?’
এই ছিল তাঁর বক্তব্য। তাঁকে বোঝানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল যে তাঁর হেঁটে বাড়ি ফিরে আসার সময়টুকুতে কলকাতার হাত থেকে দিল্লির হাতে চলে গেছে অনুষ্ঠান প্রচারের রাশ।
বহুদিন সে প্রৌঢ়া’র পিছনে তাড়া করে বেরিয়েছিল এ ‘বোকামি’র ছায়া।
দু’হাজার বাইশ; রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কভারেজ দেখিয়েই চলেছে দিল্লির একটি টেলিভিশন চ্যানেল। ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র উড়ে যাচ্ছে। চালাক মানুষ, ভয়ংকর চালাক মানুষ ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে চলেছে স্কুলে-হাসপাতালে। কারণ সেখান থেকে পালানো সব থেকে বেশি কঠিন।
শীতের রাতেও ভয়ংকর অস্বস্তি শুরু হয়েছে, টিভি বন্ধ করে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। অন্তত চোখের সামনে হাসপাতাল আর স্কুলে ক্ষেপণাস্ত্রের আছড়ে পড়া দেখতে হবে না।
তাই করেছিলাম এবং ধীরে ধীরে গলা চেপে ধরেছিল কবন্ধ এক ভয়। টিভি বন্ধ করে দিলেও যুদ্ধ তো চলছে, একইভাবে আছড়ে পড়ছে অস্ত্র, কভারেজ করা চ্যানেলের ফ্রিকোয়েন্সি টিভি’র কাছে ঘুরঘুর করছে। চালালেই আবার শুরু হয়ে যাবে সে দৃশ্যের ধারাপাত।
কী অসম্ভব প্যারাডক্স… পৃথিবীর কোণে কোণে যুদ্ধ চলছেই, তুমি ঘুমিয়ে পড়লেও চলছে, জেগে থাকলেও চলছে। তুমি দেখতে পাচ্ছ, অথবা পাচ্ছ না।
বহুদিন আগে আমিও কি তাদের কেউ ছিলাম যে প্রায় এই প্যারাডক্সের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ়া’কে ‘বোকা’ ভেবেছিলাম?
প্যারাডক্স ও তার পথ বেয়ে আসা সংকট আরও গভীর হয়েছে; এবং ঠিক এ কারণেই ‘বোকা’ মানুষদের সঙ্গে চালাকি করা বিপদজনক।
কখনও কখনও তা ঘাতক তির হয়ে, গূঢ় প্রশ্ন হয়ে এসে ছারখার করে দিতে পারে স্থিতাবস্থা।