পৃথিবীর সব বোকাদের নিয়ে একটা সভার আয়োজন হয়েছে একটি পাহাড়ের মাথায়। সেখানে খুব ঠান্ডা, সেখানে দিনে চাঁদ ওঠে, রাতে সূর্য। সেখানে কোনো মানুষ রাজনীতি করে না। সেখানে কোনো নিয়োগ দুর্নীতি নেই, সেখানে কোনো পশু কেলেঙ্কারি নেই, সেখানে কোনো মিথ্যুক নেতা-মন্ত্রী নেই। সেখানে পুলিশ নেই। সেখানে সবাই বোকা ও সরল ও সকলেই আর্টিস্ট। শিল্পী উহারা। সেখানে পৃথিবীর সব বোকারা একত্র হয়েছে, হয়েছেন।
লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এই পাহাড়ে ঘুরতে এসে দেখেন, পৃথিবীর সব বোকা একত্র হয়েছে এখানে। সন্দীপন ভাবেন তিনি বোকা না চালাক? একবার ভাবেন তিনি বোকা, একবার ভাবেন তিনি চালাক, ধূর্ত, বুদ্ধিমান ইত্যাদি। আবার ভাবেন তিনি ক্যালাস, তিনি চার অক্ষরের বোকা বলে নিজেকে আহত করেন। সন্দীপন ভাবেন, আচ্ছা শক্তি কী বোকা ছিল! সন্দীপনের ধারণা, শক্তি বোকাই ছিল। বোকা না হলে, এতো ভালো কবিতা লেখা যায় না।
সন্দীপন পাহাড়ে আয়োজিত বোকাদের, সভার কাছে এসে বসেন। তাঁদের ভালো করে লক্ষ্য করেন। তাঁদের প্রত্যেকের চোখগুলো খুব সরল। খুব মেঘাচ্ছন্ন তাঁদের চোখ দুটি। তাঁরা চুপ থাকে, কথা কম বলে, শোনে বেশি। শুনলে চালাকদের কথাই শুনতে হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। তাই তাঁরা পাহাড়ের এই সভায় বক্তৃতা বা ভাষণ দেওয়ার জন্য বাছা বাছা তেজী ও সবুজ ও জ্যান্ত কিছু চালাককে নেমন্তন্ন করে, ধরে এনেছে এখানে। সন্দীপন লক্ষ্য করলেন চালাকেরা হাসি হাসি মুখে সবাই লাল চেয়ারে বসে আছে। তারা সাদা চেয়ার পছন্দ করে না। চালাকদের পায়ে হাওয়াই চটি, চালাকেরা চালকের আসনে বসতে চায়।
জগতের সব চালাকেরাই চালকের আসনে বসতে চায়, পারলে শুতে চায়। এবং সব চালাকেরা আলোয় থাকতে চায়। আলো, সে এক ভালো চালাকদের আবিষ্কার। তো পাহাড়ের বোকাদের সভায় আমন্ত্রিত চালাকেরা সকলেই সামান্য চটি পরে আলোয় আলোকিত হয়ে বসে আছে। লেখক সন্দীপন এতে মজা পেলেন। তাঁর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ল। কবি সুভাষ কি বোকা বা সরল ছিলেন? না হলে অমন ঐতিহাসিক ভুল করেন? সামান্য চটি পরা সংগ্রামী দেখলেই সে যে ভবিষ্যতের ঐতিহাসিক রক্তচোষা হবে না এমন কী কোনো মানে আছে! সন্দীপনের মনে হল ‘পদাতিক কবি’ সাময়িক বোকা হয়েছিলেন।
আর বোকারা চিরকালই ঠিক অন্ধকারে নয়, তারা স্যাঁতস্যাঁতে আড়ালে, শিক্ষিত গোপনে ও আলোহীনতায় থাকতে পছন্দ করে। বোকারা আড়ালে অনেক কাজ করেন। আলোয় গেলেই বোকাদের সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয়।
এখানে কবি আলোক সরকার–এর একটি কবিতার অংশবিশেষ উল্লেখ করছি। কিছুই না, কবিতাটি এই লেখার বোকা ও অন্ধকারে থাকা অক্ষরগুলিকে একটু উজ্জ্বল করবে আমার ধারণা –
‘একটি প্রদীপ এসে অন্য একটি প্রদীপের শিখা/ জ্বালিয়ে দিলো। অন্ধকার মাঠের উপরে তারপর/ সমস্ত আকাশভরা তারা, সমস্ত বাগানভরা ফুল/ সমস্ত নদীর ব্যাপ্তি সম্মিলনে উপক্রমণিকা/ সাজালো সমগ্র ছন্দে। … যেন সে নিবিড় চেনা নদী তার শান্ত দুই কূল/ কিংবা সেই পাখি আর আকাশের মগ্ন পারাবার।/ অন্ধকার মাঠে মাঠে সারারাত্রি সুদূর উৎসব/ পরিচিত উন্মোচনে সংহত আনন্দ নীল আত্মীয়তার।’
লেখক সন্দীপন ভাবছেন, তাঁর নিজের লেখার যে ভাষা তা তো ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার ভাষা। সে ভাষা দিয়েই তো তিনি আলোকে অতিক্রম করে অতি অন্ধকারের দিকে গেছেন, তৃপ্ত হননি হয়তো, কিন্তু খুশি হয়েছেন। সেই ভাষায় কী বোকামির কোনো লক্ষণ ছিল! বোকা বোকা ভাষা দিয়ে কি সাহিত্য হয়? সন্দীপন বোকাদের সভায় গিয়ে ভাবেন তা। অথচ লেখার সময় তো তিনি চালাক বা বুদ্ধিমান ছিলেন না? সেই সময় (সেই সময় মানে, মিলন মুহূর্তের সময়) তো যে কোনো লেখক বা কবি বোকাই থাকেন। বোকা সরল সহজ। ননসেন্স কলম ছাড়া লেখাকে আয়ত্ত করা যায় কী? লেখা জলের মতো আসে না, সেও অন্ধকারে থাকে অনাথ হয়ে। তাকে অন্ধকার থেকে নিজের কোলে স্নেহ করে, ভালোবাসা দিয়ে আনতে হলে তো লেখককে সহজ হতে হবেই। সেখানে চালাকির কোনো জায়গা নেই। লেখা তো আর ভবিষ্যতের রক্তচোষা হওয়ার সাধনা নয়। লেখা আসলে – ‘সংহত আনন্দ নীল আত্মীয়তা!’ বোকাদের সভায় গিয়ে, চালাক বক্তাদের পাশে বসে, ভাবেন সন্দীপন। সেসব কত আগের কথা! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তাঁর ভিতর থেকে।
আর অহং? সে এক বিষম বস্তু। বোকাদের কি অহং থাকে? নাকি অহং চালাকদের জন্য! বঙ্কিমচন্দ্রকে আমি জিগ্যেস করেছিলাম। অহং কাদের থাকে? ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন উভয়েরই অহংবোধ থাকে। বোকাদের অহংবোধ বোঝা যায়। বোকাদের অহংবোধ চামড়ার ভিতর থেকে ফুটে বেরোয়, যেমন কিশোরীর স্তনের আভা বোঝা যায় বাইরে থেকে। কিন্তু চালাকদের অহংবোধ লুকনো থাকে ব্যাঙ্কের লকারে, বুক স্লেফে। চালাকদের অহংবোধ লুকনো থাকলেও তা হিংস্র এবং রিরংসায় ভরা। তাতে, একটি প্রদীপ এসে আরেকটি প্রদীপকে জ্বালায় না। তাতে ‘সংহত আনন্দ নীল আত্মীয়তা’ নেই! আমার প্রিয় উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চালাকদের অহংবোধকেই বেশি তীব্র বলতে চাইলেন।
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, আপনার রজনী উপন্যাসের ‘রজনী’ সেকি বোকা ছিল নাকি চালাক ছিল? নাকি ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী ছিল? ঋষি শুনে বললেন, ‘রজনী ছিল জন্মান্ধ। আর অন্ধ মাত্রেই চালাক এবং বুদ্ধিমান হবে। কারণ অন্ধের বুদ্ধিমান না হয়ে উপায় নেই হয়তো। এমনিতেই সে দৃষ্টিহীনতার জন্য দুর্বল হয়ে জগতে এসেছে। তার ওপর বোকা হলে আর রক্ষে নেই! তবু অন্ধেরা বোকা, ঠিক বোকা নয় হয়তো, তারা বোকা আর চালাকের সংমিশ্রণ।’ বঙ্কিমচন্দ্র এইটুকু বলে চুপ করে রইলেন। আমি তাঁকে আর ‘রজনী’ উপন্যাসের ‘লবঙ্গলতা’-র কথা জিজ্ঞেস করি না, কারণ লবঙ্গলতা ভালো পরামর্শ দিত। জটিল সংসারের পরামর্শ দাতাকে চালাক হতেই হয়। তাকে একেবারে বোকার হদ্দ হলে চলে না। যেমন এই জগত সংসারের যিনি চালক তিনি একেবারে বোকা নন, তাঁকেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই জগত প্রকৃতিকে চালিত করতে হয়।
পাহাড়ের মাথায় বোকাদের সভা থেকে লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নিচে নেমে এসে অনেকদিন কিছু লিখতে পারেননি। সেই সময় তিনি নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘হারবার্ট’ উপন্যাসটি পড়ছিলেন। আর নিজের ‘হিরোশিমা মাই লাভ’ উপন্যাসটির বেশ কিছু পরিবর্তন করেন। তারপর তো তিনি ইহজগতের বোকা ও চালাকদের জগত থেকে দেহ ছেড়ে চলেই যান।
*এই লেখায় যা বলা হল, তার পুরোটাই বানানো বা কল্পনাপ্রসূত*