পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে বান্ধবীর জন্মদিনে গিয়ে, খালি হাতে মেয়েটি হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরলে তার নির্বিকার দৃষ্টিতে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি। ত্রিশ বছর আগের এক স্কুলবেলা। কতোই বেতন সরকারি চাকর বাবার? নুন আনতে পান্তা না ফুরালেও ঠিকই আমিষের বদলে নিরামিষে চালাতে হয় একান্নবর্তী বেলা। যে মাসে পরীক্ষার ফিসের টাকা হাতে গুনে দিতে হয়, হিসাবের দাখিলা খাতার ডেবিট ক্রেডিটে গড়মিল লেগে যায়। বাবার রোজগারের টাকায় চাল, ডাল কিংবা রেশনের গম কেনার টাকা পাইপাই হিসাব করা। সেই হিসাব থেকে টেনেটুনে বাঁচিয়ে বাবা পরীক্ষার ফিস দেন আর আমি ব্যাগে সেই টাকা রেখে হাঁক ছেড়ে ক্লাসে বলি, আমার ব্যাগে কিন্তু টাকা আছে তোমরা দেখে রেখো। মাঠে খেলাধুলা সেরে এসে দিব্যি আবিষ্কার করলাম টাকাগুলো ব্যাগে নেই। কী আশ্চর্য, ক্লাসভর্তি মেয়েদের সবার মুখে বিশ্বের বিস্ময়। অসম্ভব ওরা কেউ নিতেই পারেনা।
দু’পয়সার সরকারি চাকরি করা বাবা আমার। কাকা, পিসি, মা, আমি আর আমার দুই ভাইবোনের একদিনের দুবেলার খোরাকীর দুঃখ ভুলে, আক্ষেপের সুরে উচ্চারণ করেছিলেন অমোঘ বাণী, এই দুনিয়াত তুই খাইবে ক্যাম্নে? আমার তবু অপরাধবোধ ছিলো। বাবার কপালের ভাঁজের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম তাঁর অসহায়ত্ব জেনেই। দুর্ভাবনার থৈহীন সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম আমিও। আহা বাবা টাকাগুলো কোথা থেকে যোগাড় করবেন পুনরায়? ফিস জমা না দিলে যে পরীক্ষা দেয়া হবেনা আমার! বাবাও দুশ্চিন্তা পীড়িত ছিলেন নিশ্চিত, কিন্তু মেয়ের বোকামি নিয়ে সেই নিরানন্দ সন্ধ্যায় কাকা পিসিদের হাসির হুল্লোড়ে আহ্লাদ চুইয়ে পড়ছিলো আমাদের যুথবদ্ধ পরিবারে। টাকা হারানোর শোক ঢেকে দিয়েছিলো বোকা মেয়েটির অভাবনীয় নির্বুদ্ধিতা । সবাই হেসেছে, এত বোকা মানুষ হয়! হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েছিলো সবাই কিন্তু কেউ মেয়েটিকে বুঝিয়ে দেয়নি, দুনিয়াতে কীভাবে খেতে হয়, দুনিয়াতে খেতে গেলে আসলে কতোটা চালাক হতে হয়, কীভাবে হতে হয়। মেয়েটিও বোঝেনি সে কোথায় বোকামি করেছে! মানুষকে বিশ্বাস করা বুঝি বোকামী? কিশোরী মেয়েটি বিশ্বাসই করতে পারেনা কারো কাছে ভরসা করে কিছু রেখে গেলে তাদেরই কেউ সেটা নিয়ে যেতে পারে!
সেই মায়ের মেয়ে তো আরেক কাঠি বাড়া। বন্ধুর জন্মদিনে গিফটের চাঁদা দুইশো টাকা। মা পাঁচশো টাকা দিলে বাকি টাকা এনে মাকে ফেরত দিতে হয় এটা ভালোই জানে সে। কিন্তু আরেক বন্ধুর চশমা কেনার দরকারে টাকা চাইলে আর চশমা কেনার জন্য টাকাটা দিলে কী অন্যায় হয় সেটা বুঝতেই পারেনা সে। প্রায়ই বন্ধুদের সাথে খেতে গেলে ওর বন্ধুরা টাকা আনতে ভুলে যায় আর নিজের সর্বস্ব দিয়ে মেয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে। এ নিয়ে এই দুর্দান্ত বুদ্ধিদীপ্ত যুগের একদম অনুপযোগী মেয়ের কোনো অপরাধবোধও নেই। উল্টো আমাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলে, আমার কাছে টাকা রেখে আমি বলবো নেই? তাইতো! আমি মেয়ের মা ও তাই ভাবি, দুনিয়াতে এই বোকা মেয়েটা চলবে কী করে! কিন্তু মুশকিল হলো আমি যে মোটেই ওকে চালাক হবার শিক্ষা দিতে পারিনা। সত্যিতো নিজের কাছে টাকা রেখে আমি ওকে নেই বলতে শেখাবো? আমি পারবো ওকে এমন অসৎ শিক্ষা দিতে!
একদিন বাসার বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ছেলে নিচে সমবয়সীদের সাথে ক্রিকেট খেলছে। বয়স তখন কতোই বা, আট কিংবা নয়। ব্যাটসম্যান ব্যাট পেটালে কখনও তা ছিটকে পড়ছে পাশের ড্রেইনে। আট দশজনের দলের কেউ না, বারবার ওই গিয়ে ড্রেনের ভেতর হাত ডুবিয়ে বল তুলে আনছে। একবার, দুইবার, তিনবার। আর সহ্য হলোনা। নিচে নেমে হিড়হিড় করে টেনে আনলাম বাসায়। বারবার তুই ড্রেইনে হাত দিচ্ছিস কেনো? আর কেউ নেই? ছেলে বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কাউকে না কাউকে তো তুলতেই হবে। আমি তুললে অসুবিধা কী? তাইতো কী উত্তর দেবো আমি? কাউকে না কাউকে তো বল তুলে আনতেই হবে। আমি কী করে ছেলেকে শিখিয়ে দেই, তুই না তুলে অন্য কাউকে পাঠাস! অন্য কেউ তো ওরই মতো কারও ছেলে! এই অসততা কী করে নিজের ছেলেকে শেখাই!
আমি আবার ফিরে আমাকে দেখি, সবে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছি। তখন মায়েদের স্কুলে পৌঁছে দেয়ার চল হয়নি। আমি আর আমার সাথে আরেক সহপাঠী। একসাথে স্কুলে যাই। যাওয়ার ভাড়া আমার আর আসার ভাড়া ওর। কিংবা আসার ভাড়া আমার তো যাওয়ার ভাড়া ওর। ও প্রায় প্রতিদিন যাওয়ার সময় আমি রিক্সায় করে গিয়ে ভাড়া দেই কিন্তু আসার সময় ও প্রায়ই বলে অন্য মেয়েদের সাথে হেঁটে আসবে। আমি তখন একটু চালাক হতে চাইতাম, না চল রিক্সা করে যাই। তুই রিক্সায় যা আমি হেঁটে যাবো, মুখের উপর উত্তর দিতে বিন্দুমাত্র ভাবতো না। আমার আরেকটু চালাক হয়ে কোনদিন বলা হতোনা, আসার সময় তো আমি ভাড়া দিলাম।
মা যার এমন অসংখ্য বোকামীর মাশুল দিয়েছে, দিয়েই যাচ্ছে জীবনব্যাপী তার ছেলেমেয়েরা অমন বোকামি করবে এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে! না কিচ্ছু নেই। কিন্তু দুনিয়াটা যে চালাকদের আখড়া। বোকারাই পৃথিবী গড়েছে বললে এখন যে আর চলে না। কালটা যে বোকাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে যাওয়ার কাল। তবু একটা বোকা মা কিছুতেই সন্তানদের চালাকি শেখাতে পারিনা। মা তো যাবতীয় বোকামী নিয়ে দুনিয়াতে খেয়ে পরে অর্ধশতক পার করে দিলাম, ওরাও পারবে নিশ্চয়ই।